প্যারা নাই চিল টিমের যোগী হাফং জয়

গল্প শুরুর আগে টিমের সদস্যদের আমার মত করে ছোট্ট একটা পরিচিতি না দিলেই নয়। বাকিটুকু গল্পে জানা যাবে।

টিম লিডার: সদা হাস্যজ্জ্বল গালে কিউট একটা টোলের অধিকারী আমাদের ডাক্তার “নিপুণ আপু”।

সহযোগী টিম লিডার: চুপচাপ ঠান্ডা, আসিফের ভাষ্যমতে অসাধারণ একজন মানুষ, নিপুণ আপুর স্যার খ্যাত আপুরই জীবনসঙ্গী “রাসেল ভাইয়া”।

ফাউন্ডার: বন্ধুদের জন্য নিবেদিত প্রান। ভীষন ভালো এবং ট্যুর আয়োজনে পটু একজন মানুষ “আসিফ”।

নাম প্রনেতা: সুন্দর, ভদ্র, শান্তশিষ্ট “সুমি আপু”।

সব দোষ যার: কোনো দোষ না করেও বরং ট্যুরের সব কিছুতে সুন্দর ভাবে নিজের অবদান রাখার পরেও আমি যাকে কোনো কারণ ছাড়াই দোষারোপ করি “সাদিক”।

ভালো ছেলেটা: ট্রেকিংয়ের সময় সবাইকে চলতে ফিরতে, সামনে আগাতে খুব ভালোভাবে সাহায্য করা, সুন্দর ছবি তুলে দেওয়া ” ইফতি”।

গ্রুপের প্রাণ: নিপুণ আপুর দেওয়া এই নাম পাওয়া মানুষটা ফাস্ট ট্রেকার খেতাবপ্রাপ্ত “নাদিয়া”।

অকর্মার ঢেকি: ওপরের নাম টা নিপুণ আপু দুইজনকে উদ্দেশ্য করে বললেও নাদিয়া বাদে বাকি একজনের কোনো গুন দূর দূড়ান্ত পর্যন্ত খুজতে গিয়েও না পেয়ে বরং পেলাম সবাইকে প্যারা দেওয়া তাই এই নামটাই তার সাথে যায় আর এই সে মানুষ টা হলাম আমি “বিধূন”।

যেভাবে পরিকল্পনা হলো,

আরিফ, আমার বন্ধু আসিফের ছোটোবেলার বন্ধু। বান্দরবানের ট্রিপ থেকে এসে আমি নাদিয়া আর আরিফ মিলে পঞ্চগড় যাই “কাঞ্চনজঙ্ঘা” দেখতে। কিন্তু কুয়াশার জন্য দেখতে পাই নি। তবে একদিনের সেই ট্রিপে আমরা খুব মজা করে ঢাকায় ফিরি। এরপরে আরিফের সাথেও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এবং আরিফ আমাদের “আরিফ মামা” হয়ে ওঠে। সুন্দর ও নির্ভেজাল মনের মানুষ আরিফ। ওর সাথেই প্রথম যাই ওদের বন্ধুদের আড্ডায়। আমার বাসার ঠিক কাছেই ওরা আড্ডা দেয়। এরপরে আমি বাসা পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় নিলে, স্টুডেন্ট এর বাসা থেকে আমার বাসায় আসার পথেই পরে ওদের আড্ডা। সেই সুবাদে প্রায়ই আড্ডা দেওয়া হয় বা দেখা হয় ওদের সাথে। সেখানেই একদিন শুনলাম ওরা কক্সবাজারে বাইক ট্যুরের প্লান করতেছে। আমি আর নাদিয়া আবার আরিফ মামার সাথে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার প্লান করতেছিলাম। যতই দিন যেতে লাগলো ততই আমাদের প্লান পেছাতে লাগলো। এবং ব্যাপার টা দাড়ালো এমন যে, গেলে আমাদের তিনজনের যেতে হবে। টিম নাই, তাই আমাদেরও আর মন টানলো না। ঐদিকে আসিফের থেকে শুনলাম ওদের বাইক ট্যুরও নাকি না হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আসিফকে বললাম যদি বাইক ট্যুর না হয় অন্য কোনো প্লান হলে যেনো আমাকে জানায়। তারপরে একদিন আসিফ ফোন দিয়ে বলল কোনো প্লান করলে আমরা যাবো কিনা। আগেরবারের মত এবারও জিজ্ঞেস করেই দেখি নাদিয়া রাজি। সুতরাং আসিফকে জানিয়ে দিলাম আমরা যাবো।

কোথায় যাবো সেটাও নিশ্চিত না তবে জাগয়াটা অবশ্যই বান্দরবানের কোথাও হবে। আমাদের গতবারের গ্রুপে জানানো হলে খুব একটা রেসপন্স পাওয়া গেলো না৷ আসিফের ফ্রেন্ডরাও কেউ যাবে না। অর্থাৎ আমাকে আর নাদিয়াকে নিয়েই আসিফের প্লান করতে হবে। ওর অন্য একজন ফ্রেন্ডও নাকি যাবে তাহলে আমরা চারজন হলাম মেম্বার। এরপরে শুরু হলো জায়গা নির্ধারন করা। এবং একের পর এক প্লেস নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ আসিফ বলল “যোগী (Jogihafong) জোত্লং যাবা?”

রিজ ধরে যোগীর চুড়ায় ধাবমান
ফটোগ্রাফারঃ তোফায়েল আহমেদ আসিফ

আসিফ তখনও ঠিক আমার ফ্রেন্ড ছিলো না যখন ও প্রথম যোগী জোত্লং (Zowtlang) যায়। আমার ফ্রেন্ড তাহেরা ছিলো ওর ফ্রেন্ড। তাহেরার কাছেই আমি আসিফ এর কথা শুনে বুঝি ও পাহাড় প্রেমী।ওদের ট্রিপের ভিডিও ও ছবি তাহেরার মাধ্যমে প্রথম দেখে আমার কাছে এগুলো নিছকই পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় নি। এবং এসবের কোনো মানে হয় না এমন একটা অনুভুতি ছিলো। তখন আমার ভাবনার জগত খুব ছোটোই ছিলো বলা যায়। এরপরে এই অনেকটা সময়ে বদলে যায় অনেক কিছুই। জীবন পেতে শুরু করে ভিন্ন স্বাদের আনন্দ অনুভুতি। জাদিপাই থেকে ঘুরে এসে নাদিয়া আর আমি সিদ্ধান্ত নেই একটা সময় যোগী জোত্লং ও যাবো। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি আর এভাবে আসবে এটা ভাবিনি। যেহেতু আসিফ একবার গেছে সেহেতু আমরা ভাবলাম হয়তো ও আমাদের জন্যই ওই রুটের প্লানটা করতেছে। নাদিয়া বলল, “আসিফ যেনো আমাদের জন্য প্লান না করে। ওর নিজের মত করে প্লান করুক আমরা যেটা হোক সেটাতেই যাবো। কারণ আমাদের তো সবই অদেখা।” আসিফকে এটা বলার পর বলল ও শুধু আমাদের জন্য প্লান করে নাই। যোগীর ভিউ নাকি খুব সুন্দর সেটার জন্য ও আবারও যেতে রাজি আছে। তবে জোত্লং নাও যেতে পারে। টিম কে গাইড দিয়ে পাঠিয়ে দিবে সামিট এর জন্য। তবে সিদ্ধান্তটা ওখানে গিয়ে হবে।

এরপরে ব্যাপার টা ছিলো টিম মেম্বার কম৷ কম মানুষ নিয়ে ওই রুটে গেলে খরচ অনেক বেশি পরে যাবে। আরিফ মামাকে বলা হলো কিন্তু ও যোগী জোত্লং দুই তিনবারের বেশি গেছে। এমনকি একদিনে যোগী জোত্লং দুইটাই সামিটও করেছে। এরপরে আবার টাকা খরচ করে যাওয়ার মানে হয় না। তো ও যাচ্ছে না। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎই নিপুণ আপু ও রাসেল ভাইয়া বললো তারা যাবে। এটা শুনেই তো আমি আর নাদিয়া খুশিতে ডগমগ। আমরা আবার নিপুণ আপুর ভক্ত কিনা সেজন্য। ঠিক হলো আমরা ছয়জন যাবো। থানচি থেকে আসিফের এক পরিচিত পাহাড়ি ছেলে গাইড ছাড়াই আমাদের ওর বোটে করে রেমাক্রি পৌছে দিবে এবং সেখান থেকে দলিয়ান পাড়া নিয়ে যাবে। তাতে করে আমাদের খরচ কম পরবে। এক বোটে পাঁচ জন উঠালেও আমরা ছয় জনেই যেতে পারবো বলে ঠিক হলো। এরপরে প্রায় প্রতিদিন আমি আর নিপুণ আপু মিলে সাদিক কে যাওয়ার জন্য বলতে লাগলাম। এটা ওটা নানা কথা বললে সাদিক কনভিন্স হলো শেষ মুহূর্তে।  সাথে ওর এক ফ্রেন্ডও নাকি যাবে। এবারে সমস্যা হলো বোট নিয়ে। পাঁচ জনের জায়গায় ছয় জন যাবো এক বোটে উপরন্তু এখন দুইজন বেড়েছে। কিন্তু বোটের ব্যবস্থা নাই। নিপুণ আপু আশ্বাস দিলো সে চেস্টা করবে। নিপুণ আপু অনেক ঘুরে, আর একজন অমায়িক মানুষ হওয়ার সুবাদে তার অনেকের সাথে, অনেক ট্যুর গ্রুপের সাথে ভালো সম্পর্ক। সুতরাং আমাদের অন্ধের যষ্টি তখন নিপুন আপু। বান্দরবান থেকে থানচি বাসে যাওয়ার প্লান থাকলেও শেষ মুহূর্তে আপু জীপও ম্যানেজ করে ফেলেছিলো আরেকটা টিমের সাথে মিলে।

