হতংকুচো (Hatangkucho) – মাতাইতুয়ারি (Mataituari) এই দুই জায়গার নাম মুখে মুখে অনেকবার শুনেছি, পরিচিত না হওয়ার কারণে এই যায়গা সম্পর্কে তেমন কোন লেখাও পাইনি। যা শুনেছি ভ্রমনপ্রিয় দুই-একজন বন্ধুর কাছ থেকেই শুনেছি। এ ট্রেইল সম্পর্কে গুগুলে দুই একটা ছবি আর একটা লেখা ছাড়া তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। প্রায় সবার কাছে অপরিচিত এই ট্রেইল। এখানে এখনও তেমন পর্যটকের পা পড়েনি। তবে এই হতংকুচো (Hotongkucho) মাতাইতুয়ারী ট্রাভেলারদের কাছে তেমন পরিচিতি না পেলেও বর্তমানে এটি আস্তে আস্তে পরিচিতি পাচ্ছে। মূলত ফেইসবুক গ্রুপ Adventure Madness এর মাধ্যমেই হতংকুচো-মাতাই তুয়ারি (Matai Tuari) মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। গত ১৭ই সেপ্টেম্বরে এক আড্ডায় হতংকুচোর নাম উঠে আসে, তারা আবার গ্রুপ নিয়ে যাবে! এর আগে তাঁরা গ্রুপ নিয়ে হতংকুচো তিনবার গিয়েছে। এরা ছাড়া আর কোন গ্রুপ এখানে যায় নি!
আমি এ্যাডভেঞ্চার প্রেমী মানুষ, সময় সুযোগ পেলে এই গ্রুপের সাথে বেরিয়ে পড়ি। কোন কিছু না ভেবেই ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম। ২০শে সেপ্টেম্বর রাতের বাসে রওনা হলাম। আমরা ছিলাম ৯জন বাকি পুরো বাস ছিল সাজেকের যাত্রী! দুই গ্রুপ মিলে সারা রাত আড্ডা, গান আর মাস্তি হয়েছে। রাতে আর তেমন ঘুম হয়নি। বাস চলছে পাহাড়ি পথ ধরে, সূর্য এই উঠি উঠি করছে। খাগড়াছড়ি-বান্দরবান গেলে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
সকাল ৭ টা নাগাদ আমরা খাগড়াছড়ি শহরে পৌছাই, নাস্তা করে কিছু ড্রাই’ফুড আর প্রত্যেকের জন্য ১.৫ থেকে ২ লিটার করে পানি নিলাম। সবাই চাঁন্দের গাড়ির ছাদে বসে আছে আর গাড়ি ছুটেছে নুনছড়ি থলিপাড়ার উদ্দেশ্যে। হতংকুচো মাতাইতুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলার নুনছড়িতে অবস্থিত। শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ। সবার মধ্যেই ব্যাপক এক্সাইটমেনট কাজ করছে! গাড়ি থেকে নেমে গ্রুপের পূর্ব পরিচিত এক উপজাতির বাসায় আমাদের অতিরিক্ত কাপড়চোপড়সহ অন্যান্য জিনিসপত্র রাখি। এখানকার সবাই খুব ভাল আর মিশুক। এরা এখনো টাকা চিনে নাই। ধান্ধা শিখে নাই। শুধু বাংলা বোঝে না। খুবই সামান্য বুঝে। এরা ট্রাভেলারদের সাথে খুব ফ্রেন্ডলি কথা বলে। যাই হোক, প্রায় অপরিচিত এই ট্রেইল বা ঝিরিপথ যেমন দুর্গম তেমনি অসাধারণ।
আমরা দুপরে খাওয়ার ড্রাই ফুড আর মোবাইল মানিব্যাগ ব্যাগে ভরে রওনা দেই দেবতা পুকুরের উদ্দেশ্যে। দেবতা পুকুর বা মাতাইতুয়ারি এখানকার ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান, আর এই দেবতা পুকুরে সিঁড়ী পথে যেতে হয়! তার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে ১৭৭৬ টি সিঁড়ি! জি, সতেরশো ছিয়াত্তরটি সিঁড়ি। ১৩০০+ পর্যন্ত গুনতে পেরেছিলাম। গল্প আর পাহাড় দেখতে দেখতে অবশেষে দেখা পেলাম দেবতা পুকুরের। মাঝে পাঁচ সাত মিনিট করে দুইবার বিশ্রাম নিয়েছি। পরবর্তী লেভেল হল মাতাইতুয়ারি ঝর্ণা!
