ভাইজ্যাগ / বিশাখাপত্তনম ভ্রমণ

২০১৩ এর সেপ্টেম্বর। সেইসময়টা আমি চাকরীসূত্রে হায়দ্রাবাদে আর আমার স্বামী কলকাতায়। এমনিতেই আমি তখন কোম্পানির নোটিশ পিরিয়ডে আর ২৮শে সেপ্টেম্বর এখানকার পাট উঠিয়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় ফিরে যাচ্ছিই কিন্তু তার কিছু আগে ৯ই সেপ্টেম্বরটা দুজনেরই ইচ্ছে একসঙ্গে কাটাই। আমার জন্মদিন কিনা! রেলযোগে হায়দ্রাবাদ-কলকাতার মাঝখানে ভাইজ্যাগ (Vizag) বা বিশাখাপত্তনম (Visakhapatnam) আমাদের গন্থব্যস্থল হিসেবে ধার্য করা হল। ইতিপূর্বে একবার ভাইজ্যাগ ঘুরে এলেও আমাদের আবার সেখানে যাবার উৎসাহে কোন কমতি ছিলনা।

ভিমলী বীচ, ভাইজ্যাগ

শুক্রবার অফিস থেকে বেরিয়ে মোটামুটি একই সময়ে রাতের ট্রেনে চাপলাম আমি এখান থেকে আর সে হাওড়া স্টেশন থেকে। বরাবরই দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে কোথাও যেতে আমার ভীষণ রোমাঞ্চকর লাগে আর একা হলে তো কথাই নেই! বিভিন্ন সহযাত্রীদের বিভিন্ন ভাষার সংলাপ বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে একসময় ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে আমার আগেই আমার Husband পৌঁছে যাওয়ায় ঘণ্টাখানেক তাকে আমার জন্য ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে হল। স্টেশনটি বেশ পরিছন্ন। আমি পৌঁছনোর পর স্টেশন থেকে একটা অটো নিয়ে আমরা চার কিমি দূরে আর কে বীচ চলে এলাম।

Rushikonda Beach, Vizag

শহর ছেড়ে বীচ রোডে পড়তেই সামনে ভেসে উঠল চোখ জুড়নো অথৈ সমুদ্র। বড়ো রাস্তা ধরে একদিকে সমুদ্র আর অন্যপ্রান্তে জায়গায় জায়গায় ছোটবড়ো হোটেল আর লোকালয় গড়ে উঠেছে। এই রাস্তা ধরে চলে গেলে পরপর রয়েছে Ramkrishna Beach, Rushikonda Beach, Bheemili beach সমুদ্রসৈকতগুলি। আবার পেছন দিকে রয়েছে Yarada Beach, Durga Beach।

ভিমলী বীচ, ভাইজ্যাগ

আমরা Ramkrishna Beach এ সমুদ্রের ঠিক উল্টোদিকে কম খরচে কিন্তু ঘরে বসেই সমুদ্র দেখা যাবে এমন একটা হোটেল নিলাম। অন্ধ্রপ্রদেশের এই বহু পুরনো বন্দর শহরটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে। সেদিনটা শুধুই বিশ্রাম আর সমুদ্রের ধারে বসে বিশুদ্ধ বাতাস সেবন করে কেটে গেল।

পরের দিন সকালে একটা অটো ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম Yarada Beach এর উদ্দেশ্যে। এই প্রাইভেট বীচটি শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। প্রায় কুড়ি কিলোমিটার। গ্রামের ভেতরে সরু রাস্তা দিয়ে পৌঁছালাম সেখানে। একটি পার্ক লাগোয়া পরিস্কার বীচটি সারাদিন অলস সময় কাটানোর জন্য বেশ উপযুক্ত। তবে সমুদ্র এখানে খুবই গভীর আর ভয়ানক। বন্য প্রকৃতির। তাকে সমঝে না চলার দুঃসাহস প্রাণহানিরও কারণ হতে পারে। সমুদ্রের পাড়ে গা ডুবিয়ে আনন্দ নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। জানতে পারলাম অতীতেও ঘটে গেছে কিছু মর্মান্তিক ঘটনা। সমুদ্রের সাথে নিবিড়তা বাড়ানোর আদর্শ জায়গা এই নারকেল গাছে ঘেরা বীচটি অন্যান্য বীচের তুলনায় অনেক নির্জন। পরিস্কার নীল জলের ওপর বসে আমরা পাথরের উপর আছড়ে পড়া বড়ো বড়ো ঢেউ গুলি একটি করে গুনতে থাকলাম অল্পখন নাকি অনেকক্ষণ! পার্কে রয়েছে স্নানঘরও। স্নান করে দুপুরের খাবারটা পার্কের ভেতরের রেস্তোরাঁ থেকে সারলাম। মেনুতে অনেক কিছু থাকলেও এখানে খাবারের মাণ খুব একটা ভালো নয়।

