বৃষ্টিবিঘ্নিত এক ভ্রমণ কাহিনী

প্রথমে পাহাড়, তারপরে ইকো পার্ক, এরপর একটা সি বিচ, আর তারপর ঝর্ণা এবং শেষে একটা লেক!! আহা! কি নেই সীতাকুন্ডে (Sitakunda) 🙂

আমাদের যাত্রাটা শুরু হয় ঢাকা থেকে Silver Line এর এসি বাসে করে। টিকেট কেটেছিলাম আমরা রাত সাড়ে এগারোটার। কিন্তু দশটা বাজতে না বাজতেই বাসের সুপারভাইজার লোকাল বাসের কন্ট্রাকটারদের মতো ফোন দেয়া শুরু করে তাড়াতাড়ি আসার জন্যে। উনার একের পর এক ফোনে বিরক্ত হয়ে আমরা সাড়ে দশটার দিকে যাত্রাবাড়ী মোড়ে দাড়াই আর সেখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। এতো আগে যাওয়ার ফলাফলটা ছিলো এরকম – বাস যখন আমাদের সীতাকুন্ড বাজারে নামিয়ে দেয় তখন ঘড়িতে বাজে রাত ৩.৪৫। একেতো ঝুম বৃষ্টি তার উপরে তখন গভীর রাত। রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান থেকে গন্তব্য চিনে নিয়ে আমরা একটু হেটে সীতাকুন্ড বাজারের দিকে যাই। মাঝরাত্রে হোটেল মালিককে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ‘হোটেল জলসা’ তে একদিনের জন্যে একটা রুম ভাড়া নেই ৪ জন ৫০০ টাকায় 😉 হোটেলটার সার্ভিস মোটামুটি, কোনো মতে চলে আরকি। যাই হোক, ভোরের আলো ফুটতে তখনও প্রায় ঘন্টাঘানিক বাকি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ভোর ছয়টার দিকে আমরা রুম থেকে বের হয়ে ‘হোটেল সৌদিয়া’ থেকে সকালের নাস্তা করলাম। তারপর একটা সিএনজি রিজার্ভ করলাম ‘চন্দ্রনাথ পাহাড়ের’ উদ্দেশ্যে। আমাদের যাত্রাটার শুরু এখান থেকেই।

১ম দিন

চন্দ্রনাথে উঠার আগে একটা বাশের দোকান পরে। একেকটা বাশ ২০ টাকা। পরে এসে ফেরত দিলে ১০ টাকা ফিরিয়ে দেয়। এই বাশটা যে কত উপকার করেছিলো তা বলে বুঝানো যাবে না। এটা হয়েছিলো আমাদের তৃতীয় হাত। আল্লাহর নাম নিয়ে ভোর ৬.৪৪ মিনিটে আমরা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। ভূমি থেকে ১০২০ ফুট উচ্চতার এক বিশাল পাহাড় যার পদে পদে ছড়িয়ে আছে রোমাঞ্চ আর থ্রিল! হাতের বাম দিকের রাস্তাটা দিয়ে আমরা উঠেছিলাম। একের পর এক খাড়া সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। মাঝে মাঝে পিছনে ফিরে তাকিয়ে উপভোগ করছিলাম সিতাকুন্ড শহরের অপূর্ব সৌন্দর্য! আমরা উপরে উঠছি আর মেঘ আমাদের নীচে নেমে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ আর আওয়াজ বাড়ছে। উঠতে উঠতে সামনে একটা ছোট্ট ঝর্ণা পেলাম। ঝর্ণার ঠান্ডা পানিটা যেনো আমাদের স্পৃহাকে আরো তীব্র করে তুললো। আমরা একটু একটু করে উপরে উঠছিলাম আর মাঝেমাঝে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে আমরা উঠে গেলাম বিরুপাক্ষ মন্দিরের কাছে। মন্দিরটা অনেক পুরোনো। ওখান থেকে পুরো চট্রগ্রামের অসাধারণ একটা ভিউ পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ সেখানে ফটোসেশন করে তারপরে আবারও উঠা শুরু করলাম। বিরুপাক্ষ মন্দিরের পর থেকে রাস্তাটা আরো ভয়ানক। খাড়া খাড়া একেকটা সিড়ি যার পাশে কোনো রেলিং নেই। একটু এদিক ওদিক হলেই সোজা কয়েক শত ফুট নীচে। হাতের লাঠিটা ভালো উপকারে এসেছিলো। কেনার সময় ভাবতেও পারি নি যে এতোটা সাহায্য করবে এটা। যাই হোক, আমরা তখন প্রায় হাপিয়ে উঠেছিলাম। দেড় ঘন্টা ধরে হাইকিং করেই যাচ্ছি। শরীরের শক্তি যখন প্রায় নিঃশেষ তখনই আবিষ্কার করলাম যে আমরা একদম পাহাড়ের চূড়ায় এসে পরেছি।

