অরুনাচল ভ্রমন ডায়েরী, ২০১৮

গত ২৪শে এপ্রিল মঙ্গলবার ভোরে বিমানে চেপে সপরিবার যাত্রা করলাম ভারতের উদয়মান সূর্যের রাজ্যে। আমাদের দলের ৯ জন মিলিত হলাম গুয়াহাটি বিমানবন্দরে। আগের থেকে সকল ব্যাবস্থা পাকা ছিল, গাড়ী উপস্থিত ছিল লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদোলোই বিমানবন্দরে। সেখান থেকে শুরু হলো আমাদের যাত্রা মা কামাক্ষার দর্শনের উদ্দেশ্যে।

২৪শে এপ্রিল

গুয়াহাটি শহর অতিক্রম করে নীলাচল পাহাড় শিকরে মায়ের অধিষ্ঠান। পূজার সামগ্রী কিনে আমরা চললাম মন্দিরের প্রবেশ পথের দিকে। পাথরের তৈরী মন্দিরে বিভিন্ন কালের স্থাপত্যের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। ৫১ সতীপীঠের অন্যতম এই পীঠে সকাল থেকেই নামে মানুষের ঢল। পথ নির্দেশ দেখে এগিয়ে চললাম, মূল প্রতীক্ষালয়ে পৌছে দেখলাম অগনিত মানুষের ভীর মায়ের দর্শনের আশায়। ব্যাবস্থাপনা বেশ ভালো, গরমে কষ্ট লাঘবের জন্য পর্যাপ্ত পরিমান পাখার ব্যাবস্থা আছে, এছাড়া দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থাও আছে। চাইলে ৫০১ টাকার বিনিময়ে VIP লাইনের ব্যাবস্থাও আছে , তবে তা নির্দিষ্ঠ সময়ে সংগ্রহন করা আবশ্যিক।আমাদের হাতে সময় কম থাকার জন্য গর্ভগৃহে প্রবেশ না করে দূর থেকে মাকে দর্শন করেই এই বারের মত মায়ের থেকে বিদায় নিতে হলো তেজপুরের উদ্দেশ্যে।

ব্রহ্মপুত্রকে সঙ্গী করে আঁকা বাঁকা রাস্তায় যেতে যেতে মন ভরে গেল| পথে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে আবার শুরু হলো যাত্রা। নানান নাম না জানা গ্রাম তখন সেজে উঠেছে বিহুর রঙে, তা দেখতে দেখতে সন্ধেবেলায় পথে মহাভৈরব মন্দির দর্শন সেরে সেই রাতের জন্য আশ্রয় নিলাম হোটেল পাইন ইয়ার্ড এ।

তেজপুরের পথে

২৫শে এপ্রিল

আমাদের ভ্রমনের দ্বিতীয় দিন অর্থাত ২৫শে এপ্রিল প্রাতরাশ সেরে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সকাল সাত ঘটিকায়। তেজপুরের থেকে বিদায় নেওয়ার আগে আমাদের বাহন আমাদের নিয়ে উপস্থিত হলো ব্রহ্মপুত্র পারে এক সিদ্ধিদাতা গনপতি বাবার মন্দিরে। সেখানে বাবার আর্শীবাদ সম্বল করে ও ব্রহ্মপুত্রের দিগন্তবিস্তৃত রূপকে উপভোগ করে এগিয়ে চললাম দিরাং এর উদ্দেশ্যে। আমাদের চালক আগেই জানান আজ পথ মোটেই সুগম নয়। যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ এর মধ্যেই এসে পৌঁছলাম ভালুকপং নামক স্থানে যা হলো আসাম ও অরুনাচলের সীমানা। অরুনাচলে প্রবেশের জন্য আবশ্যিক ইনার লাইন পারমিট। তা পরীক্ষা করে সেনাদল আমাদের অরুনাচলে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।

