বর্ষায় যোগি হাফং চূড়া আরোহণ

যোগি হাফং (Jogi Haphong) যা বাংলাদেশের ৪র্থ সর্বোচ্চ চূড়া। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে যোগি হাফং এর চূড়া জয় করতে গিয়েছিলাম। মাসের শেষের দিকে তখন, কলেজের পরিক্ষা শেষে মাত্রই কুরবানির বন্ধ দিয়েছিল। লম্বা ছুটি পেলে, আমার কখনো ঘরে বসে থাকতে মন চাই না। এই বন্ধে চেয়েছিলাম, বাসাই না থেকে দূরে কোথাও যায়। চিন্তা না করতেই, মাথায় চলে আসে বান্দরবান যাওয়ার কথা। বান্দরবানের একটা চূড়াতে উঠবো, সাথে কয়েকটা ঝর্ণাও দেখে আসবো।

পবিত্র ঈদ-উল-আযহার রাতে, আমরা যোগি হাফং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। বর্তমানে যোগী হাফং বা কংদুক পাহাড়, সকল ট্রেকারদের জন্য অন্যতম একটি কঠিন চূড়া হিসেবে পরিচিত। অনেকে, জৌ ত্লাং (Zow Tlang) আর যোগি হাফং এর উদ্দ্যেশ্যে সেদিকে যায় কিন্তু প্রায়ই যোগি হাফং ভালোভাবে সামিট হয় না। এই চূড়াতেই, ঘন বর্ষায় যাওয়ার জন্য হঠাৎ, আমাদের মাথায় ভুত চেপেছিল।

আগস্টের ২২ তারিখ, মধ্যরাতে আমি, ইব্রাহিম আর তমাল ভাই। ৩ জন মিলে রওনা দিয়ার জন্য, মধ্যেরাতে একত্রিত হয়েছিলাম। আমি বাসা থেকে না নামতে নামতে, সেই এক বৃষ্টি! তার উপর বিকট আওয়াজের বিজলি আর কোথাও গাড়িও পাচ্ছিলাম না। বর্ষার মাস বটেই! মনে করেছিলাম, বৃষ্টি নিজেই এসে আমাদেরকে না যাওয়ার জন্য সারা দিয়েছিল। কিন্তু, সেটা আমরা মেনে নিতে পারি নাই। সবার মন বাঁধা দিচ্ছিলো, “ভাই! আমি যাবোই!”

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস কাউন্টার থেকে আমরা বান্দরবানের বাসের টিকেট কেটে, বান্দরবান পৌঁছে যায় সকাল ১০ টার দিকে। ১১ টার থানচির বাসে উঠি আমরা। প্রায় ৩ ঘন্টা কেটেছে এই লোকাল বাস ঠ্যালানিতে! গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আসে পাশে সবুজ পাহাড় হতে হঠাৎ করে মেঘের আনাগোনা দেখা দিচ্ছিলো। আমি জীবনের সেই প্রথম থানচি দেখেছিলাম, বর্ষার মধ্যে প্রায় ২১০০ ফুট উঁচু সড়কটা পুরোপুরি মেঘে ঢাকা। এক পাশে শূন্য, অন্যপাশে দক্ষিণ চিম্বুক রেঞ্জ। মূলত, বান্দরবান-থানচি সড়কটা চিম্বুক রেঞ্জের উপরেই, বাংলাদেশ ২য় সর্বোচ্চ সড়ক। চিম্বুক রেঞ্জ দেখতে পেরেছিলাম থানচি ব্রীজের উপর নেমে। এমন পাহাড়ি বর্ষার রূপ কখনো দেখি নাই। উঁচু পাহাড়ের রঙটাই এমন অদ্ভুত, দূর থেকেও খুব একটা দানবের মতো মনে হয়।

থাঞ্চির ব্রীজ থেকে উপত্যকার মতো দেখতে, সাঙ্গু নদী এবং মেঘে ঢাকা দক্ষিণ চিম্বুক রেঞ্জ।

