বরামাঙ্গওয়া ভ্রমণ

তিনচুলে পিছনে আবছা হয়ে থাকল, বৃষ্টিতে খারাপ আবহাওয়া সাথে খারাপ রাস্তা সকাল থেকেই মনটা মেঘলা করে দিয়েছে। তার ওপর অতগুলো জায়গা (হ্যাঙ্গিং ব্রিজ, রংলি টি গার্ডেন, অর্কিড সেন্টার, তাকদা ব্রিটিশ বাংলো, দূরফিনদারা ভিউ পয়েন্ট) প্রকৃতির ষড়যন্ত্রে অদেখা থাকার শোক। পথেই বরামাঙ্গওয়া ফার্ম হাউসে (Bara Mangwa Farmhouse) ফোন করে দিলাম। গাড়ি বেশ মন্থর গতিতেই পৌঁছাল বরামাঙ্গওয়াতে। ঘড়ি তখন ১ঃ৩০ ছুঁই ছুঁই। বৃষ্টির কোন বিরাম নেই। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা হাঁটতে হবে কারণ এখান থেকেই শুরু বরামাঙ্গওয়া ফার্ম হাউসের নিজস্ব রাস্তা। দেখি একজন কেয়ারটাকার আর একজন পোর্টার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চা পাতা তোলার ঝুড়ির মত শঙ্কু আকৃতির একটা ঝুড়িতে আমাদের সমস্ত লাগেজ তুলে ছাতা ছাড়াই গট গট করে হেঁটে মিলিয়ে গেল শীর্ণকায় লোকটি। আমাদের কেয়ারটেকার মহাশয়ের পিছনে আমরা একই ছত্রে দুটি প্রাণ। সরু বাঁধানো রাস্তা একপাশে ভুট্টা ক্ষেত আরএকদিকে আরো উঁচুতে উঠছে পাহাড়।

বৃষ্টি মাথায় করে সরু রাস্তা ধরে দুজন পাশাপাশি হাঁটাটা বেশ কষ্টের, একটু ওপরে উঠে বড় গাছ গাছালি রাস্তাটির সৌন্দর্যায়ন ঘটিয়েছে। চারি দিকে শুধুই সবুজ কখনও কিছুটা সমতল জমি সবুজে ঢাকা কখনও ছোট ক্ষেত। হেঁটেই চলেছি কোথায় চলেছি জানিনা, প্রায় দশমিনিট লাগল উঠতে, বাগান ঘেরা একটা লজে আমাদের কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে বলল, কারণ আমাদের ঘরটির সাফাই চলছে। জার্নিতে আমি বেশ ক্লান্ত। রিসোর্টের সামনে খাদ আছে বুঝতে পারছি কিন্তু আপাদমস্তক ভিজে গিয়ে হেঁটে দেখার এনার্জি পাচ্ছিলাম না। মিনিট ১৫ বাদে ডাক এল। বেরিয়ে বাঁ দিক দিয়ে কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে গিয়েই থমকে গেলাম। এ যেন স্বর্গ! এমন সুন্দর দৃশ্য আগে দেখিনি। লেখায় বা ভাষায় বর্ননা করা প্রায় অসম্ভব। ডানদিকে দোতলা ফার্ম হাউসের নিচতলায় আমাদের সুইট। সামনেই খোলা রেলিং দেওয়া খোলা ছাদের মত বেশ কিছুটা জায়গা। রেলিং পেরিয়েই গভীর খাদ। নিচে জনবসতি তারপরই বয়ে চলেছে তিস্তা নদী, পাশদিয়ে গাড়ির রাস্তা তার পরই উঠে গেছে আরও একটা পাহাড়। তার গা বেয়ে তির তির ঝরে চলেছে একটা ঝর্না। মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজেদের মত করে। চোখ ফেরানো যায়না। ডানদিক বামদিকে মুখোমুখি সবদিকেই খাদের পরে পাহাড় আর মেঘেদের রাজত্ব। এ যেন পৃথিবী ভুলে স্বর্গের কোন ঝুলন্ত উদ্যানে একাকী আমি দাঁড়িয়ে। পরে জেনেছি বাঁদিকে দার্জিলিং (সেখান থেকেই পরিষ্কার আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়), মুখোমুখি কালিম্পং, এই দুটি পাহাড়ের মাঝে অনন্ত বিস্তৃত পর্বতরাজি যেগুলোকে দেখলে স্বর্গের সিঁড়ি বলে ভ্রম হতেই পারে। তবে স্বর্গ নয় ওটি আসলে নাথুলা/চায়নার দিক। এছাড়া ডানদিকেও দূরদূরান্ত পর্যন্ত অজানা পাহাড়ের সারি।