Yarada Beach , Vishakhpatnam

হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যেবেলা আবার বের হলাম সমুদ্রের টানে। কিন্তু বেরিয়ে দেখলাম বৃষ্টি পড়ছে। আমার Husband আমাকে দাঁড় করিয়ে ছাতা আনতে ছুটল। যতটা তাড়াতাড়ি গেল ফিরল কিন্তু অনেক পরে। ফলে এই সময়টুকুর সমানুপাতে আমার রাগের পারদও চড়তে থাকল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। ফিরল যখন তখনও সেরকম সন্তোষজনক উত্তর না পাওয়ায় রাগটা একেবারে চলে গেলনা। সেটা নানা ভাবে আমার ব্যাবহারে প্রকাশও পেতে থাকল। সেদিনই অবশ্য আসল কারণটা জানা গেল এবং সেটা খুব মজাদারও বটে। আমার জন্মদিনের উপহার হিসেবে কলকাতা থেকে তানিস্কের যে হারটা কিনে এনেছিল সেটা এই দুদিন আমার সামনে দেখার সাহস পায়নি পাছে Surprise টা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ছাতা আনার ফাঁকে সেটা দেখতে গিয়ে মাথায় হাত। পাতলা বলে হারটা পুরো জড়িয়ে একাকার কাণ্ড। সেটা তো আর এইভাবে দেওয়া যায়না! অগত্যা গিঁট ছাড়াতে অনেকটা সময় চলে যায় আর সেটা আমাকে না বলতে পারায় এই বিপত্তি! আজও ওই হারটা গিঁট ছাড়াতে গেলে আমার ভাইজ্যাক এর এইবারের স্মৃতির পাতাটা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। পরের দিন আমাদের আবার যে যার জায়গায় ফিরে যাওয়া বিকেলের ট্রেনে।

Yarada Beach , Vishakhpatnam

সকালের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম Bheemili beach এর উদ্দেশ্যে। বীচটি যতনা ভালো লাগবে তার চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ্য যাবার পথটা। Bheemili অবধি সমুদ্রকে সঙ্গে করেই চলতে লাগলাম। ত্রিশ কিমি রাস্তা শুধুই দেখতে দেখতে কেটে গেল। যত সামনের দিকে গাড়ি এগোয় জলের নীল বর্ণ ঘন হতে থাকে। রুপোলী বালির চর, নীল স্ফটিক জলরাশি, শরতের পেঁজা তুলোর মেঘে ভরা আকাশ আর তাল-নারকেল গাছের নানান ভঙ্গিমা সব মিলিয়ে চোখ ও মন ভরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। Bheemili beach টি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেইভাবে টুরিস্ট আকর্ষণ করতে পারেনি। এখানে মহাভারতের কিছু চরিত্রসহ অনেকগুলি সুন্দর মূর্তি আছে কিন্তু সেগুলির হালও তথৈবচই। ফেরার পথে দুপুরের খাবারটা আমরা APTDC Haritha Beach Resort এর রেস্তোরাঁতে সারলাম। খোলা বারান্দায় বসে নীচে দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র আর প্লেটে ঝলসানো সুস্বাসু বাসা মাছ Just ফাটাফাটি ছিল আমাদের ভ্রমণের ইতি হিসেবে।

ভিমলী বীচ, ভাইজ্যাগ
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ visakhapatnamvizag