মালয়েশিয়া ভ্রমণ … প্রকৃতি আর প্রাচুর্য্যের এক মোহনীয় হাতছানি

প্রথম পর্ব – লাংকাউই

ট্রাভেলার নাকি টুরিস্ট চীরন্তন এই দ্বন্দ্বের মাঝে  এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় , দুঃসাহসী ট্রাভেলাররাই যে এগিয়ে থাকবেন এতে সন্দেহ নেই কোন। কিন্তু আমাদের মত যারা একেবারে ছা-পোষা সংসারী পাব্লিক, যাদের মনপ্রাণ জুড়ে দু;সাহসী ট্রাভেলার হওয়ার অদম্য ইচ্ছা কিন্তু পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদের টুরিস্ট বানিয়েই ছেড়েছে তাদের যেন বিড়ম্বনার শেষ নেই। তাই প্রতিটি বার যে কোন ভ্রমণের ক্ষেত্রেই মনে মনে অনেক এ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছা সত্বেও ভ্রমণ সঙ্গী আমার পাঁচ বছরের কন্যাটির সেফটির কথা মাথায় রেখে সেভাবেই ট্যুর প্ল্যানটি করতে হয়। তবে যেভাবেই আমরা আমাদের ভ্রমণ প্ল্যানটি সাজাই না কেন দেশের বাইরে ভ্রমনে সবার আগে আমরা যে জিনিসটি মাথায় রাখার চেস্টা করি তা হল একটি দেশে তো বারবার যাবার সুযোগ নাও হতে পারে তাই, এই স্বল্প সময়ের প্রতিটি মুহুর্তের সর্বত্তোম উপভোগ যেন হয় তা নিশ্চিত করা। কিন্তু সাথের বেবিটির স্বাচ্ছ্যন্দের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন কম্প্রোমাইজ করতে হয় ঠিক তেমনি আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই কম্প্রোমাইজ করা যায়না। মালয়েসিয়া ভ্রমনের ক্ষেত্রেও তাই আমাদের এই ব্যাপারগুলোর দিকে দৃস্টি রেখেই ট্যুর প্ল্যানটি করতে হয়েছিল। ভ্রমন গ্রুপে আমরা দুই ফ্যামিলি, দুই বেবি সহ মোট সদস্য তিন জন। যেহেতু আমাদের ছুটি ছিল সব মিলিয়ে পাচ রাত, ছয় দিন তাই অনেক কিছু ইচ্ছা থাকা সত্বেও হয়ত করা হয়ে উঠেনি। আমরা আমাদের দিন গুলোকে ভাগ করেছিলাম  এভাবে- তিন রাত লাঙ্কাউই এবং দুই রাত কুয়ালালামপুর। কিন্তু মালিন্দো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ঝামেলার কারনে সেটা উল্টা পাল্টা হয়ে যায়,  সে এক বিরাট কাহিনী, অন্য কোন এক সময় বলা যাবে। যাই হোক আমরা বরাবরই বাজেট ট্রাভেলার, তাই এবারও টিকিট দুইমাস আগেই কেটে রেখেছিলাম।

ঢাকা টু কুয়ালালামপুর মালিন্দো এয়ার এবং কে এল টু লাংকাউই এয়ার এশিয়া। মাঝখানে চার ঘন্টা কে এল এয়ারপোর্টে সময় পার। তাই, দীর্ঘ রাতের ভ্রমনের পর মালয়েশিয়ার প্রথম  দর্শন আমার লাংকাউইতেই হয়েছিল। টিপ টিপ বর্ষন মুখর সকালে এয়ার এশিয়ার প্লেনটি যখন ল্যান্ড করল লাঙ্কাউইর বুকে তখন বৃস্টি ভেজা সোদা গন্ধে মাখানো এয়ারপোর্টটি কেন যেন খুব আপন করে নিল আমাদের। অতঃপর ট্যাক্সি করে সোজা আমাদের হোটেল স্যান্ডি বিচে। রিসোর্টে প্রবেশ করতেই যে দৃশ্য চোখের সামনে দেখা দিল এ যেন মেঘ না চাইতেই মহা প্লাবন! আমাদের সামনেই দীগন্ত বিস্তৃত  সুনীল সাগর তার ফেনিল জলরাশি নিয়ে আছড়ে পরছে যে আমাদের পায়ে! সাগরের একদম তীরেই যে আমাদের হোটেলটি। যাই হোক মুগ্ধতা কাটিয়েই তল্পি তল্পা নিয়ে সোজা রুমে। রাতজাগা দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তি সারা শরিরে , তাই ফ্রেশ হয়েই সবার আগে ঘুম।