আট জনের টিম যাবে জোগী জোত্লং। দুইটাই সামিট করতেই হবে এমন না। আমারা একটা সামিট করবো আরেকটা সেখানে গিয়ে সবাই সামিটের সিদ্ধান্ত নিলে সামিট করবো নাহলে সবাই মিলে চিল করে চলে আসবো। এবং আমরা প্রথমে জোত্লং সামিট করবো। এভাবে প্লান নিয়ে মার্চ ১৬, ২০২০ তারিখে আমি, নাদিয়া,আসিফ ও সুমি আপু সায়দাবাদ থেকে বাসে চেপে বসলাম বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।

যেতে হবে দলিয়ান পাড়া,

মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তির স্রোতে ভাসতে ভাসতে সকালে ঘুম ভাঙলো চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে বান্দরবানের রাস্তায়।বাসের জানালা দিয়ে একটি সুন্দর সকাল দেখলাম। যেতে যেতে হঠাৎই বাস থেমে গেলো। সামনেই একটি বাসের চাকা বালির মধ্যে আটকে গেছে। রাস্তায় তখন কাজ চলতেছিলো। আর বাসটা এমনভাবে ছিলো যে পাশ দিয়ে অন্য বাস যাতায়াত করতে পারবেনা৷ সময় চলে যাচ্ছে আমাদের। নিপুণ আপু, রাসেল ভাইয়া, সাদিক ও সাদিকের এক বন্ধু আগের দিন রাতেই বান্দরবান চলে গেছে। ফোনে ওদেরকে প্রায় চলে আসছি বলার পরপরই আমরা এই অনাকাঙ্ক্ষিত জ্যামে আটকা পরে যাই। তখন আবার যার বোটে করে থানচি থেকে আমাদের রেমাক্রি যাওয়ার কথা তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে আমাদের বান্দরবান পৌছাতে দেরি হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে বোটম্যান নিরুদ্দেশ এই দুটো মিলিয়ে আসিফকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। পাশকাটিয়ে একটা জীপ চলে যাচ্ছে দেখে আসিফ সিদ্ধান্ত নিলো বাস থেকে নেমে সেই জীপে করে চলে যাওয়ার। রাস্তা নাকি বেশি না। আমরা নেমে সেই জীপে উঠে চললাম। প্রচন্ড বাতাসে শীতে কাপতে শুরু করি আমরা। মাঝে আরো দুই তিনজন যাত্রীও তুলে নিলো জীপ ড্রাইভার। হঠাৎই খেয়াল করলাম জীপের গতি ধীর হচ্ছে। এবং এতটা ধীরগতিতে চালানো দেখে তার কারণ বার বার জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিলো না। তারপরে একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামিয়ে কার সাথে যেনো কথা বলে ইউ টার্ন নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললো। স্থানীয় ভাষায় কথা বলার দরুন আমরা কিছুই বুঝলাম না। আমাদের সাথে অন্য যাত্রী যারা ছিলো তারা আবার সেখানকার। তাকে বললাম কথা বলতে। সে কথা বলে জানালো ড্রাইভার এর বাবাকে আনতে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার পিছনে যাচ্ছে। আমাদের তখন কপাল চাপরানো অবস্থা। সময় বাঁচানোর জন্য গৃহীত বিকল্প উল্টো পরে গেলো আমাদের। পিছনে যেতে যেতে দেখি আমাদের সেই ঢাকা থেকে নিয়ে আসা বাসটাই জ্যাম পেরিয়ে চলে এসেছে। জীপ থেকে নেমে আমাদের বাস থামিয়ে আবার সেই বাসেই চেপে বান্দরবান পৌছালাম। গিয়ে তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সেরে নিলাম।

থানচি গামী জীপের সামনে গিয়ে সাদিক কে একটা চকলেট দিলাম। শেষ মুহূর্তে যেতে রাজি হয়ে মন খুশি করে দিয়েছিলো ছেলেটা সেজন্য চকলেট টা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রথম দেখলাম ইফতি কে। লম্বা, লালচে চুল আর ফর্সা করে একটা ছেলে। কিছুটা বিদেশি বিদেশি মনে হয়। সাদিকের ফ্রেন্ড, সাদিক বলে ওকে দেখতে নাকি টার্কিশদের মত। দেখে চুপচাপ স্বভাবের মনে হলো।আমারা সবাই এবং সাথে আরেকটা আমিয়াখুম, নাফাখুম গামি ট্রিপের কয়েকজন মিলে একটা জীপে বসে পরলাম থানচির উদ্দেশ্য। এর আগেরবার এই পথ পাড়ি দিয়েছিলাম মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। এবারে রৌদ্রজ্বল দিন। এক ভিন্ন রুপ ও ভিন্ন স্বাদ নিয়ে চলতে লাগলাম।  কেউ কেউ টুকটাক গান ধরলো। সাদিক একটু অসুস্থ ছিলো, প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে জীপের সামনে গিয়ে বসলো। আসলে বান্দরবান থেকে থানচি যেতে যেতে ট্রিপের স্বাদ পাওয়া শুরু হয়ে যায়। আর এই রাস্তাটুকুন মনে হয় শতবার গেলেও পুরোনা হবে না।

দুপুর নাগাদ আমরা থানচি পৌছালাম। পর্যটকের ভীর সেখানে। ১৭ই মার্চের ছুটি সামনে রেখে ট্রিপ দিচ্ছে সবাই। আমাদের বোটম্যানের কোনো খবর নাই। আমাদের কোনো গাইড বা বোট ঠিক করাও নাই। উপরন্তু পর্যটক অনুপাতে বোট সংখ্যা কম। নিপুণ আপু, আসিফ, সাদিক যার যার মত করে পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করে বোট সংকটের তথ্যই পেলো। যেহেতু আমাদের আগে থেকে ঠিক করা পরিচিত বোটম্যানকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না এবং থানচি গিয়েও কাউকে জিজ্ঞেস করে তার খবর পাওয়া যায় নাই সুতরাং আমাদের অন্য বোট নিতে হবে এবং সাথে গাইড। কিন্তু হঠাৎ করে বোট সংকটের মহুর্তে বোট পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পরলো। আমরা দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর পর সাদিক ও আসিফ শলা পরামর্শ করে নেয়। আমি আর নাদিয়া এটা নিয়ে মজা নিচ্ছিলাম যে কিছুই হচ্ছে না শুধু পরামর্শই হচ্ছে। গাইড ঠিক হলো কিন্তু পাওয়া গেলো না বোট। অপেক্ষারত অবস্থায় আমরা স্থান পরিবর্তন করে খাবার হোটেল গুলোর সামনে থেকে থানচি বাজার ক্রস করে ঘাটপারে গেলাম। সেখানে গিয়েও আমরা এখানে সেখানে বসে থাকি। মেজাজ সবারই প্রায় খিটখিটে অবস্থা। এমতাবস্থায় নিপুণ আপু আমাদের ড্রিংকো কিনে এনে বললো “এগুলা ক্যামিকেল দিয়ে বানানো খাওয়া ঠিক না তবুও এই গরমে খেলে ভালো লাগবে, খাও”। সেই প্রথম আমাদের ড্রিংকো খাওয়া এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে পছন্দের তালিকায় চলে আসে। এক এক গ্রুপের বোট নিয়ে থানচি থেকে বিদায় নেওয়া দেখতে থাকি আমরা। অপেক্ষার পালা শেষ করে বোট পেয়ে সেটাতে চড়ে বসতে বসতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

প্রায় সাড়ে চারটার দিকে আমাদের বোট ছুটতে শুরু করে রেমাক্রির দিকে।কম পানির স্রোতবহা সাঙ্গু নদীতে এগিয়ে চললাম আমরা। এটাই  আমার প্রথম পাহাড়ি নদী দেখা। দুপাশে পাহাড়, দুপারে পাথর, এঁকেবেঁকে চলা নদী, কোথাও  পানি বেশি, কোথাও বা এত কম যে নৌকা যেতে পারে না তখন নেমে পাড় ধরে হেটে যাই আমরা আর মাঝি ঠেলেঠুলে কোনোভাবে নিয়ে আসে নৌকা। পথটা ছিলো এক বর্ননাতীত সৌন্দর্যের ভান্ডার। একে একে আমরা তিন্দু, বড় পাথর পার হতে হতে সন্ধ্যা নেমে এলো। এবং রাতের নৌকাপথটাও মনকে কোনো অংশে কম আন্দোলিত করে নি। সেদিন রাতের আকাশে অনেক তারা ছিলো। একটি তারাপূর্ণ আকাশ দেখতে দেখতে সাতটার দিকে আমরা রেমাক্রি গিয়ে নামলাম। সেখানে যে যে যার যার হেড ল্যাম্প বের করে পরে নিলাম। আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে, গন্তব্য দলিয়ান পাড়া।

এই পথ, দূরের পাহাড়, প্রকৃতি সব যেনো আমার হয়, একান্তই আমার
ফটোগ্রাফারঃ তোফায়েল আহমেদ আসিফ

