ভারত-ভারতীর স্বর্গরাজ্য,ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার,শান্তির নীড় – ইউমথাং ভ্যালি

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল- “পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো কত দূর আর কত দূর…বলো মা?”

উত্তর সিকিম সফরের দ্বিতীয় দিনে স্বপ্নপুরী গুরুদংমার দর্শন করে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে লাচুং (Lachung) এ রাত্রিযাপন। তারপর……তারপর সত্যিই এক স্বর্গে প্রবেশ কেবল সময়ের অপেক্ষা। এ যেন এক মহান সন্ধিক্ষণ। বাবা খুব ভ্রমণ পিয়াসী,বাবার কাছেই বার বার শুনেছি ইউমথাং ভ্যালির অপার সৌন্দর্যের কথা। তাই উত্তর সিকিমের ছোট্ট পাহাড়ি গাঁ লাচুং এর সাধারণমানের কটেজ থেকে সকাল সকাল রওনা দিলাম মাত্র ২৩ কিলোমিটার দূরে থাকা ভিন্নবর্ণরঞ্জিত পুষ্পসম্ভারে সুশোভিত, পাইন, ফার, স্প্রুস, রডোডেনড্রন সমন্বিত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১,৬৯৩ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার’ ইউমথাং উপত্যকার উদ্দেশ্য।

ইউমথাং ভ্যালি যাবার পথে

একটা পাহাড়ের পর আর একটা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে উঠে চলা এই আঁকা বাঁকা পথে প্রকৃতির উজার করা অপরূপ সৌন্দর্যকে শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে উপভোগ করা ও বরফ আচ্ছাদিত পর্বতের শীর্ষে যেতে ভীষণ রকম একটা উত্তেজনা কাজ করে। একদিকে বয়ে চলেছে নীলরঙা খরস্রোতা নদী,অবিরাম গতিতে নেমে আসা ঝর্ণার শব্দ,অন্যদিকে লাল-নীল-সবুজের মেলা আর সামনে দুবাঙ্গ প্রসারী অতন্দ্র প্রহরী শ্বেতশুভ্র চাদরে আচ্ছাদিত হিমালয় দন্ডায়মান। রাস্তার দু’ধারে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করছে ‘সিংবা রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি’। এই স্যাংচুয়ারিতে রডোডেনড্রনের প্রায় ২৪ রকম প্রজাতি আপনি দেখতে পাবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,’রডোডেনড্রন’ সিকিমের রাজ্য ফুল। অসংখ্য বর্ণসমন্বিতপুষ্পসম্ভারে সুসজ্জিতা হয়ে যেন রামধনুর বেশ পরিধান করেছে রাস্তার দু’পাশ। প্রকৃতির এইসমস্ত অনন্য সৃষ্টিকে দু’চোখ ভরে উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলার পথের ধারেই দেখা মিলবে একটি উষ্ণ প্রস্রবণের।

নদী, পাহাড়, ঝর্ণা, গাছ, ফুল প্রকৃতির এক অনির্বচনীয় মহিমান্বিত দৃশ্যকে সাথে নিয়ে কখন যে আপনার গাড়ি এসে গন্তব্যস্থলে ঠিকবে তা বুঝেই উঠতে পারবেন না। বহুদিনের স্বপ্ন পূরণের পথে। নেমে পড়লাম অগণিত ভ্রমণপিপাসু ভারতীয়ের সুইজারল্যান্ড নীল-লাল-সবুজের ঝর্ণা ধারায় স্নাত, হাল্কা তুষারাচ্ছাদিত ‘ইউমথাং ভ্যালি’-র প্রকৃতির হাল্কা সবুজাভ কার্পেটে। সৌমের উজ্জ্বল আভায় উদ্ভাসিত উপত্যকার হাল্কা তুষারাচ্ছন্ন গাছগুলি রূপালি বর্ণধারণ করেছে। ঠান্ডা বেশ অল্প। সবে মিলে এক মোনোমুগ্ধকর আরামদায়ক পরিবেশ বিরাজমান। আমার শব্দভান্ডারে এমন কিছু উপাদান নেই যা দিয়ে এই নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যকে চিত্রায়িত করব।

ইউমথাং ভ্যালি

তাই সাহিত্যসম্রাটের ভাষাতেই বলি – “আহা কী দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।”

মুঠোফোনের ক্যামেরায় এই অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যকে বন্দি করতে করতে এগিয়ে চললাম উপত্যকার পাশ দিয়ে শান্ত-নীলাভ রঙ্গিতের উদ্দ্যেশ্যে। এভাবেই দু’এক ঘন্টা পরম শান্তির নীড় ‘ইউমথাং ভ্যালি’ (Yumthang Valley) এর অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ও তাকে ক্যামেরাবন্দি করতে করতে কীভাবে কাটিয়ে দিলাম তা বুঝেই উঠতে পারলাম না। এবার বিদায়ের পালা ক্রমে ঘনিয়ে এলো।কারণ এখানে দুপুরের পর থেকেই রাস্তা ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত হয়ে যায়। তাই মন না চাইলেও এবারের মতো বিদায় জানিয়ে দিয়ে লাচুং-এর উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু হল। এই ঘন্টা দুয়েকের ঝটিকা সফরের মধ্যেই পরিচয় ঘটল একাধারে বৈচিত্রময় প্রকৃতির সহিত, অন্যদিকে সাক্ষাৎ ঘটল অসংখ্য হিন্দু-মুসলিম-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ ভাইবোনের সাথে। এটাই তো ভারত-ভারতীর ঐতিহ্য-শতাব্দী প্রাচীন সংস্কৃতি, এটাই তো আমার সুজলাং-সুফলাং-শস্যশ্যামলাং জন্মভূমি, এটাই তো ‘বৈচিত্র‍্যের মধ্যে ঐক্য’, এখানেই তো ভ্রমণের সার্থকতা।

তাইতো ‘কাস্তেকবি’ এর ভাষায় স্বগর্বে বলে উঠি – “চোখভরা জল আর বুকভরা অভিমান নিয়েকোলের ছেলের মতো তোমার কোলেই ঘুরে ফিরে আসি বারবার, হে ভারত, জননী আমার।”

ইউমথাং ভ্যালি
Leave a Comment
Share