কিছুক্ষণে আমরা এসে পৌছালাম টিপি অর্কীডের বাগানে। বিভিন্ন প্রজাতীর অর্কীডে সমৃদ্ধ সেই বাগান। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে বিদায় নিলাম সেখান থেকে। এইবার শুরু হলো আমাদের পর্বতারোহন সঙ্গী হলো কামেং নদী। এই প্রসঙ্গে আমাদের চালকের বলা একটি কথা মনে পরে গেল, তিনি বলেছিলেন ‘ আমরা আধুনিক যুগের বানর, তাই সেই পাহাড়েই চড়ে বেড়াই তবে গাড়ীতে চেপে’।

পাহাড়ী পথ সম্প্রসারনের কাজ চলার দরুন বেশ কিছুটা পথ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে অতিক্রম করাটা আবশ্যিক, অন্যথায় বিকেল ৫টা পর্যন্ত আটকে পরতে হবে সেই রাস্তায়। অতএব পাহাড়ী পথের প্রতিকূলতা কাটিয়ে যতটা সম্ভব দুরন্ত গতীতে একের পর এক পর্বতমালা অতিক্রম করে চলতে লাগল আমাদের যান। পথে পরল এক নাগ মন্দির, লোকমুখে কথিত নাগ জোটের একটিকে পথ নির্মানকালে হত্যা করেন নির্মানকর্মীরা, সঙ্গীমৃত্যুর আক্রোশে কিছুতেই তিষ্তোতে দেয়না অপর নাগ, শেষে স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দির নির্মানের পর শেষ হয় পথ নির্মানকার্য।

দিরাং মোনাস্ট্রি

আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথের ধকল কিছুটা লাঘব করে ও প্রাণভরে বিশুদ্ধ বাতাস সেবন করে আবার শুরু হলো পথ চলা। এবার আমাদের গন্তব্য থুপসুং দার্গীং মনেস্ট্রি। এটি মনেস্টির সাথে সাথে তিব্বতীয় বৌদ্ধ সম্মন্ধীয় শিক্ষাগার। সেখানে গিয়ে শীতলতার আবেশে আমরা তো আবিষ্ট, মনেস্ট্রিতে রাখা চা পান করে ফিরে পেলাম নিজেদের। সেখান থেকে রাত্রিবাসের জন্য পৌছলাম আমাদের পূর্ব নির্ধারিত হোটেল সানদুপ খাং এর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।

২৬শে এপ্রিল

দিরাং এ রাত্রিবাসের পর ২৬শে এপ্রিল সকালে পা বারালাম তাওয়াং এর পথে। যাত্রা শুরুর কিছু পরেই চালক বাহন থামিয়ে জানান দিলেন প্রায় ৫০০ মিটার নিম্নগামী পথ পারি দিলেই এই শীতল স্থানে দেখা পাওয়া যাবে, এক উষ্ণপ্রস্রবণের। উদগ্রীব হয়ে ছুটলাম দেখতে। সেখানে উষ্ণপ্রস্রবণ দেখার পর চোখ পরল আর কিছুটা নীচে নামলেই ছুতে পারব কামেং নদীকে। অমনি ছুট দিলাম, নদীর তীরে কিছু সময় কাটিয়ে আবার এগিয়ে চলতে হলো।
এছাড়াও ডিরাং ছেড়ে যাওয়ার আগে পথে পরল কিউই ফলের বাগিচা, গাড়ী থেকেই তা দেখলাম।

এরপর আবার শুরু পাহাড়ী পথে পথ চলা। পাহাড় আমার খুব প্রিয় কারণ, সে তার প্রতিটি বাঁকে আমাদের জন্য সাজিয়ে রাখে নতুন শোভা। বেশ কিছুক্ষণ এমন ভাবে চলার পর সকালের দেখা বরফের পাহাড়ের অনেক কাছে চলে এলাম, তার সাথে প্রবেশ করলাম মেঘের রাজ্যে। মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছলাম বৈশাখী সেনা ছাউনিতে|সেখানে কিছু পেটপূজো সেরে এগিয়ে চললাম।