আসিফ আমাকে বললো সামনে বেশ খাড়া একটা পাহাড় উঠতে হবে তারপরে সেটা নামা বাকি রাস্তাটুকু খুব একটা কঠিন না। আমাদের পথচলা শুরু হলো। ঢাকাতেই দলিয়ান পাড়ার হেডম্যান এর ছেলের বৌয়ের হাতের মুরগির মাংস রান্নার প্রশংসা শুনেছিলাম আসিফের মুখে। এবং এখানেও আবার বললো। সুস্বাদু খাবার খাবো এটা ভেবেই মনটা ভালো লাগলো। কিছুদূর আগানোর পরই একটা পাড়া পেলাম যেখানে ওদের উপাসনালয়ের সামনে ভীষণ সুন্দর বাগান বিলাশ ফুল। ভালো ছবি না আসলেও ছবি তুললাম আমরা। তারপরে আবার হাটা। এবং যেতে যেতে আসিফের বলা সেই খাড়া পাহাড় টা উঠতে লাগলাম উঠতে উঠতে আমার মাথা ব্যথা করে মাথা ঘোরাতে লাগলো। এত খারাপ কেন লাগতেছে বুঝতে পারলাম না। এরপরে মনে হলো মাথার লাইট এর রাবারটা বোধহয় বেশি টাইট হয়ে গেছে। খুলে ঠিক করে নিয়ে হাটা শুরু করতে অনেকটা ভালো অনুভুত হলো। সুন্দর একটি তারাভরা আকাশের নিচে দিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় হেটে যাচ্ছি আমরা গল্প করতে করতে। ঢাকা থেকে করে যাওয়া একটা ছবি তোলার প্লানটা যাত্রাপথে আবারও আওরালাম। প্লানটা এরকম যে পাহাড়ের চুড়ায় গিয়ে নিপুণ আপুকে সামনে রেখে আমরা পিছনে দাড়িয়ে একটা ছবি তুলবো। আমাদের টিম লিডার হলো নিপুণ আপু। আমার এই ইচ্ছাটার কথা শুনে আপু হেসে ফেললো আর বললো “দেখা যাবে তোমরা সাবাই সামিটে গেছো আর নিপুণ আপু দলিয়ান পাড়ায় চিল করছে।” এটা শুনে সবাই ই বললো যে না ইনশাল্লাহ নিপুণ আপুও সামিট করবে যদি টিম সামিট করে তো। এভাবে চলতে চলতে আমরা দলিয়ান পাড়া যখন পৌছালাম তখন খানিকটা রাত এবং সবাই বেশ ক্লান্ত। সময়টা প্রায় সাড়ে নয়টা, আমরা গিয়ে সেই হেডম্যানের বাসাটাই খালি পেলাম এবং সেখানেই উঠলাম। ঠিক হলো পরেরদিন আমারা যোগী হাফং যাবো। এবং তারপরেরদিন জোত্লং যাবো কিনা সেটা পরে সিদ্ধান্ত নিবো। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলে খাবারের স্বাদ আশানুরূপ হলো না দেখে আসিফের দিকে কিছুটা কটমট করে তাকালাম। কারণ ও তো যাওয়ার আগে খুব প্রশংসা করেছিলো। তখন ও বললো ও নিজেও হতাশ।  খাওয়াদাওয়া শেষে সেই দিদিই এসে বললো যে সে তো জানতো না আমরা যাবো ঘরে তেমন কিছু ছিলো না আর আমরাও গিয়েছি দেরি করে তাই সে কোনো রকমে রান্না করেছে। ঢাকা থেকে প্রথমে জোত্লং সামিটের প্লান করে গেলেও পাড়ায় বসে প্লান ঘুরে সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো যে পরদিন  যোগী হাফং যাওয়া হবে এবং খুব ভোরে বের হতে হবে। পাহাড়ে তখন বেশ শীত। শীতে প্রায় সকলেই কাপতেছিলো। কাথামুড়ি দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম সবাই।

গন্তব্য যোগী হাফং,

১৮ মার্চ, প্রকৃতিতে আলো ফোটার আগেই কারো কারো ঘুম ভাঙলেও ঠিক বিছানা থেকে কেউ উঠলো না উষ্ণতা ছেড়ে। কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়ার রোমাঞ্চ তে কেউ বেশিক্ষণ সেই উষ্ণতাকে প্রশ্রয় দিতেও পারলো না। উঠে সামিটের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হতে হতে আমাদের পুর্ব নির্ধারিত সময় গড়িয়ে কিছুটা দেরি হয়ে গেলো। প্রায় সাড়ে ছয়টার দিকে আমরা পাড়া ছেড়ে বের হলাম। পাড়া থেকে গাইড নেওয়া হলো, নাম আপং বম। গল্প করতে করতে পথ চলতে লাগলাম আমরা। ধীরে ধীরে উষ্ণ হতে শুরু করলো প্রকৃতি। আমাদের মধ্যে আসিফ একমাত্র ব্যক্তি যে আগেও একবার যোগী হাফং ও জোত্লং গিয়েছে। রাসেল ভাইয়া জোত্লং গিয়েছে। শুনলাম সামনে এক থেকে দেড় ঘন্টার পথ গেলে পাবো ওয়াই জংশন। সেখান থেকে রাস্তা ভাগ হয়ে একটা জোত্লং এবং একটা যোগী গিয়েছে। আমরা একটু একটু করে চলতে চলতে ওয়াই জংশন গিয়ে পৌছালাম। হালকা  নাস্তাও করে নিলাম বিশ্রাম নিতে নিতে। এখন আমাদের শুরু হবে ঝিরিপথ ধরে হাটা।

সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত যে রাস্তা কঠিন৷ ট্রিপে আসার আগে সবাই ই এই পথের ট্রেকিং ভিডিও দেখেছে। প্রায় তিন ঘন্টার মত লাগবে আমাদের ঝিরিপথ শেষ করতে এটা অনুমান করা হলো। আমরা ঝিরি ধরে এগিয়ে চললাম। সাদিক তো পাহাড়িদের মত পাহাড়ি রাস্তায় দ্রুত হাটে বরাবরই। নাদিয়াও ওর নিজের মত করে ট্রেক করতেছে। আসিফ আমাকে সাথে নিয়ে হাটে। ওর সাপোর্টেই চলি আমি পাহাড়ে গিয়ে। সুমি আপু, নিপুন আপু, রাসেল ভাইয়া আপং দাদা একসাথে ট্রেক করতেছে। সাদিকের ফ্রেন্ড ইফতিও অনেক ভালো ট্রেক করতেছিলো। ওর নাকি প্রথম ট্রেকিং ট্যুর কিন্তু সেটা বোঝাই যাচ্ছিলো না। উল্টো আরো টুকটাক সবাইকে সাপোর্ট দিচ্ছিলো। আমরা আগাতে লাগলাম। রাস্তা কঠিন, মনের জোর প্রবল। ঝিরিপথের একটা জায়গায় গিয়ে নাদিয়া চলে গেলো সবার আগে। এবং খানিকটা এগিয়ে ওপরে উঠতেই দেখি নাদিয়া সেই পাহাড়ি বড় বড় পাথরের পথে কিছু একটা হাত দিয়ে ধরে সমানে ঝুলে ঝুলে দোল খেয়ে যাচ্ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে প্রাণোচ্ছল একটি প্রান প্রকৃতির আস্বাদন লুফে নিচ্ছে সব ভুলে। ওটা ছিলো এক প্রকার গাছের পাতাবিহীন ডাল যা ওপর থেকে নিচের দিকে ঝুলে পরেছে।একে একে আমাদের মধ্যে আরো কয়েকজন দুলে গেলো ওর মত। আমাকে বার বার বলা হলেও নিজের ব্যালেন্সিং এর ওপর কনফিডেন্স না থাকায় আর সাহস করলাম না। এখানে সামান্য কিছু সময় কাটিয়ে আমরা আবারও উঠতে শুরু করলাম। পথে  যেতে যেতে আরো একটা ছোটো টিম দেখতে পেলাম। তাদের অবস্থা দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিলো আগেরদিন হয়তো তারা জোত্লং সামিট করেছে। কথা বলে অনুমান সঠিক প্রমানিত হলো। ঝিরি পথে ছোটো বড় পাথর, বোল্ডার পেরিয়ে আমরা এগোলাম। কোথাও গাছ কিংবা গাছের শেকড় ধরে ধরে সাপোর্ট নিয়ে উঠলাম। এই করে করে যেখানে আমাদের ঝিরি শেষ হলো সেখানে আমরা রেস্ট নিলাম, কিছু খাবার খেলাম, উপড়ে পরা একটা বড় গাছের ওপর বসে আমরা মেয়েরা ছবি তুললাম।আসিফ বলেছিলো সামিট পয়েন্টে জায়গা কম তাই আরেক গ্রুপের আগেই আমারা চলে গেলে ভালো হবে। কিন্তু ঝিরির শেষ পথে বসে রেস্ট নিতে নিতে ওই গ্রুপ টা চলে এলো। আসিফ বললো ওরা বরং আগে যাক, এই রাস্তাটা নাকি অনেক খারা একজন একজন করে যাওয়া লাগে। তাই আমরা আরো কিছুক্ষণ পরে উঠবো ওরা অনেকটা এগিয়ে নিক। আমরা তখন আরো কিছুটা গল্প করে নিলাম।

গহীন অরণ্যে ওরা আট জন
ফটোগ্রাফারঃ আপং বম

আকাশে তখন ঝলমলে সূর্যের প্রখরতা। সবার আগে নিপুন আপু ওঠা শুরু করলো। কিছুদুর আগাতেই শুনলাম নিপুণ আপু কাউকে ডাকছে। সাদিককে যেতে বললে সাদিক কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললো আপু স্যার বলে রাসেল ভাইয়াকে ডাকছে। ততক্ষণে আমিও ওঠা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে রাস্তার কঠিনতা ও ভয়াবহতা অনুভব করলাম। একেবারে খারা রাস্তা, আশেপাশে ধরার মত বলতে গেলে বাঁশ কেটে রশির মত করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যেগুলো সেগুলো। কোনোমতে ভারসাম্য এদিক সেদিক কিংবা আনমনা হলেই সোজা নিচে পরে যাওয়ার ভয়। পানির উৎস ঝিরিপথ শেষ হওয়ার বেশ আগেই শেষ ছিলো। মাথায় কড়া রোদ নিয়ে আগাচ্ছি আমরা। সাথে বহন করা পানিটুকুই সম্বল।  বেশ খানিকটা কঠিন পথ পারি দিয়ে একটা গাছের গোরায় বসার মত একটা জায়গায় বসে পড়লাম সবাই। সেখান থেকে আবার জোত্লং দেখা যায়। হালকা খেলাম কেউ কেউ,  ছবিও তুললাম।