হোটেল স্যান্ডি বিচ থেকে সমুদ্র

ঘুম থেকে উঠে দুপুরে একটি ইন্ডিয়ান হোটেলে লাঞ্চ সেরে গন্তব্য ওয়াটার ওয়ার্ল্ড। আমাদের হোটেল থেকে এটি ছিল ওয়াকিং ডিস্টেন্স এ। বিকেল পর্যন্ত ওয়াটার ওয়ার্ল্ড এর রহস্যময় জগতে বিচরন । হরেক রঙ আর নানা বৈচিত্রের সাগরের প্রাণী দেখে বিকেলটা চমৎকার কাটল আমাদের। বিশেষ করে ভাবগাম্ভির্যপুর্ণ পেঙ্গুইনদের কান্ডকারখানা দেখে সত্যিই আনন্দ পেলাম অনেক। আপনাদের গ্রুপে যদি ক্ষুদে সদস্য থাকে তবে এই স্পটটি অবশ্যই মিস করবেন না। ওয়াটার ওয়ার্ল্ড থেকে বেড়িয়ে  আশে পাশে একটু ঘুরাঘুরি। ডিনারের পর রুমে প্রত্যাবর্তন।

পরদিন থ্রি আইল্যান্ড ট্যুর। এই প্যাকেজটি আগের রাতেই আমাদের হোটেলের বাইরেই কিনেছিলাম। সকালে আমাদের হোটেল থেকে পিক করে তারপর তিনটি আইল্যান্ড ঘুরিয়ে দুপুরে ফিরে নিয়ে এল তারা। তিনটি আইল্যান্ডের প্রথমটি জিয়ো ফরেস্ট পার্ক। এখানে বোট থেকে নেমে একটু হাঁটতে হয়। তবে গন্তব্যস্থলে পৌছলে যে মন ভরে যাবে এ ব্যাপারে  সন্দেহ নেই কোন।

জিয়ো ফরেস্ট পার্ক

দ্বিতীয় আইল্যান্ডটি হল ঈগল আইল্যান্ড। এখানে নামতে হবে না। বোট ম্যানরা খাবার ছুড়তেই মুহুর্তেই শত শত ঈগল হাজির।  ঝাঁক ঝাঁক ঈগলের এমন মিলন মেলা আগে কখনো দেখেছি মনে পরেনা।

ঈগল আইল্যান্ড

এবার তৃতীয় এবং সবচেয়ে সুন্দর আইল্যান্ড, নাম বারিস বাসাহ। শুভ্র বালুকা বিস্তির্ন এই দ্বিপটি মন ভরানো সৌন্দর্য্যর ডালা নিয়ে বরন করল আমাদের। এখানে ঘন্টা খানেক কাটিয়ে এক রাশ ভাল লাগা নিয়ে আইল্যান্ড ট্যুর সমাপ্ত করে আমাদের রুমে প্রত্যাবর্তন।

বারিস বাসাহ

দুপুরে হোটেলের বিচেই ঝাপাঝাপি সেরে বিকেলে গন্তব্য অরিয়েন্টাল ভিলেজ। আমাদের ভ্রমনের সবচেয়ে থ্রিলিং পার্টটি এখানেই অপেক্ষা করছিল। কেবল কার। লাঙ্কাউইর কেবল কারে যে একবার উঠবে সে হরলিক্স বা নিডো ছাড়াই ভয় কে জয় করা শিখে ফেলবে। এই রাইডে ঊঠার আগেই আপনাকে একটা প্রস্ততিমুলোক থ্রি ডি সেশনে  অংশ নিতে হবে। তারপর মুল অভিযান। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন স্কাই ব্রীজটি ( ডন টু এর শেষ দৃশ্যে  তে যেটার উপর শাহরুখ তার ভিলেনের ১২টা বাজিয়েছিল) বন্ধ ছিল তাই সেটাতে উঠার সৌভাগ্য ( কিংবা দুর্ভাগ্য) আমাদের হয়নি।