সেলা পাসে স্নোফল

এবার পাড়ি দিলাম তুষার রাজ্যে। বরফ দেখে তো আমরা সকলে আপ্লুত, এমন সময় এক বিশাল দ্বারের সামনে এসে দাড়ালাম। এটি হলো সেলা পাস, যা তাওয়াং এ প্রবেশের মুখে অবস্থিত একটি গিরিপথ। উচ্চতায় ১৩৭০০ ফিট এই গিরিপথটি পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় উচ্চতম যান চলার উপযোগী পথ।
সেখানে তুষার রাশি প্রাণ ভরে উপভোগ করছি এমন সময় চারিদিক জুড়ে সুরু হলো তুষারপাত। সে এক অপার্থীব দৃশ্যর সাক্ষী হলাম আমরা।
বেশকিছুটা সময় অতিক্রান্ত হল তুষার দুনিয়াতে। পাহাড়ী অঞ্চলে সূর্যমামা পশ্চিম গগণে হামা দেওয়ার আগে গন্তব্যস্থলে পৌঁছনো বাঞ্ছণীয়। অগত্যা তুষারপথের বুক চিরে এগিয়ে চলল আমাদের যান।

এসে থামলাম যশবন্ত সিংহের স্মৃতিস্মারকের সামনে। ইনি সেই বীর যোদ্ধা যিনি ১৯৬২ তে চীনের সাথে যুদ্ধের সময় যুদ্ধভূমি থেকে প্রাণভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে, বীরের মত প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। লোকমুখে কথিত আছে মৃত্যুর পরেও কোনো সেনা কর্মে অমনযোগী হলে তাদের নিজের উপস্থিতি জানান দিতেন। কর্মনিষ্ঠার জন্য তিনি মরনত্তোর মহাবীর চক্রে ভূষিত হন। অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম সকল বীর যোদ্ধাদের যাদের জন্য আমরাদের মাতৃভূমি আজ নিরাপদ। সেখান থেকে বিদায় নিলাম নূরানাং জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে যার অপর নাম জাং জলপ্রপাত।

নূরানাং জলপ্রপাত

নূরা একটি মেয়ের নাম আর নাং শব্দের অর্থ আত্মহত্যা। নূরা নামক একটি মেয়ে, যে যুদ্ধক্ষেত্রে যশবন্ত সিংহকে সাহায্য করেছিল, চীনে সৈনিকের থেকে নিজের সন্মান রক্ষার্থে এই জলপ্রপাতের থেকে মরণছাপ দিয়েছিল সে। বিশাল জলরাশি প্রবল গর্জনের সাথে বয়ে চলেছে অবিরাম।

তাওয়াং শহর

পথে মাছ ভাতে মধ্যাহ্নভোজন সেরে যখন তাওয়াং পৌছলাম তখন অরুনদেব পশ্চিমপাটে অস্তমান। দিনের শেষ আলোর লালিমায় সিক্ত তাওয়াং শহরের রূপ তখন অনবদ্য। আগামী দুই রাতের জন্য আমাদের আস্তানা হোটেল গায়েকী খাং। রাতে তাওয়াং এর তাপমাত্রা প্রায় ২-৩ ডিগ্রী। শীতল রাতে শরীরের ক্লান্তি দূর করতে বিছানাতে গেলাম ঠিকই কিন্তু মন অপেক্ষায় রইল পরেরদিন সকালের।