নাওয়া খাওয়া পথের কষ্ট ভুলে আমরা অবাক দৃষ্টিতে পাহাড় গিলতে লাগলাম। চমক ভাঙল আমাদের কেয়ারটেকারের ডাকে। ঘরে ঢুকে অবাক হওয়ার আরো একপ্রস্থ বাকী। দারুন সাজানো একটা ঘর, সব চেয়ে বড় আকর্ষণ সামনের দেওয়াল জোড়া বড় জানলাটা। পুরো ভিউটাই আপনি দেখতে পাবেন বিছানায় শুয়ে, দুটো ডাবল বেড, বেশ বড় ঘর বাথরুম ও বেশ সুন্দর।

এই ফার্ম হাউসটা পুরো ঘোরা হয়নি তখনও। যা বুঝলাম বেশ অনেকখানি জায়গা এবং এই ফার্মহাউসটা পাহাড় কেটে একটা বড় জায়গা জুড়ে বানানো। আসে পাশে কোনো বাড়ি, ঘর বা জনমানব নেই। মোট দুটি বিল্ডিং (প্রথমে যেখানে আমাদের কিছুক্ষন বসতে হয়েছে) ভিউ পয়েন্ট এর মুখোমুখি বিল্ডিং এর একতলায় দুটো ঘর পাশাপাশি। ওপরটায় অবশ্য কেয়ারটেকাররাই থাকেন। এই জায়গার নিচের ঘর দুটিই আদর্শ এবং সব থেকে আগে এটাই বুক হয়ে যায়। এই বিল্ডিং ছাড়িয়ে ডানদিকে গেলে বাগান। বাগান পেরিয়ে ডান হাতে কয়েক ধাপ ওপরে ওপেন ডাইনিং রুম। হাফ রেলিং দিয়ে ঘেরা ওপরে ছাদ, খেতে খেতেও পাহাড়ের দৃশ্য চোখের আড়াল হয় না।

চা খেয়ে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম কেয়ারটেকারের দেওয়া গরম জল দিয়ে। অসাধারণ লাঞ্চ ওদের নিজস্ব ডেয়ারির ঘি, ডাল, ভাত, তিল আর বেসনে মাখিয়ে কুড়মুড়ে উচ্ছে ভাজা, মাছের কালিয়া ভাত শেষ পাতে পায়েস। এরম নির্জন জায়গায় এমন খাবার কল্পনাতীত। ডাইনিং ছাড়িয়ে ১০ মিনিট হেঁটে ওদের ফার্ম। ফার্মে সব্জি চাষ হয় গরুও আছে, চাইলেই ঘুরে আসা যায়। খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা ফার্মটা দেখতে যাব ঠিক করলাম। আমাদের পাশেই আছে আর একটি পরিবার। তারাও আমাদের সাথে সাথে এলেন। সরু পাহাড়ি পথ, বা দিকে খাদ আমরা ছবি তুলতে তুলতে কিছুটা গেলাম। আমাদের প্রতিবেশী পরিবারের সাথে বাচ্চা থাকায় তারা ফিরে গেলেন ঘরে। আমরা এগোতে লাগলাম, নিচ থেকে ভেসে আসছে গরুর ডাক, কিছু কিছু খেত ও দেখা যাচ্ছে। বুনোফুল অচেনা নানান গাছপালা দেখতে দেখতে আরো মিনিট দশেক এলাম। আরো কতটা ঠাওর করতে না পেরে আমরা ফিরে এলাম সেদিনের মত।

