ডুয়ার্স ভ্রমণ ২০১৬

কোচবিহারের দেশী মদের সাথে লোকাল দেশী মুরগির লঙ্কাবাটা কষানো রাখাটা অত্যাবশ্যক। তবে কেউ কি জানতেন – সাথে ক্ষীণা জয়ন্তীর স্রোতস্বর আর সন্ধে নেমে আসা নেপালী বস্তি থেকে ভেসে আসা গান থাকলে স্বর্গের ঠিকানা খুঁজে বেড়ানোর দরকার পড়ে না! আমি তো জানতাম না।

গোড়া থেকেই শুরু করা যাক তবে। দুমাস গাধার খাটুনি খেটে থিসিস নামানোর পর শরীর -মন যখন শুধু বিশ্রাম চাইছে, শ্রীমতীর উৎসাহ ও উদ্যোগের সম্মানরক্ষার্থে ডুয়ার্স (Dooars) এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া গেল।

বক্সা জঙ্গল থেকে শুরু হলো বেড়ানো। রসিকবিল নামে যে বাঁওড়টি বিরাজ করে বক্সায়, তার রক্ষনাবেক্ষনের অবস্থা খুবই খারাপ। উন্মুক্ত মাঠে মদ্যপান, নেশাভাঙ, স্থানীয় যুবকদের দাপাদাপি, কমতি নেই কিছুরই। মন ভালো হয়ে যায় শুধু এক ঘন্টার নৌকো সফরটি করলে। পান্নারঙা জলে সেখানে আকাশের রঙ মিশে আছে সর্পিল নৌপথে। শেষ বিকেলের সূর্যটি তাকে দিয়ে যাচ্ছিলো মনখারাপের দীপ্তি। বিলের ধারে ধারে সোঁদা মাটির উপর ঘর করেছে বুনো লতার দল। তারই পাশে নিভৃতযাপনে ব্যস্ত ছিল একজোড়া সারস। আমাদের দেখে তারা অবাক হয়ে উড়ে গেলো দূরে, যেখানে আমাদের দৃষ্টি পৌঁছবেনা কখনো।

পরদিন নিয়মমাফিক কোচবিহার রাজবাড়ী ও ন্যাচারাল জু দর্শন। খাঁচার ভিতর ময়ূর, পাইথন ও লেপার্ড দর্শনের রুটিন সারার পর যে অদ্ভূত জিনিসটি আমাদের অবাক করলো তা হলো ঘড়িয়াল দর্শন। শ্রীমতীর ক্যামেরায় পোজ দেওয়ার জন্যেই যেন তিনি উঠে এলেন – ভেসে থাকলেন নাক চোখ বের করে, আবার ছবি তোলা শেষ হতেই – ভ্যানিশ।

অতঃপর জয়ন্তী। দ্যাবাদেবীতে হাঁচোড় পাঁচোড় করে ৩০০ মিটার খাড়াই পুখরিলেকে ওঠার পর একরাশ নৈঃশব্দ্য এসে দুজনকে ঘিরে ধরলো। পাহাড়ের উপর সেগুন আর গুলঞ্চলতায় ঢাকা একখানি স্বচ্ছ জলাশয়। তার সবুজ রঙে চোখের মণির ছায়া দেখা যায়। গাইড বলছিলেন বারোমাস জল থাকে এই ঝিলে। বুদ্ধপূর্ণিমার দিন পুজো হয়। চারপাশে গোটা দুয়েক শিবের থান। সভ্যতার যন্ত্রহৃদয়ের লাবডুব থেকে অনন্তযোজন দূরে এই পুণ্যস্থানে মুগ্ধতার সাথে মিশে থাকা উপাসনার ভাব – অনন্ত অখন্ড সেই ভারতাত্মার এক অপরূপ আশীর্বানী উচ্চারণ করছিলো। যেখানে বুড়োশিবের খান হয়ে ওঠে শাক্যসিংহের অর্চনাবেদী, যেখানে তিব্বতী মন্ত্রোদ্ধৃত ধ্বজ উড়তে থাকে কোচবাংলার ব্রতপাঠের সুরে, সেখানেই পূর্বের শতসহস্র চন্দ্রোদয়ের মতো আজও পূর্ণিমায় ধাত্রীপ্রকৃতি শৃঙ্গার করেন পুখরির কাকচক্ষু জলে, সেজে ওঠেন অপরূপা হয়ে।