পাহাড় চূড়ায় একটা মন্দির আছে যার নাম চন্দ্রনাথ মন্দির। এই মন্দিরের নামেই পাহাড়টার নামকরণ করা হয়েছে ‘চন্দ্রনাথ পাহাড়’। পাহাড় চূড়ায় তখন মেঘ আর মেঘ। বাতাসের গর্জনে পাশে দাড়ানো লোকের কথাও শুনা যাচ্ছিলো না। জীবনের প্রথমবারের মতো কোনো পাহাড় জয় করলাম! অসম্ভব ভালো লাগার মতো একটা অনুভূতি। উপরে উঠার পর চারপাশের দৃশ্য গুলো দেখে নিমিষেই সমস্ত কষ্ট উবে গেলো। অনেক ক্ষণ বসে থেকে আড্ডা দেয়ার পরে আমরা কিছু ভালো লাগার স্মৃতিকে সাথে নিয়ে নামা শুরু করলাম। উঠেছিলাম আমরা বাম পাশের রাস্তাটা ধরে। নামবো এখন ঠিক তার বিপরীত পাশের রাস্তাটা ধরে। নামার সময়ই বুঝলাম যে কত্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত ছিলো। যেদিক দিয়ে নেমেছিলাম সেদিককার রাস্তাটা একদম খাড়া। ইয়া বড় বড় সিড়ি। আমাদের নামতেই প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিলো। চিন্তা করছিলাম যে যারা এদিক দিয়ে না জেনে উঠে আসে তাদের না জানি কতটা কষ্ট হয়!

সীতাকুন্ড পাহাড় থেকে

পাহাড়ের ফাকে ফাকে কিছু দোকান আছে। খুব ভোর হওয়াতে উঠার সময় সব গুলো দোকানই বন্ধ ছিলো। নামার সময় একটা দোকান খোলা পেলাম। সেখান থেকে ৬০ টাকা করে পাহাড়ি ডাব কিনে খেলাম। তারপর আরো অনেকক্ষণ ধরে নামার পরে একটা সময় শেষ হলো আমাদের চন্দ্রনাথ অভিযান! এবার যাত্রা পরবর্তী গন্তব্য – সীতাকুন্ড ইকো পার্ক।

চন্দ্রনাথের গোড়াতেই অনেক গুলো সিএনজি দাড়িয়ে ছিলো। সেখান থেকে ৪ জনে একটা সিএনজি রিজার্ভ করে যাত্রা শুরু করলাম ইকো পার্কের দিকে। পার্কের গেটে যখন পৌছালাম তখন ঝুম বৃষ্টি। ওখানে একটা দোকানে আমরা কিছুক্ষণ বসলাম আর কাপ নুডুলস দিয়ে হালকা নাস্তা সেরে নিলাম। এদিকে বৃষ্টি থামার নাম গন্ধও নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম ভিজে ভিজেই যাবো দরকারে। পার্কের গেটে অনেক গুলো সিএনজি দাড়ানো ছিলো। ৫০০ টাকায় একটা সিএনজি রিজার্ভ করলাম। গেট থেকে দেড় কিলো দূরেই সুপ্তধারা ঝর্ণা। ঝর্ণাটার ছবি ইউটিউবে অনেক বার দেখেছি। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে এতো কাছে গিয়েও সুপ্তধারাকে দেখা হয় নি 🙁 প্রচন্ড বৃষ্টিতে ঝর্ণার ধারে কাছেও ঘেষা যাচ্ছিলো না। আগের দিনই সেখানে একটা আটকে পরা ছেলেকে ফায়ার সার্ভিস এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এজন্যে ওখানকার দ্বায়িত্বে থাকা লোকজন নিরাপত্তা ইস্যুতে আমাদের ঝর্ণা দেখার জন্যে নীচে নামতে দেয় নি। আমরা তাই সামনে যাত্রা শুরু করলাম। ৩ কিলোমিটার পারি দেয়ার পরে সামনে আরেকটা ঝর্ণা – সহস্রধারা

এই ঝর্ণাটা দেখার জন্যে ভূমি থেকে ৪৮৩ টা সিড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয়। নামার সময় তো খুব আরামেই নেমেছিলাম আর তখনই বুঝেছিলাম যে উঠার সময় না জানি কত কষ্ট হবে। একটু একটু করে নীচে নামতে থাকলাম। বৃষ্টি তার মতো ঝড়ছেই! আনুমানিক ৩০০ টার মতো সিড়ি ভাঙ্গার পর আস্তে আস্তে কানে আসলো এক বিকট শব্দ। আরেকটু নামার পরেই দূর থেকে দেখলাম সহস্রধারার ভয়াবহ রুপ!!