২৭শে এপ্রিল

আবার অরুনোদয় হলো অরুনাচল। ২৭শে এপ্রিল সকালে হোটেল থেকেই দেখা পেলাম ৪৫০ বছর প্রাচীন তাওয়াং বৌদ্ধগুম্ফার , অবস্থানগত কারণে সূর্যের প্রথম কিরন এসে পরে এই গুম্ফার ওপর। তাওয়াং অরুনাচলের ক্ষুদ্রতম জেলা হলেও রূপে শ্রেষ্ঠতম, চারিদিকে ঘিরে আছে তুষারশৈল। মনপা জনজাতির বাস এইস্থানে। ম্যাকমহন লাইন অনুযায়ী তাওয়াং ভারতের অন্তরগত, কিন্তু চীন তা মানতে নারাজ, তাদের মতে এটি চীন অধিকৃত তীব্বতের অংশ। এই বিতর্কের ফল ১৯৬২ সালের যুদ্ধ।

আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য ভারত চীনের সীমানা বুমলা পাস। বুমলা পাসের সফরে আবশ্যিক স্থানীয় যান ও সেনাবাহিনীর অনুমতিপত্র। দুটিরই ব্যাবস্থা আগের রাতেই পাকা করা হয়েছিল। সুতরাং সকাল ৮ টায় শুরু হলো যাত্রা। কিছুটা সুগম পথে পেরিয়ে শুরু হলো দুর্গম পথে পর্বতারোহন। প্রায় সারাবছর তুষারপাতের কারণে এখানে রাস্তা পিচ্ছিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই এই ভঙ্গুর পথ পারী দেওয়াটাই শ্রেয় মনে করেন স্থানীয় মানুষ।
চারিদিকে সুদুরপ্রসারী শূভ্র তুষারক্ষেত্র, তার মাঝে অপ্রসস্থ পথ পেরিয়ে এগোতে লাগল আমাদের যান্ত্রিক যান। পথে তিন বার অনুমতিপত্র পরীক্ষণ কেন্দ্র আছে।

প্রথমটি পেরোনোর পর হঠাৎ বিকট শব্দ তার সাথে সাথেই গাড়ী থেমে গেল। চালক জানাল ফায়ারিং চলছে। সকলে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলে সে জানাল এটি নিত্য অনুশীলনের অঙ্গ মাত্র। এতকিছুর মধ্যে খেয়ালই করা হয়নি যেখানে গাড়ী থেমেছে তার বামদিকে কিছু নীচে অপূর্ব এক সরোবর, বেশকিছুটা যার বরফাবৃত। এই তো সেই পিটি সো লেক।

পিটি সো লেক

পায়ে পায়ে থুরি যানে সাওয়ার হয়ে আবার এগিয়ে চললাম। যত এগোতে লাগলাম দেখলাম, ধীরে ধীরে নগ্ন প্রস্থরখন্ডগুলি নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলেছে বরফের চাদরের নীচে। তুষার রাজ্যের এমন শান্তির মাঝেও কারোর মনে হিংসা আসে? এই সব ভাবতে ভাবতে পার হয়ে গেলাম ভারতের অন্তরগত শেষ গ্রাম, নাগুলা| ছোট্ট গ্রাম, কিছু লোকের বাস, তবে সেখানে আছে নাগুলা লেক, স্থানীয়দের মতে এই লেককে অপবিত্র করলে আবহাওয়া খারাপ হয় ও তার প্রভাব পরে গোটা তাওয়াং জেলায়।

এসে পৌঁছলাম ওয়াই জংশান এ, এখানে শেষবারের মত অনুমতিপত্র জাচাই করা হলো। এবার চড়াই উতরাই এর অসম্ভব দুর্গম পথ পেরিয়ে গাড়ী গিয়ে থামল বুমলা পাসে। সেখানে পৌঁছে সেনাবাহীনির উষ্ণ অভ্যর্থনায় যেন সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বেশ কিছু পর্যটক একত্রিত হবার পর সেনার পথনির্দেশনায় আমরা গিয়ে হাজির হলাম সীমানায়। সীমার এপারে ভারত অপর দিকে চীন। একজন সেনা স্থানটির গুরুত্ব ও ইতিহাস বর্ণনা করল। বেশী সময় সেখানে কাটানোর অনুমতি নেই, চীনের বরফ স্পর্শ করে বেড়িয়ে পরলাম সেখান থেকে।

