শ্নোনেংপেডেং – স্বচ্ছ জলের সাথে মিতালী

মেঘালয়ের ডাউকির ছোট্ট গ্রাম শ্নোনেংপেডেং (অনেকে সোনাংপেডেং লিখে থাকে)। অখ্যাত এই গ্রামটিই হয়ে উঠেছে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কি আছে ছোট্ট এই গ্রামে? যার জন্য দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছে এই গ্রামে। প্রথম ছবিটা দেখি পানির নীচের, দেখেই মুগ্ধ! এত সুন্দর। বাকি ছবিগুলোর সাথে জাফলংয়ের অনেক মিল আছে। ডাউকি হয়ে ভিসা করেছিলাম, শিলং যাবার জন্য। গত জুলাইতে ঘুরে আসি শিলং, ভিসার মেয়াদ এখনও কয়েকমাস বাকি। এদিকে নাফিজ ভাই ঘোষণা দিয়ে দিলেন মাত্র ৩,৫০০ টাকায় ঘুরে আসা সম্ভব। ভিসা যেহেতু করা ছিল, আগের ট্রিপের ২,০০০ রুপিও বাসায় ছিল, সিদ্ধান্ত নিলাম যাওয়াই যাক। । নতুন একটা স্নোরকেলিং সেট আনিয়েছি আমেরিকা থেকে, একবার মাত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। সেটারও একটু সদ্ধ্যহার হয়ে যাবে।

রওনা দেবার মাত্র দুই দিন আগে ভয়াবহ দু:সংবাদ। এক আকস্মিক ঘোষণায় ৫০০ ও ১,০০০ রুপির নোট বাতিল ঘোষণা করেছে ভারত। কঠিন তারল্য সংকটে ভুগছে ভারত, ওখানে থাকা বাংলাদেশি পর্যটকরা আছেন বিপদে। এই অবস্থায় অবস্থায় এই ভ্রমণ বাতিল করার মতই অবস্থা। এত মন খারাপ হলো সবার। জরুরী বৈঠক ডাকা হলো, দলের জৈষ্ঠ্য সদস্যরা বসে ঠিক করবে এই অবস্থায় ভারত যাওয়া ঠিক হবে কিনা। ইতিমধ্যে বাসায় খুজে পেতে ৪৩০ রুপি পাওয়া গেল। আরেকজন সহকর্মী আপা দিলেন ৬০০ রুপি। দলের বাকি সদস্যরাও কিছু না কিছু ১০/২০/৫০/১০০ রুপির নোট জোগাড় করতে পারল। সব মিলে ৫ জনের জন্য ৩,০০০ রুপি! এটুকু সম্বল নিয়েই যেতে হবে ভারতে। আমি বললাম, সীমান্ত থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব ৫ কিমি মাত্র, যদি বিপদ দেখি প্রয়োজনে হেটে চলে আসব বাংলাদেশে, তবু আমি এই ট্রিপ বাতিল করতে ইচ্ছুক না। যাইহোক বৈঠকের পরে দলের সদস্য সংখ্যা কমে দাঁড়াল ৫ জনে। বৃহস্পতিবার রাতে এই ৫ জন মিলেই রওনা দিলাম ছোট্ট গ্রাম শ্নোনেংপেডেং এর উদ্দেশ্যে।

মেঘালয়ের বাড়ি গুলো এরকম কিউট

রাতের বাসে শ্যামলী পরিবহনে করে ঢাকা থেকে সিলেট পৌছালাম ভোর বেলা। একটা সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম তামাবিল সীমান্তে। অনেক ব্যস্ততা সেখানে, একটু আগে পৌছেছে শ্যামলীর শিলং অভিমূখী গাড়ি। আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বললো। অবশেষে প্রায় এক ঘন্টা পরে সকাল সাড়ে আটটার দিকে আমাদের ডাক পড়ল। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ শেষ করে ভারতীয় ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে আরও এক ঘন্টা শেষ। এরপর ট্যাক্সি নিয়ে মাত্র বিশ মিনিটে পৌছে গেলাম গন্তব্যে। যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম সেখানে একটা ছোট্ট হোটেলের সাথে কথা বলে কটেজ দেখতে পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসলাম। নামার সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম কিসের আকর্ষণে ছুটে আসছে পর্যটকরা।

