মেঘের রাজ্য মেঘালয়ের হাতছানি

অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল ভারতের অন্যতম মেঘ-সাম্রাজ্য মেঘালয় (Meghalaya) দর্শনে যাব। এজন্য বছরের মাঝামাঝি আমি ভিসা রেডি করে ফেলি। আমার সঙ্গী হিসেবে ভ্রমণ করে আমার ছেলেবেলার অন্যতম বন্ধু জার্মান প্রবাসী আরিফ। সে বাংলাদেশে আসে জুলাইয়ের মাঝামাঝি আর ভারতীয় ভিসা প্রসেস করে জার্মানী ভারতীয় দূতাবাস থেকেই। সেহেতেু আমরা ১৫ই আগস্ট ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতে প্রবেশ করব বলে সিদ্ধান্ত নেই।

সে অনুযায়ী ১৪ই আগষ্ট রাতে আমরা ঢাকার সায়দাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহনে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ভোরে সিলেট মাজার জিয়ারত করে টেম্পুযোগে ৭০০ টাকা ভাড়ায় তামাবিল বর্ডারে পৌঁছাই। সেখানে সকাল ৯টার পর দুই বর্ডারের যাবতীয় ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শেষ করতে করতে ১১:৩০ বেজে যায়। তারপর আমরা ১০ মিনিট হেঁটে ডাউকি বাজারে পৌঁছাই। সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করি মেঘালয়ের রাজধানী শিলং এর উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম শামসুল হক (বাড়ি আসাম)। চমৎকার বাংলায় কথা বলে। কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পারি তিনি যথেস্ট মিশুক প্রকৃতির ও আমোদী একজন মানুষ। তার সাথে আমাদের চুক্তি হয় যে, তিনি আমাদের ভারতের সবচেয়ে স্বচ্ছ জলের নদী উমাংগট, বোরহিল ফল্স (বাংলাদেশে যাকে পান্থুমাই ঝর্ণা বলে), পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং এবং তার পাশেই অবস্থিত লিভিংরুট ব্রিজ (জীবিত গাছের শিকড় দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি সেতু) দেখিয়ে তারপর শিলং এর প্রধান কেন্দ্রস্থল পুলিশবাজার নিয়ে যাবে। বিনিময়ে তাকে আমরা ২,৫০০ রুপি দিব।

শিলং যাওয়ার পথে মেঘে ঢাকা সবুজ ভ্যালী

যে কথা সেই কাজ। প্রথমেই আমরা স্নোনেংপেডেং গ্রামের উমাংগট নদীতে গেলাম। বর্ডার থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্বে এটি। নদীর পানি যথেষ্ট ঠান্ডা ও নদীর উপর যে ঝুলন্ত সেতু আছে তার উপর থেকে দেখলে নদী গভীরের পাথরগুলিও সুস্পষ্ট দেখা যায়। এই নদীটি পৃথিবীর দ্বিতীয় স্বচ্ছ জলের আধার বলে বিবেচিত। নদীতে গোসলের পর আমরা বোরহিল ফল্স দেখতে গেলাম। এই ঝর্ণার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আসলেই মুগ্ধ হতে হয়। পানির তীব্র গর্জনে কান ঝালা পালা হয়ে যায়। সেখানে কিছু ছবি তুলে আরো প্রায় ঘন্টাখানেক গাড়ি ছুটিয়ে মাওলিননং গ্রামে যাই। এই গ্রামকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামের প্রতিটি ঘরেই সামনেই ফুলের বাগান আর রাস্তার দু’পাশে তারা শুধু ফুল গাছের চাষ করে রেখেছে। যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু নানা ধরনের ফুল। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য চারপাশে। কোথাও কোন ময়লা-আবর্জনা নেই। একটু পরপর বাঁশের তৈরি ঝুড়ি রাখা আছে ময়লা ফেলার জন্য। এই গ্রামে ময়লা তো দূরের কথা, ধুলিকণার অস্তিত্বও নেই। এ গ্রামের একটু উচু স্থান রয়েছে যা বাঁশের তৈরী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। এই উঁচু স্থান থেকে বাংলাদেশের সিলেট জেলার প্রায় পুরোটা অবলোকন করা যায়।

