ভালপারাই ও আথিরাপল্লী জলপ্রপাত

গত মে মাসে দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি জায়গায় গিয়েছিলাম। বিশেষ করে কিছু দক্ষিণী পাহাড়ী জনপদ আর ওয়াটার ফল্স।

পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার আনামালাই রেঞ্জে ভালপারাই (Valparai) এর অবস্থান। সমুদ্র সমতল থেকে ১০৬০ মিটার উচ্চতায় ঘন জঙ্গলে ঢাকা এক অপূর্ব মোহময়ী জায়গা। এর প্রধান আকর্ষণ পাহাড় জোড়া চা বাগান। কেরালার মুন্নার তো এখন প্রায় সবার কাছেই পরিচিত, কিন্তু তামিলনাড়ুর ভালপারাই, সৌন্দর্যে হয়তো কোন কোন অংশে মুন্নারকেও ছাড়িয়ে গেছে।‌

ভালপারাই, তামিলনাড়ু

কোয়াম্বাটোর থেকে ভালপারাই এর দূরত্ব প্রায় ১০২ কিলোমিটার। পোলাচি হয়ে আলিয়ার ড্যামকে (Aliyar Dam) পাশে নিয়ে শুরু হলো পাহাড়ী পথে ওঠা। প্রথমেই বনবিভাগের চেক পোষ্ট। ওখানে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। দেখলাম কোন কোন গাড়ী দাঁড় করিয়ে প্লাস্টিক ফেলা হচ্ছে। তবে আমাদের সঙ্গে সেরকম প্লাস্টিক ছিল না।

এই পথে রয়েছে ৪০ টি হেয়ার পিন বেন্ড। তবে যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গেছিল তাই এই পথের সৌন্দর্য সেভাবে তখন দেখতে পাইনি। ফেরার পথে দেখতে দেখতে নেমে ছিলাম। পথের দুপাশে রয়েছে অত্যন্ত ঘন জঙ্গল যা অনেক বন্য পশুর আবাসস্থল। তাই এই পথ যথেষ্ট বিপদ সঙ্কুল।

উপরে উঠতে উঠতে নিচের আলোকমালায় সজ্জিত আলিয়ার ড্যাম দেখতে দারুন লাগছিল। ক্রমশ নিচের ড্যাম দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। ঘন জঙ্গলে ঢাকা পথে উপরে ওঠার গাড়ীর সংখ্যা কম‌, কিন্তু বহু গাড়ী নিচে নামছে। আমাদের ড্রাইভার দাদা কিন্তু খুবই ভয় পাচ্ছিলেন। কখন একটা হাতি এসে বুঝিবা পথ জুড়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পরে পরেই পথের ধারে রয়েছে সতর্কীকরণ বোর্ড। হাতি যাওয়ার করিডোর অথবা ভালুক বা লেঙ্গুরের বাসস্থান। তবে এই জঙ্গলে রয়েছে বন্য চিতা, বাইসন, সম্বর হরিন ইত্যাদি। নীলগিরি থরের মতো দুর্লভ পশুর দেখা মেলে কখনো কখনো। তবে, সবচেয়ে বেশি যেটা দেখা যায় তা হলো বানর। রাস্তার ধারের কার্লভারটে দলে দলে ছানা পোনা নিয়ে বসে আছে। এদের সাইজ কিন্তু অনেক ছোট।

আলিয়ার ড্যাম

পৌঁছোতে বেশ রাত হলো। প্রায় সাড়ে নটা। এই পাহাড়ে তো মনে হচ্ছে গভীর রাত। রাস্তায় লোকালয় একে তো খুব কম, তার উপর বৃষ্টি হচ্ছে। যা হোক, একটিমাত্র খাবার দোকান তখনো খোলা ছিল। রাতের খাবার ওখান থেকেই সংগ্রহ করা হলো। আজকের রাতটা আমরা সোলেয়ার ড্যাম এর কাছে একটা হোটেলে কাটালাম কারণ আমাদের পরের গন্তব্য আথিরাপল্লী জলপ্রপাত।

পরের দিন সকালে বেড়িয়ে পরলাম কেরালার সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত আথিরাপল্লীর উদ্দেশ্যে। তামিলনাড়ু থেকে মালাক্কাপারা চেকপোস্ট হয়ে কেরালায় ঢুকে যাচ্ছে পথ। এই পথে আথিরাপল্লী মাত্র ৮২ কিলোমিটার। পুরো পথটাই ঘন জঙ্গলাকীর্ণ। এই পথেও রয়েছে বিভিন্ন রকম বন্য পশু বিশেষ করে হাতি। কোন কোন অংশে পথ বেশ সঙ্কীর্ন। গাড়ি চলাচল করছে না বললেই চলে। তবে বাইকার্সদের দেখা মাঝে মাঝে পাওয়া যাচ্ছে। হালকা রোদ, কখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি সাথে নিয়ে চলেছি। পুরো রাস্তাটাই ভাজাচাল রিজার্ভ ফরেস্টের আওতায়। হঠাৎ হঠাৎ দু’তিনটে দোকান লোকালয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে। এমনই একটা দোকানের সামনে দেখি বিশাল এক সম্বর হরিন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চেহারা দেখে গরু বলে ভ্রম হয়।