ট্রেকিং মূলত এই দেবতা পুকর থেকে শুরু। পুকুরের ডানপাশ দিয়ে শুরু করে উঁচুনিচু গিরিপথ, ঝিরিপ, পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পুকুরের বাম পাশ দিয়ে নামতে হয়। অতি অখ্যাত পাহাড়ি সুঁড়িপথ বেয়ে শুরু হল আমাদের অভিযান।
Adventure Madness এর পূর্ব পরিচিত গাইড আছে আমাদের সাথে। গাইড ছাড়া এপথ ট্রেইল পাড়ি দেওয়া অসম্ভব! দক্ষ ও স্থানিয় গাইডের মাধ্যমে এই ট্রেইল/ঝিরিপথ পাড়ি দিতে হয়, তা নয়ত এখানে পথ হারাবেন নিশ্চিত, ধৈর্য এবং সাবধানতা এই ট্রেইলের মূলমন্ত্র! এ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর এই ট্রেইলে সামান্য অসাবধানতা হলে ঘটতে পারে বড় কোন দুর্ঘটনা।
প্রকৃতির নির্জনতা যাদের পছন্দ অথবা Wildlife Photography যাদের প্যাশন এই ট্রেইল তাদের জন্য আদর্শ। এখানে শুধু প্রকৃতি, প্রকৃতি আর প্রকৃতি। রাস্তার দুপাশে ঘন রহস্যময়ী বন, সেই বনের মধ্যে দিয়ে কখনো উঠে গেছে সিঁড়ি আবার কখনো নিতান্ত অবহেলা পায়ে তৈরি হওয়া সুঁড়িপথ।কয়েক ঘণ্টা জনমনুষ্যহীন পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে আর অচেনা অজানা পাখ-পাখালীর গান শুনতে শুনতে কখনো আবিষ্কার করলাম পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট হ্যামলেট তো কখনোও দেখা পেলাম গভীর বনের মধ্যে পাহাড়ি ঝোরার।
এর মাঝে কতবার যে বিশ্রাম নিয়েছি তার কোন হিসেব নেই। বেশ কয়েকটা পাহাড় পাড়ি দেয়ার পর অবশেষে একটা পাড়ায় সবাই বসলাম। পাড়ার এক বাড়ি থেকে পানির ব্যাবস্থা হল, এডমিন সবার জন্য কটকটি নিয়ে এসেছে। সবাই বেশ গা’ এলিয়ে কটকটি খাচ্ছে! সূর্য ঠিক মাথার উপর, তারপরও কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টা হল। এখানে একটু লম্বা সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। পাহাড়ের একদম উপড়ে ওঠার লোভটা এডমিন দেখালেন এবং কেউ- ঝর্ণা আর কত দূর জানতে চাইলে বলছে… ঝর্ণা আর বেশি দূরে না!
ঐ যে পাহাড় দেখছেন ঐটার পরেই ঝর্ণা। কিন্তু পাহাড় আর শেষই হয় না। পাহাড়ে ওঠা যেমন কষ্ট তেমনি নামার সময় মাঝে মাঝে ভয়ংকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। কিছু কিছু যায়গায় খাড়া রাস্তা নেমে গেছে, ঐসব যায়গা খুব সাবধানে নামতে হয়।
একপর্যায়ে মনে হল আমরা বেশ সমতল একটা জায়গা দিয়ে হাঁটছি। এর কিছুক্ষণ পর গ্রুপের কামরুল ভাই বললেন – পানির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন? সবাই হাঁটা বন্ধ করে দিল, ঝর্ণার স্পষ্ট আওয়াজ কানে আসতে লাগল। ঝর্ণার আওয়াজ সবার মধ্যে বেশ উৎফুল্ল ভাব চলে আসছে। সবার উদ্দীপনা বেড়ে গেল হাঁটার স্পীড দ্বিগুণ হল! তার ১০মিনিট পর দেখা পেলাম মাতাই তুয়ারী ঝর্ণার।
দেরি না করে সবাই ঝাপাঝাপি শুরু করে দিলাম, যারা সাঁতার যানি আর যারা যানি না সবাই-ই নেমে পড়লাম। ঝর্ণাটা বেশ আকর্ষণীয়, সামান্য দু-একটা কোনা ছাড়া তেমন পিচ্ছিল নেই। তারপরও সাবধান থাকা উচিৎ! ঝর্ণার খাঁজে বসা যায়, যেখানে বসে ঝর্ণার সাথে অনেক সময় কাটানো যায়… ঝর্ণার পানি যেমন ঠাণ্ডা তেমন স্বচ্ছ। এই মাতাইতুয়ারি ঝর্ণাটি এখানকার বাসিন্দাদের নিকট অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাঁদের মতে মাতাই মানে হল দেবতা আর তুয়ারী মানে ঝর্ণা!! এর মানে যাই হোক… এই মাতাই তুয়ারীতে তারা পূজা দেয়, তাদের বিশ্বাস এই ঝর্ণা তাদের জন্য আশীর্বাদ। ফেরার পথে আমরা সেখান থেকে খাওয়ার জন্য বোতল ভরে পানি নিয়েছি।কারণ ট্র্যাকিং শেষ হতে এখনও অনেকটুকু পথ বাকী। ঘণ্টাখানেক ঝাপাঝাপি করার পর সবাই স্থির হয়ে কিছু ছবি তুল্লাম। হাল্কা পাতলা খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। মাথা মুছে ভেজা কাপড়েই সবাই হাঁটছি। কারণ সামনে শুধু পাথর আর পানিপথ। দুই পাহাড়ের মাঝে বড় বড় পাথর আর ঠান্ডা পানি! মাঝে মাঝে মনের মধ্যে ভয়ের পাশাপাশি এক প্রকার অনন্দের সূর বেজে ওঠে। পানির নিচে বড় বড় পাথর, কোথাও হাটু পানি কোথাও বা বুক পানি আবার কোথাও সাঁতরে পার হতে হয়।
