সলো ট্রিপে মানালি ভ্রমণ

প্রথমেই বলে নেই, ইহা সোলো ট্রিপ ছিল। আমি কোনও প্ল্যান করে ট্রিপ করিনি। যখন যা ইচ্ছে হয়েছে করেছি। আমি সাইট সিয়িং এর জন্য নরমালি ট্রিপ করি না। কাইন্ড অফ রিলাক্সিং ট্যুর দেই বলতে পারেন। আর কস্ট কাটিং নিয়েও এতবেশি চিন্তা করি নাই।

দিন ০১

ঢাকা থেকে হানিফ বাসে করে বুড়িমারি বর্ডারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি রাত ৮ টায়, ভাড়া ৮০০ টাকা। বর্তমানে ১০০০ নন এসি। আমি শাহ আলি থ্রি সিটার এসি রিকমেন্ড করবো। ভালো সার্ভিস পেয়েছিলাম দার্জিলিং থেকে আসার সময়। বর্তমান ভাড়া ১৫০০ টাকা। হানিফ ওই লাইনে লোকাল বাস এর চেয়ে বাজে। ঢাকা থেকে দিল্লী ফ্লাইট কস্ট ১৫ হাজারের মতো। এটা অনেক বেশী।

দিন ০২

সকাল ৭ টায় বর্ডারে গিয়ে বাস কাউন্টারে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ৯ টায় বর্ডার খোলার পর ক্রসিং শুরু করি। ঢাকার কোনও সোনালি ব্যাংক থেকে ট্রাভেল ট্যাক্স দিয়ে নিজেই বাংলাদেশ সাইডের কাজ কমপ্লিট করে ফেলতে পারবেন দালাল ছাড়া। কিন্তু চেকিং এর সময় অফিসার বলবে ১০০ টাকা। ভারতীয় সাইডে ইমিগ্রেসন এর লোকজনই দালাল ধরিয়ে দেয়। ২০০ রুপি যায়। ওইখান থেকে ২০ টাকা অটো দিয়ে বাইপাস গিয়ে শিলিগুড়ি এর বাস এ উঠি। বলি বাগডোগড়া এয়ারপোর্ট এ যেতে যেখানে সুবিধা হবে ওইখানে নামিয়ে দিতে। শিলিগুড়ি গেলে এক্সট্রা জার্নি হবে এক থেকে দেড় ঘণ্টার। বাস থেকে নামার পর ২৫০ টাকা দিয়ে অটো ভাড়া নেই। পথে সিম কেনার চেষ্টা করি, বাগডোগড়া তে বাংলাদেশী শোনার পর সিম দেয় না। বর্ডারে অথবা শিলিগুড়ি অথবা দিল্লী থেকে কিনতে হবে। প্রি অ্যাক্টিভ সিম কিনলে মেয়াদ কম থাকবে। নিজে দাঁড়িয়ে রেজিস্ট্রেশান করে নিবেন। আমার দিল্লী এর ফ্লাইট ছিল বিকেল ৪ টা ৩০ এ। ৭ দিন আগে টিকেট কেটেছিলাম ৬৬০০+ টাকায়। আমি এয়ারপোর্ট এ যাই দুপুর আড়াই টার দিকে।

ইন্ডিয়া গেট

দিল্লীতে ল্যান্ড করি সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে। চেষ্টা করবেন টার্মিনাল থ্রি থেকে মেট্রো তে উঠার। বের হয়ে ৬০০ রুপি দিয়ে দেড় জিবি প্রতিদিন প্যাকেজ সহ এয়ারটেল সিম কিনি। মানালিতে পাহাড়ের উপরও এয়ারটেল নেট ছিল। কিন্তু শিলিগুড়ি-দার্জিলিং এ এয়ারটেল খুব বাজে। জিও সিম নিতে পারেন। তারপর ২৫০ রুপি দিয়ে চলে যাই সিএনজি নিয়ে কাশ্মীর গেট। Laxmi Travels এর ভলভো টিকেট কিনি। চেষ্টা করবেন অনলাইনে ZingBus এর টিকেট কিনতে, সবচেয়ে ভালো সার্ভিস ওদের। সাড়ে ৯ টায় বাস ছাড়ে। ভলভোতে সিট একেবারে নামিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে যেতে পারবেন। তাছাড়া কাইন্ডঅফ পুরা সাইড এ জানালা। বাইরের ভিউ ভালো আসে। মাঝে কিছু পাঞ্জাবি হোটেল/ধাবাতে ব্রেক দেয়।