বুমলা পাস

আবার ফিরলাম ওয়াই জংশানে, মাধুরী লেক দর্শনের অনুমতি সংগ্রহের জন্য। সাধারনত বেলা ১টার পর ঔ স্হানে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় না, তবে অনেক অনুরোধের পর অনুমতি সংগ্রহ করে সেই পথে পা বারালাম। সেখান থেকে একটি পথ নীচের দিকে নেমে গেছে সাংগেটসার লেকের দিকে| কোয়েলা ছবির চিত্রায়ন হয় এই স্হানে সেই থেকে এর নাম মাধুরী লেক। ১৯৫০ সালের ভূমিকম্পের পর একটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে জন্ম নেয় এই লেক| ভূমিকম্পের চিহ্নরূপে আজও তার বুকে বিঁধে আছে বহু মৃত গাছের কঙ্কাল।

মাধুরী লেক

এক স্বর্গীয় শান্তি বিরাজমান সেই স্হানে। বেশকিছুটা সময় অতিবাহিত করে ফেরত পথে সেই নৈস্বর্গীয় পরিবেশে পুষ্পের মত বর্ষিত হতে থাকল তুহিনরাশি। অনবদ্য সেই অনুভূতি।

সেখান থেকে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন বিকেল ৪.৩০টা। জানতে পারলাম তাওয়াং ওয়ার মেমোরিয়ালে সন্ধ্যে ৬ টায় এক শব্দ ও আলোক প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাওয়াং তথা অরুনাচলের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়। যেমন শোনা অমনি সকলে তৈরী হয়ে চড়ে বসলাম গাড়ীতে। গাড়ী আমাদের নিয়ে থামাল এক রোমহর্ষক ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থানের সামনে। ইতিহাস কথা বলল, আমরা সকলে নিষ্পলক দৃষ্টিতে হারিয়ে গেলাম সেই ইতিহাসের মাঝে। হোটলে ফিরে রাতের আহার শেষে ক্লান্তিতে কখন যে নিদ্রাদেবীর কোলে আশ্রয় নিয়েছিলাম মনে নেই।

২৮শে এপ্রিল

আজ তাওয়াং থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। পঞ্চম দিন তথা ২৮শে এপ্রিল সকালে , ঝোলা তুলে চড়ে বসলাম সফর রথে। উপস্থিত হলাম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধগুম্ফার সম্মুখে। প্রায় ৫০০ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর আবাস স্থল এটি। পঞ্চম দালাই লামার হাতে প্রতিষ্ঠা পায়, প্রায় ১০০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই গুম্ফাটি। ৮ মিটার উঁচু বৃহৎ বৌদ্ধ মূর্তি সম্বলিত গুম্ফাটির গঠনশৈলী অনবদ্য।

তাওয়াং মোনাস্ট্রি

প্রবেশ করলাম বহু স্মৃতি সংরক্ষিত প্রদর্শণশালায়, প্রত্যক্ষ করলাম নানান কালের নিদর্শন। অনেকটা শান্তি আর ফুসফুস ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে এগিয়ে চললাম পরের গন্তব্যের পথে। ষষ্ঠ দালাই লামার জন্মস্থান তাওয়াং এর এই পূণ্যভূমি। আমরা এসে পৌঁছলাম তার জন্মস্থলে। অতি মনোরম পরিবেশ সেই স্থানের। কিছুসময় কাটিয়ে এবার এগিয়ে চললাম ওয়ার মেমোরিয়ালের দিকে।