কেবল কারের এক্সপেরিএন্স আর শেয়ার করছিনা। যারা যাবেন তারা নিজেরাই বুঝে নিবেন। তবে এটার শেষ মাথায় এক জায়গা থেকে লাঙ্কাউইর সব আইল্যান্ড গুলো একসাথে দেখা যায় আর তা যে এক অপার্থিব দৃশ্য তা বলার অপেক্ষাই রাখেনা। এই রাইডের মাঝামাঝি যেয়ে আমরা হঠাত খেয়াল করলাম যে আমি আমাদের যাবতীয় ভিসা , পাস্পোর্ট সহ ব্যাগপ্যাক টি ট্যাক্সিতেই ফেলে এসেছি এবং ট্যাক্সিও আমাদের রেখে চলে গেছে, অত;পর কি হল এবং কিভাবে পরে তা ফিরে পেলাম সেটা এক বিরাট ইতিহাস। কাহিনী দীর্ঘ  ও ভ্রমণ কাহিনীতে ছন্দপতন ঘটবে বলে সে সাত কাহনে আর যাচ্ছিনা, এটি পরে কোন একদিন শেয়ার করব।  শুধু বলি ওই একটি রাত আমাদের আয়ুকে প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে নিয়ে এসেছিল।

কেবল কারের এক্সপেরিএন্স

পরদিন ভিসা ফেরত পেয়ে নফল নামাজ পরে আবার পুর্নদ্যমে ঘুরাঘুরি শুরু। তবে সময় সীমিত। তাই ঈগল স্কয়ার দেখে এবং চকলেট কিনে দুপুরে চেপে বসলাম এয়ার এশিয়ার প্লেনে, গন্তব্য কুয়ালালামপুর। আর এখানেই আমাদের লাঙ্কাউই ভ্রমনের ইতি।  কুয়ালালামপুর কথন একটু পরেই বলছি।

এবার ভ্রমন সংক্রান্ত টুকিটাকি কিছু ব্যাপার শেয়ার করছিঃ

টুরিস্ট স্পটঃ লাঙ্কাউই তে অনেক সুন্দর সুন্দর টুরিস্ট স্পট আছে। আমরা শুধু সময় স্বল্পতা আর বেবির কারণে ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, থ্রি আইল্যান্ড ট্যুর, ওরিএন্টাল ভিলেজ , কেবল কার রাইডিং, ঈগল স্কয়ার ভিজিট এই এ্যাক্টিভিটিগুলো করেছিলাম। আপনি অন্যগুলো ও এ্যাড করতে পারেন।

শপিংঃ ট্যুরিস্ট স্পট বিধায় শপিং ফ্রেন্ডলি না। কিছু কেনার কথা না ভাবাই ভাল তবে ব্যাতিক্রম চকলেট এবং এ্যালকোহল । এই দুইটা এখানে ডিউটি ফ্রি। চেনাং মল এ দোতলায় রয়েছে চকলেটের বিশাল সম্ভার।  আমরা এখান থেকেই চকলেট কিনেছিলাম। ইলেক্ট্রনিক্স জিনিস ও কে এল এর চেয়ে কম দামে পাবেন এখানে। আমরা একটা ক্যামেরাও কিনেছিলাম তাই এখান থেকে।

খাবারঃ মুসলিম কান্ট্রি বিধায় হালাল খাবার পেতে সমস্যা নাই। আমি বরাবরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী,  তাই খাবার নিয়ে খুতখুতে প্রচন্ড এবং স্বাদ একটু এদিক ওদিক হলেই মুখে রোচেনা কিছুই। তাই খাবার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট কম করে সাধারনত ইন্ডিয়ান রেস্তোরা আর কে এফ সি তেই বেশি খেয়েছি। মালয়েশিয়ান খাবার ট্রাই করেছি কম।

পরিশেষঃ পাহাড় ঘেরা ছোট্ট ছিমছাম নয়নাভিরাম দ্বিপ এই  লাঙ্কাউই। আমার পারসোনাল এক্সপেরিএন্স বলে এখানকার মানুষ গুলো অসাধারন এবং ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি। বিশেষ করে পাসপোর্ট ভিসা ফিরে পাওয়ার পর এই দ্বীপের মানুষগুলোর কাছে চীর ঋণে বাধা পরে গিয়েছি আমরা। ফিরে আসার আগে তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি কখনো মালয়েশিয়া ভ্রমণের সুযোগ হয় তবে অন্য কোথাও না হলেও অন্তত আবার আসব এখানে কিছুটা সময় কাটাতে এই খোলা প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠা  অসম্ভব সহজ, সরল, ভাল মনের মানুষ গুলোর সাথে।

