কাশ্মীর – একটি স্বপ্নপূরণ (গুলমার্গ পর্ব)

খুব ভোরে উঠে তৈরি হতে হতে ভাবছি, এই ঠান্ডায় ইমতিয়াজ ভাই এত তাড়াতাড়ি হয়তো আসতে পারবে না, কিন্তু বেরিয়ে দেখি অনেক আগে থেকেই উনি আমাদের জন্য শিকারা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। একটু লজ্জিত হয়ে উঠে বসলাম। বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। দেখলাম কাকভোরেই ঘুম ভেঙে গেছে ডাল লেকের, শুরু হয়ে গেছে জীবনযাত্রা। শিকারা বোঝাই ফুলের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বিক্রেতারা ফুল ও ফুলের বীজ বিক্রির উদ্দেশ্যে। দূরে একটু করে আকাশ রঙ বদলাচ্ছে। দুটি পাহাড়ের ঢাল থেকে একটু করে উঁকি দিচ্ছেন সুয্যিমামা। সামনে রঙিন পোশাকে সারা শরীর আচ্ছাদন করে, কেবল মুখচন্দ্রিমাটুকু উদ্ভাসিত করে শিকারা বয়ে কাজে চলেছেন সুন্দরী কাশ্মীরি তরুণীরা, জলে তাদের রঙবেরঙের প্রতিফলন যেন জলরঙে আঁকা এক চিত্রপট। দুচোখ ভরে নিঃশব্দে উপভোগ করছি এই দৃশ্যশোভা।

লিলি গার্ডেনের দিকে। ভোরের ডাল লেক।

ছলাৎ ছল জলের শব্দ, দূরে বিস্তৃত পর্বতশ্রেণি, ডাল লেকের বুকে দীর্ঘ সময় ধরে ভেসে চলা, অবিস্মরণীয় এক সূর্যোদয় কানায় কানায় ভরিয়ে দিচ্ছে মন, গুনগুন করছি, কখনও ভাবছি ‘চুপকে সে শুন… ইস পল কি ধুন…. ইস পল মে জীবন সারা…. স্বপ্নোকি হ্যায় দুনিয়া ইয়েহি……’ সত্যি নৈঃশব্দের শব্দ বোধহয় একেই বলে, আমি তো কবি নই, কিন্তু হঠাৎ মনে হল এমন মুহূর্তেই বোধহয় সৃষ্টি হয় কত কবির, কত কবিতার। স্বপ্নের দুনিয়ার আস্বাদন পেতে পেতে একসময় পৌঁছে গেলাম সেই বিস্তৃত ওয়াটার লিলি গার্ডেনে। কিন্তু নানা রঙের ফুলগুলো সব ঘুমন্ত। বারবার মনে হচ্ছিল আহা এদের প্রস্ফুটিত রূপে দেখতে নাজানি কত সুন্দর লাগত, কিন্তু সব সুযোগ তো একবারে আসে না। আবার কবে আসব, এই সময় না এলে তো এরা থাকবেও না। পদ্মবনে পৌঁছে মনখারাপটা অনেক দূর হল। আমাদের ওখানকার মতো না, কী স্পর্ধিত সৌন্দর্য ডাল লেকের পদ্মের, অপূর্ব শোভা ছড়িয়ে কেউ পাপড়ি মেলেছে, কেউ বা মেলার অপেক্ষায়, যুগপৎ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম। দেখলাম ভাসমান সব্‌জি বাগান। উঠে দাঁড়ালেও ডুবে গেলাম না। খুব মজা লাগল। পুদিনা পাতার সুগন্ধে ছেয়ে আছে চারিদিক। অরুণাচলে এমনি ভিকস্‌ গাছের পাতা হাতে নিয়ে গন্ধে আবিষ্ট হয়েছিলাম। ভাবলাম এই রহস্যময়ী প্রকৃতি নানা জায়গায় নানা বিস্ময়ের ডালি আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে। প্রতীক্ষা শুধু আমাদের কাছে যাওয়ার আর বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হওয়ার। তাই আবার কখনও সূর্যের আলোয় পূর্ণ রূপে প্রস্ফুটিত লিলি দেখে বিস্ময়াভিভূত হওয়ার বাসনা হৃদয়ে নিয়ে ফিরে এলাম, পথে ভাসমান বাজার থেকে কিনে খাওয়া হল, কাশ্মীরি রুটি আর কেহওয়া, সুন্দর তার স্বাদ। যদিও স্থানীয় নুন-চা টা আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি।

