সন্দাকফুতে প্রবল তুষারপাতের স্বাক্ষী

গত ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্দাকফুতে প্রবল তুষারপাতের স্বাক্ষী থাকার ভয়ংকর সুন্দর অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেবার প্রয়াস এই লেখা।

প্রথম দিন মানেভাঞ্জাং থেকে টংলু পৌঁছে যে নীল আকাশ ও হাত বাড়ালে ছোঁয়া যাবার মত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলাম তাতেই মন ভরে গেল। সূর্যাস্ত বা সূর্যদয়ে হাজার রংয়ের খেলা, রাতে হাড় কাঁপানো শীত, নির্জনতা কে উপভোগ করে পরদিন আমরা চার বন্ধু টংলু থেকে সন্দাকফু পৌঁছই গত ১৭ ই ডিসেম্বর সন্ধেবেলা, ল্যান্ড রোভারে চেপে। আসার পথেই আমাদের সারথি সানো-ভাই কাঞ্চনজঙ্ঘা র চূড়ায় আটকে থাকা মেঘের রাশি দেখে ভবিষ্যত্ বাণী করেছিল .. এরকম মেঘে বরফ পড়ে, কাল সান্দাকফুতে বরফ পড়ার সম্ভাবনা আছে।

সত্যি বলি, ওর কথা তখন সম্পূর্ণ বিশ্বাস হয়নি।

টংলু ট্রেকার্স হাট

যাই হোক, রাতের ঘর বুক ছিল GTA trekkers hut এ। প্রথমে কিছূ আফশোস ছিল, শেরপা চালেট বা sunrise hotel এর মতো উঁচু ও ভিউ বিশিষ্ট ঘর পাওয়া যায়নি বলে। পরে বুঝেছিলাম এতে শাপে বর হোয়েছে। রাতের খাওয়া সেরে নিতে হলো সন্ধ্যে ৭ টায়,তারপর তিনটে করে লেপের তলায় ঢুকে নিদ্রদেবীর আরাধনায় লিপ্ত হলাম সবাই। ভোর ৩ টায় ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেলো, বাইরে প্রবল বেগে ঝড়ো বাতাস বইছে আর তার সাথে আকাশ থেকে নেমে আসছে অসংখ্য বরফের কুচি। আমাদের ঘর একটু নিচুতে বলে সেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া আমাদের জমিয়ে দিতে পারে নি।

সান্দাকফু থেকে কাঞ্চনজংঘা

কিন্তু আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে জানালার ধারে জমতে থাকলো সেই বরফ, চারপাশ হটাৎ করেই ক্যালেন্ডার এ দেখা সুইজারল্যান্ড এর চেহারা নিলো।বেশ একটা ভাব আসছিল মনে, এর মধ্যেই সকাল ৮ টা নাগাদ খবর এলো – প্রবল তুষারপাতের কারণে সব টুরিস্টকে সান্দাকফু (Sandakphu) থেকে নেমে যেতে হবে। GTA তে যে দিদি আমাদের দেখাশোনা করছিলেন তিনি বললেন এই মাপের বরফ ঝড় ২-৩ দিন ও চলে। থাকতে হলে কোনো সোলার electric পাওয়া যাবে না। এদিকে পানীয়জল ও বাড়ন্ত। গোদের ওপর বিষফোঁড়া র মত আমাদের ল্যান্ড রোভার ও সান্দকফু আসতে পারছে না । আটকে আছে চার কিলোমিটার দূরের বিখেভাঞ্জন এ ।

GTA Trekkers Hut, Sandakphu

আমাদের সেই ভারী তুষারপাতে র মধ্যে দিয়েই বরফ মোড়া পথ ধরে নেমে যেতে হবে গাড়ির কাছে। কিছুক্ষন মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকার পর ঠিক করা হলো যে নেমে যাওয়াই ভালো, কারণ থাকতে হলে যা কষ্ট হবে তার থেকে নেমে যাওয়ার কষ্ট কম। যা জামা কাপড় ছিল সব গায়ে চাপানো হলো,মুখ কান ঢেকে নেওয়া হলো, চোখে উঠলো সানগ্লাস .. trekkers hut থেকেই জোগাড় করে দিল পোর্টার, যারা যারা চায় মাল দিয়ে দিতে পারে ১৫০০ টাকার বিনিময়ে।