কুপিকাটাকুম

এমনিতে এটা তেমন একটা বড়সড় ঝর্ণা না। কিন্তু কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে সহস্রধারা তার সর্বোচ্চ ভয়ানক রুপ ধারন করেছে। প্রায় ১৫০ ফুট ওপর থেকে প্রচন্ড বেগে পানি নামছিলো। পানির ছিটায় ধারেকাছে ঘেষাই যাচ্ছিলো না। আমরা দূর থেকেই কিছুক্ষণ সময় পার করে, গোসল করে চলে আসলাম। আবার সেই ৪৮৩ সিড়ি, আর এবার উপরের দিকে 🙁 এমনিতেই কয়েক ঘন্টা আগে ১০২০ ফুটের এক পাহাড় চড়ে এসেছি, তার উপরে আবার ৪৮৩ সিড়ি। পা যেনো টলছিলোই না। একটু পরপরই বিশ্রাম নিতে নিতে উপরে উঠতে লাগলাম। অবশেষে মানব জীবনের কষ্টের মতো এক সময় এই সিড়িও শেষ হলো 🙂

রিজার্ভ করে রাখা সেই সিএনজিতে করে আবারও সুপ্তধারার কাছাকাছি গেলাম যে যদি যাওয়া যায়। কিন্তু পরিস্থিতি সুবিধাজনক না হওয়াতে রিস্ক নিলাম না। ইকো পার্ক থেকে বের হয়ে আরেকটা সিএনজি নিয়ে সোজা হোটেল রুমে চলে আসলাম। আমাদের এই ২ দিনের ট্যুরের পুরোটা সময় জুড়েই ভারী বৃষ্টি ছিলো। আর সত্যি বলতে, এই বৃষ্টির জন্যেই সব গুলো জায়গার সবচেয়ে সুন্দরতম রুপটা আমরা দেখতে পেরেছি। ওইদিন রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ছাতা মাথায় নিয়ে আমরা দুপুরের খাবার খেতে গেলাম ‘অতিথি’ হোটেলে। সারাদিনের এতো খাটুনির পরে কোকাকোলার সাথে চিকেন বিরিয়ানী টা এক কথায় অমৃত মনে হচ্ছিলো। 

দুপুরে খাওয়া শেষ করে রুমে ফিরে গেলাম। সন্ধ্যা হতে তখনও প্রায় ৪/৫ ঘন্টা বাকি। প্ল্যান ছিলো বিকেলে গুলিয়াখালী সি বিচে যাবো। কিন্তুু বাইরের প্রবল বৃষ্টির জন্যে বাকিরা যেতে কিছুটা গড়িমসি করছিলো। আমি যখন একাই যাওয়ার জন্যে উঠে দাড়ালাম তখন বাকিরাও আমার সাথে রওনা দিলো। পরে নিজের মুখেই ওরা বলেছে যে না গেলে বিশাল একটা মিস করতো।

গুলিয়াখালী সি বিচটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। এমন সবুজে মোড়ানো বিচ আগে কোথাও কখনো দেখি নি। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন পড়ন্ত বিকেল। আমরা ছাড়া আর কেউ ছিলো না সেখানে। জোয়ারের পানি প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে। এদিকে ঘন কালো মেঘে অন্ধকার হওয়ার আগেই যেনো চারপাশটা নিকষ কালো হয়ে আসছে! এ যেনো এক ভয়ংকর সুন্দরের উপাখ্যান! গুলিয়াখালী নামক গ্রামের সেই সি বিচে কাটানো অল্প কিছু মুহূর্ত আজীবন মনে থাকবে।

