জানুয়ারী মাসে পাহাড়ে পর্যটক ভিড় একটু কম থাকে, তাই গাড়ি, হোটেল এর দাম অনেকটাই কম হয়। আমরা কিন্তু প্রতি বছর শীতকলে এই পাহাড়ের কাছে আসি।
আমার কাছে শীতকাল মানে পায়ে চাকা বাধা। শীতকাল মানে পাহাড়, জঙ্গল, লালমাটির পথ আর বঙ্গের সমুদ্র তীর। এসেছিলাম প্রতি বছরের মত মহাকাল বাবা কে পুজো দিতে। এই সময় আমরা ৭ দিন দার্জিলিং এ থাকি। বিকেল বেলায় লোয়ার বাজারে আরিফ এর দোকানে বসে গল্প করছিলাম, শুনতে পেলাম টাইগার হিল এ তুষার পাত হচ্ছে। মোটর সাইকেল করে ওই ছোট্ট বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলোর সাথে আমি গেছিলাম, তার গল্প আমার এর আগে দেওয়া আছে। সেইদিন রাত্রেই হোটেলে বসে আমরা ঠিক করলাম যে এই দুই দিন আরও যে আছে সেটা এখানে না কাটিয়ে, বরফের খোঁজে পেলিং যাব। এই ২/৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা যেনো নেশা চাপিয়ে দিয়েছিল এই শরীরে, দেহের গরম রক্ত যেনো আরও আরও শীতলতা কে উপভোগ করতে চাইছে।
পরদিন অনেক দর কষাকষি করে দার্জিলিং থেকে ২৫০০ টাকায় গাড়ি ভাড়া করে পেলিং এর ঠান্ডা খেতে রওনা হলাম। কিন্তু জানতাম না যে মন এই যাত্রায় পেলিং যেতে বাদ সাধবে। প্রায় তিন ঘণ্টা যাত্রা পথের পরে এসে পৌঁছালাম রবাংলায়। কি অদ্ভত ব্যাপার! এখনতো সবে দুপুর দেড়টা,পাহাড়ি শহর টাকে কুয়াশা সম্পূর্ণরূপে ঢেকে নিয়েছে, প্রতিটা গাড়ি আলো জ্বালিয়ে চলেছে, রাস্তায় মানুষ এর দেখা নেই, দোকান, ঘরবাড়ি, হোটেল সব জায়গায় আলো ঝলমল করছে। আর নয় অগ্রবর্তী, মন চাইলো এখানেই আজকের ডেরা বাঁধতে। হোটেল সংগ্রিলার সামনে গাড়ি থামালাম। হোটেল ম্যানেজার যেনো এই প্রথম খদ্দের পেলো। কি তার মুখের মধুর ভাষা, ভাড়া নিয়ে যখন কথোপকথন হচ্ছে তার মধ্যেই চলে এলো গরম কফি, ওনার অনুরোধ যে, অামরা থাকি বা না থাকি, এই কফি খেতেই হবে। ২০০০ টাকা করে দুজনের ঘর প্রায় ৬০ শতাংশ ছাড়। হোটেল খুবই সজ্জিত। সাজানো গোছানো ঘর। খাবার আলাদা।
দক্ষিণ সিকিম এর একটি পাহাড়ি শহর এই রাবাংলা (Ravangla), সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০০০ ফুট উচ্চতায় এই ছোট্ট মেঘে ঢাকা পাহাড়িয়া শহর টি। যেখানে দিনের আলোয় হঠাৎ হঠাৎ অন্ধকার ঢুকে যায়। পান্ডিম, কাঞ্চনজঙ্ঘা,কাব্রু , হিমালয়ের এই বরফে ঢাকা পর্বত শিখর গুলি এই শহর টার প্রতিবেশী।
NJP থেকে ১৩০ কিমি এর দূরত্ব। গ্যাংটক ৬৫ কিমি, দার্জিলিং ৭০ কিমি, জোড়থাং ,নামচি হয়ে এই পথ গিয়েছে। পেলিং এর দূরত্ব ৫০ কিমি, গেজিঙ ৪০ কিমি হবে। শহরের মাথার উপর বুদ্ধ পার্ক, সুবিশাল বুদ্ধ মুর্তি, সাথে মনোরম পার্ক, ল্যান্ডস্কেপ, প্রায় ৮০০০ ফুট উচ্চতায় হবে এই পার্কটি।
প্রথমদিন দুপুরে হোটেলে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নেবো ভাবছিলাম কারণ বাইরে তখন অকাল অন্ধকার,তাই কোথায় আর যাবো! একটু চোখ লেগে এসেছিলো, ম্যানেজার বাবু এসে হাজির, রাত্রের খাবারের অর্ডার নিতে। ততক্ষনে বাইরে সূর্য মামা আবার হেসেছেন। ম্যানেজার বাবুর থেকে শুনলাম এই হোটেলের সামনেই একটা সরকারি বাংলো আছে আর ওখানে নাকি আফুরন্ত চেরি ফল ফলে আছে, পোশাক আশাক সব পরাই ছিল তাই চা খেয়েই বেরিয়ে পরলাম চেরির সন্ধানে। রাস্তা দিয়ে যতই হাঁটছি ততই মুগ্ধ হয়ে এই রূপসী বাংলা কে দেখছি। একটা খুব সুন্দর বাংলো, লোহার দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে মনে হলো যেনো বায়োস্কোপ এ দেখা কোনো বিদেশি বাড়ির সাজানো বাগান।
ভিতরে যাবার রাস্তার দুধারে চেরি গাছ আর তাতে ফুল ফুটে চারি দিকটাকে গোলাপী রঙের রঙায়িত করেছে। আর তার পাশে পাঁচ পাপড়ির পদ্ম ফুল খিলখিল করে হাসছে। তবে সাবধান,প্রচুর জোক গাছে ও ঘাসের ভিতরে। আমার মনে হয় এত সুন্দর ফুল গুলোকে মানুষের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই এই রক্তচোষা পাহারাদার গুলো পাহারা দিচ্ছে। তবে দুই চোখ দিয়ে এর রূপ টাকে শোষণ করলাম।
পরদিন ব্রেকফাস্ট করে ১০০০ টাকায় চুক্তি করে বুদ্ধ পার্ক দেখতে চললাম। খাড়াই পথ পেরিয়ে যেখানে পৌঁছালম, হলপ করে বলতে পারি যে, সেখানে ভগবান ছাড়া আর কারো বসবাস করবার অধিকার নেই।
অভূতপূর্ব এই রূপে আমার সাড়া শরীর জুড়ে আনন্দের তরঙ্গ বয়ে গেলো, বিস্ময়কর প্রকৃতির কমনীয়তা, দেবদূতোপম রূপের গাম্ভীর্যতা, মনোরম পরিবেশে ঐশ্বরিক ভূমিতে দাড়িয়ে আমি আনয়ন রূপের নির্যাস সারা শরীরে ছড়িয়ে দিলাম, যার মাধুর্য আজও আমার মনে গভীরে বিচরণ করছে।
Leave a Comment