ঘরে এসে দেখি বিদ্যুৎ নেই। আমাদের পাশের ভদ্রলোক বললেন এখানে এটাই সমস্যা এদের কোন পাওয়ার ব্যাকআপ নেই। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। জানলার ধারের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। ঘুম ভাঙল আমার সঙ্গীর ডাকে। “তাড়াতাড়ি ক্যামেরা নিয়ে এসো চাঁদ ডুবে যাবে” আমিও কোনকিছু না ভেবে দৌড়ালাম। ছবি তুলে বারান্দায় ঘুরছি এমন সময় দেখি চাঁদ মামা ওপরে উঠছেন। বোকার মত কান্ড ঘটিয়ে দুজনেই হেসে গড়াগড়ি। বিদ্যুৎ আসছে যাচ্ছে। আমরা ফোন আর ক্যামেরা চার্জেই রেখে দিয়েছি তাই। সন্ধ্যের স্ন্যাকস মোমো আর চা। এই নির্জনতায় কিছুটা সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাই বুঝি ভালো। ব্যস্ত জগতের শিকড় উপরে ফেলে দিয়ে গা ভাসালাম তারা আর মেঘেদের রাজ্যে। দূরের পাহাড় গুলো টিমটিমে আলোয় চিক চিক করছে, যেন শত সহস্র জোনাকিরা বাসা বেঁধেছে দিনের শেষে। বারান্দায় ছড়িয়ে পড়েছে চাঁদের আলো। ভরা পূর্ণিমায় জোৎস্না স্নাত হয়ে বসে আছি দুজনে। কিছু না থাকলেও সময় এখানে দিব্যি কেটে যায়। পাশের পরিবারটিকে অবশ্য ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তারা আর আলোর খেলা উপভোগ করতে বেচারাদের ঢের দেরি। ১০ টার একটু আগেই খাবারের ডাক পড়ল। রাতে রুটি খাব আগেই বলেছিলাম রুটি, ডাল, ডাবল ডিমের কারি, সব্জি আর স্যালাড। খুবই ভালো রান্না।

খেয়েদেয়ে আড্ডা জমালাম সবাই মিলে। পরেরদিনই আমাদের পাশের পরিবারটির এখানে চেক আউট, কেউ তার বদলে যদি না আসে তবে এই গোটা পাহাড়ে আমরা দুজন একা। ভেবে বেশ ভয়ই করল। পরদিন কোথাও যাওয়ার নেই, এখানেই থাকব আর একটা রাত। তাতে অবশ্য কোন সমস্যা নেই বেশ লাগবে এই পাহাড়ে রাজত্ব করতে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ালাম বাইরে ক্যামেরা নিয়ে। মেঘ সরে গিয়ে পরিষ্কার আকাশ। এসে আবার ঘুমিয়ে গেলাম, যখন ঘুম ভাঙল রোদ এসে বিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ব্রাশ করতে করতেই চা এসে গেল। কেটলিতে দেওয়া গরম জলে স্নান করে তৈরি হয়ে গেলাম ব্রেকফাস্ট সারতে। আলুর পরোটা, সব্জি আর আচার। আরো একবার চা পাওয়া গেল। আমরা ঠিক করলাম যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই রাস্তাটা আজ দেখতে যাব। এখানেও পিছু নিল রিসর্টের দুটি কুকুর, সারা রাস্তা আমাদের সঙ্গে। সরু রাস্তা, পাশে গাছের সারি। একটা জায়গায় এসে রাস্তাটা গেছে বাঁদিকে বেঁকে আর ডানদিকে খেত অর কিছুটা সমতল। ওখানেই নেমে এগিয়ে গেলাম, শুধু সবুজ আর সবুজ। কোনো জনপ্রাণী নেই। খেতে ফলে রয়েছে ভুট্টা। একটা দুটো বাড়ি থাকলেও কোন লোকের দেখা নেই। হয়তো এগুলো স্টাফ কোয়ারটার। অনেক ছবি তুলে আমরা ঘরে ফিরে এলাম। এককথায় বলতে গেলে ‘কি দেখিলাম ! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না!’ এরই মাঝে আমাদের প্রতিবেশিরা বিদায় নিয়েছে। দুপুরে লাঞ্চ ভাত ডাল, ঘি, বেগুন ভাজা, সব্জি ও চিকেন আর ডেজার্ট এ পায়েস।