দ্বিতীয় পর্ব – কুয়ালালামপুর কথন

ল্যাঙকাউয়ি ( Langkawi ) এর মাটি ছেড়ে  এয়ার এশিয়ার ছোট্ট এয়ারক্র্যাফটটি যখন আমাদের নিয়ে উড়াল দিল কুয়ালালামপুরের আকাশের পানে তখন এই ছোট্ট দ্বিপটিকে বিদায় দিতে মনের মাঝে এক অদ্ভুত বিষন্নতা কাজ করছিল। তবে সেই সাথে এক গোপন উত্তেজনাও কাজ করছিল কেমন হবে এই দেশটির প্রধান নগরী। অবশেষে  সাগর পাহাড়ের মিতালী আর চীর সবুজের অপার্থিব সৌন্দর্য্য থেকে আবার আমাদের আগমন ঘটল বাস্তবতার জগতে। ইটকাঠের অবকাঠামোয় গড়া , একের পর এক চোখ ধাঁধানো আকাশচুম্বি বিল্ডিং আর ঝা চকচকে কৃত্তিম সৌন্দর্য্য নিয়ে রাজধানী শহরটি বরণ করল আমাদের।  টুইন টাওয়ারের সমুন্নত শির বেশ কয়েক কিলোমিটার আগে থেকেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল আমাদের। নগরীর ব্যস্ততম এলাকা বুকিত বিন্তাং এ আগে থেকেই বুকিং করে রাখা হোটেলে ঊঠে পরলাম আমরা। ফ্রেশ হয়ে আবার বের হলাম খাবারের সন্ধানে। রাস্তায় বেরিয়ে হতবাক! ওমা এ যে দেখি মিনি বাংলাদেশ। যে দিকেই তাকাই শুধু বাংলাদেশীদের সমারোহ। রাস্তা পার হলেই একাধিক বাংগালি হোটেল। তিনদিন ইন্ডিয়ান কারি আর চিকেন ফ্রাই এর শ্রাদ্ধ করে আজ থরে থরে বাঙালি খাবার দেখে তর যেন সইছিলনা আমাদের। বেশ কয়েক পদের ভর্তা, ভাজি, মাছ, ডাল , সব্জী দিয়ে উদরপুর্তি করে হোটেলে প্রত্যাবর্তন।

সন্ধ্যায় কুয়ালালামপুরের মুল আকর্ষণ টুইন টাওয়ার দর্শন। রঙ বেরং এর আলোর ফোয়ারা বেষ্টিত এই জগদ্বিখ্যাত গগন ছোঁয়া টাওয়ার টি আসলেই চিত্তাকর্ষক। আমরা অবশ্য খুব বেশি ওপরে উঠিনি। এর শপিং মলে যেয়ে তো আমাদের চোখ ধাধিয়ে গেল। জগদ্বিখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডগুলি তাদের অভিজাত সামগ্রি নিয়ে হাজির এখানে। আমাদের মত মধ্যবিত্তরা সেখানে বড় বেমানান। নাম মনে নেই এমন কোন একটি ব্র্যান্ডে একটি ছোট্ট পার্সের দাম করেছিলাম, চাইল বাংলাদেশি টাকায় ২০ হাজারের মত। আমি চোখ কপালে তুলে তিনবার ভিমরি খেয়ে বেড়িয়ে এলাম শো রুম থেকে। অতঃপর আরো কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে ফিরলাম আমরা হোটেলে। হোটেলে ফিরতেই দেখি আমাদের হোটেলের ঠিক সামনেই স্ট্রিট ব্যান্ড শো চলছে। বেশ কিছু উদ্যাম তরুন তরুনী তাদের সঙ্গীতের মুর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছে প্রায় সবাইকে। ফিরতে চেয়েও ফেরা হলনা আর। সঙ্গীতের যে একটি নিজস্ব ভাষা আছে যা ভৌগলিক সীমারেখার অনেক ঊর্ধে। মুগ্ধ হয়েই শুনছিলাম আমরা ভিনদেশী ভাষার সেই গান। মালয়েশিয়ান তরুনিরা  যথেস্টই স্মার্ট। জিন্স, টি শার্ট আধুনিক পোশাকের সাথে হিজাবে আবৃত চুল। মিউজিকের সাথে সাথে নিয়ন্ত্রিত নাচও চলছে তাদের সমান তালে। হঠাৎ গানে চেনা সুরের ছোয়া, দেখি মালয়সিয়ায় তরুন এবার প্রাণ খুলে গাইছে বলিউডের গান। বুঝলাম হিন্দী গান যথেস্ট জনপ্রিয় এখানে। পরপর হিন্দী, আরবি আর ইংলিশ বেশ কিছু গান শুণে আমরা আবার ধর্ণা দিলাম সেই বাংগালী রেস্টুরেন্ট এ। আবার দেশি খাবারের স্বাদ নিয়ে রুমে প্রত্যাবর্তন এবং ঘুম। পরদিনের এ্যাডভেঞ্চার যে বাকি এখনো।