আবার পথচলা শুরু, তপ্ত রৌদ্র মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলা চূড়ার উদ্দেশ্যে। পুরোটা রাস্তা বলতে গেলে আমরা নিপুণ আপুর ড্রাই ফুড খাই। সাদিক আপুর ব্যাগ বহন করেছিলো। ও যেখানেই বসে পরতো সেখানেই ব্যাগ থেকে খাবার বের করে নিজেও খেতো আমাদেরও দিতো। এমনকি আপু অনেক সময় থাকতোও না পাশে। আমার তখন মনে হচ্ছিলো এই নিপুণ আপুর ড্রাই ফুডের ভরসাতেই মনে হয় আমরা চলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম এনার্জি লেভেল সবার ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। আমি,আসিফ, সাদিক আর নাদিয়া কিছুটা আগে এবং নিপুণ আপু, রাসেল ভাইয়া, ইফতি, সুমি আপু ও আপং দাদা কিছুটা পিছনে হয়ে চলতে লাগলাম। ইফতি তাড়াতাড়ি যেতে পারলেও বাকিদের সাপোর্ট দিয়ে দিয়ে আগাচ্ছিলো। চলতে চলতে দুই গ্রুপের মধ্যে বেশ খানিকটা দুরত্ব চলে এলো। তখন আমাদের সবাইকেই ক্লান্তি পেয়ে বসেছে। যেতে যেতে আমরা একটি চূড়ার কাছাকাছি গেলাম। আসিফ বললো এটা থেকে ভিউ নাকি অনেক সুন্দর।  এরপরেও আরো একটি চূড়া পাবো তারপরেই সামিট পয়েন্টের চূড়া। প্রথম চূড়ায় গিয়ে এক মন্ত্রমুগ্ধ ভালো লাগা কাজ করলো। চোখ যেন ভীষন সৌন্দর্যের ঝলকে ঝলসে যাওয়ার জোগার। পাহাড় গুলোকে সৃষ্টিকর্তা থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে। রোদ থাকলেও সেখানে বাতাসও রয়েছে। আমরা রেস্ট নিয়ে নিলাম এবং ছবি তুলে নিলাম। নিপুণ আপুরা এসে পৌছাতেই আমরা সামনে আগানো শুরু করলাম তাদের রেখে।

প্রথমে কিছুটা নেমে আবার ওঠা। একটা বাঁশ বাগান পেলাম। সেই বাগানে ছায়ার মধ্যে দিয়ে এগোতে ভালোই লেগেছিলো। এর পরে আবার একটি চুড়া পাওয়া গেলো। সেখানে গিয়েও আমরা প্রকৃতির রুপ আরো কিছুটা নিখুঁতভাবে অনুভব করে নিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে বাতাসের ঝটকায় আমার মাথার ক্যাপটা নিচে পরে যায় মায়ানমার অংশে। এবারে পুরো রোদ টা লাগবে মাথায় আর চোখে। এসব ভেবে ভেবে সেই চূড়া ত্যাগ করে সামনে আগালাম। পথে যেতে যেতে  সেই ছোটো টিমটার কয়েকজন আগে চলে গেলো এবং নাদিয়া আর সাদিকও আমাদের ক্রস করে সামনে গেলো। আসিফের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী সামনেই তিন নম্বর চূড়া মানে সামিট পয়েন্ট। সুতরাং মনে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কিন্তু শরীরে অনেকখানি ক্লান্তি নিয়ে আগাচ্ছি। অতঃপর সেই চূড়া পেলাম দেখি সাদিক ও নাদিয়া বসে আছে। অপর টিমের গাইড দাদা আমাদের পিছনে রয়ে গেলো। সাদিক ও নাদিয়া বলল এটাই নাকি সামিট পয়েন্ট। অন্য টিমের গাইড দাদা ওদের বলেছে। কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছে যাওয়ায় মনের অবস্থা যখন উচ্ছসিত আসিফ তখন বলল ভিন্ন কথা। চেহারাটা বাংলার পাঁচের মত করে ও বলল ওটা নাকি সামিট পয়েন্ট না। আমি, সাদিক আর নাদিয়া এটা শুনে জায়গায় স্তব্ধ। আসিফ যেই জায়গাটা নির্দেশ করে বলতেছিলো যে ওটা সামিট পয়েন্ট সেটা খুব একটা কাছে না। তারচেয়েও বড় কথা সেখানে যেতে প্রথমে নামতে হবে তারপরে আবার উঠতে হবে। ক্লান্ত শরীর আর কিঞ্চিৎ মনোবল নিয়ে সেই সময়ে সেটা কঠিন ব্যাপার ছিলো। আসিফ অনেকটা ওর নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো এটা ভেবে যে এতক্ষণেও চূড়ায় যেতে পারলাম না কেন। বিরক্তির চূড়ান্ত হয়ে সাদিক বললো আর আগাবে না, সামিট করবে না। এমনকি নাদিয়াও বললো সামিট করবে না৷ কিন্তু আসিফের হাবভাব দেখে আমিও যাবো না এটা বলার সাহসই পেলাম না। আসিফ আগানো শুরু করলো। কথা না বাড়িয়ে আমি আগানো শুরু করলাম আমাকে দেখে সাদিক বললো “এত সাহস কই পাও মামা?”। ঠিকমত এটার উত্তর না দিয়ে নিচে নামতে নামতে বললাম “যতটুকু নামবো তার চেয়ে বেশি আবার উঠতে হবে।” এভাবে কিছুটা আগানোর পর আসিফ বললো “তোমার জিএস (নাদিয়া) কি আসতেছে নাকি?”। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওকে ডাক দিতেই ও পিছন থেকে বললো ” যাও, আমি আসতেছি আস্তে আস্তে”। আমি ভাবলাম ফাস্ট ট্রেকার ও এখন স্লো হয়ে গিয়েছে। ঐদিকে নিপুণ আপু, রাসেল ভাইয়া, সুমি আপু,ইফতি আর আপং দাদা পিছনে। আমাদের কাছে তাদের কোনো খবর নাই যে তারা কোথায় আছে বা কি করতেছে। সাথে করে নিয়ে আসা পানিও প্রায় শেষের পথে। এমনিভাবে আমরা ধীরে ধীরে যোগী হাফং এর চূড়ায় পৌছালাম।

থরে থরে সাজিয়ে রাখা পাহাড়ের মাঝে সদর্পে মাথা জাগিয়ে দাড়ানো জোত্লং
ফটোগ্রাফারঃ তোফায়েল আহমেদ আসিফ

সময় প্রায় দেড়টা সূর্য তখন মাথার ওপর থেকে হেলে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে। রোদের তীব্রতা প্রখর। শরীরের অবস্থা এমন যে এই বুঝি মস্তিষ্কের কথা শোনা বন্ধ করে দিবে। কিন্তু একটা পাহাড়ের চূড়ায় আমরা এবং সেটাও বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ চূড়া যোগী হাফং এর। এই ভাবনাটাই যথেষ্ট শরীর ও মন কে চালিয়ে নিতে। প্রথমে আমি এবং আসিফ তারপর সাদিক ও নাদিয়া চূড়ায় গেলাম। সেখান থেকে জোত্লং কে দেখে নিলাম চোখভরে। কত কত পাহাড়, রিঝ লাইন,চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। কয়েকটা ছবি তুলে আমরা সবাই চূড়ার ঢালুতে বাশের ছায়ায় বসে রেস্ট নিলাম। আসিফ, সাদিক ও নাদিয়াকে দেখলাম একেবারেই ক্লান্তি গ্রাস করে নেওয়া শরীর নিয়ে চুপচাপ আছে। তখন আমিই শুরু করলাম সামিট নোট লিখা। আমাদের টিমের নাম “প্যারা নাই চিল”। সামিটে যাওয়ার পূর্বেই ট্রিপের কোনো এক সময় আমরা সবাই মিলে যখন ভেবেছিলাম যে টিমের একটা নাম দেওয়া উচিত তখন সুমি আপু এই নাম টা রেকমেন্ড করলে বাকি সবাই তাতে সম্মতি দেয়। এবং দলের নাম “প্যারা নাই চিল” ঠিক হয়ে যায়। নিপুণ আপুকে টিম লিডার করে আমি নিজেই সবার নাম লিখে ফেলি এবং সেটা নিয়ে আপুদের জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম। যোগীর চূড়ায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যাওয়ায় আমরা সেখান থেকে ফোন কল করে নিলাম। সেখানে বসে আরিফকে ফোন দিলে আরিফ বললো ও নাকি কপিতাল পাহাড়ের চূড়ায়। ওর কথা বিশ্বাস না করলে ও পিয়া আপুকে ফোন দিলো। পিয়া আপুও বললো যে তারা কপিতালের চূড়ায়। পিয়া আপু, মহৎ পেশায় নিয়োজিত আরিফদের পরিচিত একজন ডাক্তার আপু। দেখা হয়নি তখনো তবে অনেক গল্প শোনা হয়েছিলো তার। কিছুক্ষণ পরে নিপুণ আপুরা সবাই এসে পৌছালো। সামিট পয়েন্ট হয়ে ঢালুতে বিশ্রাম নিতে আসলে আমি সামিট নোট লিখে ফেলেছি বললাম। কিন্তু আপুর নামের বানানে প্রথম টা দন্ত্য ন এবং পরের টা মূর্ধন্য অথচ আমি দুইটাই দন্ত্য ন দিয়ে লিখেছি। তখন টিমের প্রত্যেকের এনার্জি লেভেল শেষের কোঠায়। কেউই ঠিকমত নড়াচরা করা তো দূর কথাও বলতে চাচ্ছে না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আগের নোট টা কেটে আবার সবার নাম লিখবো। সবাই এমনকি নিপুণ আপুও বললো “যেটা লিখছো ওটাতেই হবে নতুন লিখার দরকার নাই।” কিন্তু আমি নতুন করেই লিখলাম।

সে এক ভীষণ ভালো লাগার মুহুর্ত
ফটোগ্রাফারঃ সায়েরী আক্তার বিধূন

 সেই সময়ে খুব সম্ভবত আমিই কম ক্লান্ত ছিলাম। এর পরে আমরা গ্রুপ ছবি তুলে নিলাম বাংলাদেশের পতাকা সহ। ঢাকা থেকে ঠিক যেভাবে নিপুণ আপুকে সামনে করে ছবি তুলতে চেয়েছিলাম সেভাবে পারলাম না। তবে যেভাবে পারলাম সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে নামার জন্য প্রস্তুত হলাম  নিপুণ আপুরা তখনও চূড়ায়, তারা ছবি তুলতেছিলো।

