২০১৭ এর ৪ঠা জুলাই গরমের ছুটি কাটাতে সপরিবারে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রওনা দিলাম দার্জিলিং জেলার এক স্বল্পপরিচিত গ্রাম লেপচাজগত। যদিও গ্রামটি আর স্বল্পপরিচিত নয়। বাঙালীদের কাছে কিছুদিনের জন্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে মেঘের রাজ্যে ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। নিউজলপাইগুড়ি থেকে সকালে রওনা দিয়েছিলাম। পথে সোনাদার কাছে গাড়ী থামালাম ব্রেকফাস্টের জন্যে। গাড়ী থামতেই ঠান্ডা হাওয়া আর মেঘ ঘিরে ধরলো আমাদের, হঠাৎ শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি। পাশেই একটি রেষ্টুরেন্ট এ ঢুকে গরম নুডুলস আর ধূমায়িত চা এ চুমুক দিয়েই রওনা দিলাম গন্তব্যর উদ্দ্যেশ্যে।
গাড়ী ঘুম স্টেশনের বামদিকে বেঁকে গেলো আর কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেই স্বপ্নপুরী লেপচাজগত এ। ততক্ষনে বৃষ্টি থেমে গেছে। গাড়ী থেকে নামতেই ঠান্ডা হিমেল আর মেঘ আমাদের স্বাগতম জানালো। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে লেপচাজগতের দূরত্ব কমবেশী ৭৮ কিমি, যেতে সময় লাগলো কমবেশী ৩ ঘন্টা।
আগে থেকেই বুকিং করা লেপচাভিউ হোমস্টের মালিক প্রকাশ লামা ভাই এর আন্তরিক আপ্যায়ন আমাদের অভিভূত করলো। হোমস্টের বারন্দায় নিজের হাতে সাজানো রকমারী ফুল আর অর্কিডের সমাহার। প্রকাশ ভাইয়ের নিজেদের হাতে বানানো খাঁটি বাঙালীয়ানায় মধ্যাহ্নভোজন সেরেই আমরা পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে পড়লাম গ্রাম ঘুরতে। গ্রাম ঘুরে কি দেখলাম তা এখানে বর্ননা না করে কিছু ছবি দিলাম। গ্রামের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য কখনো ভোলার নয়।
নাম না জানা কত ফুল, অর্কিড আর পাইনে ঘেরা মেঘের রাজ্য এই লেপচাজগত। রাস্তায় হাঁটুন আর হোমস্টের বারান্দায় থাকুন যেকোন সময়ে ভাসমান মেঘ এসে পা ভিজিয়ে দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাবে। জীবনের এই স্বল্প পরিসরে এত জায়গা ঘুরেছি কিন্তু পশ্চিমবাংলার মধ্যে দার্জিলিং এর এত কাছেই এত সুন্দর জায়গা থাকতে পারে তা কল্পনাও করতে পারিনি। সারাদিন ঘুরে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার আগেই ঢুকে পড়লাম হোমস্টেতে। ঢুকতেই প্রকাশ ভাই নিয়ে এলেন গরম চা আর সাথে ভেজ পকোড়া। কি বিচিত্র সেই চা এর কাপগুলি। প্রকাশ ভায়ের কাছে খবর নিলাম ভারত নেপাল সীমান্তের পশুপতি মার্কেটে পাওয়া যায় এই সুন্দর কাপগুলি। যাই হোক সন্ধ্যায় রাস্তার উপরে বসার সীটে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম। রাত বাড়তে ঠান্ডার আধিক্য টের পেলাম। রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশে দূরের দার্জিলিং সহ অন্যান্য পাহাড়ী জনপদের আলো ঝিকমিক করতে লাগলো। কি অপরূপ সেই দৃশ্য। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করেই শুয়ে পড়লাম।
হঠাৎ দরজার ধাক্কার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো, জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনো অন্ধকার, দরজার বাইরে প্রকাশ ভাই এর কন্ঠস্বর শুনে উঠে পড়লাম। দরজা খুলতেই বললেন তাড়াতাড়ি আসুন, আজ লেপচাভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেই লোভ না সামলাতে পেরে হাল্কা একটা চাদর জড়িয়েই ক্যামেরা আর লেন্স নিয়ে ছুটলাম ভিউপয়েন্টের দিকে। তখনো দিনের আলো ভালোভাবে ফোটেনি। ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলো। মনের আনন্দে ফ্রেমবন্দি করলাম কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটতে পর্যটক ভরে গেলো।কনকনে ঠান্ডায় হাত পা কাঁপতে লাগলো। তাড়াতাড়ি নেমে এলাম হোমস্টেতে।
