মিশন: চিয়ং মুরং পাড়া

৭ নভেম্বর, ২০১১। রাত ৮ টা।

ব্লগার হুদাই পেচাল এবং আমার ফোনালাপ:
হু.পে: ভাই, ঈদের ছুটিতে ঘরে বইসা থাকতে থাকতে দম বন্ধ হইয়া যাইতাছে, চলেন কোথাও থেইকা ঘুইরা আসি।
আমি: হ্যাঁ, সেরকম একটা প্ল্যান আমার মাথাতেও আছে; প্ল্যানটা হলো এবার পাহাড়ে ট্রেকিং করতে যাবো। যাবি নাকি আমার সাথে ট্রেকিং-এ?
হু.পে: ভাই, পাহাড় দেখতে হলে রাঙামাটি চলেন।
আমি: নাহ্ । স্যরি। ওইসব সাজানো-গোছানো জায়গায় যাবার আমার কোন ইচ্ছাই নেই। অ্যাডভেঞ্চার আছে, প্রতিক্ষণে উত্তেজনা আছে -এমন কোন জায়গাতে যেতেই আমার আগ্রহ বেশি। এবার তাই প্ল্যান করেছি, বান্দরবানের লামা উপজেলার একটা মুরং (ম্রো) পাড়া ঘুরে আসবো। ট্রেকিং-ও হবে, আবার ম্রো-দের সাথে কিছুটা সময় কাটানোও হবে। ম্রো-রা সাধারণত অনেক দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় থাকে। লামা পৌরসভা থেকে সবচাইতে কাছাকাছি ম্রো পাড়া হলো গজালিয়ার ’চিয়ং মুরং পাড়া’। ট্রেকিং করে যাবার উদ্দেশ্য দু’টি -এক. পাহাড়ী রাস্তায় চলার পথের সৌন্দর্য উপভোগ করা এবং দুই. ম্রো আদিবাসীদের জীবনযাত্রার কিছু অংশ পর্যবেক্ষণ করা। এবার তাই ওখানটাতেই যাবো বলে মনস্থির করেছি। কিরে হুদাই, যাবি নাকি আমার সাথে?
হু.পে: অবশ্যই যাবো।
আমি: উঁহু । বললেই তো আর হয়ে গেলোনা। ট্রেকিং করাটা অনেক কষ্টের। অর্ধেক পথ গিয়ে যদি বলিস, আর যাবিনা, তাহলেতো বিপদ।
হু.পে: কোন সমস্যা নাই। আল্লাহ ভরসা। যা থাকে কপালে। চলেন তাহলে ’চিয়ং মুরং পাড়া’ থেকেই ঘুরে আসি এইবার।

১১ নভেম্বর, ২০১১, শুক্রবার।

লামা পৌরসভার গজালিয়া স্ট্যাণ্ড থেকে চান্দেরগাড়িতে জনপ্রতি ২০ টাকা করে ’বুড়িরঝিরি’ পর্যন্ত আসতে আমাদের সময় লাগলো ৪০ মিনিট। সকাল ৮.৩০ -এ ছেড়ে যাওয়া প্রথম গাড়িটাই আমরা ধরতে পেরেছি। ’আমাদের’ বলতে আমি আর ব্লগার হুদাই পেচাল ছাড়াও এবার সাথে রয়েছে দু’জন স্থানীয় পাহাড় স্পেশালিস্ট – মনিকা এবং কেওহ্লা মার্মা। অচেনা পাহাড়ী পথে দল ভারী থাকা ভালো। এজন্যেই আমাদের সাথে ওদের দু’’জনকেও নিয়ে নিলাম।