আমাদের পেটে অনেক খিদে ছিল। বান্দরবান থেকে থানচির বাসে উঠার আগে, সেই একটা মাত্র বিস্কুটের প্যাকেট, রঙ চাতে ভিজিয়ে খেয়েছিলাম। এমনেও তখন ৩ টার মতো বেজে গিয়েছিলো। না খেয়েই আমাদের সেদিন তাড়াহুড়ো করে রেমাক্রিতে চলে যেতে হয়। ট্রলারে করে গিয়েছিলাম, আমাদের পরিচিত এক মাঝিকে নিয়ে সেখান থেকে। সাঙ্গু নদীতে প্রায় ২ ঘন্টার মতো সময় লেগেছিলো সেখানে পৌঁছাতে। সাঙ্গু (Sangu) নদী, যা বাংলাদেশের ২য় দীর্ঘতম নদী এবং একমাত্র নদী যেটা পুরো বান্দরবানের বুক ছিড়ে পাহাড়ের আঁকেবাঁকে ঘেষে গেছে। একমাত্র কয়েকটার মধ্যে, এই সাঙ্গু নদীর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের মধ্যেই। তার উৎপত্তি বান্দরবানের অনেক গহীনে, Sangu-Matamuhuri Reserve Forest এর মধ্যে। এই নদী, রিজার্ভ ফরেস্টের অন্তর্ভুক্ত আন্ধারমানিক থেকে লিক্রি পেরিয়ে, শঙ্খ নদী (উজান) হতে আরো দূরে মাতাদুসরি, ব্রুংক্ষিয়াং, তংক্ষিয়াং, লাগপাই, থাকব্রো ইত্যাদি ঝিরির সাথে মিলেছে। রেমাক্রি থেকে এসব জায়গা, পুরো একটা ভিন্ন দুনিয়ার পথে মনে হবে।

রেমাক্রি যাওয়ার পথে, মাঝে মাঝে উওাল ঢেউয়ের ধাক্কা আর বড় বড় পাথরের অসাধারাণ আকার আকৃতি দেখে, মুহূর্তে মনটা কেড়ে নিয়েছিলো। বড় পাথর এলাকায়, বিভিন্নরকমের বিরাট আকৃতির পাথর, রানি পাথর আর রাজা পাথর! বৃষ্টির ঢলে, পাথর গুলো সব ঢুবে আছে। নদীতে এমন স্রোত কখনো দেখি নি। পাহাড়ে ঘেরা এবং বর্ষার সৌন্দর্যের একমাত্র অপরূপ বাংলা হয়তো এটাই!

একদম বিকেলে, আমরা রেমাক্রি গিয়ে পৌঁছাই। সেখান থেকে রাতে আমাদের পিচ্ছিল কাঁদায় এবং রেমাইফা খালের বুক পরিমাণ পানি বারবার পার করতে খুব কষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। রাত যেহেতু, সুবিধার্থে একটা গাইড রেখেছিলাম সাথে। প্রায় ৩ ঘন্টা লেগেছে, এই পিচ্ছিল পথে অন্ধের মতো হেটে হেটে। অন্যান্য সময়, শুকনো থাকলে ২ ঘন্টার বেশি লাগার কথা না। সকাল বেলা রউনা দিতে পারলে আসে পাশে ঘেরা সবুজবীথি মায়ার রূপ দেখা যেতো। এক পাশে, মদক রেঞ্জ। কোথাও চিম্বুক রেঞ্জের দেখা। রঙিন পাথর ভরা রেমাইফা ঝিরি, আর যাওয়ার পথে মুরংদের “কেউশিং পাড়া” এবং মারমাদের “চংখথ পাড়া” পড়বে।

