বালি ভ্রমণ – দারুচিনি দ্বীপ, আগুন পাহাড় আর নীল সাগরের ঘ্রান মাখানো কয়েকটি দিন ( পর্ব ১)

জাভা সাগরের বুকে ভেসে থাকা ঠিক যেন ছোট্ট একটি মুরগীছানার আকারের দ্বীপটি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। কিন্তু দুরত্ব এবং খরচের কথা চিন্তা করে এই স্পট টিকে বাকেট লিস্ট থেকে বের করে এক্সপেরিয়েন্স এ পরিণত করতে একটু দ্বিধাতেই ছিলাম। কিন্তু এবার ঈদের আড়াই মাস আগে হঠাত করে সিদ্ধান্ত নিলাম যাই থাকুক না কপালে, এবার বালি না গেলে চলবেই না। অতঃপর শুরু হল আমাদের প্ল্যানিং এবং বরাবরের মতই আমরা ঝাপিয়ে পরলাম সেই প্ল্যান কে বাস্তবায়ন করতে। স্টাডি করে যা বুঝলাম তা হল, বৈচিত্রে ভরা এই স্থান টিকে ভালভাবে এক্সপ্লোর করতে হলে কমপক্ষে সাত থেকে আট দিনের একটা লম্বা সময় দরকার। শুধুমাত্র তিন চার দিনের জন্য এখানে গিয়ে আফসোস বাড়ানোর কোন মানেই হয়না। তাই ঈদের ছুটি টিকেই কাজে লাগাতে হবে এবং শুধু তাই নয় ঈদ টাও ওখানে করতে হবে তাছাড়া তো আর এতদিন ছুটি ম্যানেজ করা যাবেনা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রতিবারের মতই এবারো ভ্রমণের প্রায় আড়াই মাস আগেই প্লেনের টিকিট কেটে এবং অনলাইনে হোটেল বুকিং দিয়ে রেডি আমরা। আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্লোজফ্রেন্ড অনির্বাণ পররাস্ট্র মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তা যার পোস্টিং এখন জাকার্তা বাংলাদেশ দুতাবাসে। মুলত বালির প্রতি আমাদের আগ্রহটি সেই আমাদের মাঝে প্রথম জাগিয়েছিল। আমরা যাব শুনে অনির্বাণ তার পরিচিত একজন ড্রাইভার কে আমাদের জন্য ঠিক করে দিল। ভিসা যেহেতু অন এ্যারাইভাল কাজেই এখানে আর সে সংক্রান্ত কোন ঝামেলা নেই। এবার শুধু দিন গোনার পালা। এবার আমাদের ট্যুরের অভিযাত্রী আমরা তিনজন, আমি, আমার জামাই আর আমার ছয় বছরের কন্যা। আমাদের ভ্রমণ প্ল্যানটি হল সাত রাত আট দিনের। পুরোটা সময়ই বালি থাকব শুধু এক রাত থাকব নুসা লেম্বোগান নামক একটি দ্বীপে। যারা আমার থাইল্যান্ড ভ্রমণ কাহিনী পড়েছেন তারা জানেন ফিফি দ্বীপের কথা। রাতের ফিফির সেই মোহিনী রুপ থেকে আমরা এতই ইন্সপায়ার্ড ছিলাম যে এবারো তাই আমাদের ট্যুর প্ল্যানে একটা রাত বরাদ্দ রেখেছি একটি আইল্যান্ডের জন্য।

you can enjoy lunch watching the beatiful view of mount batur from sari restaurent.

অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে জুনের ২২ তারিখে আমরা হাজির এয়ারপোর্টে। ই বি এল স্কাই লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাত দেখি খুব পরিচিত একটি মুখ তার স্ত্রী সন্তানসহ অপেক্ষা করছেন আমাদের পাশের সোফাতেই। আমাদের সবার প্রিয় তামিম ইকবাল। ওরা যাচ্ছিল সিঙ্গাপুর। নিত্যদিনের গতবাধা জীবনে আমরাই হাপিয়ে উঠি আর তাদের তো আস্টেপৃষ্ঠে বাধা জীবন। এক্টুখানি ছুটির অবসরে তাই হয়ত ফ্যামিলি নিয়ে উড়াল দিতে চলেছে সিঙ্গাপুরে একান্তই নিজেদের মত সময় কাটাতে। কাছে যেয়ে অটোগ্রাফ চেয়ে আর বিরক্ত করতে মন চাইলনা। থাক না সে তার মত।

যাই হোক নির্দিস্ট সময়েই আমাদের থ্রি মাস্কেটিয়ার্সকে নিয়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানটি উড়াল দিল মালয়শিয়ার পথে। ওখানে প্রায় পাঁচঘন্টা ট্রাঞ্জিটের পর একই এয়ারলাইন্সের আর একটি বিমান আবার আমাদের নিয়ে পৌছে দিল বালির মাটিতে। স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটায় আমরা পৌছে গেলাম বালি ডেনপাসার এয়ারপোর্ট এ। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই দেখি নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে আমাদের ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই চোখে পরল বিখ্যাত বালি গেট। আইকনিক এই গেটটি বালির প্রতিটি স্থানেই, টেম্পল, অফিস, আদালত , অলি, গলি, ঘরবাড়ি সবখানেই উপস্থিত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই নান্দনিকতা চোখে পরার মত।