কাল রাতের আঁধারে দৃষ্টিগোচর হয়নি, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে শহীদ আমাদের দেশের ২৪২০ জন বীরের নামাঙ্কিত স্মারকসৌধ দিনের আলোয় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই বীরদের নিদ্রাবিহীন রাতের পরিবর্তে আমরা নিদ্রিত রাত্রিযাপন করতে পারি, এই সব ভাবনাদের ভীড়েই বিদায় নিলাম আমরা।
আজ আমাদের গন্তব্য বমডিলা। যে পথে এসেছিলাম, সেই পথেই ফিরে চলেছি। পথটা আজ অনেক চেনা মনে হচ্ছে। পাহাড়ী ঝর্ণার জল, সদ্য কিশোরীর মত লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের সঙ্গীনী হয়ে, আবার কোথাও লুকিয়ে পরছে পাহাড়ের বাঁকে। মেঘেদের সাথে ছোঁয়াছুয়ি খেলতে খেলতে ক্রমাগত এগিয়ে চললাম। পথে কখনো থেমে উষ্ণ চায়ের পেয়ালাতে চুমুক দিয়ে গলা ভেজালাম।

সেলা পাস যাওয়ার পথে

আজ ফিরে যাচ্ছি বলে আবহাওয়ারও মন আমারই মত বিষণ্ণ। মাঝেমধ্যেই বারিধারায় ভিজিয়ে দিচ্ছে পথ ঘাট। পথে দেখা হলো নূরানাং জলপ্রপাতের সাথে। তারপর আবার এগিয়ে চললাম সেলা পাসের পথে। শুরু হলো তুষার চাদরে আবৃত বক্র গিরিপথের দিকে এগিয়ে চলা। আমাদের চালক শোনালো সেলা ও নূরার বীরত্বের কাহিনী। যশবন্ত সিংহের বীরত্ব গাঁথা পূর্বেই বর্ণন করেছি। যশবন্ত সিংহ যখন দেশ থেকে অরুনাচলের বিভাজন রোধ কারার উদ্দেশ্যে অস্ত্রধারন করেন, তখন তাকে প্রতিনিয়ত সাহায্যের অঙ্গীকার করেন তার প্রিয়তমা সেলা। বান্ধবীর অঙ্গীকারকে নিজের প্রত্যয়রূপে স্বীকার করেন নূরাও।

তিন দিন পর্যন্ত চীনে সৈনিকদের বিভ্রান্ত করে যুদ্ধ চালায় তারা। তারপর যশবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর হত্যা করা হয় সেলাকে, অপমান থেকে রক্ষা পেতে আত্মহত্যাকে আলিঙ্গন করে নূরা। সেই যুদ্ধে এমন ভাবেই শেষ হয়ে যায় অসম সাহসী জুগলের প্রেম কথা ও দুজনের বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি, কেউ তার খবর রাখেনি। কোনো সরকারি নথিতে উল্লেখ নেই সেলা ও নূরার এই বলিদানের কাহিনী, তারা রয়েছে মানুষের হৃদয়ে। এই উপাখ্যানের তরীতে চড়ে কখন যে সেলা পাসের সম্মুখে উপস্থিত হলাম মনে নেই।

সেলা আজও শ্বেতপরিধানে যেন অপেক্ষারতা তার প্রিয়তম যশবন্তের জন্য, বিরহের মাঝেও সুন্দরী সে, মনে হচ্ছে বীরত্বের গৌরবে উজ্বল তার মুখখানি। মধ্যাহ্নভোজনের জন্য সেলা পাসে ক্ষুদ্র কয়েকটি পণ্যশালা ব্যাতীত তেমন কিছু নেই। তাতেই ম্যাগীর ফরমাশ করে উপোভোগ করতে লাগলাম মনোরম প্রকৃতি, বাইরে শুরু হলো প্রবল তুষারপাত, অগত্যা খাদ্যপণ্য সহ চেপে বসলাম গাড়ীতে। রৌদ্র বর্ষণের লুকোচুরির মাঝেই পাহাড়ী পথের বাঁক কোথাও নেমে গেছে উপত্যকার কোলে, আবার কোথাও উঠে গেছে আকাশ ছুঁতে| আমরাও আজ গা এলিয়ে দিয়েছি তার সাথে।