পাহাড় ছেড়ে ফিরার পালা,

প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট চূড়ায় অতিবাহিত করে পৌনে তিনটার দিকে আমরা আগের টিম আগেভাগে নামতে শুরু করলাম। সাদিক প্রায় দৌড়ে নামতে থাকলো। ওর পরেই নাদিয়া চলতে লাগলো। আমি আর আসিফ তারপরে। এবং নিপুন আপুরা সবার পিছনে। বাঁশবাগানে এসে একটা জায়গায় আমি আর আসিফ বসে বিশ্রাম নিলাম। এবং লক্ষ করলাম সেখানে কয়লার কালি। অর্থাৎ সেখানে হয়তো কেউ সাম্প্রতিই ক্যাম্পিং করেছিলো। এবং খেয়াল করলাম জায়গাটা ক্যাম্পিং এর জন্য ভালোই। পিছনের গ্রুপ থেকে ইফতি চলে আসলো। খানিকটা বসে ও আবার সামনে চলে গেলো। সে সময়ে সেখানে আমি আর আসিফ রাজ্যের গল্প জুরে দিলাম। এবং গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে আসিফ প্রায় ঘুমিয়েই যাচ্ছিলো তখন আমরা অলসতা ছেড়ে আবার চলতে শুরু করলাম। এখনো ফিরার রাস্তা লম্বা। কিছুটা চলতে চলতে সামনে দেখলাম সাদিক ইফতি ও নাদিয়াকে। ঠিক সেই জোত্লং ভিউ পয়েন্টের গাছের নিচটায় যেখানে আমরা ওঠার সময়ও বিশ্রাম  নিয়েছিলাম। সাদিক শুয়ে আছে এমনকি ও নাকি একটা ঘুমও দিয়ে ফেলছে। আমি আর আসিফ সেখানে বসলাম না। দাড়িয়েই টুকটাক খেয়ে নিলাম আর নিপুণ আপুর খাবারের ব্যাগটা তো সাদিকের সাথেই ছিলো। এবং সবার সাথে বাঁচিয়ে রাখা শেষ পানি টুকু সেখানেই শেষ করে ফেলালাম সবাই। আবারও আমরা নামতে থাকলাম। বরাবরের মত সাদিক দৌড়ে নেমে গেলো সেই সাথে ইফতিও। তখন মনে হচ্ছিলো এই চট্টগ্রামের ছেলেগুলো মনে হয় জন্মসূত্রেই পাহাড়ি পাহাড়ি টাইপ হয়। নাদিয়া আমি ও আসিফ ধীরে ধীরে নামতেছিলাম। আসিফের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলোনা, পানির জন্য খুব তৃষ্ণার্ত। আসিফ বলতেছিলো নিপুণ আপুদেরও পানি সংকট হবে। চূড়াতেই নাকি আপু পানির কথা বলতেছিলো।  নাদিয়া আমাদের ক্রস করে সামনে এগিয়ে গেলো। এবারে আমরা চলে এলাম সেই খাড়া রাস্তাটায় যার শেষেই ঝিরি পথ। পিছন থেকে কিছুক্ষণ পর পর নাদিয়াকে ডেকে সামনে ও  ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে আগাচ্ছি। ঝুকিপূর্ন সেই খাড়া রাস্তাটা নামার সময় হঠাৎই আসিফ ভারসাম্য হারিয়ে নিচে নামতে থাকে এবং শেষমেষ একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলে নেয়৷ এটা দেখে ভয়ে আমি শিউরে উঠি। সেই সময়টা মনে হয়েছিলো আসিফ বুঝি একেবারেই পরে গেলো পাহাড় থেকে। পুরো ট্রিপে ওটাই ছিলো একটা অতিমাত্রায় ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। 

আমরা ঝিরি পথের শুরুতে নেমে এলাম। সাদিক ইফতির দেখা নাই ওরা অনেক সামনে। নাদিয়া এগোতে লাগলো এমন সময়ে আমাদের গাইড আপং দাদাকে দেখতে পেলাম নিপুণ আপু, রাসেল ভাইয়া ও সুমি আপুকে রেখে সে নেমে এসেছে পানির জন্য। তারা পানি ছাড়া এগোতে পারতেছে না। ঝিরিপথেও বেশ খানিকটা নামার পরে পানি পাওয়া যাবে। সামনে সাদিক ও ইফতি আছে এটা মাথায় রেখে নাদিয়া এগিয়ে গেলো একা একাই। আপং দাদাও দ্রুত পায়ে চলে গেলো পানির উৎসের লক্ষ্যে। আসিফ কয়েক পা এগিয়ে বসে পড়লো, পানি ছাড়া ওর পক্ষেও আগানো সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ সেখানে আমরা বসে থাকলাম। তারপরে আপং দাদা পানি নিয়ে এলো আমরা অল্পকরে পানি খেলাম এবং বোতলে করে একটুখানি পানি নিয়ে আবার সামনে হাটতে থাকলাম। কতটুকু আগানোর পরে দেখি সেই ছোট্ট টিমের একজন প্রায় দুলে দুলে  হাটতেছে। আমাদের দেখে করুন সুরে বললো “ভাই, পানি আছে?”  তাকে দেখে সেই প্রথম একজন মানুষকে পানির জন্য অত্যধিক কাতরানো অবস্থায় দেখলাম। আসিফ তাকে পানি দিলো। বাকি বেঁচে যাওয়া পানিটুকু নিয়ে সামনে যেতে যেতে আমরা দেখলাম সেই টিমের আরো কিছু সদস্য পানির জন্য বসে আছে, তাদের গাইড পানি আনতে গিয়েছে। এবং তাদের কাছ পর্যন্ত হেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দূর থেকে দেখা গেলো তাদের গাইড পানি নিয়ে আসতেছে। পানির উৎস কোথায় জিজ্ঞেস করতে সে বললো কাছেই। তবুও আমরা তাদের থেকে একটুখানি পানি খেয়ে হাটা দেই। হঠাৎই আমি ও আসিফ খেয়াল করলাম সামনে অনেক বড় বোল্ডার, লাফিয়ে নামা ছাড়া উপায় নাই এবং সেটাও ঝুকিপূর্ণ কারণ ধরার মত কিছু নেই। তখন আমরা বুঝলাম যে আমরা ভুলপথে নেমেছি আরো ওপর থেকে হয় ডান পাশ নাহয় বাম পাশ দিয়ে কিনারা ধরে নামতে হতো। আসিফের শরীরে অবস্থা খারাপ, ও শুধু মনের জোরে হেটে যাচ্ছে। মূলত আমরা সবাই ই মনের জোরেই হাটতেছিলাম শরীরের অবস্থা কম বেশি সবারই খারাপ। এমতাবস্থায় আবার পিছনে উপরের দিকে গিয়ে নেমে আসা অনেকটা মরার ওপর খরার ঘা। আসিফ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে পিছনে তাকিয়ে বলল “অনেকটা উঠে তারপর নামতে হবে। তারচেয়ে বরং আমি লাফিয়েই নামবো।” ওর এই কথা শুনে আমর তো চক্ষু ছানাবড়া। আসিফ বেশ ভালো লম্বা ওর পক্ষে যেভাবে লাফিয়ে নামা সম্ভব আমার পক্ষে সেটা অসম্ভব৷ আসিফ অনেকটা রিস্ক নিয়ে কিছুটা ব্যাথা পেয়ে লাফিয়ে নিচে পড়লো। আমি ওপরে রয়ে গেলাম। পিছনে গিয়ে আবার রাস্তা ধরে নেমে আসবো এমনটাও ভাবলাম কিন্তু সেই এনার্জি পেলাম না৷ নিচে থেকে আসিফ বলে যাচ্ছে আমি পারবো তবে আমি কোনো আত্মবিশ্বাস পেলাম না। কয়েক মুহুর্ত পরে দেখলাম পাথরের গা বেয়ে গাছের শিকরের মত কিছু নেমে গেছে। আসিফকে জিজ্ঞেস করলাম ওগুলো আমার ভারে ছিরে যাবে কিনা। ও বললো ছিড়বে না। সেগুলো ধরে নিচে থেকে বাড়িয়ে দেওয়া আসিফের হাতের ওপর এক পা রেখে বাকিটুকু লাফিয়ে পরে নিচে নামলাম। এবং তারপরে আবার হাটা দিলাম। নামতে নামতে আমরা একজায়গায় জমে থাকা পানি পাই৷ সেখানে গিয়েই আসিফ পা ডুবিয়ে বসে পরে এবং সেটা দেখে আমিও পা ভিজিয়ে নিলাম। সেখান থেকে উঠে আমরা সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি সাদিক, ইফতি ও নাদিয়া রেস্ট নিচ্ছে। সাদিক শুয়ে আছে এবং সেখানেও নাকি ও ঘুমিয়ে নিয়েছিলো। যেটাকে আমরা সবাই মিলে ল্যাটানো বলতেছিলাম। সেখানে জানলাম পিছনে ফেলে আসা পানি থেকেই নাকি অন্য টিমের গাইড পানি নিয়েছে এবং নাদিয়া, সাদিক ওরাও সেখান থেকেই পানি নিয়েছে। যদিও সেটা প্রবাহিত ঝিরির পানি ছিলো না তবুও তৃষ্ণার্ত সবাই আর সহ্য করতে না পেরে সেই জমে থাকা পানিই খেয়েছিলো। তবে আমাদের গাইড আপং দাদা নাকি আরো নিচে গিয়ে প্রবাহিত পানিই নিয়ে এসেছিলো সবার জন্য। সেটা আরো খানিকটা নিচে। এটা শুনে সেই মুহুর্তে দাদার জন্য শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিলো। আসিফ আবার ওপরে উঠে সেই জমে থাকা পানি থেকে পানি আনতে গেলো। কারণ ও পানি ছাড়া চলতে পারতেছিলো না৷ আর প্রবাহিত পানির উৎস একেবারে কাছাকাছি না হওয়ায় ঝুকি নিতে চাচ্ছিলো না৷ আমরা সবাই বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আসিফ পানি নিয়ে আসলো৷ ততক্ষণে দেখতে পেলাম আপং দাদা সুমি আপু কে নিয়ে নামতেছে নিপুণ আপু রাসেল ভাইয়াকে পিছনে রেখে। সে এলে জানতে পারলাম আপুরা বেশ পিছনে আসতে সময় লাগবে। তখন আসিফ ও সাদিক বললো যত দেড়িই হোক আপং দাদা যেনো আপু ভাইয়াকে সাথে নিয়ে পাড়ায় ফিরে। আমরা সবাই মিলে ওয়াই জংশন পর্যন্ত আগাবো এমকি পাড়া পর্যন্তও ট্রাই করবো যেহেতু সাদিক পাহাড়ি রাস্তা একবার গেলে মনে রাখতে পারে আবার আসিফও আছে এছাড়াও বড় সহায়ক হলো সাদিকের ফোনে অফলাইন জিপিএস ডাউনলোড করা ছিলো। সবমিলিয়ে আমরা আগালাম এবং আপং দাদাকে ফেরত পাঠালাম আপুদের কাছে। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে শেষের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই টুপ করে সন্ধ্যা নামবে। সুমি আপুর শরীরের কন্ডিশন খারাপ৷ খুব কষ্ট হচ্ছে তার৷ পানির জন্য সবার অবস্থাই খারাপের দিকে ছিলো কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আমার বাকিদের মত পানির কষ্ট হয়নি। কারণ অজানা তবে আমি সেভাবে তৃষ্ণার্ত হইনি। আরো সামনে গিয়েই প্রাবাহিত পানির ধারা পেয়ে যাই। এবং সেই সাথে ফিরে আসে স্বস্তি কারণ সামনে পর্যাপ্ত পানির সোর্স আছে। প্রথমে সাদিক ও নাদিয়া তারপরে আমি ও আসিফ এবং পিছনে সুমি আপুকে সাপোর্ট দিয়ে নামিয়ে আনতেছিলো ইফতি। ইফতি সেভাবে কাউকে চিনে না। ট্যুরেই প্রথম পরিচয় অথচ সেই শুরু থেকে ও সবাইকে যথেষ্ট ভালো সাহায্য করে যাচ্ছে।পাহাড়ে সাদিক নিজে নিজে চলে কাউকে নিয়ে প্যারা নিতে চায় না। তাই ইফতিকে দেখে আমি সাদিকের সাথে দুষ্টামি করলাম এই বলে যে “দ্যাখো ইফতিকে, কত্ত ভালো একটা ছেলে। কিছু শিখো ওর থেকে”।