Iconic Bali Gate

গাড়ি যতই এয়ারপোর্ট এড়িয়া ছেড়ে শহরের দিকে ঢুকছিল ততই বালি সুন্দরির ছিমছাম, গোছানো, ছবির মত রুপ চোখে পরছিল আমাদের। কিছুদুর পর পরই বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে নান্দনিক ভাস্কর্যগুলো শহর টির সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণ। সেই সাথে আর একটা জিনিসের সাথে আমাদের হাল্কা পরিচয় হল আর তা হল ট্র্যাফিক জ্যাম। বুঝলাম এ ব্যাপারে বালি সুন্দরি হয়ত একটু ভোগাবে আমাদের। পরে অবশ্য তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম, সে কাহিনী পরে। আমাদের হোটেল টি কুটা বিচে অবস্থিত হওয়ায় এয়ারপোর্ট থেকে খুব বেশি দূরে যেতে হলনা। যদিও আমরা রিস্ক না নিয়ে একাধিক হোটেল বুকিং দিয়েছিলাম। বলা তো যায়না যদি এটাতে কোন সমস্যা হয় কিংবা এই হোটেল আমাদের ভাল না লাগে? কিন্তু প্রথম দেখাতেই হোটেলটা আমাদের বেশ ভাল লেগে গেল। তাই কোন সংঙ্কোচ ছাড়াই এটাতেই উঠে পরলাম । দীর্ঘ সাত ঘন্টার আকাশ জার্নি ( ঢাকা টু কে এল ৪ ঘন্টা এবং কে এল টু ডেনপাসার ৩ ঘন্টা ) এবং পাঁচ ঘন্টা ট্রাঞ্জিট সব মিলিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর। কিন্তু তা হলে কি হবে? হোটেলে বসে থাকব নাকি? কোন রকমে লাগেজ রুমে রেখে ফ্রেস হয়েই বেড়িয়ে পরলাম। আশেপাশে একটু ঘুরে , কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে, কে এফ সি তে রাতের খাবার খেয়ে সে দিনের মত ক্ষান্ত দিয়ে হোটেলে প্রত্যাবর্তন এবং ঘুম। পরদিনের জন্য এনার্জি সংগ্রহ করতে হবে না ?

rice terrace

পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরেই যাত্রা শুরু আমাদের। গন্তব্য কিন্তামানি ট্যুর। মাউন্ট বাতুর ( লাইভ ভল্কানো) , বাতুর লেক , কফি প্ল্যান্টেশন, রাইস টেরেস এবং সময় হলে এলিফ্যান্ট টেম্পল দেখব আজ এই হল আজকের প্ল্যান। যাওয়ার পথেই কফি প্ল্যান্টেশন পরায় এখানেই আগে নেমে যাওয়ার সিধান্ত নিলাম। আমরা যেতেই একজন গাইড এসে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালো আমাদের। পাহাড়ি এলাকায় নানান রকম গাছপালা ঘেরা সাজানো গোছানো ছবির মত সুন্দর কফির বাগান। পেছনেই বিশাল কমলা বাগানে গাছগুলি কমলার ভারে নুয়ে পরছে। এক পাশে কফি আর কোকো বিনের গাছ আর অন্য দিকে বিন থেকে তৈরি হচ্ছে হরেক রকম কফি। জীবনে এই প্রথম কফি আর কোকো বিনের গাছ থেকে যারপরনাই এক্সাইটেড আমরা। বিশ্বের সবচেয়ে দামী কফি লুয়াক ও তৈরি হতে দেখলাম এখানে। তবে সে কফি তৈরির প্রসেস দেখে শুধু ইহ জনমে নয় পরজনমের জন্যও কফি খাওয়ার ইচ্ছা প্রায় উবে যাওয়ার দশা আমাদের। থাক সে বর্ননা আর এখানে দিলাম না, গুগল করলেই আপনারা পেয়ে যাবেন।

cocoa beans
coffee beans

দেখা শেষ হতেই টেবিলে বসিয়ে ১২ রকম কফি ( লুয়াক ছাড়া ) দিয়ে চল্ল আমাদের আপ্যায়ন। সম্পুর্ণ ফ্রি এই কফি গুলোর স্বাদ আস্বাদন করে কিছু ‘র’ কফি আর ডার্ক চকোলেট কিনে আবার আমরা উঠে বসলাম আমাদের গাড়িতে।