অতপরঃ শুরু হলো প্রায় ৪৫ ডিগ্রী তে হেলানো পথে নিম্নমুখী যাত্রা। রাস্তা প্রায় ৬ ইঞ্চি বরফের চাদরে ঢাকা, আকাশ থেকে নামছে আরো বরফ,তাপমাত্রা কত জানা নেই,তবে -১০ বা -১৫ ডিগ্রী হওয়া ও আশ্চর্যের কিছু না। পায়ে একদম সাধারণ স্নিকার্স জুতো, শুধু মোজার সংখ্যা একের বদলে দুই। জীবনে প্রথম বার এই অভিজ্ঞতার সামনে পড়ে সবাই কিছুটা ঘাবরে গেছিলাম বৈকি। তবে ওই যে বলে, ডর কে আগে জিত হ্যায়..পা ফেললাম সামনে।

স্নো ফলের মধ্যেই সান্দাকফু থেকে নীচে নেমে চলা

রাস্তা প্রবল পিছল। বারে বারে ই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। বিশেষত রাস্তার বাঁক গুলো ছিল কংক্রিট করা, সেখানে পা ফেললেই ছোট বেলায় পার্কে স্লিপ চড়ার মত গড়িয়ে যাচ্ছিলাম ১২-১৫ ফুট নিচে। রাস্তায় যে পাহাড়ি মানুষ দের সাথে দেখা হচ্ছিল, সকলে আন্তরিকতার সাথে জিজ্ঞেস করছিলেন দলের সবাই ঠিক আছে কিনা, সবাই নামতে পারছে কিনা। ওরাই বলে দিলেন, রাস্তার ধারে বরফ জমা বোল্ডার ভর্তি নালার মধ্যে দিয়ে যেতে। পায়ে কিছুটা গ্রিপ পাওয়া যাবে। যে বরফের মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেকে নিয়ে নামতে নাকানি চুবানি খাচ্ছিলাম সেই রাস্তাতেই পোর্টাররা নামছিল, এক একজন ৩ টে করে ভারী লাগেজ নিয়ে। দেখে অবাক আর লজ্জা দুটোই লাগছিল।

প্রায় ৪০ মিনিট চলার পর দেখা হলো ড্রাইভার সানো-ভাই এর সাথে, বলে দিলো গাড়ি নিচে আছে। মাল গাড়িতে রেখে বিখাভাঞ্জন এর কিষান জি এর দোকানে বসে চা জলখাবার খেতে। সে চলেছে ওপরে সান্ডাকফুতে, কোনো টুরিস্ট আটকে থাকলে নামিয়ে আনতে। কি আশ্চর্য শৃঙ্খলায় এই পাহাড়ি মানুষেরা কাজ করে চলে, দেখে আশ্চর্য হতে হয়। যাই হোক, বোঝা গেলো দুর্যোগ বেশ বড়ো মাপেরই। মহিলা শিশু সহ প্রায় ৭০-৮০ জন পর্যটক আটকে পড়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ওপরে আটকে গেলে তারা না পাবে জল, না পাবে খাবার। সবাই কে নামিয়ে আনার জন্য প্রায় পেশাদার উদ্ধারকারী দলের তৎপরতায় কাজ করে চলেছে সন্দকফুর বাসিন্দারা।

বিখেভাঞ্জন এ আটকে পড়া ল্যান্ড রোভার

আমরা চারজন আবার পা বাড়ালাম নিচের দিকে। কিছুক্ষন পরে আমরা পৌঁছলাম সেই জায়গায় যেখানে সব ল্যান্ড রোভার আটকে আছে। মাল তুলে দিলাম গাড়িতে। অপেক্ষা না করে নীচে এগোলাম সবাই। আরো ১ ঘন্টা চলার পর বরফ হালকা হয়ে এলো। তবে বৃষ্টির কোনো কমতি নেই, রাস্তা ও পুরো জলকাদা ভর্তি। পিঠের ব্যাগ থেকে জ্যাকেট, মোজা, জুতো সব ভিজে একাকার।

শেষ পর্যন্ত আমরা পৌঁছলাম বিখাভাঞ্জান এর আরো আধ কিলোমিটার নীচে কিষান জির দোকানে। গরম চা এর কাপ হাতে অপেক্ষা শুরু হলো কখন সানো- ভাই আসে গাড়ি নিয়ে। মনে এই দুশ্চিন্তাও ছিল যে বরফ তো পড়েই চলেছে, গাড়ি আদৌ নামতে পারবে তো? শেষ পর্যন্ত আরো ৪৫ মিনিট বাদে হাজির হলো গাড়ি, চাকায় লোহার চেইন বাঁধা। কিছুক্ষন বাদে চেইন খুলে , গাড়ির windscreen বরফ সরিয়ে শুরু হলো মানেভাঞ্জন এর দিকে ফিরতি যাত্রা। শেষ বারের মত ওপরে তাকিয়ে দেখলাম, ঘন‌ মেঘের থেকে নেমে আসা বরফে আস্তে আস্তে ঢাকা পড়ছে আমাদের ফেলে আসা পথ।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ escapesandakphusnowstorm