পানির নিচে পাথর থাকার কারণে খুব সাবধানতার সাথে পা ফেলতে হয়, অসাবধান হয়ে পা দিলেই পড়ে যেতে হবে এবং যেন তেন ভাবে নয় খুব মারাত্মক ভাবে। এখান থেকে বের হওয়ার সহজ কোন রাস্তা নেই, হয় পাহাড় চড়তে হবে, না হলে এই গিরিপথ পাড়ি দিতে হবে। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথর সামনে পড়ছে। যেগুলো পার হতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এই দুর্গম জায়গা পাড়ি দেয়ার জন্য অসম্ভব মানসিক শক্তির প্রয়োজন, বিশেষ করে যারা সাঁতার জানেন না তাদের বেশ ভয়ঙ্কর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। ট্রেকিং যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে এই জায়গার সম্পূর্ণ স্বাদ আপনিই পাবেন! লেখা পড়ে যতটা না কঠিন ভাবছেন এই গিরিপথ তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। নিচের ভিডিও লিঙ্কে গেলে ট্রেইলের ১৫% ট্রেকিং দেখতে পারবেন।
একসময় গিরিপথ শেষ হলে আবার সমতল ঝিরিপথ শুরু হয়েছে তখন মোটামুটি বিকাল হয়ে গেছে। শেষবার সামান্য বিশ্রাম নিয়ে সবাই চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফের হাঁটা আরম্ভ করলাম। এর মধ্যে দুইবার বৃষ্টি হল, বৃষ্টির কারণে লাল মাটির পাহাড়ি পথ একদম পিচ্ছিল হয়ে গেল! ফলে পাহাড় থেকে নামার পথে সবাই-ই স্লিপ খেয়েছি।
এরপর কয়েকটা পাহাড় পাড়ি দেয়ার পর দূর থেকে সেই দেবতা পুকুর চোখে পড়ল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এল। সন্ধার আলোয় পুকুরে গোসল করে ক্লান্ত শরীরে খাগড়াছড়ি সহরে পৌঁছাই।
ঢাকা থেকে অনেক কোম্পানির বাস খাগড়াছড়ি যায় ভাড়া কম বেশি ৫২০ টাকা। খাগড়াছড়ি শহর থেকে চাঁন্দের গাড়ী বা সি এন জি পাবেন নুনছড়ি থলিপাড়া যেতে। চাঁন্দের গাড়ী সর্বোত্তম। তারপর পায়ের উপরেই নির্ভরশীলতা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা ট্রেইল তাই আপনার ফেলে আসা চিপসের খোসা যেন সেখানকার পরিবেশ নষ্ট না করে সে দিকে খেয়াল রাখবেন।
দেবতা পুকুর এখানকার ধর্মীয় জায়গা তাই এখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরিত থাকবেন। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ বাংলা বোঝে না তাই বাংলা বোঝে এবং এই গিরিপথে আগে গিয়েছে এমন গাইড নিবেন। অনুমতি ছাড়া স্থানীয় কারো ছবি তুলবেন না, অবশ্যই ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ/পলিথিন নিয়ে যাবেন। দুপুরে ফিরে আসা সম্ভব নয় তাই সাথে ড্রাই ফুড ও পানি নিবেন তবে এখানে আপনি দুটাকা দরে ফরমালিন মুক্ত পাহাড়ি কলা কিনতে পারবেন। মাতাই তুয়ারীতে তারা পূজা দেয় তাই তার ধর্মীয় ভাব বজায় রাখুন।
সব শেষে…
কম্পিউটার মোবাইল ফেসবুক ইন্টারনেট ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য প্রকৃতির সাথে কাটিয়ে আসেন। ভ্রমণের সময়টুকু শুধুমাত্র নিজের জন্য রাখুন, ভালো হয় সঙ্গে কাউকে না নিলে। স্থির হয়ে বসুন, দেখুন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে, উপভোগ করুন চারপাশের নির্জনতা। এই নির্জনতা আপনাকে স্থির ও চিন্তায় কেন্দ্রবিন্দু হতে সাহায্য করবে। বেরিয়ে যান এবং নিজেকে আবিষ্কার করুন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজনের সাথে, সে হলো আপনি নিজেই।
Leave a Comment