ম্রো আদিবাসী

ঢাকা থেকে করে আসা প্ল্যান মোতাবেক আমাদের এবারের গন্তব্য গজালিয়া ইউনিয়নের ’’চিয়ং মুরং পাড়া’’। লামা পৌরসভা থেকে এই ম্রো (মুরং) পাড়াটিই সবচাইতে কাছে। লামা উপজেলায় ম্রো-রা আসলে থাকে অনেক দুর্গম পাহাড়ে, যেসব জায়গার অনেকগুলোতেই লামা থেকে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ দিনের পায়ে হাঁটা পথ। মারমা কিংবা ত্রিপুরা আদিবাসীদের মতো এরা সমতলে বসবাস করেনা। এই দুর্গম পাহাড় থেকে প্রতি শুক্রবার তারা লামা উপজেলায় আসে এবং পৌরসভার কাছে অবস্থিত মারমা পাড়ায় বাসা ভাড়া করে এক রাত কাটায়। কেননা পরের দিন শনিবার লামা বাজারে হাট বসে। ম্রো-রা তাদের হাতে বানানো বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং জুম চাষে উৎপন্ন ফসল এই হাটে বিক্রি করতে আসে।

পাহাড়ী আদিবাসীদের মধ্যে ম্রো-রা অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চাদপদ জাতি হিসেবে পরিচিত। যদি শিক্ষার কথা বলি, তাহলে হাতে গোণা সামান্য কয়েকটি ম্রো পরিবারে একজন মাধ্যমিক পাশ করা ছাত্র বা ছাত্রী পাওয়া যাবে। চিকিৎসার ব্যাপারে বলতে গেলে অধিকাংশ ম্রো-ই স্থানীয় গাছ-লতা-পাতা দ্বারা চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকে। খুব বেশি জরুরী প্রয়োজন না হলে এরা পাহাড় থেকে লামা পর্যন্ত আসেনা। আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এরা বাংলাদেশ সরকারের ই.পি.আই কার্যক্রমের টিকা সমূহও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেবার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, টীকা দিলে বাচ্চার জ্বর হয়, বাচ্চা মারাও যেতে পারে।

পরিশ্রমী ম্রো নারী

পাহাড়ের অনেক উঁচুতে ম্রো-রা বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে বাড়ি বানায়। সাধারণত এরা নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতেই পছন্দ করে। তাই যখন তাদের পাড়ার কাছাকাছি কোন বাঙ্গালী পাড়া গড়ে ওঠে, তখন তারা তাদের কারবারীর (দলনেতা) নির্দেশে নিজেদের পাড়া ছেড়ে আরও দুর্গম কোন এলাকায় গিয়ে নতুন পাড়া গড়ে তোলে। অন্যান্য আদিবাসীদের মতোই ম্রো মেয়েরা খুব পরিশ্রমী। বাচ্চা প্রতিপালন এবং পরিবারের কাজ করা ছাড়াও এরা জুম চাষ করে অভ্যস্ত। ম্রো নারীরা তাদের নিজস্ব ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা বোঝেনা এবং ম্রো ছাড়া অন্য কারও সাথে কথাও বলেনা। কিন্তু পুরুষেরা মারমা ও বাংলা অল্প বোঝে এবং অন্যদের সাথে কথাও বলে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, জামা-কাপড় পরিধানের বিষয়ে ম্রো নারী এবং পুরুষ -উভয়ই বেশ উদাসীন বলেই মনে হলো।

ফিরে আসি আমাদের ’চিয়ং মুরং পাড়া’ ট্রেকিং-এর গল্পে। বুড়ির ঝিরি স্ট্যাণ্ড থেকে সকাল ৯.৩০ এর দিকে আমরা চার অভিযাত্রী হাঁটা শুরু করলাম। পিঠে আমার ব্যাকপ্যাকে টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর হাতে ডিএসএলআর। চমৎকার আবহাওয়া। গল্প করতে করতে চারজন এগিয়ে চলেছি। সামান্য উঁচু-নিচু রাস্তা। এভাবে চলতে চলতে পর পর তিনটা ঝিরি পার হলাম। চলার পথে বুড়ির ঝিরি মার্মা পাড়া পেছনে ফেলে কাইম্পা পাড়ার দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। এই ফাঁকে একটা কথা না বলে পারছিনা। গত ৫ অক্টোবর, ২০১১ তারিখে আমি এই ’চিয়ং মুরং পাড়া’ যাবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিল। এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সেবার আমি একটা পাহাড়ী খরস্রোতা খালে পড়ে গিয়ে কোন মতে বেঁচে ফিরেছিলাম। আর ক্যামেরাটাও সৌভাগ্যবশত: বেঁচে গিয়েছিল। সেবার আমার সাথে আরেক স্থানীয় পাহাড় স্পেশালিস্ট অরূপম ছিল। চলার পথে আচমকা একটা সাপ তার পা জড়িয়ে ধরেছিল। অল্পের জন্যে সাপের কামড় খায়নি সে। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ে সেবারের যাত্রাটা খুব একটা সুখকর ছিলনা আমাদের জন্যে। এবার অবশ্য বৃষ্টি নেই, পাহাড়ে বেশ একটা শীতের আমেজ পড়েছে।

