অল্প কথায় ভিয়েতনাম ভ্রমন বৃত্তান্ত

গত ০৩ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত ভিয়েতনাম এ ৮ দিনের একটা ট্যুর দিয়ে আসলাম। আপডাউন টিকেট ছিলো মালিন্দো এয়ারে যা আমি ট্যুরের ৭ দিন আগে নিজে নিজেই কেটেছি মালিন্দোর ওয়েবসাইট থেকে। ২৫৮০০ টাকা আপডাউন। ভিয়েতনামে আমি ৮ দিনে ৪ টি জায়গায় থেকেছি। হো চি মিন ২ দিন, হই আন ২ দিন, হ্যানয় ২ দিন, ফুকক ২ দিন।

হো চি মিন

বাংলাদেশ থেকে আমরা হো চি মিন এ ল্যান্ড করি ৪ তারিখ বিকালে। ওখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আমাদের আগে থেকে রিজার্ভ করা বুই ভুয়েন স্ট্রিট এর হোটেল এ যায়। ঐ দিন পৌছে সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো। ফ্রেস হয়ে আশে পাশের রাস্তা হেটে দেখেছি, স্কাই বার(২৭ তলা) এ গিয়ে কিছু খেয়ে, বসে সময় কাটিয়েছি।রাতে স্কাই বারে গেলে পুরো সিটি ভিউ দেখতে পাবেন। পরদিন ওয়ার মিউজিয়াম, নটরডেম , পিংক ক্যাথেড্রাল, পোস্ট অফিস এগুলা দেখে সময় কাটিয়েছি। সময় স্বল্পতায় চু চি টানেল যেতে পারিনি কারন ওটা দেখতে প্রায় ১ দিন লাগে। সন্ধার পর আমাদের হোটেল সংলগ্ন বুই ভুয়েন স্ট্রিট এ সময় কাটিয়েছি রাত ১১ টা পর্যন্ত। বুই ভুয়েন পুরা ভিয়েতনাম এর সবচাইতে ব্যাস্ত আর উৎসবমুখর এলাকা, যেখানে নাইটলাইফ আপনাকে পাগল করবে যদি নাইট লাইফের প্রতি আপনার ইচ্ছা থাকে। মোটামুটি সারা রাত এই নাইটলাইফ পাবেন যেখানে লাইভ ডিজে সহ বার, স্ট্রিট পারফর্মার, খাবার দাবার আর মানুষে লোকারন্য থাকবে।

হো চি মিন

হই আন

৬ তারিখ সকালের ফ্লাইটে আমরা দানাং পৌছায়। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ২৮ কিমি দুরের হই আনে ওল্ড টাউনের একদম পাশেই একটা হোটেলে উঠি(৫ মিনিটের হাটা পথ)। অনেকে দানাং থাকে, কিন্তু দানাং এর চাইতে হই আন অনেক বেশি সুন্দর আর অন্য রকম একটা পরিবেশ। আমার কাছে পুরা ভিয়েতনামের হই আন সবচাইতে সুন্দর লেগেছে। এখানে আমি ১ মাস ও কাটিয়ে দিতে পারতাম 🙂 ওল্ড টাইনে সব হলুদ রঙের পুরাতন বাড়ী, আলো ঝলমলে হাজার হাজার ল্যান্টার্ন, শত শত প্রদীপ ভাসা নদি, আলোকিত নদি আপনার মন বদলে দিবে। আমরা সন্ধ্যা বাই সাইকেল, হেটে হেটে ঘুরেছি, নদির পাশের রেস্টূরেন্টে খেয়েছি, ছবি তুলেছি, বেশ রাতে ফেরত এসেছি। স্কুটি ভাড়া নিয়েছিলাম, কিন্তু রাস্তায় চলার দিক উলটা হওয়াই অসস্তি বোধ করায় কিছুক্ষন পর ফেরত দিয়েছি। স্কুটী থেকে বাইসাইকেল বেটার যা আপনাকে হোটেল ফ্রি দিবে। তাছাড়া ওল্ড টাউনে স্কুটি নিয়ে ঘুরতে পারবেন না।

