ইউসমার্গ
ইউসমার্গ যাওয়ার পথে যা পৃথকভাবে মনে ভালোলাগার উদ্রেক করল, তা হল রাস্তার দুই ধারে জায়গায় জায়গায় প্রাচীরবিহীন আপেল বাগিচা। মনে হল অবারিত দ্বার, কিন্তু জানা কথাই যে ওই বাগিচাগুলিও মালিকানাধীন, কেবল তাঁরা প্রাচীরের বাঁধনে না বেঁধে বাগানগুলিকে অধিক মাত্রায় উন্মুক্ত প্রকৃতির অংশ করে তুলেছেন। ফেরার পথে এই খোলামেলা আপেল বাগানে নামব ঠিক করলাম।
ইউসমার্গে পৌঁছে দেখলাম আবার একটি সুন্দর সুবিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা, যেদিকে চোখ যাচ্ছে উঁচুনীচু সবুজ পাহাড়, একটির উপর থেকে আরেকটি যেন উঁকি দিচ্ছে। অন্যান্য ভ্যালিগুলোর থেকে ইউসমার্গে অজস্র ছোটো বড়ো পাহাড়ের এই তরঙ্গায়িত বিস্তার বেশি করে চোখে পড়ল। সবুজ তরঙ্গের লীলায়িত বিস্তারে প্রকৃতি যেন আরও মোহময়ী রূপ লাভ করেছে। বেশ সস্তায় দুটি ঘোড়া পেলাম দুধগঙ্গা, বরগা ভ্যালি, আর হাইজিন ভ্যালি দেখব বলে।
দুধগঙ্গা আসলে বরফ গলা জলে পুষ্ট নদী ও ঝরনার সঙ্গমস্থল, জল যেখানে দুধসাদা রূপে প্রবাহিত হয়, যদিও জলের স্রোত কম থাকায় সেই দুধসাদা বর্ণ আমরা দেখতে পেলাম না, তা দেখতে পেলাম আরও উপরে বরগা ভ্যালির রাস্তায়, যে রাস্তায় যেতে যেতে মনে হয় এখানে এর আগে কোনো জনমানব আসেনি, আমরাই প্রথমবার চলেছি অজানা কোনো গুপ্তধনের সন্ধানে। আর প্রকৃতির সে গুপ্তধনের সন্ধান যে বৃথা হল না, তা বলাই যায়। কাশ্মীরের প্রধান প্রধান দর্শনীয় স্থান ঘুরে এসে এখানে নতুন কী দেখতে পাব সে ভাবনা মনে হালকাভাবে দু-একবার যে আসেনি তা বলব না, কিন্তু আবার প্রতিবারের মতোই নিজ মাহাত্ম্যে আমাদের মনের দ্বিধাকে ধুয়ে মুছে দিল কাশ্মীরের এই উপত্যকা। আদি অকৃত্রিম অপাপবিদ্ধ সরল সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায়, ইউসমার্গ হল তাই। এ যেন স্বয়ং ঈশ্বরের বিরাজভূমি, তাই এত সজীব সুন্দর, কলুষতা ও মলিনতাবিহীন, এত দূষণমুক্ত। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো মানুষের উপস্থিতি টের পেলাম না। ঘোড়ায় চেপে যেন কোনো এক রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি। নির্জন বনভূমি, সেই নির্জনতায় সুর মিলিয়ে অজস্র পাখির ডাক, উদাসী হাওয়ায় বুনো ফুলের মাথা দোলানো, পাশ দিয়ে অবিশ্রান্ত ধারায় কুলুকুলু নাদে বয়ে চলা স্বচ্ছতোয়া স্রোতস্বিনী। তার ওপারে রয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট একটি দরগা। তাতে অনেক রঙিন টুকরো কাপড় বাঁধা। কে জানে কখন কারা এসে সৃষ্টিকর্তার আপন লীলাভূমিতে দরগা বানিয়ে হৃদয়ের গোপন বাসনা মেটানোর আকুতিতে বেঁধে দিয়ে গেছে তাদের রঙিন টুকরো মনস্কামনাগুলিকে।