দিন ০৩

ভোর থেকে শুরু হয় স্বর্গীয় রাস্তা দিয়ে যাত্রা। অনেক সুন্দর ভিউ। কিছু ল্যান্ড স্লাইড এর কারণে দুপুর ১২ টার আশেপাশে মানালি পৌছাই। ম্যাপ এ মল রোড এর আশেপাশের কিছু হোটেল এর প্রাইস দেখি। অধিকাংশই ২০০০+ রুপি, ৮০০ রুপির একটি হোটেল খুঁজে পাই। গিয়ে হিন্দি তে কথা বলে ৬০০ রুপি তে ফিক্স করি, আইডি দেওয়ার সময় বাংলাদেশী দেখে বেচারা কষ্ট পায়। বিদেশীদের কাছে দাম বেশী নেয়। একটা জিনিস খেয়াল করেছি, ওইদিকের মানুষ খুব ভালো। হোটেল মালিক খুবই ফ্রেন্ডলি। জানালা থেকে সুন্দর হিল ভিউ। একেবারে মল রোড এ। ডাবল বেড, পরিষ্কার বাথরুম গিজার সহ। আশেপাশে বাঙ্গালী হোটেল ও আছে। প্রথম বার ম্যাল রোডে গিয়ে পাশের পাহাড়ের ভিউ দেখে অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। বাকি দিন হাঁটাহাঁটি করে, রেস্ট নিয়ে কাটিয়ে দেই। আমার ইচ্ছে ছিল হামতা পাস ট্রেক করার, কিন্তু একা দেখে গাইড ছাড়া দোকানদার টেন্ট-স্লিপিং ব্যাগ ভাড়া দেয় নাই। বরফের সিজন কমলে সামনে ইকুইপমেন্ট কিনে আবার যাবো।

মানলি শহরের ভিউ

দিন ০৪

সকালে চলে যাই হাডিম্বা মন্দিরে। মন্দির এর পরিবেশ খুবই রিলাক্সিং এবং সুন্দর। সকালে না গেলে অনেক ভিড় হয়। অবশ্য ৯টার আগে গেলে ভিড় থাকবে না, কিন্তু তখন দোকান/পার্ক বন্ধ থাকবে। সকালে নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ। মল রোড থেকে মন্দির, ভাসিস্ট মন্দির, ওল্ড মানালি সব জায়গার সিএনজি ভাড়া ১৫০ রুপি। উল্টা আসার সময় দামাদামি করে ১০০ তে আসতে পারবেন। ১০ টার দিকে ব্যাকপ্যাক এ অল্প কিছু খাবার+জল কিনে চলে যাই ওল্ড মানালি। ওই দিকে সুন্দর সুন্দর কটেজ আছে। ওল্ড মানালি থেকে লামা ডুগ ট্র্যাক এর স্টার্ট পয়েন্ট এ হেঁটে যাই। গুগল ম্যাপ কে বিশ্বাস করবেন না। আমাকে দেড় ঘণ্টা অতিরিক্ত ঘুরিয়েছে। লোকাল দের জিজ্ঞেস করুন। আমি ভুল করে লামা ডুগ এর রাস্তায় না গিয়ে কল্যাণ ভিলেজ এর দিকে চলে যাই। এই ভুলটা অনেক ভালো ছিল। স্বর্গীয় একটা ট্রেকিং। এইটাতে মানুষ যায়না বলতে গেলে। কিছুই চিনি না, খালি ট্রেইল ধরে হেটেছি, একা বসে ছিলাম সুন্দর পয়েন্ট গুলোতে।

আপেল গাছ

শেষে জংলি আপেল বাগানের দেখা। তখন কিছু খেয়েছি, কিছু ব্যাগ এ নিয়েছি। খুবই নির্জন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাতে গুণা কয়েকজন লোকাল ছাড়া কাউকে দেখিনি। লোকালরা ঘোড়া/গাভী চড়ায় পাহাড়ের উপর দিয়ে। ট্রেকের কয়েক কিলো পার হওয়ার পড়ে একা একজন মেয়েকে দেখেছিলাম ট্রেকিং করছে। আর কাউকে দেখিনি পুরা ট্রেকে। ভেবে দেখুন বাংলাদেশে একা মেয়ে ট্রেকিং এ গিয়েছে। কাল্যান গ্রাম ঘুরে উল্টা হেঁটে আবার সন্ধ্যায় ওল্ড মানালি ব্যাক করলাম। সারা দিনে ২০ কিলো+ হেঁটেছিলাম।