সাঙ্গু নদী, তিঁন্দু ঘাটে পৌছানোর আগে।

সেদিন রাতের ৯:০০টা বাজে, আমরা দলিয়ান পাড়ায় পৌঁছালাম। রাত্রে ছিলাম, সেখানের হেডম্যানের এক ভাতিজির বাসায়। পাহাড়ে গেলে, আমি কখনো পাহাড়ি খাবার না খেয়ে থাকতে পারি না। সেদিন রাতেই বাঁশ কোড়ল আর পাহাড়ি মুরগী দিয়ে আমাদের পেট ভোজন করানো হয়। যে ঘরে রাত্রে ছিলাম, ঘরের দাদা আমাদের যোগি হাফং যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছেন। এই দাদাই, আমাদেরকে পরের দিন চূড়াই নিয়ে যাবে বলেছে।

যোগির চূড়াটা দেখতে কেমন যেন আমার খুব অদ্ভুত মনে হয়। ৪টা ভাঙা ভাঙা চূড়া, যার মধ্যে “North Peak” টাই সবচেয়ে উঁচু। কংদুক পাহাড় বললে, সকল মারমা জাতিরা চিনবে এই চূড়া। আবার বম জাতিদের মতে এর নাম “লৌহ ত্লাং”, কারন যোগির গায়ে অনেকগুলো “লৌহ” নামক ঝিরি বেয়ে নেমেছে। ত্রিপুরাদের মতে “লুকু” চূড়া নামেও বেশ খ্যাত। লুকু নামের আরো অনেকগুলো চূড়া আছে, থিন্দোলতে লাং (Thingdawlte Tlang/৭তম) এবং লখু তং (Lakhudaung/১২তম)। মূলত, লুকু অর্থ যে চুড়া গুলো আছে, দেখতে কিছুটা টুপির মতো। “যোগি হাফং” বাংলাদেশের ৪র্থ সর্বোচ্চ চূড়া, যার উচ্চতা আনুমানিক ৩২২২-৩২৫৮ ফুট। আমাদের অফলাইন জিপিএস দিয়ে, এর উচ্চতা ৩২৫২ ফুট পেয়েছিলাম। যোগি হাফং এর পাশেই আরেকটা চূড়া জৌ ত্লাং (Zow Tlang), যা ২য় সর্বোচ্চ চূড়া। এর উচ্চতা ৩৩২৮-৩৩৫৩ ফুট। দুটো চূড়ার মাঝে, ২৯০০ ফুটের কাছাকাছি উচ্চতার “আয়ান ক্লাং (Ayan Clang)” নামের একটা চূড়া আছে। এই ৩টা চুড়াই বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের রেঞ্জ, মদক রেঞ্জে অবস্থিত। মূলত বান্দরবান জেলায়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত, এই মদক রেঞ্জ দিয়েই ভাগ করা হয়েছে। অন্যদিকে, বান্দরবানের সাথে সংযুক্ত ভারতের বর্ডার রেং ত্লাং রেঞ্জের সাপেক্ষে আঁকা হয়েছে।

২৩ তারিখ, ভোর ৬:৩০টায় আমরা দাদাকে নিয়ে যোগি হাফং এর জন্য রওনা দিয়েছি। গুড়ো গুড়ো বৃষ্টি তখন, দলিয়ান পাড়ার চারপাশে মেঘে ঢাকা। শুরুর পথটুকু খুবই পিচ্ছিল, আমাদের ট্রেকিং জুতোও ভালো কাজ দিচ্ছে না। দলিয়ান পাড়ার নিচে, ঠান্ডা “রেমাইফা ঝিরি” ধরেই আমাদের ট্রেকিং শুরু হয়। কোথাও কোমড় সমান পানি, কোথাও পিচ্ছিল পাথর, আর কোথাও মারাত্মক পানির ঢল। প্রতি মুহুর্তেই বড় বড় টাইগার জোঁকের কামড় এবং গ্রীন ভাইপার নামক একটা বিষাক্ত সাপের প্রথম দেখা!