কাইম্পা পাড়ার আদিবাসী বসতি

সকাল সাড়ে দশটার দিকে কাইম্পাপাড়া পৌঁছানোর পর আমরা বিশ্রাম নিলাম। এই কাইম্পা পাড়াতেও অবশ্য মুরং পরিবার রয়েছে। এখানে একটি ত্রিপুরা পরিবারও বাস করে। পাহাড়ী শিশুদের জন্যে নিয়ে আসা চকোলেট দিলাম তাদের। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাইম্পাপাড়ার ম্রোদের সাথে খাতির করে ফেললাম। তারপর তাদের অনুমতি সাপেক্ষে বেশ কিছু ছবি তুললাম আশে পাশের বসতিগুলোর।

আবার শুরু হলো পথ চলা। এবারের রাস্তা কিছুটা দুর্গম। লামা বাজার থেকে কেনা ১৩০ টাকা দামের বেল্টসহ রাবারের স্যাণ্ডেলটা বেশ কাজে দিচ্ছে। এ বছর এপ্রিলে রুমা থেকে বগালেক ট্রেকিং – এর সময় সাথে খালি বোতল নিয়েছিলাম ঝিরি থেকে পানি খাবার জন্যে। ’চিয়ং মুরং পাড়া’-র রাস্তায় ঝিরি রয়েছে, কিন্তু বিশুদ্ধ খাবার পানি নেই। তাই লামা বাজার থেকে ব্লগার হুদাই পেচালের বুদ্ধি করে নিয়ে আসা ১ লিটার পানি বেশ কাজে দিয়েছে। অবশ্য মুখে চুইংগাম থাকাতে হাঁটার সময় পানির পিপাসাটা অনেকক্ষণ পরপর লেগেছে।

আমি আর মনিকা সামনে এগিয়ে চলেছি, অনেক পেছনে আছে হুদাই পেচাল এবং কেওহ্লা

পাহাড়ী দুর্গম রাস্তায় এগিয়ে চলেছি আমরা

বেলা এগারোটার দিকে আমরা ’চিয়ং মুরং পাড়া’-র কাছাকাছি একটা দুর্গম পাহাড় বেয়ে উঠছি। সামনে আমি আর মনিকা, পিছনে হুদাই পেচাল আর কেওহ্লা। ওদেরকে পেছনে ফেলে আমি আর মনিকা বেশ খানিকটা এগিয়ে একটা বসার মতো জায়গায় ছায়ার নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। অনেকক্ষণ হয়ে গেল, কিন্তু ওদের কোন খবর নেই। পাহাড়ের উপর থেকে চিৎকার করে ডাকলাম “”হুদাই, তুই ক————ই””। কোন উত্তর নেই। এবার আরও জোর দিয়ে ডাকলাম, ””হুদাই, তুই ক——————ই””। এখনও কোন সাড়া-শব্দ নেই। মনিকা আর আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম ওদের কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে। বেশ খানিকক্ষণ পর কেওহ্লার মৃদু আওয়াজ পেলাম। আমি আর মণিকা খুব দ্রুত আবার নামা শুরু করলাম। বেশ টেনশন হলো, ওদের আবার কোন বিপদ হলোনাতো?!

