সময়টা ছিল ২০১২, প্রথমে প্লান করলাম মে মাসে যাব। সব প্লান করলাম কিন্তু বিভিন্ন কারনে যাওয়া হল না। আগস্ট মাস আসল, রোজার ঈদের ছুটি। লম্বা ৮ দিনের ছুটি কাটানোর প্লান করে ফেললাম। থাইলান্ড যাব বলে আগেই ভিসা করা ছিল, ভিসার মেয়াদ ও আগস্ট মাসেই শেষ। ঈদের ৭ দিন আগে ঠিক করলাম এখনি সময় যাবার, না হলে আর হবেনা। কিন্তু পকেট ফাকা। মামা+চাচা+কাজিন = ৫০০০০+৫০০০০+২০০০০ = ১২০০০০ ধার আর নিজের ৩০ হাজার। এই ১৫০০০০ এর বাজেট।
প্রথমেই দৌড় দিলাম ট্রাভেল এজেন্সীর কাছে, টিকেট লাগবে! নাই নাই নাই!! অনেক কষ্টে বাংলাদেশ বিমান এ টিকেট পেলাম কিন্তু দাম পড়ল বেশি। ২৩০০০ এর টিকেট পড়ল ৩১৫০০ টাকা। ব্যাপার না, যাব তো যাবই।
ফ্লাইট ৩টায় কিন্তু বাংলাদেশ বিমান যথারিতি ঐতিহ্য বজায় রেখে ফ্লাইট লেট, ছাড়ল ৫টায়। আমার প্লান ছিল ব্যাংকক এ নেমেই বাসে করে চলে যাব ফুকেট কিন্তু ফুকেট এর শেষ বাস ছিল ওদের রাত ১০টায়। ফ্লাইট ডিলের কারনে আমি তখন মহা চিন্তিত এবং অনেকটা শিওর যে আমি তখন ফুকেট এর বাস পাব না। আর না পেলে আমার পুরো প্লান চেঞ্জ করতে হবে। ব্যাংকক এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম ১০টায়, এয়ারপোর্ট এর ট্রাভেল এজেন্সী বা ট্যাক্সি ক্যাব কেউ বলতে পারে না যে আমি তখন যেয়ে ফুকেট এর বাস পাব কিনা। তবু রিস্ক নিলাম, একটা ক্যাব নিয়ে চলে গেলেম সাউথ বাস টার্মিনাল। যেয়ে দেখি সব কাউন্টার বন্ধ। কিছু লোকাল বাস এর টিকেট রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে। একটা সুপার শপ খোলা ছিল। ওদের বল্লাম যে ফুকেট এর বাস পাব না? কিন্তু ওরা ইংরেজি বোঝেনা। যারা টিকেট বিক্রি করছিলো তারাও বুঝেনা। শুধু এটুকু বুঝাইল যে NO FUKET BUS, আমি আর আমার স্ত্রী কি করব বুঝতেসিলাম না। এমন সময় এক লোক নিজেই এসে কথা বলল। সরাসরি ফুকেট এর বাস নাই কিন্তু ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে পারবো।
ওনার কথামত আমি যেভাবে গেলাম
১১ঃ৩০ – ব্যাংকক থেকে সুরাথানি পৌছালাম সকাল ৮টায় ভাড়া ৬০০ বাথ (ডাবল ডেকার বাস, ফুল এসি্ নিচতলা দোতলা মিলে ২৪ সিট আরাম করে শুয়ে যাওয়া যায়) রাস্তা ক্রস করে লোকাল বাসের জন্য অপেক্ষা।
৮ঃ৩০ – লোকাল বাসে করে ফুকেট। প্রথম আধা ঘন্টা আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে, তারপর আমার বউ সিট পেল, আমি দাঁড়িয়ে। আরো ১ ঘন্টা পর আমি সিট পেলাম, ভাড়া ২০০ বাথ। ফুকেট পৌছালাম ১২ টায়। সেখান থেকে একটা ক্যাব এ গেলাম পাতং বিচ। যাবার পথে ক্যাব ড্রাইভার একটা ট্রাভেল এজেন্সীতে নিয়ে গেল হোটেল বুকিং এর জন্য। আমার চাহিদা অনুযায়ী বিচের কাছেই (৫মিনিট হাটা পথ) উনি একটা হোটেল ঠিক করে দিলেন আমার বাজেট অনুযায়ী। অসম্ভব ভাল মানুষ। উনার কাছ থেকে আমি ফিফি জাহাজের টিকেট + ফি ফি হোটেল বুকিং + ফুকেট টু ব্যাংকক বাসের টিকেট করে ফেললাম।