এভাবে শরীর ও মনের ক্লান্তি নিয়ে কিছুটা গল্প করে করে আমরা আগাতে থাকলাম ওয়াই জংশনের দিকে। আমরা ঝিরি পথে ছোটো বড় বোল্ডার পেরিয়ে নিচে নামতেছিলাম। সন্ধ্যা নেমে এলো, শুরু হলো আমাদের হেডল্যাম্প জালিয়ে পথচলা। এরমধ্যেই আমি আবার পায়ের নখে প্রচন্ড ব্যাথা পেলাম। তবে সেটাকে অবজ্ঞা করেই চলতে লাগলাম। সুমি আপুর ব্যাকপেইন এর সমস্যা থাকায় চলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। ইফতি তাকে দায়িত্ব নিয়ে নামিয়ে আনতেছিলো। ঠিক এই জন্যে ইফতিকে সেদিন “ভালো ছেলে” নাম দিয়ে দেই।

আসিফের তখন কারো দিকে খেয়াল নেই। ওর নিজেরই খুব কষ্ট হচ্ছিলো। সাদিক বার বার বলতেছিলো ইফতির এটা প্রথম ট্রেকিং ট্যুর ও অনেক প্যারা খাচ্ছে সুমি আপুকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে, আসিফ যেনো যায়। কিন্তু আসিফের শরীরের অবস্থাই ভঙ্গুর। সেজন্য মেজাজও খিটখিটে কোনো কথা না শুনে ও কেবলই আগাচ্ছিলো। একটা পর্যায়ে যখন দেখলো নাদিয়াও সুমি আপুকে সাপোর্ট দিচ্ছে তখন ও ওদের সাথে এক হয়ে একে অপরকে সাপোর্ট দিয়ে ফিরতে লাগলো। এবারে আমি আর সাদিক একেবারে শুরুতে এবং পিছনে নাদিয়া, সুমি আপু, আসিফ ও ইফতি একসাথে। সাদিক কিছুক্ষণ পর পর জিপিএস দেখতেছিলো এবং বাকিদের সাথে কথা বলে রাস্তা ধরে ধরে আগাচ্ছিলো। এভাবে আমরা ওয়াই জংশনের প্রায় কাছে চলে এসেছি বুঝতে পেরে দুইজন প্লান করে বললাম যে ভুল রাস্তায় চলে এসেছি। তবে সেভাবে অনেক বেশি আতঙ্কিত হলো না কেউ৷ আমরাও প্রাঙ্ক আর বাড়ালাম না। ওয়াই জংশনে যাওয়ার পর সেটাই যে সঠিক ওয়াই জংশন সেটা সিওর হওয়ার জন্য যাওয়ার সময় সাদিক না ইফতি কার ফোনে যেন ওয়াই জংশনে বসে ছবি তোলা ছিলো সেটা দেখে নেওয়া হল। পুরোটা রাস্তা আমরা নিপুণ আপুর কথা বলতে বলতে এলাম। রাতের বেলা তারা বেশ পিছনে পরে গেছে। এমনকি আসিফ এটাও বললো যদি তাদের কোনো প্রবলেমের জন্য আগাতে না পারে তাহলে পাড়ায় গিয়ে আবার গাইড নিয়ে আমাদের আসতে হবে। সুতরাং আমাদের পাড়ায় যাওয়াটা জরুরি। সাদিক আর আসিফ মিলে বললো ওরা আরো কিছু রাস্তা চিনে আগাতে পারবে গাইড ছাড়াই। এই কথার ওপর ভিত্তি করে আমরা আবার আগালাম। এবং পথে চলতে চলতে ঠিক করে নিলাম যে আমরা পরেরদিন আর পাহাড় সামিটে যাবো না। সবাই মিলে কেথাও গল্পে গল্পে সময় কাটাবো। কিন্তু দলিয়ান পাড়ায় থাকতে চাইলাম না আমি। কাছাকাছি অন্য কোনে পাড়া হলে ভালো হয়। তাহলে আমাদের আরো একটি পাড়া দেখা হয়ে যাবে। তখন সাদিক বললো “মামা আমরা কালকে তিন্দু গিয়ে ল্যাটাবো, সাঙ্গুর পানিতে ভিজবো।” তিন্দু নিয়ে আসিফের কাছে প্রথম শুনেছিলাম “বাংলাদেশের স্বর্গ যদি বান্দরবান হয় তাহলে সেই স্বর্গের রাজধানী তিন্দু।” সেই তিন্দুর প্লান শুনে আমরা সবাই ই রাজি বাকি রইলো নিপুণ আপু আর রাসেল ভাইয়া। তারা এলে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। আমরা চলে এলাম স্বল্প পানি সহ একটা ঝিরিতে যেটা আড়াআড়ি পার হতে হবে। সামনে গিয়ে যদি রাস্তা ভুল হয়ে যায় সেই ভয় এবং নিপুণ আপুদের জন্য অপেক্ষা করা দুইয়ে মিলিয়ে আমরা সেই ঝিরির পানিতে পা ভিজিয়ে বসে বসে গল্প জুরে দিলাম। পাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহানো হলো।

অপেক্ষারত অবস্থায় একটুখানি উঞ্চতার আয়োজন
ফটোগ্রাফারঃ তোফায়েল আহমেদ আসিফ

 প্রায় এক ঘন্টা আমরা সেখানে অপেক্ষা করলাম কিন্তু আপুদের দেখা পেলাম না।  এর মধ্যেই দেখি জোত্লং যাওয়া একটা টিম ফিরতে শুরু করেছে। আমরা ভাবলাম এদের সাথে আমরা পাড়ায় ফিরে যাই কারণ আপুদের যদি আবার আনতে যেতে হয় তাহলে সেই সমাধান এখানে বসে অপেক্ষা করার মাধ্যমে হবে না৷ আমাদের পাড়ায় গিয়েই সাহায্যের জন্য আগাতে হবে। কিন্তু তবুও আপুদের রেখে যেতেও ইচ্ছা হলো না। আমরা অনেকটা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম বলতে গেলে। জোত্লং টিমটা অনেক বড়। একটু পরপর দুইজন তিনজন করে করে আমাদের ক্রস করে যাচ্ছে আর আমরা তাদের সাথে ফিরবো কি ফিরবো না সেই দ্বিধাদ্বন্দে আছি। একটা সময় তাদেরকে জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম তারা পিছনে তিন জনের কোনো গ্রুপ দেখেছে কিনা। শিওর হয়ে তারা কিছু বলতে পারলো না। এরপরে ওই গ্রুপের গাইড সহ টিম আসলে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে দেখেছে এবং তারা অনেক পিছনে আছে। তাদের গাইড আমাদের গাইড আপং দাদার কথা বললে আমরা শিওর হই যে পিছনে নিপুন আপুরা আসতেছে। তখন আমরা ওই টিমের সাথে হাটা শুরু করি। তাদের সাথে গাইড ছিলো আমাদের সাথে ছিলো না।পাড়া পর্যন্ত রাস্তা চিনা নিয়ে আসিফ ও সাদিকের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকলে আমরা কৌশলে সেই টিমের সাথে হাটা শুরু করি যাতে রাস্তা ভুল না হয়। ঠিক তখন আমার হাটার গতি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। হাত, পা ও শরীরে ব্যাথা অনুভব করি। একটা সময় আমি আর আসিফ ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরি পাড়ার একেবারে কাছাকাছি এসে। সবাই রেখে চলে গেলও আসিফ কখনো যাবে না এটা তো কনফার্ম। আসিফের জন্যই পাহাড়ে ট্রেকিং টা আমার নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে হয়ে থাকে। ও একটা ভরসার জায়গা। যার জন্য আমি ওর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। এভাবে পাড়ার প্রবেশমুখে প্রথম ঘরটায় গিয়ে আমরা পেপে খাই এবং বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকি। তখন আমরা নিপুণ আপুদের দেখি। তাদের দেখা মানেই ভীষণ এক স্বস্তি।এমনকি আপুরা ঝিরি থেকে চিংড়ি মাছ ধরে নিয়ে এসেছিলে পরবর্তীতে যেগুলো আমাদের পেটে না গিয়ে একটি বিড়ালের উদরপূর্তি করেছিলো।সেখান থেকে আমারা আমাদের নির্ধারিত ঘরে পৌঁছাই রাত যখন দশটা পেরিয়ে সামনের দিকে তখন। ততক্ষণে পাহাড়ের গায়ে শীত জেঁকে বসেছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা সকলে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসি। আসিফের মুখে যেই দিদির রান্নার খুব প্রশংসা শুনেছিলাম কিন্তু আগের দিন সন্তুষ্ট হতে পারি নাই তার হাতের মুরগী রান্না খেয়ে এবারে আমরা সবাই মুগ্ধ এবং আসিফে কথার সত্যতা পেলাম। তারপরে সবাই আমাদের ডক্টর নিপুণ আপুর সাথে মেডিসিন নিয়ে কথা বলে যার যেটা লাগবে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পরলাম। সেই সাথে আপু ভাইয়ার সাথে কথা বলে আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে আমাদের পরেরদিনের গন্তব্য বান্দরবান নামক স্বর্গের রাজধানীতে।