coffee beans are being roasted
free coffee testing

গাড়ি এবার ভুপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচুতে। বুকে এক্সাইটমেন্ট অনেক, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি দেখতে যাচ্ছি য! শুনেছি ট্র্যাকার রা সেই মাঝ রাতে উঠেই চলে যায় এই মাউন্টেনে ট্র্যাকিং করতে। অতঃপর মাউন্টেনের কাছাকাছি গিয়ে বাতুর লেকের গরম পানিতে ডিম সেদ্ধ করে নাকি তারা তাদের ব্রেকফাস্ট সারে। বাচ্চা নিয়ে আমাদের তো আর ট্র্যাকিং সম্ভব নয়, তাই দূর থেকেই সই, তবু তো আগ্নেয়গিরি দেখা বলে কথা! অবশেষে দূর থেকেই দেখা মিলল পোড়ামুখির। যথার্থ পোড়ামুখিই বটে , সেই সাথে সর্বনাশিও। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছিল সে একসময় তার আশেপাশের বিস্তির্ন অঞ্চল। তার সেই সর্বনাশের চিহ্ন এখনো চোখে পরে কালো পোড়া ছাইয়ে ঢাকা পর্বত ঘেরা বিরানভুমি দেখে। তবু কি তার রাগ মিটেছে? এখনো সে ভিতরে জ্বলছেই ধিকি ধিকি। মাঝে মাঝে উদ্গিরিত কাল ধোঁয়া এখনো তার তার ভেতরের চাপা অঙ্গারের ই স্বাক্ষ্য দেয়। তাই তো সে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। বাতুরের আকাশে সেদিন অনেক মেঘের আনাগোনা থাকায় তার চাপা অঙ্গারের খোঁজ সেদিন আমরা পেলাম না। মেঘ যে ঢেকে নিয়েছে তার সকল ধোঁয়া। কিছুক্ষন ওখানে কাটিয়ে দুপুরে লাঞ্চ করতে চলে এলাম সারি রেস্টুরেন্ট এ। চমৎকার লোকেশনে অবস্থিত এই রেস্তোরাঁটিতে বসে মনোমুগ্ধকর বাতুর আর আর তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা লেকের মোহিনী রুপ দর্শন করতে করতে ইন্দোনেশিও ফুডে লাঞ্চ করা যে এক চমৎকার , মাস্ট ডু এক্সপেরিয়েন্স এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কোন।

Scenic View of Mount Batur

বাতুর দর্শন শেষ, এবার গন্তব্য রাইস টেরেস। এখানে বলে রাখা ভাল যে কফি প্ল্যান্টেশন আর রাইস টেরেস কিন্তু অসংখ্য রয়েছে বালিতে। তাই আমরা আমাদের যাত্রা পথে যেটি পরেছে সেটিতেই গিয়েছি। অধিকাংশ রাইস টেরেসগুলি উবুদে অবস্থিত। ইন্দোনেশিয়াতে ধান চাষ হয় প্রচুর আর রাইস টেরেস হল পাহাড়ের গায়ে চাষকৃত ধান ক্ষেত। পাহাড় কেটে কেটে সিড়ির মত করে বপন করা ছবির মত সাজানো ধান গাছগুলো যে তার চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে পর্যটকদের মনের খোরাক মিটাবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। আমরাও এর মনভুলানো রুপ আস্বাদন করে এক বুক তৃপ্তি নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। এলিফ্যান্ট টেম্পল একটু দূরে হওয়ায় আর যাওয়া হলনা সেদিন। জ্যাম না থাকায় সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরতে পারলাম হোটেলে। রাত হতে এখনো বাঁকি আর আমরা সময় কাটাবো হোটেলে? কাভি নেহি। হোটেল থেকেই ৪ মিনিটের ওয়াকিং ডিস্টেন্স এ লিপ্পো মল। তাই সন্ধ্যা কাটাতে চলে গেলাম সেখানেই। সন্ধ্যা হতেই মলের সামনেই চলে স্ট্রিট মিউজিকের আসর। উদ্দাম সেই মিউজিকে কিছু সময় গা ভাসিয়ে , কিডস জোনে কন্যার খেলার আবদার মিটিয়ে অবশেষে সেখানেই ডিনার শেষে বেশ রাত করেই ফিরলাম হোটেলে। পরদিনের এ্যাডভেঞ্চার তো আরো থ্রিলিং, যেতে হবে সাগর পাড়ি দিয়ে ছোট্ট একটি দ্বীপ নুসা লেম্বোগান। সেই দ্বীপের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ক্লান্ত শরির এলিয়ে দিলাম বিছানায়। আর এভাবেই একটি ঘটনাবহুল আর এ্যাডভেঞ্চারপুর্ণ দিনের সমাপ্তি। ( চলবে)

পরের পর্বঃ বালি ভ্রমণ – দারুচিনি দ্বীপ, আগুন পাহাড় আর নীল সাগরের ঘ্রান মাখানো কয়েকটি দিন ( পর্ব ২)

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ baliindonesiastorytravel