ওল্ড টাউন, হই আন

পরদিন প্যাকেজ নিয়ে সান ওয়ার্ড ফ্রেন্স ভিলেজ ট্যুরে গিয়েছি। কেউ ব্যাক্তিগত ভাবে যেতে পারেন, তবে আমি প্যাকেজ নিতে প্রিফার করি। খরচ ও ঝামেলা কম। কারন সেটা হই আন থেকে ৫০ কিমি দূরে এবং বেশ সময় লাগে। প্যাকেজ নিলে খরচ কম, গাইড থাকায় ঝামেলা অনেক কমবে। ফ্রেন্স ভিলেজ ট্যুরে আপনি গোল্ডেন ব্রিজ দিয়ে পার হয়ে পুরা ফ্রেন্স কলোনি দেখবেন। ৩ ধাপের ক্যাবল কারের মাধ্যমে আপনি ফ্রেন্স ভিলেজ পোছাবেন, মাঝে অনেক গার্ডেন ও অনেক কিছুই আছে যা আপনাকে অবাক করবে। আর ফ্রেন্স ভিলেজ আপনাকে মিনি ইউরোপের টেস্ট দিবে।আমার অনেক ভালো লেগেছে। প্যাকেজে দুপুরের বুজে খাবার ইঙ্কলুডেড। সন্ধায় ফিরে এসে আবার ওল্ড টাউনে হেটে বেড়াইছি, নাইট মার্কেটে ঘুরেছি, খেয়েছি।

হ্যানয়

৮ তারিখ সকালের ফ্লাইটে আমরা হ্যানয় পৌছায়। সেখানে ওল্ড কোয়ার্টারে হোটেলে উঠি। হো চি মিন ঘুরে আসার পর হ্যানয় অতোটা ভালো লাগেনি। নরমাল শহর। সিটি সেন্টারে কিছু নাইটলাইফ আছে। আমরা লাইভ কন্সার্ট পেয়েছিলাম। বিখ্যাত ডং এক্সুয়ান মার্কেটে গিয়েছিলাম বিকালে। সন্ধার পর পাশেই নাইট মার্কেট আছে, ঘুরে দেখতে পারেন। ডং এক্সুয়ান বা নাইট মার্কেটের থেকে যাই কিনেন, দাম দর করে কিনবেন। ৬০% থেকে দাম বলা শুরু করবেন। ওল্ড কোয়ার্টার সিটি সেন্টারের একদম পাশে হওয়াতে এখানে থাকলে সব গুলা হেটেই দেখতে পারবেন। পরদিন আগে থেকে নেয়া প্যাকেজে সকালে আমাদের জন্য গাড়ী আসে হ্যালং বে (Ha Long Bay) ট্রিপ এর জন্য। ওল্ড কোয়ার্টার থেকে ১৭০ কিমি দূরে হ্যালং বে। পৌছাতে ২.৫ ঘন্টার মত লাগবে। সেখানে পৌছে বেশ পরিপাটি সুন্দর ক্রুজে ঘুরবেন , খাবেন, মাঝে ১টা কেভ ট্রিপ আছে, গাইড সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখাবে। আমার কাছে হ্যালং বে মোটামুটী লেগেছে। অতো ভালো পাইনি, কারন সারাদিন বৃষ্টি ছিল, বেশ শীত ছিলো। সন্ধার দিকে ফেরত এসেছি।

হ্যালং বে

ফুকক

১০ তারিখ সকালের ফ্লাইটে আমরা ফুকক পৌছায়। এটা একটা সাদা বালির আইল্যান্ড। কিছুটা ইন্দোনেশিয়ার বালি এর মত। অনেক গরম। হ্যানয়ে ১২ ডিগ্রি থেকে এখানে এসে ৩০ ডিগ্রি পেয়েছি। এয়ারপোর্ট থেকে রিসোর্ট এর নিজস্ব গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে গেছে। আমাদের রিসর্ট ছিলো ডুওং ডং এলাকায় যেটা সেন্টার বলতে পারেন। পাশেই বালির মত রেস্টুরেন্ট, বার সব কিছুই আছে সারি সারি।বিচ পার্টি পাবেন মাঝে মধ্যেই। আমরা আমাদের রিসর্ট এর বিচসাইড বারেই সময় কাটীয়েছি। এর পর রাতে বাইরের একটা ইন্ডিয়ান রেস্টূরেন্ট এ খেয়েছি।