এগিয়ে চলেছি হাইজিন ভ্যালির দিকে। আমাদের অতীব নিরীহ সরল দুই ঘোড়াচালক দু’জন নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় নিজেদের ভাষায় কিছু বলার চেষ্টা করছে দেখে কৌতূহল হল। জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত করে বলল সম্ভবত কাল রাতে এদিকে চিতা বাঘ গেছে, বৃষ্টিভেজা মাটিতে পায়ের দাগ দেখে তারা অনুমান করেছেন, যদিও দিনের বেলা আসার সম্ভাবনা কম। শিহরিত হয়ে ভাবলাম কোথায় এসে পড়েছি, মনে রোমাঞ্চকর এক ভালোলাগা ছেয়ে গেল। বেশ কয়েকবার ঘোড়ায় চেপে ভয়টা অনেকখানি কেটে গেছে, দিব্যি উপভোগ করছি এই অপরিসীম সৌন্দর্যে অধ্যুষিত স্বর্গলোককে। মনে হল, অনেক মানুষ তো সত্যিই এর আগে এসেছেন, বেড়িয়েছেন এখানে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বিন্দুমাত্র ছাপ এখান থেকে বিলুপ্ত হল কীভাবে ! হয়তো এই সুবিশাল পর্বত ও বনানীর কাছে আমাদের ক্ষুদ্র অস্তিত্ব এতটাই তুচ্ছ যে, স্বাভাবিক নিয়মে তা প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে গেছে। স্মৃতিতে জেগে উঠলেন বিভূতিভূষণ, যাঁর হাত ধরে প্রকৃতির নিবিড় পাঠ অনুধাবন করেছি আমরা। বারবার মনে পড়ছিল ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের সেই লাইনগুলি “কতকাল হইতে এই বন পাহাড় এই এক রকমই আছে। সুদূর অতীতের আর্যেরা খাইবার গিরিবর্ত্ম পার হইয়া যেদিন পঞ্চনদে প্রবেশ করিয়াছিলেন, এই বন তখনো এই রকমই ছিল; বুদ্ধদেব নববিবাহিতা তরুণী পত্নীকে ছাড়িয়া যে-রাত্রে গোপনে গৃহত্যাগ করেন, সেই অতীত রাত্রিতে এই গিরিচূড়া গভীর রাত্রির চন্দ্রালোকে আজকালের মতোই হাসিত; তমসাতীরের পর্ণকুটীরে কবি বাল্মীকি একমনে রামায়ণ লিখিতে লিখিতে কবে চমকিয়া উঠিয়া দেখিয়াছিলেন সূর্য অস্তাচলচূড়াবলম্বী, …………সেদিনটিতেও পশ্চিম দিগন্তের শেষ রাঙা আলোয় মহালিখারূপের শৈলচূড়া ঠিক এমনি অনুরঞ্জিত হইয়াছিল, আজ আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে যেমন হইয়া আসিতেছে।” সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে একইভাবে প্রশান্ত সৌন্দর্য নিয়ে বিরাজ করা সেই পাহাড়-পর্বত, বনভূমি, নদী, উপত্যকা আজও যে সেই একই সহজ ছন্দে নিজস্বতা বজায় রেখে বিরাজ করছে, তা আমরা চাক্ষুষ করলাম এই ইউসমার্গে, বরগা ভ্যালি ও হাইজিন ভ্যালি যাওয়ার পথে।
হাইজিন ভ্যালিও এমনি মলিনতাবিহীন সবুজ স্নিগ্ধতায় ভরা এক মায়াবী উপত্যকা, যেখানে পৌঁছালে মনের মধ্যে এমন এক উদাসী বাউলকে অনুভব করা যায়, যাকে এমনি ব্যস্তদিনে মনে পড়ে না। বা হয়তো মনে পড়ে কোনো অবিরাম বৃষ্টিপাতের সন্ধ্যায় একাকী ঘরের জানালায় বসে, অথবা ট্রেনের জানালা থেকে দূরের মাঠের সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে। আমি জানিনা, এমন গভীর ও অনির্বচনীয় পরম আনন্দের আস্বাদ আমি জীবনে আগে কখনও পেয়েছি কিনা, কিন্তু একশোবার স্বীকার করব, কাশ্মীর আসার আগের আমির সঙ্গে কাশ্মীর থেকে ফেরা আমির তফাত শুধু আমি নিজেই জানব। কী দেখলাম, কী অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরব, কোথায় আছি, কোথায় যেতে হবে, সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল, কেমন যেন অসাড় আচ্ছন্ন