টুইন টাওয়ার দর্শন

পরদিন সকালে রেডি হয়ে আবার সেই বাঙালি রেস্টুরেন্ট এ গমন ব্রেকফাস্ট এর আশায়। কিন্তু এবার খেতে যেয়েই বিপত্তি। রুটি বা পরোটার সাথে যে সব্জীগুলো তারা সাজিয়ে রেখেছে প্রতিটিই যে গতদিনের বেঁচে যাওয়া তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। যাই হোক কোন রকমে নাস্তা করে পরবর্তী গন্তব্য গ্যান্টিন হাইল্যান্ডের জন্য তৈরি আমরা। ট্যাক্সি করে প্রায় দেড় ঘন্টার ড্রাইভের পর গন্তব্যস্থলে পৌছলাম। এখান থেকে দশ মিনিটের কেবল কার রাইড এর পর মুল স্পটে পৌছলাম আমরা। কেবল কারের এক্সপেরিএন্স আবার ঘটল আমাদের। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই স্পটটি আসলে মালয়েশিয়ার একটি অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। গ্র্যান্ড হোটেল, থিম পার্ক, এ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ক্যাসিনো সম্বলিত পরিপুর্ন বিনোদন কেন্দ্র এই স্থানটি। ভুমি থেকে অনেক উচুতে অবস্থিত হওয়ায় সর্বদাই চলছে মেঘের লুকোচুরি। হালকা শীতভাব ও লাগতে পারে তাই বেবি সাথে থাকলে হাল্কা শীতের কাপড় সাথে রাখা ভাল।

গ্যান্টিন হাইল্যান্ডের ভিতরে

দুপুর পর্যন্ত গ্যান্টিং ঘুরে ফেরার পথে আর একটি বাঙালি রেস্টুরেন্ট এ লাঞ্চ সেরে ফিরলাম আমরা। কিছুটা অসুস্থ ছিলাম আমি, তাই আমাদের এই বিদেশ ভ্রমনটির আর একটি উদ্দ্যেশ্যও ছিল আর তা হল ডক্টর দেখানো। দেশে থাকতেই অনলাইনে ডক্টরের  এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া ছিল, কিন্তু এয়ারলাইন্সের সিডিউল বিপর্যয় এর কারণে তা মিস করেছি আগেই। তাই সেদিন বিকেলেই কোন হসপিটালে যেয়ে অন্য একটি ডক্টরের প্রাইভেট চেম্বারে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে গেলাম কন্সাল্ট করতে। শুভ্র শশ্রুমন্ডিত ডক্টরের অমায়িক ব্যবহারের  মুগ্ধতা নিয়ে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে আশেপাশে একটু ঘুরাঘুরি। এর মাঝে বেশ কিছু বাংলাদেশির সাথে কথা হল যারা জিবীকার তাগিদে বছরের পর বছর পরে রয়েছেন বিদেশ বিভুই এ। এর মাঝে একজন আমার কন্যাকে দেখে নস্টালজিক হয়ে পরলেন। মেয়েকে কোলে নিয়ে ছলছিল চোখে বলে চললেন তার সংসারের কথা, তার এখন পর্যন্ত মুখ না দেখা কন্যার কথা যার জন্মের পর একবার ও ফিরতে পারেন নি দেশে। পরিবার পরিজন ছেড়ে দেশ থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা এই অচেনা পরিশ্রমী মানুষ গুলোর প্রতি এক অদ্ভুত মমতায় আচ্ছন্ন হলাম আমরা। সেদিনের মত  ডিনার সেরে আমাদের চতুর্থদিনের ঘুরাঘুরি সমাপ্ত করে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। এর মধ্যে আবার আরেকটি বিপত্তিও ঘটেছে , সকালের সেই বাসী খাবার তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে দিয়েছে অলরেডি।  আমাদের ছয়জনের টিমের চার জনেরই পেটে তীব্র ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। ভাগ্যিস পর্যাপ্ত ঔষধ আর স্যালাইন সাথে থাকায় সে যাত্রায় রক্ষা! এতদিন অন্য এত রেস্টুরেন্ট এ খেয়েও কোন সমস্যা হলনা শেষে কিনা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট এ খেয়ে এই হাল! বুঝলাম এই কয়দিনে টাটকা খেয়ে অরিজিনাল বাংলাদেশি বাসী খাবার আর সহ্য করেনি আমাদের পাকস্থলি। সেইসাথে মনটা খারাপ ও হল একটু। বাঙ্গালী কি চেঞ্জ হবেনা কখনো?