উদ্দেশ্য তিন্দুতে ল্যাটানো,

আমারা সকালে বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠলাম। শরীর ব্যাথা সকলের। হেলেদুলে হাটতে হয়। ধীরে ধীরে আমারা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বাইরে বের হয়ে দেখি আগেরদিনের জোত্লং টিমের সবাই যোগী যাচ্ছে। সামিটের চাইতে গল্পময় সময় কাটানোকে প্রাধান্য দেওয়ায় আমাদের তেমন তাড়া নেই। সবাই মিলে একবার পাড়ার দোকান ঘুরে আসলাম। সেখানে বসে আড্ডা দিতে ভালোই লেগেছিলো। এরপরে আবার নিজেদের আস্তানায় ফিরে খাওয়াদাওয়া করে সবাই প্রস্তুত হয়ে নিলাম। সাদিক কফি করলে সবাই কফি খেলো। আমরা যে বাসায় ছিলাম সেই দিদির ছোটো একটি ফুটফুটে বাবু ছিলো। মাশাল্লাহ কি কিউট বাবুটা! আমি নাদিয়া আর সুমি আপু অনেকটা সিরিয়াল ধরেই সেই বাবুটার সাথে ছবি তুলে নিলাম। বাবুটার নাম আবেত নাকো। যেই ঘরটায় আমরা ছিলাম তার পাশেই একটা সুন্দর ক্যারাম খেলার ঘর ছিলো।নিপুণ আপু পাহাড়ি বাচ্চাদের সাথে ক্যারাম খেললো একটু খানি।

একটি বাচ্চাসুলভ মুহুর্ত
ফটোগ্রাফারঃ ইফতেখার কোড়েশী

ধীরে  ধীরে আমরা পাড়া ত্যাগ করলাম। সেদিন সবচেয়ে বেশি দুর্বল ছিলাম আমি। সবাই আমার থেকে ভালো হাটতেছিলো। শরীর ব্যাথা আমার পা যেনো চলতেছিলো না। আমরা অনেকটা গল্প করে করে আগাচ্ছিলাম। বিশ্রাম নিয়েছিলাম একটা ঝিরির পাশে। সাদিক তো যেখানে বসে সেখানেই শুয়ে পরে। তারপরে আবার হাটা শুরু। চলতে চলতে পরের বিশ্রাম টা নিলাম একটা পাড়ার নিচের দোকানে নিপুণ আপু সবাইকে চা সহ আরো কিছু কিনে কিনে খাওয়ালো। তারপরে আবার হাটা পথে টুকটাক ছবি তোলা। এবারে বসলাম একটা পাড়ামুখে কাঠ দিয়ে পাতা বেঞ্চিতে। এই পাড়ারই কোনো এক ঘরের বারান্দায় বসে যাওয়ার সময় আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম। এভাবে চলতে চলতে আমরা রেমাক্রির প্রায় কাছাকাছি পেনাডং পাড়ায় চলে আসলাম। যাওয়ার সময় এই পাড়াটারই চার্চের ঠিক সামনে ভীষণ সুন্দর এক বাগান বিলাশ গাছ দেখেছিলাম রাতের বেলা। গাছ ভর্তি ফুল দিনের বেলা আরো সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিলো। আমরা সবাই সেখানে ছবি তুলেছিলাম। বাকিদের রেখে আমি সাদিক আর আসিফ আগেভাগে সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম। এসে পৌছালাম রেমাক্রি খালে। আসিফ ও সাদিক আমাকে সেখানে রেখে রেমাক্রি বাজারে যেতে চাইলো। তবে সাদিকের বার বার বারণ করা এবং সাথে করে নিয়ে যেতে স্পষ্ট অনিচ্ছা প্রকাশ করার পরেও আমি নাছোড়বান্দার মত ওদের সাথে করে খাল পার হয়ে চলে যাই। আমার আবার অদেখা যে কোনো জায়গায়ই দেখতে বেশ লাগে। বাজার থেকে ফিরে এসে দেখি নিপুণ আপু, নাদিয়া আর সুমি আপু রেমাক্রির প্রবাহিত পানির ধারায় মনের আনন্দে একেবারে বাচ্চাদের মত ভিজতেছে। তিনটি প্রানের সেই নিষ্পাপ উচ্ছল আনন্দ আমার চোখকে মুগ্ধতার পরশ দিয়েছিলো। ইফতি তাদের সেই মুহুর্ত ফ্রেমে বন্দি করেছিলো। নিপুণ আপুকে আমি সবসময় দেখেছি সমুদ্র, ঝর্না, ঝিরি কিংবা খালের পানিতে মন খুলে খুব আনন্দ নিয়ে ভিজতে। এই মানুষটা এমনিতেই ভীষণ রকমের অমায়িক। আর ট্রিপে গিয়ে তার সেই বিমোহিত নিষ্পাপ আনন্দ চারপাশে আরো বেশি প্রশান্তি ছড়ায়।

নির্মল আনন্দ দেওয়ার উপাদান
ফটোগ্রাফারঃ ইফতেখার কোড়েশী

আমি সেভাবে না ভিজলেও খালের পানিতে একটু আধটু ভিজে ছবি তুলেছিলাম, ভিডিও করেছিলাম। আপুরা পুরো এনার্জি রিগেইন করে ফিরে আসলে আমরা খালের পারে একটা দোকানে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। তারপরে তিন্দুগামী বোটে আমরা সবাই চেপে বসি। আবারও শুরু হয় আমাদের সাঙ্গু নদীর সৌন্দর্য অবলোকন। যাওয়ার সময় এই পথটুকুন আমাদের পাড়ি দেওয়া হয়েছিলো প্রকৃতিতে অন্ধকার নেমে আসার পরে। আর ফিরার পথে দিনের আলোয় প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান স্পষ্ট। যা চোখ ও মনকে এক ভিন্ন প্রশান্তি দেয়। প্রকৃতির সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে আমরা তিন্দু পৌছালাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। আমরা সবাই একটা দোতলা কটেজের উপরের দুইটা রুম নিলাম। আসিফরা নাকি এর আগে একবার এই কটেজটায় থেকেছিলো। সেখানে পাহাড়িদের বাড়িতেও থাকার ব্যবস্থা ছিলো তবে সেই দোতলা কটেজটাই আমাদের কাছে বেশি সুন্দর লেগেছিলো। ওপরে গিয়ে ব্যাগসহ সাথের জিনিসপত্র রেখে আমরা নামলাম। সাদিক সেই তিন্দু আসার সিদ্ধান্ত হওয়া থেকে বলতেছিলে তিন্দুর পানিতে ভিজবে, আসিফও ভিজবে। আমরা এক দোকানে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে চলে গেলাম পাথরের মাঝে সাঙ্গুতে। নিপুণ আপু আর রাসেল ভাইয়া রইলো পাড়ে বড় পাথরের ওপর। নাদিয়া কিছুটা এগিয়ে পাথরে বসলো। আমি আর সুমি আপু বেশ খানিকটা পা ভিজিয়ে আরো একটু দূরে বসলাম। সাদিক পুরো মাঝে গিয়ে গলা পর্যন্ত ভিজে পানিতে ভাসতে লাগলো। আসিফ ও ইফতিও কাছাকাছিই বসে ছিলে। আসিফের নেওয়া স্পিকারে আমরা গান শুনলাম। রাতের বেলা পাহাড় বেষ্টিত পাথরের ওপর বসে সাঙ্গুর পানিতে ভেজা,এটা যেনো প্রত্যাশার চাইতেও সুন্দর কিছু মুহুর্ত পাওয়া ছিলো। সেই সাথে নদীর কলকল শব্দ আমাদের আরো বেশি বিমোহিত করেছিলো। বেশ অনেকটা সময় আমরা সেখানে ছিলাম। তারপরে আসার আগে আমিও গলা পর্যন্ত ভিজে এক ভিন্ন ভালো লাগার অনুভুতি গ্রহণ করি৷  কি জানি! আবার কখনো এমন সুযোগ পাই কি না পাই। সবাই উঠে পরলাম কটেজে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে এবং উঠে দুপা চলতেই পাথরে স্লিপ করে পরে গিয়ে হাটুতে ব্যাথা পাই। তারপরের পথটুকু সাদিকের হাত ধরে পার হই। কটেজ থেকে নেমে রাতের খাবারের দোকানে যাই৷ সেখান থেকে ফোন কলের ব্যবস্থা থাকায় আমারা প্রয়োজনীয় ফোন কল করে নেই। তারপরে রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে নদীর পাশের মাচাং টাতে আমি, নাদিয়া, সুমি আপু, সাদিক ও ইফতি বসে গল্প জুরে দেই। নিপুণ আপু আর রাসেল ভাইয়া কটেজে চলে যায়৷  আমারা সেদিন এই কথা সেই কথা মিলিয়ে নানা গল্পে সময় কাটাই। একটা পর্যায়ে বেশ ঠান্ডা অনুভুত হলে কটেজ থেকে কম্বল আনিয়ে নেই মাচাংয়ে। তারও বেশ কিছুক্ষণ পরে আমরা উঠে চলে যাই ঘুমের জন্য।

