The trekking trail from Viswema side - once the stairs ended
বিগত কয়েক বছর ধরে নাগাল্যান্ডের জুকু ভ্যালী (Dzukou Valley) ট্রেক রুটটি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। আর করবে নাই বা কেন, ঘরের কাছে এমন চোখ ধাধানো সবুজের সমারোহ থাকলে পাহাড়প্রেমীরা তো ভিড় জমাবেই! তবে কোহিমা থেকে জুকু পৌছাবেন কি করে, থাকবেন কোথায়, খরচ কেমন এই নিয়ে বেশ কিছু কনফিউশন রয়েছে; আর ঠিক সেই কারণে এই লেখাটি।
প্রথমত, জুকু ভ্যালী একটি ছোট ও তুলনামূলকভাবে সহজ ট্রেক। একদিন ভ্যালি পৌছাতে আর একদিন ভ্যালি থেকে নামতে লাগে। আর এই ট্রেকটি করতে ট্রেক এজেন্সির স্বরনাপন্ন হওয়ার কোনো মানেই হয় না। একটু কষ্ট করে Google করলে বা আদার ব্যাপারীতে জুকু ভ্যালির ওপর পোস্ট দেখলেই দিব্বি নিজে প্ল্যান করে চলে যাওয়া যায়। আর রইলো বাকি কনফিউশনগুলো, আশাকরি সেগুলো এই পোস্ট পড়লে ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
আমরা ৩ জন মিলে এই ট্রেকটা করি। মাথাপিছু কলকাতা থেকে কলকাতা খরচ ১২০০০ (ফ্লাইট এবং 3AC ট্রেন ভাড়া নিয়ে) । সময় ৭ দিন।
নাগাল্যান্ড (Nagaland) ভ্রমন বা জুকু ভ্যালী ট্রেক করতে ILP or Inner Line Permit বাধ্যতামূলক। এই পারমিট যে কেউ খুব সহজে কোলকাতার নাগাল্যান্ড হাউস থেকে ৫০.০০/পারমিট এর বিনিময় করিয়ে নিতে পারেন। সাথে ভোটার বা আধার কার্ডের দুটো কপি নিয়ে গেলেই হয়ে যায়। Google করে কলকাতায় নাগাল্যান্ড হাউসের লোকেশন দেখে নিতে পারেন।
ডিনার-নাইটস্টে-ব্রেকফাস্ট নিয়ে মাথা পিছু ৮০০ টাকা খরচ/দিন। পিক সিজনে খরচ কত হয় জানা নেই। হোমস্টে বুক করতে রভি দিদি বা আকিনো দিদি কে ফোন করতে হবে। Dawn Homestay, Kigwema লিখে Google করলে কন্ট্যাক্ট নম্বর পেয়ে যাবেন।
কলকাতা থেকে ট্রেনে ডিমাপুর অথবা ফ্লাইটে কলকাতা থেকে ডাইরেক্ট ডিমাপুর বা গৌহাটি হয়ে ডিমাপুর পৌছে যাওয়া যায় অনায়াসেই। ডিমাপুরে নেমে সোজা চলে যান ডিমাপুর স্টেশন সংলগ্ন শেয়ার ট্যাক্সি বুথে যেখানে মাথাপিছু ৩০০ টাকায় শেয়ার গাড়ি আপনাকে নিয়ে যাবে সোজা কোহিমা AOC স্ট্যান্ড।
শেয়ার গাড়ি থেকে নেমে একটু দূরে পরের শেয়ার গাড়ির স্ট্যান্ড মাঝের এই অল্প দূরত্বের জন্য ১০ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে অনায়াসেই চলে যাওয়া সম্ভব BOC স্ট্যান্ড। এই স্ট্যান্ড থেকে আবার শেয়ার গাড়িতে, ৫০ টাকা মাথাপিছু দিয়ে পৌছে যাওয়া যায় কিগ্বেমার ডন হোমস্টের সামনে। এই শেয়ার গাড়ি আপনাকে ভিস্বেমা গ্রাম অব্দিও নিয়ে যেতে পারে; তবে ভিস্বেমা গ্রামে সেরকম থাকার ব্যবস্থা চোখে পরে নি, বা থাকলেও হয়তো আমি দেখতে পাইনি। সেক্ষেত্রে কিগ্বেমার Dawn Homestay আদর্শ।
দিন ১: কলকাতা থেকে দুপুরের ফ্লাইটে গৌহাটি – তারপর রাত ১১.৩০ টার নাগাল্যান্ড এক্সপ্রেস ধরে পরদিন ভোর ৫টায় ডিমাপুর পৌছানো।