আথিরাপল্লীকে (Athirappilly) ভারতের নায়াগ্রা বলা হয়। কেরালার কোচি থেকেও মাত্র দু ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় ত্রিশূর জেলায় সোলেয়ার রেঞ্জে অবস্থিত এই জলপ্রপাতে। চালাকুডি (Chalakudy) নদী তামিলনাড়ুর আনামালাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ভাজাচালে একটি খরস্রোত (rapids) তৈরি করেছে। এরপর আরো প্রায় ৫ কিলোমিটার পরে এর উলম্ব পতন (vertical fall) অসাধারণ এক জলপ্রপাত তৈরি করেছে। নাম তার আথিরাপল্লী।

ভাজাচাল ওয়াটার ফল্সকেই বলা যেতে পারে গেটওয়ে অফ্ আথিরাপিল্লী। তামিলনাড়ুর দিক দিয়ে মালাক্কাপারা হয়ে এলে এখান থেকে ফল্স ঘুরে দেখার জন্য টিকিট সংগ্ৰহ করে নিতে হবে। ফলসে প্রবেশের মুখে বোর্ডে দেখলাম সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। বন দফতর ও স্থানীয় বন সংরক্ষণ সমিতি যৌথ ভাবে দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে। প্রবেশ করার পর দুটি ভিউ পয়েন্ট থেকে ফল্সের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। একটি উপর থেকে আর একটি খাঁড়া সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে, যেখানে পাহাড় থেকে জল নেমে এসেছে প্রায় ২৫মি.(৮০ফুট) নিচে, সেখানে দাঁড়িয়ে। এই অসাধারণ দৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। প্রচুর পরিমাণে জল, ভয়ঙ্কর শব্দে পতিত হয়ে, ধোঁয়ার সৃষ্টি করছে। চারটি ধারার ভয়ঙ্কর পতন লেন্সবন্দী করছে শ’খানেক ট্যুরিস্ট। জলধারার একটু কাছে গেলে অবশ্যই আপনি ভিজে যাবেন।

ভারতের নায়াগ্ৰা আথিরাপল্লী জলপ্রপাত

অনেক ছোট বড়ো রেস্টুরেন্ট বা খাওয়ার হোটেল রয়েছে প্রবেশ পথের পাশে। পার্কিং জোন থেকে রাস্তার উপর দাঁড়িয়েও এক ঝলক দেখে নেওয়া যায় এই ফল্স। আবার কোন কোন রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে খেতে এই অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করা যায়।

ভালপারাই ফিরে প্রথমেই দেখে নিলাম সোলেয়ার ড্যাম। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা লেকটির সৌন্দর্য অতুলনীয়। এখানে রয়েছে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এরপরে পৌঁছে গেলাম এক নদীর ধারে। নদীর নাম কুঝান্গাল। ভালপারাই এর প্রধান আকর্ষণ এর অপরূপ ঢেউ খেলানো চা বাগান। চা ও কফি প্ল্যানটেশন, বিভিন্ন মশলার চাষ এখানকার প্রধান অর্থনীতি। পাহাড়ের পর পাহাড়, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত সবুজ এই চা বাগান গুলো কেরালার মুন্নারকে মনে পড়িয়ে দেয়। বিকেলের নরম আলো গায়ে মেখে চা বাগান গুলোর সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে। সন্ধ্যার আলোআঁধারিতে আবার ঝোপের মধ্যে দেখা দিলেন বাইসন। একটি নয়, তিন তিনটি।

চা কিন্তু চিরহরিৎ

পরদিন সকালে বিড়লা টেম্পল দর্শন করে, চা বাগানে ফটো সেশন সেরে ভালপারাইকে বিদায় জানালাম। ফেরার পথে আলিয়ার ড্যাম দেখতে ভুল হয়নি। ভালপারাই তার নিজগুণে চিরকাল রয়ে যাবে মনের কোনায়। ফিরে এলাম কোয়েম্বাটোর। এখান থেকে চেন্নাই হয়ে হাওড়া গামী ট্রেনে বাড়ীর পথে।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Athirappillytamil naduvalparai