কটেজের জানালা থেকে দেখা উমংগট নদী

পাহাড়ি নদী উমংগট। তার পাশে পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট কটেজ। একটা কটেজ পছন্দ করে উঠে পড়লাম আমরা। সেই কটেজের জানালা খুললেই দেখা যায় নদীর স্বর্গীয় দৃশ্য। দুপুরে খাবারের অর্ডার দিয়ে নুডলস খেয়ে বের হয়ে পড়লাম। নৌকার মাঝি ফ্রাংক আমাদের গাইড, চমৎকার বাংলা ও ইংরেজি বলে সে। স্নোরকেলিং করার জন্য তর সইছিলনা আমার। বলার অপেক্ষা রাখেনা, মাত্রই শিখেছি আমি। দলের বাকি সবাইকে নিয়ে রওনা দিলাম ঘাট থেকে। সবাইকে বাধ্যতামূলক লাইফজ্যাকেট পরিয়ে দেয়া হল। ফ্রাংক চালাচ্ছে নৌকা। জায়গাটা জাফলংয়ের মত দেখতে। শুধু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, আর পর্যটকের সংখ্যা অনেক কম। স্বচ্ছ নদীর তলদেশ দেখা যাচ্ছে অনেক জায়গায়। নদীর উপর একটা বেইলি ব্রীজ, দুই জন মানুষের বেশি একসাথে হাটা যাবেনা এধরণের প্রশস্থ। নদীর ওপাশের গ্রামের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে এই বেইলি ব্রীজটি। নদীর এক পাশে নৌকা থামালো ফ্রাংক, স্নোরকেলিং করার জন্য জায়গা দেখিয়ে দিয়ে গেল।

উমংগট নদীতে স্নোরকেলিং

সময় গড়িয়ে দুপুর তখন। ঝকঝকে রোদ নদীর অনেক গভীরে পৌছে দিচ্ছে আলো। নেমে পড়লাম স্নোরকেলিংয়ে, অসাধারণ দৃশ্য। শুধু মাছের সংখ্যা খুব কম, ভাবলাম পাহাড়ি নদী, মাছের সংখ্যা তো কম হবেই। কিছুক্ষণ নদীতে মাছ তাড়িয়ে গেলাম জীপ লাইনিং করতে। একটিমাত্র তারের সাথে হার্নেস বেধে পার হতে হবে নদী। একটু একটু ভয় লাগছিলো, কিন্তু সবার আগেই রওনা দিলাম। পরিস্কার ইংরেজীতে গাইড বুঝিয়ে বলল কি করতে হবে। তারপর হার্নেস পরিয়ে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিল। কয়েক মূহুর্তেই পার হয়ে চলে গেলাম নদীর ওপারে। সেখানে ক্লিফ জাম্পিংয়ের ব্যবস্থা আছে। অত উপর থেকে ঝাপ দেবার সাহস হলোনা আর।

ঘন্টাখানেক পরে ফ্রাংক ফিরে এসে আমাদের কে নিয়ে গেল নদীর আরও উজানে। বড় বড় পাথরের মধ্যে অত্যন্ত সাবধানে নৌকা চালাচ্ছে। জায়গাটার শেষ ভাগে একটি জলপ্রপাত। বড় বড় পাথরের বোল্ডারের মধ্য থেকে পানি বের হয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীতে। এ জায়গার সৌন্দর্য বলে বা ছবি দেখিয়ে বোঝানো সম্ভব না। বড় বোল্ডারের উপরে কিছু মৎস্যজীবি মানুষ মাছ ধরছে বড়শি দিয়ে। এই গ্রামে মাছের অনেক দাম, কেজি ৬০০ রুপি। রসিকতা করে ফ্রাংককে বললাম, আমাদের বলতা, আমরা মাছ নিয়ে আসতাম তোমাদের জন্য।

বড় বড় এসব বোল্ডারের দিয়ে আরেকটু উজানে গেলে অপেক্ষা করছে জলপ্রপাত

বেলা প্রায় তিনটা তখন, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। সেই কখন এক বাটি নুডলস খেয়ে তার উপর বেচে আছি। কটেজে ফিরে আসতেই ফ্রাংক খাবার নিয়ে এসে টেবিলে সাজিয়ে দিল। নদীর ধারের টেবিলে বসে খেয়ে নিলাম চমৎকার রান্না করা খাবার। ঘুমে দুচোখ বুজে আসছে, কারণ আগের রাতে ভালো ঘুম হয়নি বাসে, তার উপর এতক্ষণ পানিতে দাপাদাপি। সবাই শুয়ে পড়লাম। জানালা দিয়ে চোখ গেলো বিকেলের শ্নোনাংপেডেং গ্রামের উপর। এরকম জায়গায়, এরকম সময় ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করব তা হতে পারেনা। নিচে নেমে এসে নদীর পাড়ে বসে চা খাচ্ছি, আশেপাশেই লোকজন তাবু ফেলছে, রাতে তাঁবুতে থাকবে তারা। পূর্ণিমা বাকি আছে আরও দু/তিনদিন, কিন্তু তা বোঝার কোন উপায় থাকলোনা। চাঁদের আলো যেন ভাসিয়ে দিচ্ছে পুরো গ্রাম। টর্চ সাথেই ছিল, কিন্তু দরকারই পড়লোনা।