সকালের প্রাতরাশ সেরেই গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম সুখিয়া বাজার, জোড়পখরি, সীমানা বাজার, মানেভঞ্জন ও নেপাল বর্ডার ঘুরে সুখিয়া বাজারে কেনাকাটা করে হোমস্টে ফিরলাম। মধ্যাহ্নভোজন করে একটু বিরতি নিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম দার্জিলিং ম্যাল এর উদ্দ্যেশ্যে। মহাকাল মন্দির দর্শন করে সম্পূর্ণ বিকাল এবং সন্ধ্যাটা সপরিবারে আড্ডা দিলাম ম্যালে। দার্জিলিং মার্কেট থেকে শীতবস্ত্র কেনাকাটা করে ফিরে এলাম হোমস্টে। পরদিন সকালেই বেড়িয়ে একে একে দেখে নিলাম ঐতিহ্যপূর্ণ ঘুম স্টেশন, ঘুম মনাস্ট্রি, বাতাসিয়া লুপ, পিস প্যাগোডা, হ্যাপী ভ্যালী টি স্টেট, জুলজিক্যাল পার্ক, তেনজিং রক, আরও দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে ফিরে এলাম।
বিকাল আর সন্ধ্যা লেপচাজগতেই আড্ডা দিলাম। পরদিন সকালে প্রাতরাশঃ সেরে বেড়িয়ে পড়লাম সারাদিনের জন্যে তাকদা, তিনচুলে, লামহাট্টার উদ্দ্যেশ্যে। আাঁকা বাঁকা পাহাড়ী পথ আর চা বাগানকে সঙ্গী করে ঘুরলাম এই সুন্দর দর্ষনীয় ভ্রমনস্থলগুলি। ফেরার পথে রাস্তায় বৃষ্টি পেলাম, বৃষ্টির পর মেঘ আর পাহাড়ী জনপদগুলি কি সুন্দর লাগে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারলাম না। হোমস্টে ফিরতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আমাদের ভ্রমন পর্ব শেষ। পরের দিন সকালেই রওনা হতে হবে নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দ্যেশ্যে। সকাল হলো হাতে একটা বড় টিফিন বক্স নিয়ে হাজির প্রকাশ ভাই। আমরা সকালেই রওনা দেব শুনে ভোর বেলা উঠে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে আমাদের সকলের জন্যে গরম পরোটা আর ফুলকপি দিয়ে একটা অসাধারণ শব্জি বানিয়ে রেখেছিল। আমার হাতে দিয়ে বললেন এত সকালে খেলেন না, তাই খাবার বানিয়ে দিয়েছি, গাড়ীতে বা ট্রেনে উঠে খেয়ে নেবেন। আমি ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি অমায়িক আর উদার হৃদয়ের মানুষ। সত্যি ঐ হোমস্টে তে থাকাকালীন ওনার আতিথেয়তা আর ব্যবহার জীবনেও ভুলবো না। সম্পূর্ণ ভ্রমন কাহিনীতে আরও একজন অতিথি ছিল, যে আমাদের সকলের মন জয় করে নিয়েছিল। সে হল প্রকাশ ভাই এর ছয়মাসের ছোট্ট কুকুর “লাকি”। লেপচাভিউ হোমস্টের সকল সদস্যকে বিদায় জানিয়ে আবার আসবো ফিরে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রওনা দিলাম নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দ্যেশ্যে।
আপনাদের সবার সুবিধার্থে আমি LEPCHAVIEW HOMESTAY নম্বর আর থাকা খাওয়ার ও গাড়ি খরচ উল্লেখ করলাম –
LEPCHAVIEW HOMESTAY
প্রকাশ লামা – ৯৮৩২৪২৯৪৮৬ / ৭৮৭২২২৮১১২
হোমেস্ট তে থাকাখাওয়া নিয়ে জনপ্রতি খরচ 900/-
NJP থেকে লেপচাজগত- 2000/-
লেপচাজগত থেকে সারাদিনের দার্জিলিং সাইট ট্যুর- 2000/-
লেপচাজগত থেকে সারাদিনে তাকদা, তিনচুলে, লামহাট্টা সাইট ট্যুর- 2500/-
Leave a Comment