কেওহ্লার কাছে যখন পৌঁছালাম, তখন দেখি পাহাড়ী রাস্তার ধারে হুদাই পুরা বিধ্বস্ত অবস্থায় একটা ছোট গাছের নিচে বসে রয়েছে। আমাকে দেখেই বললো, ””আমি আর যাবোনা। আপনারা যান, আমি এখানেই বসে থাকবো। অনেক কষ্ট, আমার আর পা চলতেছেনা।”” হুদাই কে মনে করিয়ে দিলাম ঢাকাতে থাকা অবস্থায় আমাদের ফোনালাপের কিয়দংশ। বললাম, ””তখনতো খুব বীরের মতো বলেছিলি কোন সমস্যা নাই, কোন ব্যাপার না, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এখন?””

হুদাই বেশ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ””আগে জানলে কি আর কইতাম?”” যাইহোক, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং অনেক বোঝানোর পর হুদাই আবার পাহাড় বেয়ে ওঠা শুরু করলো আমাদের সাথে। এভাবে আরও বেশ খানিকক্ষণ পথ চলার পর বেলা ১১.৩০ মিনিটে আমরা পৌঁছালাম সেই বহুল প্রতীক্ষিত ’চিয়ং মুরং পাড়া’য়।

আমাদের দেখে পাহাড়ী ম্রো নারী এবং শিশুরা ভিড় করলো। ইশারায় একজনকে বললাম, ’পানি খাবো’। ম্রো-রা খুবই অতিথিপরায়ণ, তা তাদের ব্যবহারেই প্রকাশ পেল। ছোট শিশুদের জন্যে সাথে করে নিয়ে আসা চকোলেটগুলো দিলাম। সেই অল্পদামী চকোলেট পেয়েই তারা আনন্দে আত্মহারা।

অনেক উঁচু পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এই ’চিয়ং মুরং পাড়া’য় ৮ থেকে ১০ টা পরিবার বাস করে। দেখেই বোঝা যায়, অত্যন্ত দরিদ্র এরা। কিন্তু প্রচণ্ড দুর্গন্ধ চারিদিকে। কেওহ্লা জানালো, ম্রো-রা শূকর পালে এর মাংস খাবার জন্যে। এই শূকরের জন্যেই এত বেশি দুর্গন্ধ। ম্রো-রা কুকুর খেতেও বেশ ভালোবাসে। এজন্যেই ’চিয়ং মুরং পাড়া’য় বেশ কিছু কুকুর দেখলাম।উৎসবের সময় এরা কুকুরকে পেট ভরে ভাত খাওয়ায়। তারপর সেই কুকুর মেরে এর মাংস খায়। এমনকি কুকুরের পেটে থাকা ভাতগুলোও এরা খায়।

পাহাড়ের চূড়ায় চিয়ং মুরং পাড়া

বেলা সাড়ে বারোটার দিকে আমরা পাহাড় থেকে নামা শুরু করলাম। যে পথে উঠেছিলাম, সেই পথেই ফিরলাম বুড়িরঝিরি পর্যন্ত। যাত্রী ছাউনীতে বসে পায়ের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো জোঁক। রক্ত খেয়ে একেবারে ঢোল হয়ে গিয়েছে। পাহাড়ে এই জোঁকের প্রকোপ বর্ষায় আরও বেশি।

আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রায় ঘন্টা দুয়েক বসে থেকেও কিয়াজুবাজার থেকে লামা পর্যন্ত ফিরতী কোন গাড়ি পেলামনা। পাহাড়ী এলাকায় এই যানবাহনের সমস্যা খুবই প্রকট। অবশেষে একটা পিক-আপ আসতে দেখে সেটিকে ৪০০ টাকা দিয়ে রিজার্ভ ভাড়া করে লামা পর্যন্ত ফিরে এলাম। শেষ হলো আমাদের ’চিয়ং মুরং পাড়া’র অভিযানপর্ব।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Bandarbanlamastorytravel