ভারতের বিছানাকান্দি, শ্নোনেংপেডেং গ্রাম

নদীটা যেখানে হাটুজল হয়ে আমাদের বিছানাকান্দির মত হয়েছে, সেখানে এসে একটা বড় বোল্ডারের উপর বসে রইলাম আমরা। সময় যেন থমকে গেল। অপার্থিব জোছনা, পাথর কেটে নদীর ছুটে চলার শব্দ, আর নি:স্তব্দ পাহাড়, সবমিলে যেন অন্য এক পৃথিবী। গ্রামের কয়েকটা ঘরে আলো জলছে, এছাড়া কোথাও মানুষ্য সৃষ্ট আলো নেই। বিধাতা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই ইলেকট্রিসিটি নিয়ে গেল। পুরো পৃথিবীতে এখন শুধু চাঁদটাই আলো দিচ্ছে মনে হলো। রাত আরও বাড়লে নদীর পাড় থেকে উঠে চলে গেলাম বেইলি সেতুতে। প্রচন্ড বাতাসে দাঁড়ানোই কঠিন সেখানে। তাই সেতুতেই শুয়ে পড়লাম। এর মধ্যে ফ্রাংক এসে ডেকে নিয়ে গেল রাতের খাবারের জন্য। নদীতে পাওয়া মাছ দিয়েই রান্না হয়েছে। অসাধারণ খাবার। রাতে মড়ার মত ঘুমালাম সবাই।

চলছে নদীর পারে খাওয়া দাওয়া

সকালে উঠে নাস্তা শেষ করেই আবার দৌড় দিলাম পানিতে। আমি ব্যস্ত স্নোরকেলিং নিয়ে, বাকিরা কায়াকিং নিয়ে। একটি কায়াকে দুজন উঠা যায়, দলের দুজন চলে গেল কায়াক নিয়ে। বাকিরা চেষ্টা করছিলাম পানির নিচের মাছ দেখার জন্য। আগের দিন মাছ তেমন একটা দেখিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম ব্যপারটা কি ঘটেছে। সবার আগেই পানিতে নামতে হবে। রোদ বেড়ে গেলে মাছ গভীর পানিতে চলে যায়। ছোটখাটো মাছের খলিসা গোত্রের এক ঝাক মাছের দেখা পেলাম। সেই সাথে আরও কয়েক ধরণের মাছ। প্রায় কালো পাথরের রংয়ের এক ধরণের মাছ দেখলা কয়েকটা। হঠাৎ করে এদেরকে সনাক্ত করাও কঠিন, এত সুন্দর করে পাথরের গায়ে লুকিয়ে থাকে। কয়েকমিনিট চলার পর গত রাতে খাওয়া ট্রাউট ধরণের মাছগুলোকে দেখলাম। এরা ২০০-২৫০ গ্রাম ওজনের হবে, মোটামুটি নিরাপদ দূরত্ব বজিয়ে রেখেছে। এদিকে এক ঘন্টার বেশি স্নোরকেলিং করে আমার রীতিমতো ঠান্ডা লাগছে, তাই উপরে উঠে আসলাম।

পানির নিচের স্বর্গ

বাইকারদের বিশাল একটা দল এসেছে, ৯০০ জনের। সবাই একই “রয়েল এনফিল্ড” বাইক চালায়। টুকটাক কথা হলো তাদের সাথে। ভাগ ভাগ হয়ে বিভিন্ন গ্রামে উঠেছে তারা। এই কয়েকজন এসেছে জলপাইগুড়ি থেকে বাইক চালিয়ে। মুম্বাই-দিল্লির মত শহর থেকে আসা লোকজনও এসেছে তাদের সাথে। এর মধ্যে আমাদের কায়াকিং দল ফিরে এসেছে। এবার আমার যাবার পালা। দলের আরেকজনকে নিয়ে রওনা দিলাম। বুঝলাম কায়াকিং সহজ কাজ না। পানিতে স্রোত প্রায় নেই, কিন্তু বাতাসে বার বার কায়াকের দিক পরিবর্তন করে দিচ্ছিলো। অবশেষে একটা ছোট ঝর্ণা দেখে জায়গাটা ঘুরে ফিরে আসলাম তীরে।

কায়াকিং টিমের কঠিন ভাব

নির্ধারিত সময় শেষ আমাদের, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। এই গ্রামে ছিলাম মাত্র ২৪ ঘন্টা। তাতেই মনে হচ্ছে কতদিন ধরে আছি আর কত কিছু করে ফেলেছি। ফ্রাংকে বিদায় দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে রওনা দিলাম তামাবিলের উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সি ঠিক করাই ছিল। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ শেষ করে তামাবিল থেকে একটা গাড়ী ভাড়া করে চলে এলাম সিলেট। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকাল চারটার মত বেজেছে। পানসীতে না খেলে কি আর হয়, তাই বোয়াল মাছ ও গরুর মাংস দিয়ে খেয়ে হানিফের ঢাকার বাস ধরে রাত ১১ টা নাগাদ ফিরে আসলাম বাসায়। বৃহস্পতিবার রাত ১১ টা থেকে শনিবার রাত ১১ টা, এর মধ্যেই শ্নোনেংপেডেং অভিযান শেষ।

Leave a Comment
Share