অবশেষে সূর্যিমামা পাটে যাওয়ার আগে এসে পৌঁছলাম বমডিলাতে। মনেস্ট্রির অতিথিশালায় আমাদের রাত্রিবাসের ব্যাবস্থা করাই ছিল। বিপত্তি সৃষ্টি হয় যখন আমরা জানতে পারি, প্রবেশ পথ পুনঃনির্মানের কাজের দরুন বেশ কিছু পথ অতিক্রমের জন্য ভরসা এই পদযুগল। শহুরে মানুষদের ঝোলাসহ সোপান আরোহন, সে যেন এক যুদ্ধ।

কষ্টের পথ পেরিয়ে অতিথিশালাটিতে পৌঁছে এক লহমাতে সকল কষ্ট লাঘব হয়ে গেল। সত্যি মনে হলো ঈশ্বরের দেশে অতিথি হয়ে এলাম আমরা। অপার শান্তি বিরাজমান চারিদিকে। বমডিলার সর্বোচ্চ স্হানে অবস্থিত এই গুম্ফা। “বৌদ্ধং স্মরনং গচ্ছামি” মন্ত্রে মুখরিত এই পরিবেশে বসে নীচে বমডিলা শহরটিকে দেখে মনে হচ্ছে, জোনাকীবাতি জ্বালিয়ে পাহারারত সে। রাতের সুস্বাদু আহার শেষে, মনোরম সেই পরিবেশে, পরম শান্তিতে হারিয়ে গেলাম স্বপ্নলোকে।

২৯শে এপ্রিল

প্রশান্তির রাত্রিযাপনের পর, নতুন রবি বরণের তাগিদে ঘুমের কম্বল উদ্ঘাটন করে করে হাজির হলাম অতিথিশালার বাইরে। তখনও মেঘেদের মায়াজাল ছিন্ন করে অরুনদেব দর্শন দিতে ব্যর্থ। আমরা ভোরের আলো গায়ে মেখে পদব্রজে বেড়িয়ে পরলাম বৌদ্ধমঠের উদ্দেশ্যে। কিছুটা চড়াই পথের পরেই দেখা পেলাম শূভ্রপ্রস্তর নির্মিত মাঝারি আকারের বৌদ্ধমঠের। ভোরের আরাধনাতে মুখরিত তখন চারিদিক। বেশকিছুটা সময় উপোভোগ করলাম মনোমোহিনী এই প্রকৃতির শোভা। চোখে সবুজের কাজল পরে ও প্রাণভরে জীবনীবায়ু সংগ্রহ করে ফিরলাম নিজ আস্থানায়। শহর তখনও মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে নিদ্রামগ্ন।

বমডিলা মোনাস্ট্রি

প্রাতঃরাশ সেরে অগ্রসর হলাম নামেরী রাষ্ট্রীয় উদ্যানের উদ্দেশ্যে। পথে পরল টেঙ্গা সেনাঘাটি, কামেং নদীর তীরে অবস্থিত সুসজ্জিত এই স্থান। পাহাড়ী পথ একেঁ বেঁকে পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে আছে সুতোর মতো , যেন এক নক্সীকাঁথা এঁকেছে। আজও আকাশের মুখ ভার। রোদ বৃষ্টির লুকোচুরির মাঝেই এগিয়ে চললাম। পথে পরল এক ঝুলন্ত সেতু। কামেং নদীর প্রবাহধারাকে বিঘ্নিত না করার উদ্দেশ্যেই তার জন্ম। পায়ে হেঁটে পারাপার করা যায় এই সেতু। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা, দোদুল্যমান সেতুর মাঝে দাঁড়়িয়ে আরো রূপসী লাগছে কামেংকে। পর্বতবক্ষ বিদির্ণ করে উচ্ছল স্রোতরাশি এগিয়ে চলেছে লাগামছাড়া ভাবে, প্রস্তরখন্ড গুলিও যেত বাধা দিতে ব্যার্থ হয়ে, গা এলিয়েছে তার স্রোতে।