হোটেল ভাড়া ১০০০ বাথ, মোটামুটি ৩ স্টার হোটেল কিন্তু বিচের কাছে। তাই পছন্দই হল, নাম মনে নাই। হোটেলে ঢুকলাম ২টায়। আগের দিন বাসা থেকে বের হইসি দুপুর ১টায়, তারপর আবার বিছানা পেলাম পরের দিন ২টায়। তার উপর টেনশন তো ছিলই। ফার্স্ট টাইম বিদেশ ভ্রমন তাও সঙ্গিনীকে নিয়ে।
যাই হোক আগে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে খেলাম তারপর রুমে গিয়ে গোসল সেরেই ঘুম। ঘুমটা একটু দেরিতেই ভাংলো। তখন প্রায় সন্ধ্যা, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চলে গেলাম বিচে। কক্সবাজারের মত ঢেউ নেই কিন্তু নীল পানি। সন্ধ্যার পর হাটা শুরু করলাম রাস্তার ধার ধরে ধরে। তখনি বিচের পাশের ছোট ছোট দোকান থেকে পরদিনের জেমস বন্ড আইল্যান্ড ট্যুর প্যাকেজ কিনে নিলাম। যে প্যাকেজ দুপুরে ট্রাভেল এজেন্সী চাইসিল ১৮০০ বাথ সেটা এখানে কিনলাম ৯০০ বাথ। ৯০০ বাথ এ হোটেল থেকে জেটি আপ ডাউন, সারাদিন ট্রলারে করে ঘুরাঘুরি (James Bond Island + আরো ২টা জায়গা) আর দুপুরের লাঞ্চ, ভালই!!
সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরলাম। পাতং বিচের বেশিরভাগ মার্কেট আমাদের কক্সবাজারের বিচ মার্কেটের মত কিন্তু আরেকটু উন্নত। আর আছে প্রচুর বার, রেস্টুরেন্ট। যেটাতে খুশি ঢুকবেন, নাচ গান চলতেই থাকে সকাল পর্যন্ত।
সকাল ৮টায় আমাদের পিক করবে জেটিতে যাবার জন্য। আমি মোবাইলে ৭টায় এলার্ম দিলাম। কিন্তু ৭ টা বাজার ১ মিনিট আগেই রিসেপশন থেকে ফোন, আমাদের গাড়ি চলে আসছে। কাহিনি কি? গাড়ি তো আসার কথা ৮টায়। মনে পড়ল আমার হাত ঘড়ির সময় চেঞ্জ করসি কিন্তু মোবাইলের সময় ব্যাংকক এর সময়ের সাথে ঠিক করিনি। ওদের সময় আমাদের থেকে ১ ঘন্টা আগায়ে। আমি বললাম ১০ মিনিট দাড়াতে বলেন।
জাস্ট ১০ মিনিটে নিচে নেমে দেখি গাড়ি নাই। রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলে গেছে কি না। উত্তর না 🙁 আমি যাদের থেকে প্যাকেজ নিসি ওদের ওখানে ফোন দিতে বললাম, ওরা জানাল ওয়েট করতে। অন্য আরেক গ্রুপকে রিসিভ করে আমাদের পিক করবে।
সারাদিন চলে গেল জেমস বন্ড আইল্যান্ড ট্যুরে। রাতে খেলাম শুধু ম্যাকডোনাল্ডের ৫৭ বাথের বার্গার আর জুস ১৫/২০ বাথ। আর সন্ধ্যা থেকে আবার সেই শপিং আরে ডিস্কো ড্যান্স 😀
সকাল ১০ঃ৩০টা ছিল মনে হয় জাহাজ। তাইলে ৯টায় গাড়ি চলে আসল, তার আগে ৭টায় ঘুম থেকে উঠে বিচে গেলাম। একটু পানিতে নামলাম, আজ যাব ফি ফি। দ্বিতীয় দিন আর ফুকেটের প্রথম দিনই প্যাকেজ কিনেছিলাম মনে আছে? প্যাকেজের মধ্যেই গাড়ি ইনক্লুডেড ছিল। হোটেল থেকে জেটি অনেক দূর, প্রায় ১.২৫ ঘন্টা লাগসে। জাহাজ ভাড়া ১০০০ বাথ (ফুকেট টু ফি ফি – আপ ডাউন), প্রায় ৩ঘন্টা লাগে যেতে।
আমরা ছিলাম ফি ফি ভিলা রিসোর্ট এ। জেটি থেকে একটু দূরে কিন্তু একেবারে বিচের পাশে। আমাদের ছিল ডিলাক্স বাংলো, ভাড়া ২০০০ বাথ। সেদিন আবারো বিচে নামলাম বিকালে, সন্ধায় রেস্টুরেন্টগুলোতে ঘুরলাম। এটা অনেকটা সেন্টমার্টিন এর মত, খুব বেশি কিছু নাই। বাট রিলাক্স এর জন্য অনেক ভাল।