দিন ২: ডিমাপুর স্টেশনের সংলগ্ন শেয়ার ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ৩০০ টাকা মাথাপিছু ভাড়ায় সোজা কোহিমার AOC স্ট্যান্ড; সময় লাগে ৩.৩০ থেকে ৪ ঘন্টা। রাস্তার অবস্থা অনেক জায়গায়ই ভালো নয়। AOC থেকে ১০ টাকা মাথাপিছু ভাড়ায় বাস ধরে BOC স্ট্যান্ড; যেখান থেকে কিগ্বেমা বা ভিস্বেমা যাওয়ার শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। সময় ১০ মিনিট। তারপর সেখান থেকে মাথাপিছু ৫০ টাকায় শেয়ার গাড়িতে কিগ্বেমার ডন হোমস্টে।
অনবদ্য আতিথেয়তা উপভোগ করে ব্যাগপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে চিকেন আর পর্ক দিয়ে লাঞ্চ সেরে হোমস্টের পাশের জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে চড়াই ভেঙ্গে পৌছে যাওয়া কিসামা হেরিটেজ ভিলেজ। সাথে অসম্ভব সুন্দর কিছু ভিউ পয়েন্ট উপরি পাওনা। এয়ারটেলের হাইস্পিড নেটে গুগল ম্যাপ দেখে মেন রাস্তা ধরে সন্ধ্যে ৫.৩০ টা নাগাদ ফিরে আসা আবার হোমস্টেতে। কাঠের আগুনে সুস্বাদু রান্না দিয়ে ডিনার সেরে পরের দিনের রিজার্ভ গাড়ি বলে (২০০০) সোজা কম্বলের তলায়।
দিন ৩: সকাল ৭.৩০ টায় রিজার্ভ সুমো নিয়ে ৮.৩০ তে ভিস্বেমা ট্রেক স্টার্টিং পয়েন্টে নেমে হাটা শুরু। কম-বেশি এক ঘন্টায় চড়াই সিড়ি ভেঙ্গে এবং অজস্রবার রাস্তায় ছবি তুলতে এবং ভিউ দেখতে দাড়িয়ে জুকু টপের ট্রেকার্স হাটে পৌছানো বেলা ১২.৩০ টায়। ট্রেলের এবং ভ্যালীর সৌন্দর্য নিয়ে লিখতে গেলে আলাদা আরেকটা লেখা হয়ে যাবে।
সেইদিন রাত অব্দি নিজেদের নিয়ে যাওয়া খাবার দাবার দিয়ে পেট ভরিয়ে, সন্ধ্যে ৬ টায় ট্রেকার্স হাটের কিচেনে ডাল-ভাত-আলুসব্জি-আচার-পাপড় সহযোগে ২০০ টাকায় ডিনার সারা।
দিন ৪: ভোরবেলায় উঠে ছবি তোলা পর্ব সাঙ্গ করে, ভ্যালিতে নামা এবং সারাদিনটা ভ্যালিতে কাটিয়ে, বিকেলে ফিরে আসা ট্রেকার্স হাটে। তারপর, তিব্বত থেকে আসা তেনজিং, সিঙ্গাপুর থেকে আসা ভিক্টর, বাংলাদেশের সোহেল আর জার্মানি থেকে আসা সাব্রিনা, সবার সাথে আড্ডা-গল্পে, অন্ধকারে চাঁদের আলোয় ডিনার সারা আর রাত ১২ টা অব্দি জেগে জেগে ভূতের গল্প করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়া।
দিন ৫: হাতে এইদিনটা অতিরিক্ত থাকায়, এই দিনটাও আমরা জুকু-তে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তবে ভ্যালিতে নামার বদলে, ট্রেকার্স হাটের পিছনদিকে ওয়াচ টাওয়ার অব্দি ট্রেক করি। এখান থেকে সমস্ত জুকু ভ্যালির ভিউ অসাধারণ। দুপুর অব্দি ওখানে কাটিয়ে আবার ফিরে আসা ট্রেকার্স হাটে। তারপর পড়ন্ত বিকেলের কমলা আলোয় চোখভরে দেখে নেওয়া জুকু ভ্যালিকে। কখনো বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ায় তো কখনো চাঁদের আলোয় মেঘেদের মাঝে ডুবে থাকা জুকু ভ্যালী তখন স্বর্গ দেখার থেকে কিছু কম না। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে চলেছে Wind of Change