প্রথম ২ ঘন্টা এরকম খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠার পর, যোগির খুব কাছে উঠে আসি। ত্রিপুরা জুম, সোনালী পাকা ধান যোগির সারা গায়ে। জুমঘরে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিই। আমরা শারীরিকভাবে তখনই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। সারা পায়ে জোঁকের দেওয়া লাল রক্তভরা আদর, বাঁশবনের কালোশলায় চুলকাতে শুরু করে সারা গায়ে। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল, সোনালী জুম পুরো মেঘে ঢাকা, যা দেখে মুহূর্তে সকল ঘ্লানি মুছে যাই। চারদিকে পাহাড়ের সমারোহ, মাঝে জুমের রাজ্যে। মেঘের ছুয়ে যাওয়া স্পর্শ শরীরে, এক নতুন শিহরণ দিয়ে যায়। অপরদিকে শূন্য আকাশের বিশালতা সুউচ্চ পাহাড়ে গিয়ে মিশে যাওয়ার দৃশ্য, নিজ চোখে দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়। ডান পাশে, যোগির ৪টা চূড়া খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, পিরামিডের মতো দেখতে আয়ান ক্লাং আর অনেক উঁচুতে জৌ ত্লাং।

বৃষ্টি শেষে, প্রথম রোদের ছোয়া। দলিয়ান পাড়ায়, বিজিবি ক্যাম্প থেকে মদক রেঞ্জ।

জুমঘর ত্যাগ করে, জুমের পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে যেতে থাকি, নিচের দিকে নেমে আসলে “লৌহ ঝিরি” তে যোগির মেইন ট্রেইল, এখান থেকে শুরু। পিচ্ছিল পাথরে পা দিয়ে দিয়ে উপড়ের দিকে উঠে যাচ্ছে, খাড়া ঝিরি দেখে মনে ভয় চলে আসে। বাঁশ গাছ ধরে ধরে কোনোভাবেই উপরে উঠে যাচ্ছিলাম, বড় বড় পাথর বেয়ে নেমে আসছিলো ছোট-বড় ঝড়নার মতো অনেকগুলো ক্যাসকেড। বৃষ্টি মাত্র শেষ হলে, ঝিরির প্রবণতা ধিরে ধিরে কমে আসছিলো। ইতিমধ্যে, জোঁক গুলো রক্ত খেতেই আছে। পিচ্ছিল পাথর থেকে পরে যাওয়ার ভয়ে পায়ে রক্ত খেতে থাকা টাইগার জোঁকের দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। সারা গায়ে একরকম চুলকায় আর লাল হয়ে গেছে শরীর।

এমন ২ ঘন্টার মতো হেটে, আমরা ঘন একটা বাঁশবনে উঠে পরি। চূড়ায় উঠার আগে, এই বাঁশবনটাই আমাদের শরীরের শেষ ক্ষতি করে ছেড়েছে। উপরে হালকা আলো দেখতে পারছিলাম, মনে শুধু একটাই আশা নিয়ে সেই উপরে পৌঁছে যায়৷ একপাশে ঝোপঝাড় আর এক পাশে খোলা জায়গা থেকে বিশাল দানবের মতো দেখতে জৌ ত্লাং এবং আয়ান ক্লাং। রিজ লাইনের পাথর পুরোটায় পিচ্ছিল ছিল, আর ঝোপঝাড়ের পরিমাণ বেশি থাকায় গাছ কেটে কেটে যেতে, আমাদের রিজলাইনেই প্রচুর সময় লেগে গিয়েছিলো।

চূড়া পর্যন্ত আমাদের মোট ৫ ঘন্টা লেগে গিয়েছে। চূড়ায় পৌছে যে দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে, নিজেকে এক অন্য জগতে ভেসে নিয়ে যাওয়ার মতো। আর এতো কষ্টের বিনিময়ে, চূড়ায় উঠে নিজ দেশের পতাকা উওোলন করার অনুভূতি বলেও বুঝিয়ে শেষ করা যাবে না। অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু, সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থাকাতেই হয়তো, বর্ষাকালে এই চূড়ায় যাওয়াটা সম্ভব হয়েছিলো।