গুলিয়াখালী সি বিচ

বিচ থেকে রাস্তায় এসে একটা অটো রিজার্ভ করে আমরা আবার চলে আসলাম সিতাকুন্ড নামার বাজারে। একটু ফ্রেশ হয়ে বাইরে ঘুরতে বের হলাম। একটা সিটির আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে সন্ধ্যার পরে। অনেকটা সময় আমরা বাইরে কাটলাম। ইচ্ছা ছিলো পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেল লাইনে বসে আড্ডা দিবো। কিন্তু সবাই টায়ার্ড থাকায় রুমে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। রাত ১০ টার দিকে ডিনার করতে গেলাম ‘হোটেল আলামীনে’। সাদা ভাতের সাথে সবজি, মুরগীর রোস্ট আর ডাল দিয়ে জম্পেশ একটা খানা খেলাম। তার সাথে শেষে ছিলো ফ্রুট কাস্টার্ড। 

 সেদিনের মতো ট্যুরের সমাপ্তি। আগামী কালকে যাবো নাপিত্তছড়াতে

২য় দিন

আগের দিন রাতটা শেষ করেছিলাম বৃষ্টি দিয়ে। পরের দিন সকালটাও শুরু হলো বৃষ্টির সাথে। তাও যেই সেই বৃষ্টি না, একদম ঝুম বর্ষণ। প্রথমে তো ভেবেছিলাম ঢাকা ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যা আছে কপালে, আজকেই যাবো নাপিত্তাছড়া। হোটেল রুম থেকে চেক আউট করে ‘রাজভোগ’ হোটেলে নাস্তা করলাম পরোটা, হালুয়া, ডাল আর চা দিয়ে। শেষে নিয়েছিলাম রস মালাই। আমি আসলে একটু পেটুক টাইপের তো, তাই খাওয়াদাওয়া নিয়ে কখনই কিপ্টামি করি না। 

খাওয়া শেষে মেইন রাস্তায় উঠে একটা লেগুনায় চড়ে এসে নামলাম মীরেরসরাইয়ের নয়দুয়ার নামক জায়গাতে। রাস্তা পার হতেই একটা লোক এসে জিজ্ঞেস করলো যে গাইড লাগবে কিনা। এমনিতে সবাই বলেছিলো যে নাপিত্তছড়াতে গাইড লাগে না। কিন্তু কি মনে করে জানি আমরা ৫০০ টাকায় গাইড নিজাম ভাইকে নিয়ে নিলাম। সেদিনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিলো এটা। বাকিটা পথে পদে পদে বুঝেছিলাম যে ওইদিন গাইড না নিলে কত বড় ভুলটা করতাম। এখন একদম ভরা বর্ষা। চারপাশে অথৈ পানি। ইউটিউবে যেই নাপিত্তাছড়ার চিত্র দেখে গিয়েছিলাম গিয়ে দেখি বর্তমান চিত্র একদম আলাদা। যাই হোক, আল্লাহর নাম নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম।

নাপিত্তাছড়া ট্রেইল

মেইন রাস্তা থেকে আনুমানিক ২ কিলোমিটারের মতো হেটে মূল নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে পৌছানো যায়। আমরা একদম অজ পাড়াগাঁয়ের মধ্য দিয়ে হাটতে লাগলাম। বৃষ্টিতে পুরো রাস্তায় তখন হাটু সমান কাদা। হাটা শুরু করার আগে রাস্তার মোড় থেকে যে লাঠিটা কিনে নিয়েছিলাম সেটা এখন আমাদের সবচেয়ে ভরসার আশ্রয় হয়ে উঠলো। লাঠিটা কম করে হলে ২০ বার স্লিপ করার হাত থেকে বাচালো। মাঝে আমরা একটা চায়ের দোকানে ৫ মিনিট বিরতি দিয়ে হালকা নাস্তা করলাম। তারপরে আবার হাটা শুরু। হাটতে হাটতে এক সময় রেল লাইনের দেখা পেলাম। এই রেল লাইনটাই ঢাকা থেকে এসে চট্রগ্রাম মূল শহরের দিকে চলে গেসে।

রেললাইনটা পার হয়ে আরো কিছুক্ষণ হাটার পরে আমরা পানির একটা প্রবাহ দেখতে পেলাম। গাইড জানালো এখান থেকেই মূল ট্রেইল শুরু। ওখানে ‘রাহাত হোটেল’ নামে একটা খাবারের দোকান আছে। আমরা ভারী জামাকাপড় আর ব্যাগ জুতা ওই দোকানে রেখে দুপুরের খাবারের জন্যে অর্ডার করে গেলাম। ওই দোকান থেকেই ২০ টাকা করে অ্যাংলেট ভাড়া নিলাম। আপনারা যারা কোনো ট্রেইলে যান তারা সাথে করে অবশ্যই অ্যাংলেট নিয়ে যাবেন। খুবই উপকারে আসবে।