দুপুর কাটল খোলা বারান্দায়। মেঘেদের ভোল বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেই খেলা দেখেই সময় চলে যায়। বিকালে চা আর পাকোড়া খেয়ে ঘুরে বেড়ালাম চারপাশ। ভুতের মত একা তারার আলোয় আমরা (যথারীতি লোডশেডিং)। রাতের ডিনারটা আমরা ঘরেই নিলাম। বাইরে খোলা আকাশের নিচে মোমবাতির আলোয় আমাদের প্রথম ক্যান্ডেল লাইট ডিনার (যদিও এটাকে forced candle light dinner বলা চলে 😀 ) । আকাশের তারার মতন অগুনতি স্মৃতি নিয়ে ঘুমালাম।

রাতে আমরা ঠিক করলাম পরদিন আমাদের আগের (লামহাট্টার) ড্রাইভার কুঙ্গা জীকেই যোগাযোগ করব । ফার্ম হাউসটি থেকে গাড়ি পাওয়া যেত যদিও, তবু অচেনা রাস্তায় চেনা লোকের সঙ্গ বেশি উপভোগ্য মনেহল। সকালে শেষবারের মত চারিদিক ঘুরে, চা আর চাউমিন খেয়ে বরামাঙ্গওয়া কে স্মৃতির চিলেকোঠায় সযত্নে বন্ধ করে পা বাড়ালাম দার্জিলিং এর পথে।

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য

  • বরামাঙ্গওয়া ফার্ম হাউস বুক করতে হলে ওদের ওয়েবসাইটে নাম্বার দেয়া আছে। নামঃ Mr. Sandipan Datta
  • তিনচুলে থেকে বরমাঙ্গওয়া মোটামুটি ৩০-৪০ মিনিটের পথ এবং রাস্তা অত্যন্ত সংকীর্ণ ও খারাপ। অবশ্যই বড় গাড়ী বুক করবেন।
  • আমরা তিনচুলের রাই রিসোর্ট থেকে Bollero গাড়ী নিয়েছিলাম, ৮০০ রুপী পড়েছিল।
  • আপনারা সরাসরি NJP থেকেও গাড়ী বুক করতে পারেন, বড় গাড়ী (Recommended) নেবে ২০০০ রুপী আর ছোট গাড়ী নেবে ১৫০০ রুপীর মত। মনে রাখবেন শেয়ারড ট্যাক্সি এই রুটে নেই বললেই চলে।
  • খাওয়া দাওয়া মাথা পিছু ৬০০ রুপী এক একজনের ( সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, বিকেলের স্ন্যাক্স, রাতের খাবার এবং চা)
  • বরামাঙ্গওয়া তে দোকানপাট এবং জনবসতি বেশ কম, নেই বললেও চলে, ATM ও নেই, তাই প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আগেই কিনে রাখবেন।
  • এখানে কোনো Power Backup নেই এবং বারে বারে লোডশেডিং হওয়ার প্রবণতা আছে। সুতরাং সাথে Power Bank রাখা ভালো।
  • মনে রাখবেন, বরমাঙ্গওয়া ফার্ম হাউসের দরজা অবধি গাড়ী আসেনা। মেইন রোড থেকে প্রায় ১০ মিনিট আপনাকে একটি সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে হেঁটে পৌছতে হবে। তাই ওখানে পৌছনোর ১৫ মিনিট আগে ওনাদের ইনফর্ম করে রাখবেন। ওরা মেইন রোডে এসে ট্যুরিস্টদের নিয়ে যায়।

বিঃদ্রঃ অসুস্থ বা বয়স্ক মানুষের জন্য হুইল চেয়ার এর ব্যাবস্থা আছে। ওরা খুবই অতিথিপরায়ন।

Leave a Comment
Share