জয়ন্তীর জঙ্গল সাফারি আরেক অভিজ্ঞতা। জলদাপাড়া, গোরুমারার মতো টুরিস্ট ভারাক্রান্ত নয় বরং সভ্যতাপীড়িত মাটির আর্তনাদ থেকে বহু দূরে, এই অনিন্দ্যসুন্দর বনানীর অস্তিত্বটি ধরিত্রীর ক্ষতে একখানি মোলায়েম প্রলেপের মতো বিস্তৃত রয়েছে । বনপথের গভীরে সিট্রোনেলা, নাম না জানা ফার্ন আর অসংখ্য অর্কিড আলোকপ্রত্যাশী হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অপেক্ষায়। শাল আর সেগুনের চূড়ায় চূড়ায় তাদের আদরের উজ্জ্বল রোদ পথ হারিয়েছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা মাদকতা আছে। একটা অতল আহ্বান রয়েছে-যাতে সর্বস্ব সমর্পন করে দেওয়া যায়। উচ্চকিত ঝিল্লীরব , শুকনো পাতার আলতো মচমচ আর বুনো বাঁশের জঙ্গলে পথ হারানো শিরশিরে বাতাসের ফিসফিস ছাড়া সে নৈঃশব্দ্যও কিন্তু অসম্পূর্ণ। অলৌকিক সেই দুপুরে আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম অনন্তের উপস্থিতি, স্পর্শ করছিলাম পূর্ণতার এক মুহূর্ত। না, জয়ন্তীর জঙ্গলে কোনো পশু আমরা দেখিনি। ভালোই হয়েছে। মায়াবী প্রকৃতির প্রকৃত সন্তান যে জীবজগৎ, তাদের মায়ের কোলে দেখার মতো শুদ্ধতা আমাদের দৃষ্টি বহুদিন হারিয়েছে।

তারপর স্বর্গ। অর্থাৎ জয়ন্তী নদীর কোলের হোমস্টে তে পদার্পণ। শিয়রে সবুজ পাহাড়ের মুকুট সাজিয়ে ক্ষীণস্রোতা জয়ন্তী বয়ে চলেছে অবিচল। উপলাকীর্ণ বিস্তৃত নদীশয্যার শরীরে শীর্ণ অথচ সতেজ একটি ধমনীর মতোই তার চলাচল। সুন্দরী জয়ন্তীর সৌন্দর্য্যাস্বাদনের প্রকৃত সময় কিন্তু সূর্যাস্তের পর। যখন শেষ সূর্যরশ্মিটি বিদায় নেবে দূর পাহাড়ের চূড়াথেকে , যখন চাঁদের আলোয় নদীশয্যাটি স্নাত হয়ে নেবে রাতযাপনের আগে, যখন অপরিমেয় এক নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে জয়ন্তীর স্রোত ছুটে যাবে মাতালের মতো অনির্দেশ, ঠিক তখন। ঠিক তখন আমাদের সামনে থাকবে কেয়ারটেকার সূর্য তামাংয়ের বাড়ির তৈরী দিশি কোচ মদ আর লোকাল দিশি মুরগির লঙ্কাবাটা কষানো।ঠিক তখন নদীর দিক থেকে দমকা একটা পাগলা হাওয়া আসবে আর সামনের নিস্পত্র গাছটিকে দুলিয়ে দিয়ে এসে শ্রীমতীর অবাধ্য চুলগুলোকে দামাল করবে। ঠিক তখন পিছনের নেপালি বস্তির চত্বরে আগুনের চারধারে শুরু হবে গান। ঠিক তখন আকাশ আমাদের আরও কাছাকাছি চলে আসবে। ঠিক তক্ষুনি আমরা পেয়ে যাবো স্বর্গের ঠিকানা।

ফেরার পথে জলদাপাড়া ও নিয়মমাফিক হাতি, গন্ডার, বাইসন দর্শনশেষে যখন বাগডোগরা ফিরছিলাম, নিজেদের বড়ো অসহায়, বড়ো উদ্বাস্তু মনে হচ্ছিলো।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ dooarsindia