পরদিন একটা ডে প্যাকেজে ২ টা আইল্যান্ড ট্রিপে গিয়েছি। এর মধ্যে স্নোর কেলিং, ফিশিং, খাওয়া দাওয়া, অন্তরভুক্ত ছিলো। সন্ধায় ফিরে এসেছি। ১২ তারিখ সকালের ফ্লাইটে আবার হ চি মিন এয়ারপোর্টে গিয়ে সেখান থেকে কিছুক্ষন পর দেশের ফ্লাইটে রওনা দিয়েছি।

Kien Van, Kiến Giang

খাবার

বালির তুলনায় সস্তা মনে হয়েছে। একটা জিনিস হলো, ভিয়েতনাম এর খুব জনপ্রিয় খাবার হলো শুকর(পর্ক)। স্ট্রিট ফুডে মোটামুটি সব কিছুতেই পর্ক দেবার চেস্টা করে। একারনে শুধু মাত্র একবার স্ট্রিট ফুড খেয়েছি, তাও সেটা ছিলো ব্যাং এর পা ভাজি। তাছাড়া স্ট্রিট ফুডে আপনি যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন যে আপনাকে পর্ক ছাড়া দিতে, লাভ নেই। তারা বুঝবে না। বেশির ভাগ ভিয়েতনামী ইংরেজী পারে না, বোঝেও না। ভালো রেস্টুরেন্ট এ গেলে অন্তত ইংরেজি বোঝাতে পারবেন। প্রতিটা এলাকায় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। গুগল ম্যাপেই পাবেন। খরচ একটু বেশি, কিন্তু আরাম করে খেতে পারবেন। তাছাড়া ভালো রেস্টুরেন্ট এ পর্ক বিহিন খাবার পাবেন যেটা স্পেসিফাই করা থাকবে। পর্ক খেতে না চাইলে স্ট্রিট ফুড কম খাওয়াই ভালো। হ্যানয় এ আমার ভার্সিটির ২ জন ১ বছর ধরে চাকরিতে আছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, স্ট্রিট ফুডের নুডলসেও তারা পর্ক এর গুড়া মাংশ মিশায়। এজন্য স্ট্রিট ফুড অ্যাভোইড করেছি। বিভিন্ন ধরনের সি ফুড পাবেন সব রেস্টুরেন্টেই। যত পারেন খান, এটা ভালো জিনিস। আমি সি ফুড খেয়েছি ইচ্ছা মত।

রাস্তা, ট্রাফিক, ট্যাক্সি

রাস্তা অনেক অনেক ভালো। সব মোড়ে ট্রাফিক লাইট আছে, যেটা সবাই মানে। কিছুক্ষন পর পর ৩০ সেকেন্ড বা ১ মিনিট এর সিগ্নাল আছে কিন্তু জ্যাম নাই, কেউ অকারনে হর্ন বাজায় না। হাইওয়ে গুলা দেখার মত। স্টিয়ারিং বাম পাশে না হলে নিশ্চিত আমি নিজেই ড্রাইভ করে লং ট্রিপে যেতাম। ট্যাক্সি নিয়ে একটু সমস্যা আছে। মিটার ছাড়া ট্যাক্সিতে ওঠা যাবে না। এরা এই একটা যায়গায় ধান্দাবাজ। মিটার দেখে ঊঠেন, সমস্যা নাই।

ভিনাসুন, মাই লিন এর সুনাম আছে। চাইলে গ্রাব ও ইউজ করতে পারেন যেটা আমাদের উবার এর মত।