রাতের কুয়ালালামপুর

কুয়ালামপুরের শেষ দিন। রাতে আমাদের ফ্লাইট। শেষ  দিনটি সর্বদাই আমরা রাখি শপিং এর জন্য। দুপুর পর্যন্ত শপিং করে হোটেল থেকে চেক আউট করে ট্যাক্সি করে পুত্রজায়ায় গমন। পুত্রজায়ার সেই বিখ্যাত মসজিদটি আর প্রশাসনিক বিভিন্ন কেন্দ্রগুলি ঘুরে ফিরে দেখে এয়ারপোর্ট প্রত্যাবর্তন। কিন্তু বিধি বাম! ফ্লাইট একদিন ডিলে । এই কাহিনী আগেই বলেছি লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে, এটি পরে আলাদাভাবে লিখব। যাই হোক এয়ারলাইন্সের খরচে আমাদের আর একদিন সময় বাড়ল তবে এবার ঠিকানা পুত্রজায়া। সারাদিন হোটেলে থেকে মাঝখানে একটু সময় টেস্কো শপিং মলে ঘুরাঘুরি করে অবশিষ্ট কয়েকটি রিঙ্গিত শেষ করে আবার সন্ধ্যায় এয়ারপোর্ট। এবার  এয়ারলাইন্স ই আমাদের এয়ারপোর্টে পৌছানোর দায়িত্বটি নিয়ে নিল। অতঃপর রাত একটার দিকে আমরা  মালয়শিয়ার মাটি ছেড়ে উড়াল দিলাম ঢাকার পথে  আর সেই সাথে সমাপ্ত হল আমাদের পাচ রাত ছয়দিনের Malaysia Tour.

এবার কমন কিছু প্রশ্নের উত্তরঃ

খরচঃ পাঁচ রাত ছয় দিনের ( এক রাতের খরচ এয়ারলাইন্সের) মালয়েশিয়া ট্যুরে আমাদের টোটাল খরচ পরেছিল শপিং ছাড়া প্রায় এক লাখ ২৬ হাজারের মত। মালিন্দো এয়ারে ঢাকা টু Kuala Lumpur রিটার্ন টিকিটে আমাদের তিন জনের লেগেছিল ৭২০০০ টাকা। এয়ার এশিয়ায় কে এল টু লাংকাউই রিটার্ন এ তিনজনের ১২০০০ টাকা।  ভিসাতে পার পার্সন ৪০০০ করে মোট ১২হাজার টাকা লেগেছিল। আমাদের তিনজনের লাংকাউই এবং কে এল দুই জায়গাতেই আমাদের হোটেল ভাড়া পরেছিল পার নাইট ১৫০ রিঙ্গিত যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৬০০ টাকা। এখানে যে কথা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন তা হল আমরা গিয়েছিলাম ২০১৪ তে । তখন বাংলাদেশি ২৪ টাকা সমান এক রিঙ্গিত ছিল।  এখন রিঙ্গিতের মান পরে যাওয়ায় এক রিঙ্গিত সমান বাংলাদেশি ১৯ টাকা। কাজেই বলাই বাহুল্য এখন খরচ আগের চেয়ে অনেক কমে আসবে।  অবশ্য ভিসার খরচ এখন আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে  এবং  ই ভিসাও চালু হয়েছে। আপনাদের সুবিধার জন্য খরচগুলো সব টাকায় দেয়ার চেস্টা করলাম।