বৃষ্টি থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। কোমড় সমান পানি পেরিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। তখনও ভাবি নি যে পরবর্তী ৪ টা ঘন্টা হতে যাচ্ছে জীবনের অন্যতম সেরা মূহুর্ত। পানির প্রবাহটা অনেক শক্তিশালী। তার উপরে নীচে গুপ্ত ধারালো পাথর। লাঠি দিয়ে ব্যালেন্স করে চলতে হচ্ছিলো। গাইড আমাদের প্রতিটা স্টেপেই সহজ রাস্তাটা দেখিয়ে দিচ্ছিলো। আমাদের যেখানে হাটতেও কষ্ট হচ্ছিলো গাইড নিজাম ভাই সেখানে আগেভাগে দৌড়ে সামনে গিয়ে আমাদের ছবি তুলছিলো। পুরো ট্যুরেই উনি আমাদের অসংখ্য ক্যান্ডিড তুলেছেন 🙂

অনেকখানি আগাবার পরে আমরা নাপিত্তাছড়ার গহীনে প্রবেশ করলাম। চারপাশে বিশাল পাথুড়ে পাহাড় আর তার মাঝে দিয়ে বয়ে চলা একটা পানির স্রোতধারা। একদিকে ঘন জঙ্গল আর একদিকে আকাশ ছোয়া কিছু টিলা! তার মাঝে দিয়ে আমরা চলেছি অভিযাত্রী হয়ে। নিজেদের তখন বিয়ার গ্রিলস মনে হচ্ছিলো। জীবনের প্রথম এমন কোনো এডভেঞ্চারে বের হলাম। প্রতিটা মুহূর্তই থ্রিল আর উত্তেজনা আমাদের ছুয়ে যাচ্ছিলো। অনেক খানি সামনে আগাবার পরে একটা মোড় পরলো। গিয়ে দেখলাম ওখানে দুটো ছেলে বসে আছে, পার হতে পারছে না। ওদের রেখেই ওদের গ্রুপ সামনে চলে গেসে। প্রথমে ভাবলাম এ আর এমন কি! কিন্তু একটু পা ছোয়াতেই বুঝলাম যে পানির শক্তিকে কখনই অবহেলা করা উচিত না। লাঠিটা মাটিতে গেড়ে তাতে ভর দিয়ে জাস্ট দুই পা হাটু পর্যন্ত নামিয়েছিলাম। আরেকটু হলে পানির প্রবাহ  লাঠি সুদ্ধ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। প্রচন্ড দক্ষতায় নিজাম ভাই অন্যপাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে আমাদের ৪ জন সহ ওই বসে থাকা ২ জনকেও পার করে নিলো।

বান্দরাকুম

মোড়টা পার হবার পরপরই সামনে আসলো অপূর্ব এক জলরাশি – কুপিকাটাকুম। যারা শুকনো মৌসুমে এই খুমে গিয়েছেন তারা আসলেই হতভাগা। ভরা বর্ষায় এর যে সৌন্দর্য! তা কোনো কবি সাহিত্যিকও ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। বেশ কিছুটা সময় পার করে আমরা আবার সামনে এগুতে লাগলাম। মাঝে আরো কিছু ছোট ছোট ঝিরি আর ঝর্ণা পেলাম। চারপাশে বিশাল পাহাড় দিয়ে ঘিরে রাখা পথ ধরে আমরা সামনে এগুতে লাগলাম।
প্রায় ৩০ মিনিটের মতো ট্রেকিং করার পরে এখন পর্যন্ত আমার লাইফে দেখা সবচেয়ে সুন্দরতম ঝর্ণার দেখা পেলাম। ঝর্ণাটার নাম ‘মিঠাছড়ি ঝর্ণা’। উপর থেকে ছোট একটা জলরাশি পাথরে বাধা পেয়ে নীচের দিকে বিস্তৃত হয়ে পতিত হচ্ছে। যেই বৃষ্টির জন্যে সকালে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো সেই বৃষ্টিটাই আমাদের সকল গন্তব্যকে আরো আকর্ষনীয় করে তুললো। মিঠাছড়ি থেকে আরেকটু দূরে গিয়ে পেলাম বিশাল আরেকটা ঝর্ণা ‘বান্দরকুম’। দুই পাশে বিশাল পাথুরে পাহাড়ের মাঝে দিয়ে প্রায় ১০০ ফুট উপর থেকে পতিত হচ্ছে এই ঝর্ণার জলরাশি। আজীবন মনে রাখার মতো কিছু স্মৃতি সাথে নিয়ে তারপর আমরা ফিরতে শুরু করলাম। গাইড এবার আমাদের পাহাড়ের আড়ালে থাকা সরু কিন্তু সহজতর পথ দিয়ে নিয়ে আসলো।