প্রশান্তির ভেলায় চরে ঘরে ফেরা,

তিন্দুর সেই কটেজে ঘুম ভাঙলো ভোরে তবে বেশ খানিকটা উষ্ণ স্লিপিং ব্যাগ থেকে ঠান্ডায় বের হওয়াটা কঠিন। তবুও পাহাড়ে সকাল দেখার লোভ সংবরণ করা দায়। তাই ঘুম জরানো চোখে তখন স্লিপিং ব্যাগটা খুলে চাদরের মত মুড়িয়ে বারান্দার বসার বেঞ্চিটাতে বসলাম। সকালের স্নিগ্ধতা উপভোগ করলাম। কিছুক্ষণ পরে নাদিয়াও চলে এলো,এসে পাশেই সাদিকের সেই আগের দিন এসেই টানানো হ্যামকে শুয়ে পড়লো। কতক্ষণ পরে ঘুমে আবার চোখ ভারি হয়ে এলে আমি রুমে চলে গেলাম এবং নাদিয়া হ্যামকেই একটা সুন্দর ঘুম দিলো। তারপরে সবাই উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। সাদিক ও ইফতি আগেই বললো ওরা এখান থেকে যাওয়ার আগে আবারও পানিতে ভিজে গোসল করে নিবে। সেটা শুনে সুমি আপুকেও আগ্রহী দেখা গেলো এবং শেষ পর্যন্ত নাদিয়াও পানিতে নামলো। ওরা চারজন যখন নদীতে আমি, আসিফ, নিপুণ আপু ও রাসেল ভাইয়া তখন পাড়ে। সেখানে বাশের তৈরি ভেলা ছিলো। আমি সেই ভেলায় চড়লাম ইফতির সাথে৷ ইফতি সামনে থেকে ভেলা বাইছে আর আমি পিছনে।  নিপুণ আপু পাড় থেকে ছবি তুলছে।

তিন্দুতে সাঙ্গুর পানিতে চিল
ফটোগ্রাফারঃ নুসরাত আফরিন নিপুণ

  মাঝনদীতে গিয়ে ইফতি ভেলা থেকে নেমে যায়। আমি তখন একা ভেলায়। এবং সেটা বয়ে কিনারায় আনা আমার পক্ষে সম্ভব না। এটা নিয়ে ওরা দুস্টামি করলো। এবং অনেক চিল্লাচিল্লি করে ইফতিকে দিয়ে ভেলাটা আমি পাড়ে নেওয়াই। সেখান থেকে নেমে কটেজে ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত হই৷ নদী থেকে বাকিরাও উঠে একেবারে তৈরি হয়ে নেয়। তৈরি হওয়ার পরে সাদিক ছবি তুলতে এলে বারান্দায় ওর সাথে ছবি তুলে নেই। নিচে গিয়ে ইফতির সাথেও ছবি তুলে নেই। এবং আমাদের কটেজটা ভালো লাগায় কটেজের পাশেও ছবি তুলি। ইফতি তখন বলেছিলো “তোমাদের নৌকায় সুন্দর ছবি তুলে দিবো নে।” ছেলেটা যে ভালো ছবি তুলে সেটা তখনো সেভাবে জানতাম না। নাদিয়া নেমে এলে পাহাড়ি এক দিদি ওকে খুব মমতা নিয়ে বলে ও নাকি দেখতে তার মেয়ের মত। ব্যাপারটা অনেক সুন্দর ছিলো। ফিরার পথে তিন্দু হয়ে আসায় এবং কম সময় সেখানে থাকায় আমরা হয়তো স্বর্গের রাজধানীর মত উপলব্ধি করতে নাই। তবে যেই সময়টুকু কাটিয়েছি নিঃসন্দেহে সেটা আমার জীবনের কাটানো সুন্দর সময় গুলোর মধ্যে একটা। ফিরে এসে নাদিয়া বলেছিলো “আমারা কিন্তু তিন্দু ঘুরি নাই তেমন। আবার কোনো প্লানে তিন্দু ঘুরবো।” অর্থাৎ তিন্দুর মোহ আমাদের কাটে নাই।

এবারে আমাদের বোটে করে থানচি ফিরার পালা। সকালের সোনালি রোদ মাথায় নিয়ে আমরা বোটে চড়ে বসলাম। সকালের রোদের সৌন্দর্য প্রকৃতিতে প্রকট। সেটা পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলা সাঙ্গুর সৌন্দর্যকে আরো বেশি ফুটিয়ে তুলেছিলো। আমার তখন ” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়” এর সাথে খুব দ্বিমত পোষন করতে ইচ্ছা হলো। কবিতায় সে বলেছিলো-

“অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।”

তার বলা এই কথাটা মানতে পারলাম না। আমার নিজস্ব নদীটা যদি এমন সুন্দর হয় তাহলে আমি সেটার বদলে পাহাড় কিনতে পারবো না। বরং পাহাড় কিনতে বিনিময় স্বরুপ অন্য কোনো বিকল্প বের করবো। তবে যেকোনো মূল্যেই আমি পাহাড় কিনবো সেই সাথে নদীটাও আমারই থাকবে।

আমদের বোটে আমি, নাদিয়া, ইফতি ও সাদিক ছিলাম। ইফতি আমাদের ছবি তুললো। সাদিককে বকা দিতে দিতে (মজা করে), সবাই মিলে গান গাইতে গাইতে এবং পাহাড় ও নদীর অফুরন্ত সৌন্দর্য চোখভরে লুফে নিতে নিতে আমরা থানচি চলে এলাম। তখন রৌদ্রজ্বল প্রকৃতি, পানির ছিটেফোটা রোদের ঝলকানিতে যেনো চিকচিক করতেছিলো। নৌকা ঘাটে ভিড়ার আগ মুহুর্তে শুনলাম কে যেনো মামা মামা বলে ডাকছে। শুরুতে আমি ভেবেছিলাম নৌকা চালকরা মনেহয় একজন আরেকজনকে ডাকছে। এরপরেই দেখি সেটা আরিফ মামা এবং আমাদেরই ডাকছে। মামাকে দেখে আমার যেনো ষোলোকলা পূর্ণ। আসার আগেই আরিফকে বলেছিলাম ওকে আমরা মিস করবো এবং করেওছিলাম। সেই ওকেই আমরা আবার কাকতালীয়ভাবে থানচিতে পেয়ে গেলাম।সুতরাং ট্রিপের আনন্দ আরো বেড়ে গেলো।ওপরে উঠে আমাদের সাথে দেখা হলো পিয়া আপুর যার গল্প শোনা হয়েছিলো অনেক। আপুকে দেখে খুব অল্প সময় মিশে আপুর সম্পর্ক একটা ধারনাই জন্মালো তখন “খুব আদর করতে জানা মায়াবী একজন মানুষ”। আমরা  দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলাম। আরিফ মামা অনেক ঘুরে একটা তরমুজ কিনে এনে খাওয়ালো। তারপরে আরিফ মামারা ও আমরা একই জীপে চড়ে বসলাম বান্দরবান শহরের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষন জীপে গল্পে গল্পে কাটানোর পর বরাবরের মত গাড়িতে উঠেই আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে গেলে আমি জীপের সামনের সীটে চলে গেলাম আরামে ঘুম দেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পরে পিয়া আপুও চলে আসলো। এবং পিয়া আপুর কোলে পরে আমি ঘুমাতে ঘুমাতে আমাদের জীপ এসে থামলো শহরে। ডেকে ডেকে আমার ঘুম ভাঙানোর পর জীপ থেকে নামতেই আরিফ মামা আর পিয়া আপু আমাকে ও নাদিয়াকে তাদের সাথে কেওক্রাডং যেতে বললো। কিন্তু আমরা বিশেষ করে আমি আর এনার্জি না পাওয়ায় তাদের প্রস্তাব গ্রহন করতে পারলাম না।

একটি পরিপূর্ণ ও হাস্যজ্বল সেলফি

 রাতে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে ঢাকাগামী বাসে চেপে বসলাম আমরা যারা ঢাকায় ফিরবো তারা। সেই সাথে সাদিক ও ইফতিও উঠলো আমাদের বাসে, নেমে যাবে চট্টগ্রাম।  আমি তো বাস চলতেই ঘুম কখন সাদিক ও ইফতি নামলো টের পেলাম না কিংবা আমাকে নামার সময় ডেকে বলে গেলেও তীব্র ঘুমের ঘোরে থাকায় ঘুম ভাঙলে সেটা মনে পরলো না। ভোরের আলো ফোটার আগেই বাস নামিয়ে দিলো সায়েদাবাদ। আমি, নাদিয়া, আসিফ ও সুমি আপু রাস্তায় কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আলো দেখা দিলে চলে গেলাম বাসায়৷

এই তো কয়েকদিন আগেই কোথায় যেনো দেখলাম “পাহাড়ের ভুমিকা আছে, কিন্তু উপসংহার নাই।” পাহাড় কে নিয়ে ভালোলাগারও একই অবস্থা। যেই ভালোলাগার শেষ নাই সেটা জোরপূর্বক শেষ করার সামর্থ্য আমার নাই। আমার সাধ্য আছে বার বার শুরু করা এবং এক শুরুর পরে আরেক শুরুর জন্য অপেক্ষা করা। আমি বরং অপেক্ষাটাই করে যাই। অপেক্ষা করে যাই পাহাড়ের মহত্বে অগোছালো নিজেকে গুছিয়ে নিতে, অপেক্ষা করে যাই পাহাড়ের কাছে নিজেকে ভেঙেচুরে রেখে আসতে, অপেক্ষা করে যাই খুব হাপিয়ে ওঠা এই আমার জন্য প্রশান্তি কুড়িয়ে আনতে। বারংবার এই অপেক্ষা যেনো শেষ না হয়। এই অপেক্ষায় বড় সুখ……..

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Jogi Haphongjogihafong