ফ্লাইট

এক স্টেট থেকে আরেক জায়গায় যেতে বাস, ট্রেন অথবা এয়ার। আমরা যেহেতু অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম, তাই বাসে বা ট্রেনে যাত্রা না করে ডমেস্টিক এয়ারে যাত্রা করে সময় সেভ করেছি। আমরা প্রথম ৩ টা ডমেস্টিক ফ্লাইট কেটেছি ভিয়েতজেট এ। এটা বাজেট এয়ার, কিন্তু অনেক ফ্লাইট এবং কিছুক্ষন পর পর। আমি দেশ থেকে নিজে নিজেই কার্ড দিয়ে টিকেট গুলা সব কেটে নিয়ে গেছিলাম ওয়েবসাইট থেকে। এরা চেকিন লাগেজ দেইনা। আমি আমাদের ২ জনের জন্য প্রতিটা ফ্লাইটে ১ টা ২০ কেজি লাগেজ কিনেছিলাম যার প্রতিটা ছিল ৬ ডলার এর মত।লাস্ট ডমেস্টিক টা কেটেছিলাম ভিয়েতনাম এয়ারে। কারন ভিয়েতজেটের বদনাম আছে মাঝে মাঝে ফ্লাইট ডিলে করার। আমরা ৩ টার মধ্যে ২ টাই ডিলে পাইনি, ১ টাই ১ ঘন্টা ডিলে পেয়েছি। এজন্য শেষের টার রিস্ক নেই নাই যেহেতু তার পরেই আমাদের দেশের ফ্লাইট। ডমেস্টীকে ভিয়েতজেট সবচাইতে সস্তা, ভিয়েতনাম এয়ার সবচাইতে ব্যায়বহুল যারা ২০ কেজি করে লাগেজ নিতে ও দেয় এবং খুব সময় সচেতন।

ক্যাবল কারে ফ্রেন্স ভিলেজ যাওয়ার পথে

খরচ

হোটেল খরচ আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম। আমি বাংলাদেশ থেকেই সব হোটেল অ্যাগোডাতে বুক করে পে করে গিয়েছিলাম, যাতে অনেক সুবিধা হয়েছে। আমরা ৩-৪ স্টার মানের হোটেল এ ছিলাম বেশির ভাগ সময়। শুধু হই আন এর টা ২স্টার ছিলো কিন্তু অনেক সুন্দর ছিলো। সব হোটেল এই সকালের চমতকার বুফে ব্রেকফাস্ট ছিলো। হোটেল খরচ পার নাইট ৩০$ – ৪৫$.

ইন্টারনাল ফ্লাইট খরচ অনেক কম যদি এক্টু আগে কাটেন৷ ভিয়েতজেট সবচাইতে সস্তা।

খাবার এর খরচটা একটু বেশি যদি শুকর পরিহার করতে চান। ইন্ডিয়ান খাবার খেতে গেলে ২ জনের কমে যাবেন না। তাদের যে কোন আইটেম ২-৩ জনের জন্য। আমাদের ৮ দিন এর ট্যুরে সব সহ ২ জনের টোটাল ২১০কে এর মত খরচ হয়েছে।

ভিয়েতনাম অনেক পরিস্কার জায়গা। সব জায়গায় ডাস্টবিন আছে।বাইরে কোন ময়লা ফেলে দেশের নাম কেউ খারাপ করবেননা। কেউ স্কুটি ভাড়া নিলে ট্রাফিক লাইট মেনে চলবেন। আমি রাত ১ টার সময়ও ফাকা রাস্তায় ১ টা গাড়িকে ট্রাফিক আইন ব্রেক করতে দেখিনি।এরা অনেক ভাল, ভালো ব্যবহার পাবেন। দয়া করে অকারনে এদের কারো সাথে খারাপ ব্যাবহার করে নিজের বংশের পরিচয় সহ দেশের নাম খারাপ করবেন না।

হ্যাপি ট্রাভেলিং 🙂

Leave a Comment
Share