চূড়া থেকে “সাকা হাফং“, বাংলাদেশের প্রথম সর্বোচ্চ চূড়ার স্পষ্ট দেখা পেয়ে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়েছিলো। সেই চূড়ায় উঠার অনেক স্বপ্ন বেঁধেছিলাম, কিন্তু ২বার চেষ্টা করেও সেটা সম্ভব করতে পারি নাই। চূড়ার উপর থেকে ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ, একপাশে জৌ ত্লাং-আয়ান ক্লাং, উল্টোদিকে সাকা হাফং আর ইশ্বর মূণীর ৩টা চূড়া কিছুটা মেঘে ঢাকা। একপাশে, ইয়াং বং-কির্স তং-রুঙরাং তং-মরিফা তং আর তার উল্টোদিকে পুরোটা মিয়ানমারের (Labawa), চীন স্টেটের পাহাড়সারি।

যোগি হাফং এর গায়ে সোনালী ত্রিপুয়া জুম।

চূড়া থেকে ফিরে আসার মধ্যপথে, জুমঘরে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলাম। ত্রিপুরা জুম আর কির্স তং চূড়া দেখে দেখে, লবণমরিচ মাখা কাঁচা ভুট্টোর সিদ্ধ খেয়ে, নিজের মনটা জুড়িয়ে নিয়েছি। সারা গায়ে রক্ত, শুকিয়ে গিয়েছিলো আর চুলকানির ক্ষয়িষ্ণতা কমে আসতে থাকে। আকাশের কোনো এক পাশে হালকা রোদের আলো দেখা দিলে, মেঘে আবার ঢেকে যায়। দলিয়ান পাড়ায় ফিরে আসার পথে, রেমাইফা ঝিরিতে নিজের শরীর মনের শান্তিতে ভিজিয়ে নিয়েছি। রাতে আবারো পাহাড়ি খাবার খেয়েই পেট ভোজন করা হয়।

রুট

চট্টগ্রাম – বান্দরবান – থানচি – রেমাক্রি – দলিয়ান পাড়া – যোগি হাফং – দলিয়ান পাড়া – পুঙখোণ পাড়া – ঈশ্বর মূনি পাড়া (ব্যার্থ) – সাকা হাফং (ব্যার্থ) – পুঙখোণ পাড়া – তারংপি সাইতার – নাফাখুম – রেমাক্রি – থাঞ্চি – বান্দরবান – চট্টগ্রাম

খরচ

আমাদের ৩জনের জনপ্রতি খরচ গিয়েছিলো ৪৬০০/-। খুব কম খরচ আর কম সময়ে সবকিছু কমপ্লিট হওয়ার কারন, অযথা কোথাও সময় নষ্ট করতে বাধ্য হয় নাই। আর খুব নিখুঁত ভাবে, যাওয়ার ১০ দিন আগে থেকে হিসাব বানিয়ে রাখা হয়েছে, যদিও জৌ তলাং সহ ৫০০০ টাকা খরচ হওয়ার কথা ছিল।

বর্ষার সময়, থাঞ্চি থেকে রেমাক্রি যাওয়ার বোট খরচ অনেক বেশি বলে। আসা যাওয়া রিজার্ভ, ট্যুরিস্টদের জন্য ৬০০০/-, কখনো আরো বেড়ে যায়। তবে শীতকালে, ৪৫০০/- দিয়ে আর খুব ভোরে লোকাল বোটও পাওয়া যায় জনপ্রতি ৩০০/- নিবে। রেমাক্রি থেকে দলিয়ান পাড়া যাওয়ার জন্য, চাইলে একটা গাইড নিয়ে যাওয়া যাবে এবং দলিয়ান পাড়া থেকে যোগি হাফং অথবা জৌ তলাং এর জন্য গাইড খরচ ১০০০/- নিবে। দলিয়ান পাড়ায় খাওয়া, প্রতি বেলা জনপ্রতি ১৫০/- এবং রাতে থাকা জনপ্রতি ১০০/- নিবে।