সোনাংপেডেং সাসপেনশন ব্রীজ

গ্রামের মধ্যে কয়েকটি ভালো মানের হোটেল আছে। হাতে সময় যেহেতু কম তাই আমরা গাড়িতে বসেই লাঞ্চ সেরে নিলাম। গ্রামের পাশেই প্রায় ২০০ সিড়ি নিচে নামলে গাছের শিকড় দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি ‘লিভিংরুট ব্রিজ’ সেতুটি চোখে পড়ে। দেখতে হলে জনপ্রতি ২০ রুপির টিকিট কাটতে হবে। এটি দেখলে মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসাই করতে হয়। আসলে এটি নদীর উপরে ফিকাস ইলাস্টিক গাছের নমনীয় শিকড়কে গাইড করার মাধ্যমে গঠিত হয় এবং তারপরে সময়ের সাথে সাথে শিকড়গুলি বৃদ্ধি এবং মজবুত করার পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয় যতক্ষণ না তারা কোনও মানুষের ভার ধরে রাখতে পারে। লিভিংরুট ব্রিজ দেখে আমরা গ্রাম থেকে বের হওয়ার মুখে একটি ব্যালেন্সিং রক বা ‘ভারসাম্য পাথর’ দেখতে পেলাম। বিশাল পাথরটি শুধুমাত্র একটা ছোট স্তম্ভের উপর দাঁড়ানো। খুবই অদ্ভত। না দেখলে বিশ্বাস হয় না। দেখতে দেখতে প্রায় দুপুর ৩টা বেজে যায়।

লিভিং রুট ব্রিজ

এরপর আমাদের গাড়ি রওনা হয় শিলং-এর উদ্দেশ্যে। চমৎকার সুন্দর মসৃণ রাস্তা। বাংলাদেশের হাইওয়েগুলোর মতই। শুধু রাস্তায় গাড়ির আধিক্য নেই। পাহাড়ের গা ঘেষে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে চলতে থাকে আমাদের গাড়ি। পাশেই প্রায় আড়াই হাজার ফুট গভীর খাদ বা ক্যানিয়ান। ভুলক্রমে চাকা হড়কে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না আমাদের অস্তিত্ব। সন্ধ্যার কিছুপর আমরা পুলিশবাজার চৌরাস্তায় এসে পৌঁছাই। আমাদের ড্রাইভার শামসুল ভাইকে বলে রাখি তিনি যেন পরদিন সকাল ঠিক ৭টায় এখানেই অপেক্ষা করেন। তারপর ট্যাক্সি থেকে নেমে আমরা পুলিশবাজার থেকে একটু ভিতরে ১,০০০ রুপিতে একটা হোটেলে রুম ভাড়া নেই। রুমে হাতমুখ ধুয়ে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার পুলিশবাজার চৌরাস্তায় চলে আসি। সেখানে বসেছে প্রায় শ’খানের স্ট্রিটফুডের দোকান। শিলং ঘুরতে আসবেন আর স্ট্রিটফুডের স্বাদ আস্বাদন করবেন না, তা কি হয়? চিকেন থেকে শুরু করে হাজারো ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার পাওয়া যায় এখানে। যাহোক স্ট্রিটফুড খেয়ে আমরা একটা বাঙালী হোটেল খুঁজে বের করে সেখানে ভাত-মাছ খাই। বিল মিটিয়ে আমরা রুমে চলে আসি কারণ সেখানে রাত ৮টার পরই পুরো শিলং শহর কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় এবং শীতও পড়ে যথেষ্ট। হোটেলে সটান হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেই।