এদিন ইচ্ছা ছিল সকাল বেলা একটু ঘুরে দেখব। ওদের ট্রলারে করে half day tour দেয়া যায়, কিছু স্পটে নিয়ে যায়। খরচ ৬০০-৭০০ বাথ। কিন্তু সেদিন ছিল ঈদ, আর ফি ফি তে অনেক মুসলিম তাই half day tour package বন্ধ ছিল। ফুল ডে ট্যুর ছিল কিন্তু আমাদের হাতে সময় ছিল না। কারন আজই দুপুর ১ঃ৩০টায় ব্যাক করব। ফুল ডে ট্যুর যদি শিপ এ করেন তাহলে ২০০০-৩০০০ বাথ পর্যন্ত আছে। আর ট্রলারে করলে ১০০০-১২০০ এর মধ্যেই করে ফেলতে পারবেন।
কি আর করা বিচ এরিয়া তে ঘুরলাম। আশেপাশে আবার একটু ঘুরলাম। দুপুরে আবার জাহাজে করে ফেরার পথ ধরলাম। সন্ধ্যায় ফিরলাম ফুকেটে। আগে থেকে বলা ছিল যে আমরা হোটেলে ফিরব না। আমাদের হোটেলে ফেরার বদলে বাস টার্মিনালে নামায়ে দিতে হবে। সে অনুযায়ী আমাদের টার্মিনালে নামায়ে দিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বাস। ডাবল ডেকার ২৪ সিট। ফুল এসি। পরের দিন সকাল ৭টায় পৌছালাম ব্যাংকক। এবার ডিরেক্ট ফুকেট টু ব্যাংকক।
টার্মিনাল থেকে ক্যাব নিয়ে চলে গেলাম (মিটারে) সুকুম্ভিত এরিয়াতে হোটেল খুজতে। আবারো বলছি সম্ভব হলে আগে থেকে বুকিং করে যাবেন। আমরা উঠলাম নানা হোটেলে। ৪ স্টার টাইপ। রূমটা অনেক অনেক পছন্দ হইসিল। ১৮০০ বাথ। কিন্তু এখানে ওয়াই ফাই ফ্রি ছিল না। ঘন্টা হিসেবে কিনতে হত।
আজ ব্যাংকক এ ঈদ, তাই পাঞ্জাবী পড়লাম। আর বউ শাড়ী। টার্মিনাল থেকে আসার পথেই চোখে পড়েছিল বাঙালী রেস্টুরেন্ট। মনিকা’স কিচেন। এছাড়াও পাবেন রাজধানী রেস্টুরেন্ট কিন্তু ঈদের জন্য বন্ধ ছিল। সকালের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে দুপুরে বের হলাম আশে পাশের মার্কেটগুলাতে কোথায় কি পাওয়া যায় দেখতে। খুব বেশি ঘুরতে পারিনি, ৮টায় মার্কেট বন্ধ। তবে একটা আইডেয়া পেয়েছিলাম।
সন্ধ্যা থেকে আবার সেই ডিস্ক, লাইভ মিউজিক, বার এসব ঘুরাঘুরি।
সকালে একটু দেরি করেই উঠলাম। তারপর সোজা চলে গেলাম সিয়াম প্যারাগনে। অবশ্যই Under World Sea দেখবেন। ১৫০০ বাথ মিনিমাম। সারাদিন লাগসে দেখতে, বিকালে চলে গেলাম শপিং মলে।
আশেপাশে একটু ঘুরলাম। দুপুরে ফিরতি ফ্লাইট। আপনারা যারা পারবেন পাতায়া (Pataya) ঘুরে আস্তে পারেন সপ্তম দিন। সেখত্রে ষষ্ঠ দিন সিয়াম প্যারাগন (Siam Paragon) এ যাবেন। পাতায়া যাই নি তাই অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারছি না। যেহেতু ফুকেট আর ফি ফি ঘুরে আসছি তাই আবার বিচে যেতে ইচ্ছে করেনি।
টিপস (Tips)
বিঃদ্রঃ সমস্ত খরচ একজন হিসেবে বলা হয়েছে। হোটেল ভাড়া একজনের যা দুইজনেরও তা। আর খাবার খরচ প্রতিবেলা ১৫০ থেকে ২০০ বাথ। আবার ম্যাকডোনাল্ড বার্গার খেলে ৬০ বাথ। ব্যাংকক এ যে কদিন ছিলাম মনিকাস কিচেনেই খেয়েছি। ভাত না খেলে আমার হয় না।
Leave a Comment