যোগি হাফং সহ এমন আরো অনেকগুলো চূড়ায় উঠে যা বুঝেছি, দেশের প্রতিটা সর্বোচ্চ পাহাড়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ, বিজ্ঞতা, ঝুঁকিগ্রহণ, উচ্চতা, উদ্দেশ্য এবং আবর্তন আছে। কোথাও যেতে মনমানসিকতা লাগে, আর কোথাও লাগে কপাল। কঠিন ট্রেকের মধ্য একমাত্র যোগি হাফং চূড়াটার মধ্য পরিচয় দিয়ে থাকে, কারন বান্দরবানে অনুমতি দেওয়া যতোগুলো ট্রেক আছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে কঠিন।

যোগি হাফং চূড়া থেকে “আয়ান ক্লাং” (বামে) এবং জৌ তলাং (ডানে)।

তবে, আমার মতে বান্দরবানের সবচেয়ে কঠিন ট্রেইল হিসেবে “যোগি হাফং” কে গ্রহণ করা উচিত হবে না। চূড়ার মধ্যে, বাংলাদেশের কঠিন ট্রেইল হিসেবে বলা যাবে অন্য আরো কিছু চূড়া, যেমন: নাসাই হুম (Nasai Hum), মদক-৩য় (Mowdok-3rd), লাইস্রা হাফং (Laisra Haphong), মুখরা তুথাই হাফং (Mukhra Thuthai Haphong/৮ম), আলাপা তং (Alapa Taung), তউং মি (Taung Mey) ইত্যাদি। যে চূড়ায় উঠা হয়েছে কম, সেই চূড়ায় যাওয়ার পথ নাই বললেও চলে। খুব বুনো ট্রেইল হয়ে থাকে জঙ্গলে, বাঁশবনে এবং আগাছা বনে। যে চূড়া সম্পর্কে কম চেনা হয়েছে, সেই চূড়ায় খুব কম অভিযানও দেয়া হয়েছে। সুতরাং, সেই চূড়ার ট্রেইল সবচেয়ে দুর্গম এবং কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, নতুন যাত্রীদের জন্য। যদিও এমন জায়গা নিষিদ্ধ করা আছে, তা আমাদের জন্যই ভালো। সেখানে যাওয়ার জন্যও কাউকে অনুপ্রেরণা দেওয়া উচিত হবে না। তবে, অনেকে সেখানে ইলিগ্যালভাবে যায়, পাহাড় চূড়া জয় করার সন্তুষ্টি মিঠানোর জন্য৷

ঘুরাঘুরি করি আমার নিজের পৈশাচিক আনন্দে। সহজলভ্য জাতের ট্রেইল গুলোকেই বিশেষ করে পছন্দ করি, যেটা দ্বারা আমার ব্যাক্তিগত জীবন অপেক্ষা নিজের দেশের ক্ষতি করবে না। কেউ পাহাড়ে ঘুরতে ভালোবাসে, কেউ সমুদ্রে। ভ্রমণে কেউ দুর্গম পথে হাটতে পছন্দ করে, আর কেউ মজা করতে। এমনো আছে, কেউ ২/৩ দিনের বেশি সফর পছন্দ করে না। আবার কেউ কেউ ১০ দিনের চেয়েও আরো বেশি সময়ের সফর পছন্দ করে। পাহাড়ের প্রতি ভালোবাসা? কারো প্রতি জেদ? নিজের ব্যার্থতায় হাহাকার? নাকি প্রতিযোগিতার মনোভাবে এভাবে ঘুরি? আমি ঠিক তা জানিনা কেন ঘুরি। কিন্তু একটা ব্যাপার সঠিক, আমি প্রায় সবগুলোর কারন সম্মুখীন হয়েছি।

সবার চোখে ঘুরাঘুরির জগৎ একরকম নয়। ট্রেকিং আর ট্রাভেলিং, ২টায় ভিন্ন। যত্রতত্র জায়গায় ময়লা না ফেলে, নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে, সর্বোপরি সবার সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় বাংলাদেশের এসব জায়গার যোগ্যতা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা সম্ভব।

Leave a Comment
Share