জড়বৎ হয়ে পড়ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, এ আমার অনুভূতিহীনতার বোধ নাকি সূক্ষ্মানুভূতি, যা আমাকে এই অপার উন্মুক্ত পবিত্র প্রকৃতির সামনে এমন বিবশপ্রায় করে তুলেছে। কোটি প্রণাম জানালাম তাঁর চরণে, যিনি আমাকে এই বৈচিত্রের সম্মুখীন করলেন। আসলে এ তো ঈশ্বরেরই আর এক রূপ, যার সন্ধানে যুগে যুগে আপন ভুলে, স্বজন ভুলে, ঘর ভুলে, পরিবার ভুলে পথিক বেরিয়ে পড়ে, তাকে টেনে রাখতে পারে না কোনো প্রিয়জনের আবেগ বা আকুলতা। এতে যে কী সুখ, কী পরম আনন্দ তা তো জানে সেই, যে তাকে চিনতে পারে। আমরা ছাপোষা মানুষ, মুরোদ কোথায় সব ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ার। কিন্তু হিসেবি মনের অঙ্ক কষে যতটুকু পারব আসব তোমার টানে, কথা দিলাম, হে পাহাড় পর্বত নদী অরণ্যানী কথা দিলাম তোমাদের, বারবার ফিরে ফিরে আসব তোমার কাছে।
ফেরার পথে পথের ধারে উন্মুক্ত একটি আপেল বাগিচায় নেমে পড়লাম, মালিকের বদলে অদূরে দণ্ডায়মান সুউচ্চ পাহাড়গুলি যেন পাহাড়া দিচ্ছে পরিপক্ব ফলের বাগিচাকে। আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না, কিছু ফটো বা ভিডিও করা ছাড়া। যদিও অনেকবারই গাছ থেকে অন্তত একটি ফল পেড়ে খাওয়ার সাধ হয়েছিল, কিন্তু নিয়ম রক্ষার্থে তা আর হয়ে ওঠেনি। আজ নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ছিল দেখার মতো সুন্দর, সেই নীলাকাশতলে যদি সুদৃশ্যরূপে হাতছানি দেয় এমন কাঙ্ক্ষিত প্রিয় ফলের বাগান, তো মনকে আর আটকায় কে ! মন ভরে আশা মিটিয়ে ছবি তোলা সাঙ্গ করে ফিরে এলাম। যেহেতু বেলা অনেকটা বাকি, তাই দুজনেরই বড়ো ইচ্ছে হল আর একবার ওয়াটার লিলি অভিযানে যাওয়ার। যদি বারবার তিনবারের প্রচেষ্টায় কিছু ফল লাভ হয়। আর আজকের রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশ, ঝলমলে আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল আজ আমরা নিরাশ হব না। জাভেদ ভাইয়ের ফোনে ইমতিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল, সে রাজি, ফাঁকাই বসে আছে ঘাটে। তিনটের মধ্যে ফিরে এসে চেপে বসলাম শিকারায়। আর সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ভিডিও কল করার সময় বুঝেছি যে এখানে সন্ধ্যে নামে অনেকটা দেরি করে, সাত টার পরেও দিনের আলো থাকছে। তাই আশা রইল ভালোই। আর যেমন আশা তেমন ফল।
আমাদের ভ্রমণ পর্ব সাঙ্গ হল মন ভরে প্রস্ফুটিত ওয়াটার লিলির পূর্ণ সান্নিধ্যে এসে। অন্য কোনো শিকারা চালক এই পাগলামি সহ্য করতেন কিনা জানিনা, কিন্তু ইমতিয়াজ ভাই যেভাবে আমাদের উন্মাদনা হাসিমুখে সহ্য করছিলেন, তাতে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মুগ্ধ হলাম। কবি বলেছিলেন না, ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো…’ মর্মে মর্মে অনুধাবন করলাম সত্যিটা। কালে ফেলে কাকে যে দেখি, মিষ্টি গোলাপী দূরের ওই আহ্লাদিনী, যে আলতো লজ্জায় গোলাপী