যাতায়াতঃ  এশিয়ায় অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষনের দেশ মালয়েশিয়া। কুয়ালালামপুরের তুলনায় লাংকাউইর মানুষজন ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি বেশি।  যাতায়াতের জন্য আমরা ট্যাক্সিই প্রিফার করেছি। লোকাল মুভমেন্ট এর জন্য  অনেক সস্তা বাহন ও ছিল যেমন মনো রেল , পাবলিক বাস ইত্যাদি কিন্তু সেগুলো নির্দিস্ট জায়গা থেকে ছাড়ে। বেবিকে নিয়ে হেটে প্রতিবার সেই স্পটগুলোতে যেয়ে এই ট্রান্সপোর্ট গুলি এ্যাভেইল করার চেয়ে ট্যাক্সি তাই আমাদের কাছে সহজ মনে হয়েছে। মিটার থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ট্যাক্সি ড্রাইভার চুক্তিতেই গিয়েছে। মিটারে রাজী হয়নি তারা। ইটকাঠের শহর বুঝি মানুষ কেও কাঠখোট্টা বানিয়ে ছাড়ে কিছুটা ।

শপিংঃ শপিং এর ক্ষেত্রে দামাদামির অপশন কম। বেশ কিছু হোলসেলের মার্কেট আছে । একই জিনিস রাস্তার ধার থেকে নিলে কয়েক ডবল দামে কিনতে হবে কিন্তু এই হোলসেল মার্কেট থেকে কিনলে অনেক চিপে কিনতে পারবেন  কিন্তু শর্ত হল কিনতে হবে মিনিমাম ছয়টি। গিফট এর জন্য আপনি কিনতেই পারেন একই রকম ছয়টি পণ্য।   হরেক রকমের ঘড়ি আর ব্যাগ এখানে কিনতে পারেন অনায়াসেই। আর ব্র্যান্ডেড জিনিস যদি কিনতে চান তার জন্য তো বড় বড় শপিং মলগুলো আছেই। তবে দেশের বাইরে গেলে গার্মেন্টস প্রোডাক্ট কিনতে যাওয়া বোকামী কেননা গার্মেন্টস প্রোডাক্ট তৈরিতে  আমাদের দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে এমন দেশ কিন্তু খুব নগন্য। তাই বেশ কয়েকবার কিনতে যেয়েও পিছনে মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ দেখে আর কেনা হয়নি কোন পোশাক। কিনতে যেয়ে কিনতে না পারার মধ্যেও যে এক ধরনের গর্ব আর আনন্দ থাকতে পারে বুঝেছি তখন। তবে হ্যা, যেকোন জিনিস কেনার আগে কোয়ালিটিটা একটু যাচাই করে নিতে ভুলবেন না কিন্তু।

পরিশেষঃ আমাদের মালয়েশিয়া ট্যুরটি ছিল সবচেয়ে ঘটনাবহুল একটি ট্যুর যার শুধুমাত্র ভ্রমণ পার্ট টি এখানে শেয়ার করলাম। বৈচিত্রময় ঘটনাগুলি পরে শেয়ার করব। আমরা সময় স্বল্পতার কারণে একটি অসম্ভব সুন্দর ট্যুরিস্ট স্পট বাদ দিয়েছি আর তা হল পেনাং। হয়ত এই চার দিনের মধ্যে ম্যানেজ করে যেতে পারতাম কিন্তু তাতে শুধু চোখের দেখাই হত হয়ত, আত্মার খোরাক  কতখানি মিটত সন্দেহ। তাই সেই দৌড়ের মধ্যে যেতে চাইনি।

কখনো পাহার, সাগর আর চীর সবুজের বিশালতা আবার কখনো বা চাকচিক্যময়, সুরম্য আট্টালিকা শোভিত সুবেশি নগর জীবন এই দুইটির স্বাদই  যদি একই সাথে পরিপুর্ণ ভাবে উপভোগ করতে চান তবে আপনার একা কিংবা আপনার পরিবার পরিজন সহ ভ্রমণের জন্য একটি আদর্শ স্থান হতে পারে এশিয়ার এই অসম্ভব সুন্দর দেশটি। চমৎকার আতিথেয়তা আর উদার প্রকৃতি আপনার ভ্রমন পিয়াসী মনকে যে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কোন।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ kuala lumpurlangkawimalaysia