এলিফ্যান্ট ফলস

পরদিন সকাল ৭টায় আমরা পুলিশবাজার চলে আসি। সেখানে পরোটা-ডিম দিয়ে নাস্তা সেরে এককাপ চা খেতে খেতেই আমাদের ড্রাইভার শামসুল হক ভাই হাজির। আমার তাকে প্রথমেই লাইটলুম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ান যেতে বলি। এটি মেঘালয়ের অন্যতম বড় একটি ক্যানিয়ান। প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা সেখানে পৌঁছাই। এটা একটি আশ্চর্য জায়গা। এই কুয়াশা, এই রৌদ্র। কোন ধারাবাহিকতা নেই এই মেঘ-রোদের খেলার। ক্যানিয়ানের কাছাকাছি ধারটা সবুজে ঘেরা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্যানিয়ানে আমরা এর গভীরতাটাই দেখতে পারিনি, কারন কুয়াশার কারনে দুই হাত সামনের বস্তুও দেখা যাচ্ছিল না। যদিও পরবর্তীতে চেরাপুঞ্জিতে আমরা আরও কয়েকটি ক্যানিয়ান দেখেছিলাম। যাহোক, লাইটলুম থেকে আমরা বিখ্যাত এলিফ্যান্ট ফল্স দেখতে গেলাম। এই ঝর্ণা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিছুদিন আগেই ঘুরে গেছেন। গেটের কাছে তার ছবিও আছে। সফেদ ফেনার মতো ধারায় পানি প্রবাহিত হয় বলে ঝর্ণাটির রূপ এককথায় অনন্য। এই ঝর্ণা দেখতে হলে আপনাকে ২০ রুপি দিয়ে টিকিট কাটতে হবে।

মকটক ভিউ পয়েন্ট

ফল্স দেখে আমরা শামসুল ভাইকে বললাম যে, চেরাপুঞ্জি ( পূর্বের নাম সোহরা আর সোহরা মানে চূড়া, চেরাপুঞ্জি আসলেই পাহাড়ের চূড়ায়। পরে নাম রাখা হয় চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জি অর্থ কমলালেবুর দ্বীপ। কারণ এখানে কমলালেবুর চাষ বেশি হয়। চেরাপুঞ্জি একসময় মেঘালয়ের রাজধানী ছিল। ১৮৬৪ সালে চেরাপুঞ্জি থেকে শিলংয়ে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়) যাব- চলেন। তিনি বললেন, যেতে যেতেই দুপুর গড়িয়ে যাবে। তাই পথেই লাঞ্চ সারতে হবে। আমরা বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না, গাড়ি দ্রুত টেনে চলেন। শামসুল ভাই ঝড়ের বেগে চেরাপুঞ্জির দিকে গাড়ি ছুটালো। পাহাড়ি রাস্তায় প্রায় পৌঁনে একঘন্টা যাবার পর দুপুর ২:৩০ মিনিটের দিকে আমরা একটা হোটেলে থামলাম। সেখানে কাসার থালায় ছোট ছোট বাটিতে পাপড়, ডাল, শাক, মাছ ও পায়েস দিয়ে পেটপুরে ভাত খেলাম। হোটেলের পাশেই রয়েছে অসম্ভব সুন্দর একটি ক্যানিয়ান। আবারো ছবি তোলার পালা। ছবি তুলেই রওনা হলাম চেরাপুঞ্জির নোহকালিকাই ফল্স দেখতে। এখানেও একই রকমভাবে টিকিট কেটে আসতে হবে। এই ফল্স ১,১১৫ ফুট গভীর।