গুলমার্গের পথের সৌন্দর্য এরকমই।

গুলমার্গ যাওয়ার রাস্তায় আবার পেলাম আপেল বাগানের সারি। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম। ‘গুলমার্গ’ অর্থাৎ ফুলে খচিত পথ কেন নাম হয়েছে তা বুঝতে পারলাম গুলমার্গ পৌঁছানোর কয়েক কিলোমিটার আগে থেকে অসংখ্য নাম না জানা বুনো পাহাড়ি ফুলের সমাবেশ দেখে। বিচিত্র তাদের শোভা চোখ জুড়িয়ে দেয়। যদিও গুলমার্গের ঘোড়াওয়ালা ও সহিসদের ব্যবহার আশানুরূপ না হওয়ায় মন ব্যথিত হয়েছিল, কিন্তু মঞ্জুরের কথা স্মরণ করে তা ভুলে যেতে চাইলাম। আসলে ট্যুরিস্ট একেবারে কম থাকায় পকেট ভরানোর সুযোগ তারা একবিন্দু ছাড়ছিল না। আমাদের সম্মিলিতভাবে জানানো হল যে গন্ডোলায় চাপার জন্য কোনো হাটাঁ পথ নেই, একমাত্র ঘোড়াই ভরসা। আর ঘোড়ার জন্য চার্জও অনেকখানি। কিছু একটু দরদস্তুর করার ওদের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। ঘোড়ায় আমি বেশ ভয় পাই শুনে অন্য একটি লোককে আবার তিনশো টাকার বিনিময়ে জোর করে সঙ্গে গছিয়ে দেওয়া হল আমার খেয়াল রাখার অজুহাতে। এর জন্যও টাকা ! কই কাল তো লাগেনি। আবার বুঝলাম সবাই মঞ্জুর নয়। তাই হয়তো তাকে সারাদিনে, পরের দিনগুলিতে ঘোড়ায় চেপে এতবার মনে পড়ল।

গল্ফকোর্স, গুলমার্গ।

প্রথমে গেলাম একটি চিল্‌ড্রেনস্‌ পার্কে। একটি বিষয় সবজায়গায় মন জুড়িয়ে দিচ্ছে, তা হল ঘন সবুজ উপত্যকা। পার্কের সবুজের গালিচায় বিষন্ন মনকে একটু গড়িয়ে দিলাম। গলফ্‌ কোর্স, রাজা হরি সিং-এর পরিত্যক্ত বাংলো, ট্রাউট প্রজনন কেন্দ্র, ‘মিশন কাশ্মীর’-এর বুমরো গানের ও অন্যান্য অনেক সিনেমার শ্যুটিং স্পট, সবকিছু দেখতে দেখতে পৌছালাম গুলমার্গের গন্ডোলার কাছে। দুটি ফেজে গণ্ডোলা রাইডিং হয়, বরফের সময় নাকি দ্বিতীয় ফেজে না গেলে অনেকখানি অদেখা থেকে যায়, এখন বরফ তেমন না থাকার কারণে, আর প্রথমেই এসে অনেকখানি অবাঞ্ছিত খরচের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না পেরে প্রথম ফেজে গণ্ডোলা চাপার যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। দুজনের দেড় হাজার মতো লাগলো। রোপওয়ে আগেও চেপেছি। কিন্তু প্রতিবার বরফ দেখার জন্য ছিল সেই উড়ান। কিন্তু এই সবুজ মনোরম উপত্যকা, যাযাবর শ্রেণির মানুষগুলির অস্থায়ী মাটির ঝুপড়ি, বিরাট বিরাট বনস্পতির কোনো এক ঝড়ে উপড়ে পড়ে থাকা – এইসব দেখতে দেখতে উপরে কংডুরিতে পৌঁছে গেলাম, আমাদের জানানো হল এক ঘন্টা মতো সময় আমরা এখানে কাটাতে পারব। আরও উপরে কেউ কেউ উঠে যাচ্ছে দেখে মনে একটু কষ্ট হচ্ছিল, ভাবছিলাম ওখানটা হয়তো আরও সুন্দর।