পাহাড়ী পথকে বিদায় জানিয়ে পা রাখলাম সমতলে। এসে পৌঁছালাম ভালুকপং এ। মধ্যাহ্নভোজন সেরে যাএা শুরু করলাম জঙ্গলের পথে। বেশ কিছুক্ষণ পাকা রাস্তায় সফর করে, গাড়ী এগিয়ে চলল জঙ্গলের বুক চিঁড়ে। সবুজে ঘেরা মনোরম প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে যান্ত্রিক যানটি আমাদেরকে নিয়ে হাজির করল লালিমৌ শিবিরের সামনে। জঙ্গলের মাঝে এক গ্রাম্য পরিবেশের আমেজ সেখানে। রাতের খাবারের ফরমাশ করে নিজ নিজ কুঠীরে ক্লান্তি দূর করতে গেলাম আমরা।

লালিমৌ ন্যাচার ক্যাম্প

তখন সবে বেলা সারে তিনটে, আমরা পায়ে পায়ে বেড়িয়ে পরলাম কাছেই বহমান জিয়া ভারলী নদীর খোঁজে। প্রসঙ্গত, বলে রাখি কামেং নদী আসামে জিয়া ভরালী নামে খ্যাত। জঙ্গলের একটি অংশ হলেও এখানে আছে মানুষের বাস, প্রকৃত জঙ্গল নদীর অপর পারে। তবুও খাদ্য সন্ধানে হস্তীবাহিনী হানা দেয় এইস্থানেও।

গ্রামের মাঝে মাটির পথ, পথিকের থেকে পথ চিনে এগোতে লাগলাম। বেশ কিছুটা এসে মনে হলো অচেনা পথে সন্ধ্যের মুখে বেশী না এগোনোই শ্রেয়। তখন সূর্যের অস্তরাগে রক্তিম হচ্ছে এই ধরণী। পাখীরা দিনের শেষে ফিরে চলেছে বাসায়। ধবলী নিয়ে গৃহে ফিরছে রাখাল বালক। আমরাও ফিরলাম আমাদের কুঠীরে। ফিরে চুমুক দিলাম চায়ের পেয়ালাতে, প্রাণ জুরালো আসাম চায়ের স্বাদে।

নাগরিক সভ্যতার থেকে অনেক দূরে এই পর্ণ কুঠীর, দূরদর্শনের বোকাবাক্স অমিল এই স্থানে। এই সুযোগে সকলে মেতে উঠলাম লুডো খেলায়। বেশ কিছু সময় কাটলো হৈ হুল্লোর করে। আবার সকলে কিছুক্ষণ বিশ্রামের আশায় পৌঁছোলাম নিজ কক্ষে। কিছুসময় অতিবাহিত হলো নিজ গতিতে। খবর পেলাম আমাদের এক আত্মীয়ের কক্ষে প্রবেশ করেছেন সর্প দেবতা। তা নিয়ে চলল তান্ডব। খুবই ভীত ও চিন্তিত হয়ে পরলাম সকলে। পরে ভাবলাম কে সত্যি অনুপ্রবেশ করেছিল? শহুরে ঘ্রাণযুক্ত মানুষগুলিই তো বেমানান এই নির্ভেজাল প্রকৃতির মাঝে। রোমাঞ্চের মধ্যে দিয়ে সমাপ্ত হলো সেই রজনী। কেবল সেই রাতে নিদ্রাদেবী বিমুখ হয়ে রইলেন, প্রায় বিনিদ্র রাত্রিযাপন করলাম আমরা সকলে।

পরদিন সকালে গৌহাটি ফিরে, এয়ারে কলকাতার কোলে ফিরে আসা।

Leave a Comment
Share