দিন ০৫

ওইদিনের টার্গেট ছিল যোগিনী ওয়াটার ফল। ডিরেক্ট অটো নিয়ে নিচে যেতে পারেন অথবা ট্রেক করে যেতে পারেন। আমি অটো নিয়ে যাই ভাসিস্ট মন্দিরে। ওইখান থেকে ট্রেকিং শুরু। এক-দেড় ঘণ্টার ছোট+সুন্দর একটা ট্রেকিং। পৌঁছে যাবেন ঝর্নার নিচে। ঝর্নার আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে যেতে হবে আরও উপরে। ভয়ানক খারা রাস্তা। কষ্ট করে উপরে উঠার পর সার্থক মনে হবে দৃশ্য দেখে। ঝর্নায় স্নান করে আরেকটু উপরে উঠে ছোট একটা গুহার মতো আছে, এখানে অনেকক্ষণ বসে থাকি। খুব সুন্দর ভিউ।

যোগিনী ওয়াটার ফল

দিন ০৬

ইচ্ছে ছিল রোথাং পাস এ যাওয়ার, কিন্তু হটাৎ স্নো এর কারণে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। লোকাল বাস এ করে সকাল ৯ টায় যাত্রা শুরু করি কাসোল এর উদ্দেশ্যে। ভাড়া ১৮০ রুপি। ট্যাক্সি নিলে ৩-৪ হাজার। ডিরেক্ট বাস না পেলে ভুন্তার বাস এ গিয়ে ওইখান থেকে আরেক বাস এ যেতে পারেন কাসোল। কাসোল গিয়ে গুগল দিল আবার বাঁশ। দুই ঘণ্টার আজাইরা ট্রেকিং, পিঠে ভারী ব্যাগ নিয়ে। ক্লাউড ব্রাস্টে ব্রিজ উড়ে গেছে ১৫-২০ দিন আগে। গুগলে আপডেট নেই। ছজ (Choj) ভিলেজে গিয়ে টেণ্ট ভাড়া করি দিন প্রতি ৫০০ করে। অরিজিনাল ভাড়া তখন ১৫০০ রুপি। কিন্তু ব্রিজ উড়ে যাওয়ার কারণে টুরিস্ট নেই। যারা গেছে অনেকটা ট্রেকিং করে যেতে হয়েছে। সুন্দর পরিবেশে হালকা হাঁটাহাঁটি+রিলাক্স করে প্রকৃতির মাঝে দুই দিন কাটিয়ে দেই।

দিন ০৮

দুপুর ১১ টায় মানালি এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ২ টার দিকে হোটেল চেক ইন করি মানালিতে। ওই দিন ও আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে কাটিয়ে দেই। আসলে যেদিকেই যান সুন্দর ভিউ আছে।

দিন ০৯

ভ্রিগু লেক ট্র্যাকিং এর রাস্তা দুইটা। যেটা সবচেয়ে সুন্দর, সেটা খুব কম মানুষ করে। ভয়ানক খাড়া। মানে অসম্ভব খাঁড়া। আমার টার্গেট দিনের মাঝে যতদুর যেতে পারি গিয়ে ফিরে আসা। সকালে চলে যাই ভাসিস্ট মন্দিরে। শুরু করি ট্রেকিং। আমার লাইফের দেখা সবচেয়ে কঠিন আর ভয়ঙ্কর সুন্দর রাস্তা। ৯৭০০+ ফিট এ যখন পৌছাই তখন ৪ ডিগ্রী টেম্পারেচার ড্রপ। কিন্তু ভয়ঙ্কর সুন্দর। উল্টা পাঁশে বরফ যুক্ত পাহাড় চুড়া। একটা পাহাড়ের মাথা ভর্তি অসংখ্য নাম না জানা ফুল। এক পাশে দেবদারু গাছ এর সারি। সন্ধ্যায় চলে আসি মল রোড।

দিন ১০

সকাল ১১ টায় চেক আউট করি হোটেল। ZingBus ছাড়বে বিকেল চার টায়। এর মাঝের সময় বসে ছিলাম হাডিম্বা মন্দিরের সুন্দর নিরিবিলি পার্ক এ।

দিন ১১

সকাল নয় টার দিকে পৌছাই দিল্লীতে। মেট্রো রেল এ ৫০-৭০ রুপি তে চলে যাই এয়ারপোর্ট এ। বিকেল সাড়ে ৪ টায় বাংলাদেশ বিমান এর ফ্লাইট। ভাড়া ৭৬০০+ বাংলাদেশী টাকায় টিকেট কেটেছিলাম যাত্রার ৫-৬ দিন আগে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা ৭ টার দিকে ঢাকা ল্যান্ড করি।

বিঃদ্রঃ মোট খরচ কতো হয়েছে তার হিসেব রাখিনি।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Himachalmanalisolo trip