লালিমায় চেয়ে আছে অপরিচিতের পানে, নাকি একেবারে হাতের নাগালে আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জীবিত বিকশিত পাপড়ি দুগ্ধশুভ্র গরবিনীকে, মন পুলকে মাতোয়ারা, কী যে করব, কী করতে পারলে এই মহান দুর্মূল্য ক্ষণটিকে যথাযথ মূল্য প্রদান করা যাবে তা মাথায় আসছে না। উদ্ভ্রান্তের মতো হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া এই পরশমণিকে নিয়ে আমাদের পাগলামি তাই আর থামে না। একেবারে লিলি গার্ডেনের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে আমাদের শিকারা, অভি শিকারার প্রান্তে শুয়ে পড়ে ভিডিও করছে, চারিদিকে হাতের কাছে অগুণতি রঙবেরঙের ওয়াটার লিলির সমারোহ, মনের মধ্যে খুব আনন্দ, যাক আমাদের এই ভ্রমণ যেন আজ সম্পূর্ণতা পেল, নাহলে এই পূর্ণ ফুটন্ত সৌন্দর্য চাক্ষুষ না করে ফিরতে হলে একটু কষ্ট হয়তো মনের কোণে থেকেই যেত। অপূর্ব লাগল, ঠিক যেমনটি কাশ্মীর ট্যুরিজমের বিজ্ঞাপনে ড্রোন থেকে নে
ওয়া ভিডিওটিতে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তেমনটি চোখের সামনে দেখে আমার চক্ষু সার্থক করলাম। শেষবেলায় যা পেলাম তা যে তুলনাহীন। ঘন্টাদুয়েক ডাল লেকের পাড় ধরে হেঁটে বেড়ালাম, পদ্মের বীজ খেলাম, কত বড়ো বড়ো এক একটা। অলস পদচারণার মাঝে দেখি পশ্চিমে লেকের জলে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে, উজ্জ্বল সোনারঙে রাঙিয়ে দিয়েছে ডাল লেকের জলকে অস্তায়মান সূর্য। কী অপূর্ব এক সূর্যাস্ত। ঘাটে যেতে না যেতেই ঝুপ করে ডুবে গেল দিগন্তে। কী অপরূপ শোভা, বহুক্ষণ যার রেশ রয়ে গেল লেকের জলে, পড়ন্ত বিকেলে আর আমাদের মনে। সবকিছু মিলিয়ে এক গভীর প্রাপ্তির আনন্দ নিয়ে ব্যাগ গোছাতে বসলাম, বাবার হাসিমুখ দেখার লোভে সাধ্যের চেয়ে বেশি ওজনের আপেল বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কী আর নিয়ে যেতে পারব প্রিয়জনদের জন্য। হৃদয়ভরা স্মৃতি, ক্যামেরা ভরা কিছু সুন্দর মুহূর্ত আর এই সুগন্ধী সুমিষ্ট আপেল। কিন্তু মন চায় এইসব পাহাড়-পর্বত-প্রান্তর-উপত্যকা, এই নদী-অরণ্য-শ্যামলিমা, অফুরান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এসব কিছু বয়ে নিয়ে যেতে, যাতে আমাদের দেখা এই স্বর্গভূমিকে আমাদের চোখ দিয়ে দেখতে পারে, আমাদের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোন-বন্ধুরা। কী করে তা সম্ভব বল, এইখানে যে আমাদের সীমাবদ্ধতা। তার চেয়ে চল ইচ্ছে বানাই, তাদের বাধ্য করি এখানে আসার জন্য। তারাও দেখুক, বুঝুক প্রকৃত সত্য কোথায়, প্রকৃত ঈশ্বর কোথায় বাস করেন, চাক্ষুষ করুক, জীবন ধন্য করুক, এই উদার প্রান্তরে খুঁজে পাক আপন অন্তরের অন্তস্তলে নিহিত সেই পরম আপন জনকে, অনুভবে ধরা দিক সে অন্তরতম। তাই এই প্রয়াস, প্রথমবার মনের আনন্দে লেখার মধ্যে বলতে চাওয়া, দৈনন্দিনতার বেড়ি ভেঙে একবার চল মন নিজ নিকেতনে।
ছবি সৌজন্যে : Avijit Goldar
Leave a Comment