গুলমার্গ

তবে কংডুরিও কতখানি অপার্থিব সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা তা দুচোখ ভরে দেখে পূর্ণ উপলব্ধি করলাম। ওখানে আর একবার ঘোড়া নেওয়ার জন্য ঝোলাঝুলি হল, না নেওয়ায় একটু বাঁকা কথাও হজম করতে হল। বিশেষ পাত্তা না দিয়ে দুজনে নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত করে নেমে এলাম। নেমে এসে আবার একবার ধাক্কা, দেখলাম দিব্যি সুন্দর পায়ে হাঁটা রাস্তা রয়েছে, যেখান দিয়ে অনেক মানুষ হেঁটে আসছে রোপওয়ে চাপতে, বুঝলাম কেমন ঠকেছি। সমতলের মানুষ বলে কিনা জানিনা, পাহাড় মানে আমাদের কাছে কেবল পৃথক এক ভূপ্রকৃতি নয়, উন্মুক্ত প্রকৃতির মতো উদার সরলহৃদয় মানুষজনের পরিচয় বিভিন্ন পাহাড়ে এতবার পেয়েছি, যে মনে তাদের সততা সম্পর্কে এক অভ্রান্ত ধারণা গেঁথে বসে গিয়েছিল। তাই টাকার ক্ষতির চেয়েও মনে বেশি আঘাত দিল আমার স্বপ্নের পর্বত নগরীর মানুষের অসততা, তা যেন আমার ব্যক্তিগত স্বপ্নেরই পরাজয়। ওয়াজোয়ান খাওয়ার অভিজ্ঞতাও খুব সুখকর হল না।

কংডুরি। গুলমার্গের বিখ্যাত গন্ডোলার প্রথম ধাপ।

সবুজ উপত্যকা দেখে, বরফের সময় গুলমার্গের দুধসাদা রূপ কল্পনা করে, আজকে পাওয়া ভালোলাগাগুলোকে এই ভেবে ঝালিয়ে নিলাম, যে কাশ্মীরে মঞ্জুর আর ইমতিয়াজের মতো মানুষ থাকে, সেই কাশ্মীরের যে কোনো মানুষের কাছে ন্যূনতম আঘাত গায়ে নেওয়া মানে ওদের ছোটো করা। তাই ‘গুলমার্গ’ অর্থাৎ ফুলে ভরা পথের সুন্দর স্মৃতিগুলো সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আবার সুদীর্ঘ আপেল বাগান, সেই বাগানে কত প্রজাতির আপেল, সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম, গাছের নীচে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে প্রচুর আপেল, একজন কর্মচারী তা বেছে বেছে কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর স্তুপের মতো জমা করছে একজায়গায়। সেই আপেল খাওয়ার লোভ কী সামলানো যায় ! খেলাম আর বাড়ির জন্য কিনে নিলাম। তারপর পরিতৃপ্ত মন নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। চাচাজি বললেন যে কাল পহেলগাঁও-এর রাস্তায় আরও আপেল দেখা যাবে।

কংডুরি, গুলমার্গ।

উৎফুল্ল মনে হাউসবোটে ফিরলাম আর ডিনার অর্ডার করলাম। পাঁচরাত হাউসবোটে থাকার পরিকল্পনা না থাকলেও অফ সিজিনে রেট কম হওয়ায় পছন্দের হাউসবোটে আমাদের রাত্রিবাসের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া হল। খুব আনন্দিত হয়ে ভাত রুটি চিকেন দিয়ে রাজকীয় ডিনার টেবিলে বসে রাজকীয় এক নৈশাহার সমাপণ করলাম। এবার প্রতীক্ষা পহেলগাঁও দেখার। যার নামখানি এত সুন্দর, সে নিজে কতখানি সুন্দর, তা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু অন্যান্য রাতের মতো নিশ্ছিদ্র ঘুম এই রাতে হলনা। কারণ সাররাত ঝোড়ো হাওয়া আর বাতাসে হাউসবোটখানি দুলতে লাগল, আর অভি ঘুম জড়ানো গলায় বারদুয়েক ভূমিকম্প হচ্ছে বলে আমার ভয় বাড়িয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে গেল। আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল এই ভেবে যে, আমাদের বেড়ানোর সময় তো সীমিত, আর দুর্যোগের আবহাওয়ায় যদি পেহেলগাম না যেতে পারি, বৈশরণে না ওঠা যায় তো কী হবে ! দুশ্চিন্তার মধ্যে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।

ট্যাংমার্গের আপেল বাগান। গুলমার্গ থেকে ফেরার সময়।

<< আগের পর্বঃ কাশ্মীর – একটি স্বপ্নপূরণ (সোনমার্গ পর্ব)

পরের পর্বঃ কাশ্মীর – একটি স্বপ্নপূরণ (পেহেলগাম পর্ব) >>

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ gulmargindiaKashmir