নোহকালিকাই ফলস দেখে রওনা হলাম চেরাপুঞ্জির আরেক বিষ্ময় মোসমাই কেইভা বা মোসমাই গুহা দেখতে। ২০ রুপিতে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলে একটা গা ছমছমে অনুভূতির সৃষ্টি হবে। জুতা, কেডস পরে গুহায় প্রবেশ না করাই ভাল, কারণ সেটা ভিজে যাবে। এর থেকে স্যান্ডেল কিংবা খালি পায়ে যেতে পারেন। খুবই ভেজা ও স্যাঁতস্যাঁতে হলেও পিছল নয় একটুও। গুহায় প্রবেশ করে বুঝতে পারলাম যে এটা সাধারণ গুহা না। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হলেও গুহার দেয়াল প্রাকৃতিকভাবেই চমৎকার নৈপুণ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। গুহার দেওয়ালের গা থেকে চুয়ে পড়া ফোটা ফোটা পানি বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে। গুহার ভিতরে উজ্জ্বল ফ্লাড লাইটের কারণে আলোকস্বল্পতা হওয়ার অবকাশ নেই। মোটামুটি সব কিছুই পরিস্কার দেখা যায়। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ছোট্ট টানেল পড়লো, এখানে কুজো হয়ে পার হতে হয়। এই জায়গাটায় কিছুটা পানি আছে। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আর কি। এই টানেলটি পার হলে চোখে পরবে ‘এক্সিট’ লেখা। আমরা এপথে গুহা থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে পা ধোয়ার জন্য কল রাখা আছে, চাইলে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারেন।

সেভেন সিস্টার্স ফলস

যা হোক প্রায় ১৫ মিনিটে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পড়ন্ত বিকেলটা কাটাবো চেরাপুঞ্জির আরেক বিষ্ময় সেভেন সিস্টার ফল্স বা মোসমাই ফল্স দেখে। কারণ এটি মোসমাই গুহা থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ। এই ফল্স-এ একসাথে সাতটা ধারায় পানি প্রবাহিত হয় এবং এটি ২৩০ ফুট গভীর। ফলসটি রাস্তার পাশে বিধায় কোন টিকিট কাটতে হয় না তবে গাড়ি পার্কিং ফি ২০ রুপি মাফ নেই। ফল্সটি দেখে আবার পুলিশবাজার আসতে আসতে রাত প্রায় ৮টা। ২,০০০ রুপি ভাড়া মিটিয়ে শামসুল ভাইকে পরের দিন সকাল ৮টায় একই স্থানে আসতে বললাম। তারপর সেই আগের হোটেলেই ডিনার সেরে ক্লান্ত শরীরে হোটেলে এসে লম্বা ঘুম।

সবুজ ভ্যালী

পরদিন সকালে নাস্তা সেরে ঠিক ৮টায় আমরা ডাউকি (বাংলাদেশে এই বর্ডারকে তামাবিল বলে) বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথিমধ্যে মেঘ পাহাড়ের কিছু অসাধারণ ছবি আমরা তুলে নিই। সকাল ১১টার দিকে আমরা বর্ডারে পৌঁছে শামসুল ভাইকে ১,৭০০ রুপি ভাড়া প্রদান করি। এরপর আবারও দু’পাশের ইমিগ্রেশন শেষ করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

পুনশ্চ : ‘প্যারাডাইজ আনএক্সপ্লোরড’ কাকে বলে ? আমরা অনেকেই জানি না। এর দ্বারা ভারতের নর্থ-ইস্টের সাতটা রাজ্যকে বোঝায়। সেই সাতটা রাজ্যের অন্যতম একটি হলো এই মেঘালয়। যারা কম খরচে ভারত ঘুরতে চান তাদের জন্য মেঘালয় একটা ভাল ভ্রমণস্থান হতে পারে। শিলং-এর পুলিশবাজারে তেমন কিছু কিনতে পাওয়া যায় না। দু’একটা শপিং মল আছে কিন্তু দাম যথেষ্ট চড়া। এই ভ্রমণে আমাদের জনপ্রতি ১২,০০০ রুপি খরচ হয়েছিল। আমরা প্রতি বেলাতেই সামসুল ভাইকে গেস্ট করে একসাথে খেয়েছি। বস্তুতঃ তিনি অনেক সহায়ক ছিল আমাদের জন্য। শাসমুল ভাইয়ের মোবাইল নাম্বার- ৯৪৮৫০০২৪১৬।

Leave a Comment
Share