ফিরে এসে ভেজা শরীরেই দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। সেদিনের আইটেল ছিলো সাদা ভাত, আলু ভর্তা, সেদ্ধ ডিম, মুরগীর মাংস আর ডাল। চার ঘন্টা অনবরত পানির সাথে যুদ্ধ করার পরে এই খাবারটা আমাদের কাছে ধরা দিলো অমৃত হয়ে। কবজি ডুবিয়ে তৃপ্তি ভরে খেলাম।

এবার ফেরার পালা। গাইড নিজাম ভাইয়ের প্রতি খুশি হয়ে তাকে আরো কিছু অতিরিক্ত বকশিস দিয়ে আমরা ফেরা শুরু করলাম। আবার সেই ২ কিলোমিটার, আবার সেই কর্দমাক্ত রাস্তা। মূল রাস্তার অপর পাশে একটা পুকুরে গোসল করে পোশাক পাল্টে নিলাম। সন্ধ্যা হবার তখন খুব বেশি দেরী নেই। আর বৃষ্টি তো আছেই। তবুও সিদ্ধান্ত নিলাম এই ট্যুরের শেষ গন্তব্যে যাবো – ‘মহামায়া লেক‘।

মহামায়াতে পৌছে প্রথমেই যেই অনুভূতিটা মনে আসলো সেটা হচ্ছে – “মহামায়া সত্যিই এক মায়ার নাম”। হাতে সময় কম থাকায় ৩০ মিনিটের জন্যে ২০০ টাকায় একটা বোট ভাড়া করলাম। ট্যুরের ওই দুই দিনের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে মধুরতম ছিলো মহামায়াতে কাটানো ওই ৩০ মিনিট। প্রকৃতি যেনো নিস্তব্ধ হয়ে আছে আপনারই অপেক্ষায়। চারপাশে মন জুড়ানো সবুজ পাহাড় আর তার মাঝে দিয়ে বয়ে চলা এক অপূর্ব সুন্দর লেক। এর মধ্য দিয়ে আপনি ভেসে চলেছেন না জানি কোন এক অচেনা গন্তব্যে! কোনো এক প্রিয় মানুষের শূণ্যতা প্রচন্ড ভাবে অনুভব করলাম। মহামায়ার সত্যিই মায়া আছে। এই মায়ার বাধন আপনি কখনোই ভুলতে পারবেন না।

মিঠাছড়া

লেক থেকে বের হতেই বাইরের দোকান থেকে কিছু আচার কিনে নিলাম। এবার বাড়ি ফেরার পালা। মূল রাস্তায় উঠে লেগুনায় চড়ে ‘বারইয়ার হাট’ নামক জায়গাতে নামলাম। সেখান থেকে একটা লোকাল বাসের টিকেট কাটলাম। তাৎক্ষণিক কোনো গাড়ি ছিলো না বলে লোকালের টিকেট কেটেছিলাম। খুব বেশি দরকার না হলেও ভুলেও এই সব লোকালে উঠবেন না। উঠার সময় তাদের মন ভোলানো কথা শুনতে শুনতে উঠেছিলাম, নামার সময় নেমেছি তাদের গালি দিতে দিতে -_-

রাত আটটায় আমরা চট্রগ্রাম থেকে রওনা দিলাম। ১২ টার দিকে বাস নামিয়ে দিলো ঢাকার ‘চিটাগাং রোড’। এবার ঢাকার বৃষ্টিতে ভিজে ১২.৩০ ও বাসায় ঢুকলাম। আর তার সাথে সাথেই শেষ হলো অসাধারণ, অকল্পনীয় একটা ট্যুরের সফল সমাপ্তি 🙂 🙂

বিঃদ্রঃ আমাদের দেশটা প্রচন্ড সুন্দর। অনুরোধ থাকবে এই সুন্দরকে বিনষ্ট না করার জন্যে। আপনি যদি পরিবেশকে সুন্দর না রাখতে পারেন তবে আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ, বাড়িতেই থাকুন বাইরে বের হবেন না। সৃষ্টিকে নোংরা করলেও স্রষ্টাও কিন্তু তার শোধ তুলতে ছাড়বেন না।
Leave a Comment
Share