দিন ৬: এইদিন ভোরবেলা ৬.৩০ তে ট্রেকার্স হাট থেকে রওনা হয়ে, ভিস্বেমা ট্রেক রুট ধরে ১০ টা নাগাদ পৌছে গেলাম ভিস্বেমা ট্রেক স্টার্টিং পয়েন্টে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাটতে হলেও, অভিজ্ঞতা মন্দ না। বরং ফিরে আসার আগে জুকু ভ্যালীর আরো ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠা। যেটুকু জোঁক বাবাজির দর্শন পেয়েছি সেটা ওই একঘন্টার সিড়ি নামার পর্বে। ফোনে টাওয়ার পেয়ে ডন হোমস্টের রবি দিদিকে গাড়ি পাঠাতে বলায়, ট্রেক স্টার্টিং পয়েন্টে চলে আসে রিজার্ভ গাড়ি।
রিজার্ভ গাড়ি নিলে খরচটা অবশ্যই বেশি হয়ে যায়। রিজার্ভ গাড়ি না নিলে, ওখানে কারো সাথে শেয়ার যাওয়া অথবা আরো কয়েক কিলোমিটার হেটে এসে ভিস্বেমা গ্রামে মেন রাস্তা থেকে লিফ্ট অথবা শেয়ার গাড়ি নেওয়া যায়।
প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে একঘন্টায় হোমস্টে পৌছে ওখানে স্নান লাঞ্চ সেরে ক্যামেরা এবং হোমস্টের ছাতাগুলো বগলদাবা করে দুপুর ৩ টে নাগাদ রবিদিদির সাথে তার গ্রাম দেখতে বেরিয়ে পড়া। রবিদিদির বাড়ির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে, ওদের খেতের প্লাম আর পীচ গাছ থেকে ফল নিয়ে, নাগাল্যান্ডের বিখ্যাত প্যাডি ফিল্ড ঘুরে, জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম যখন ঘড়িতে তখন ৬ টা বাজে। হোমস্টেতে ফিরে আবার খাবার দাবারে মনোযোগ দেওয়ার সাথে সাথে চলল এক ফেলো ট্রেকারের জাখামা ট্রেল দিয়ে ফেরার পথে হারিয়ে যাওয়ার রোমহর্ষক গল্প।
দিন ৭: ফেরার পথে সবাইকে আলস্য় গ্রাস করায়, হোমস্টে থেকে রিজার্ভ গাড়ি (২৩০০ টাকা) নিয়ে নেওয়া হয় ডিমাপুর স্টেশনের জন্য। লাঞ্চ করে, ২.৩০ তে নাগাদ রওনা দেওয়ায় রাস্তায় খাবারের জন্য থামতে হয়নি। তবে কেনাকাটার জন্য হল্ট করেছিলাম। আর রাস্তার কাজের জন্য প্রায় একঘন্টার বেশী গাড়ি দাড়িয়ে ছিল। রাত ৮ টা নাগাদ পৌছে গেলাম ডিমাপুর স্টেশন ডিনার সারা হলো স্টেশনের ১ নম্বর প্লাটফর্মের ওপর IRCTC-র Food Track-এ। ওই চত্বরে লাঞ্চ বা ডিনার সারার জন্য এটাই বেস্ট জায়গা। খাবারের স্বাদ ও মান দুইই ভালো।
তারপর পরদিন কলকাতা ফেরাটা একই ভাবে, যেভাবে ডিমাপুর পৌছেছিলাম।
উল্লেখ্য, আমাদের হাতে সময় ছিল, একটা সপ্তাহ কাটাবার ছিল, তাই জুকু ভ্যালী ট্রেকটা সবমিলিয়ে ৭ দিনের ছিল। কিন্তু চাইলে এই ট্রেকটা ডিমাপুর থেকে ডিমাপুর ৩ -৪ দিনেও করা যায়। আমাদের সাথে কোনো গাইড ছিল না। শুধু জুকু পৌছানোর সময় এক বন্ধুর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার ব্যাগ নেওয়ার জন্য একজন পোর্টার ছিল। ফেরার দিন আমরা ৩ জনেই নেমেছি কোনো গাইড পোর্টার ছাড়া।
তবে আমরা যে ভ্যালীতে এতোদিন কাটালাম, তাতে কোনো আফসোস নেই। বরং, আবার কোনোদিন সুযোগ হলে আবার এইভাবে কাটিয়ে আসবো কটা দিন। আমাদের জাখামা ট্রেল দিয়ে নামা হয়নি যেহেতু টিমের একজনের কিছু হেলথ ইসুস ছিল। ভিস্বেমার থেকে জাখামা ট্রেলটা বেশ ডিফিকাল্ট। অনেকেই ওই রুটে পথ হারায়। ওই রুট দিয়ে জুকু পৌছাতে হলে এক নাগারে চড়াই ভাঙ্গতে হবে, সাথে অ্যাডভেঞ্চার ফ্রি। শুধু মাত্র ওই ট্রেলটা এক্সপিরিয়েন্স করার জন্য, আবার কোনোসময় পৌছে যাব জুকু ভ্যালী।
ট্রেকের সময়কালঃ জুন, ২০১৯
Leave a Comment