স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ

সুইজারল্যান্ডকে আমি প্রথম দেখি যশ চোপড়ার ক্যামেরায়। ছবির নাম চাঁদনি। তখন বাড়িতে হিন্দি সিনেমা দেখার অনুমতি ছিল না। তাই দিদির এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম। ছবির মতো সুন্দর দেশটি দেখে প্রথম দর্শনেই মোহিত হয়ে পড়ি। এর পরে আরও অনেক বার দেখেছি তাকে সিনেমার পর্দায়। তবু দেশটির প্রতি মুগ্ধতা কমেনি একটুও।

স্বামীর কর্মসূত্রে এখন প্যারিসে রয়েছি। তাই শেনেগন ভিসা তো হাতে রয়েছে! ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশে ভ্রমণের ছাড়পত্র হল এই ভিসা। সুইজারল্যান্ডও রয়েছে সেই তালিকায়। পশ্চিমের সব দেশেই শরতের এক অন্য সৌন্দর্য। এই সময়ে গাছের পাতায় চলে রংবদলের খেলা। তাই শরতের শুরুতেই ঠিক হল সুইজারল্যান্ড বেড়ানোর পরিকল্পনা।

আমাদের যাত্রা শুরু জুরিখ দিয়ে। সুইজারল্যান্ড (Switzerland) এর বাণিজ্যিক রাজধানী এই শহর। প্যারিস থেকে ফ্রান্সের টিজিভি ট্রেনে চেপে রওনা দিলাম। অতি দ্রুতগামী ফ্রান্সের এই ট্রেনটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। ট্রেনের কাচের জানলা দিয়ে মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে ৭০০ কিলোমিটারের পথ মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় অতিক্রম করে পৌঁছলাম জুরিখ।

পাহাড় ঘেরা ছোট্ট সাজানো শহর (Zurich) জুরিখ। কাছেই রাইন জলপ্রপাত। ইউরোপের সব থেকে বড় জলপ্রপাত। জুরিখ থেকে ট্রেনে ঘণ্টাখানেক। তার পর কিছুটা পায়ে হেঁটে পৌঁছলাম জলপ্রপাতের কাছে। অবাক করে দেয় এর ব্যাপ্তি। চার পাশের রঙিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।

দ্বিতীয় দিনে আমরা জুরিখ থেকে ইন্টারলাকেনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। যাত্রাপথে পড়ে রাজধানী বার্ন। অন্যান্য দেশের রাজধানী শহরগুলির থেকে আলাদা এই শহর। রূপকথার মতো সুন্দর শহরটির ওল্ড টাউনটিকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ টাউন’-এর মর্যাদা দিয়েছে। পরিবার নিয়ে জীবনের কয়েকটি বছর এই শহরেই কাটিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন। সেই বাড়িটি এখন মিউজিয়াম।
বার্ন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম ইন্টারলাকেনের পথে। পাহাড় ঘেরা দু’টি হ্রদ— লেক থুন এবং লেক ব্রিয়ানজ। এর মাঝের উপত্যকাই হল ইন্টারলাকেন। প্রকৃতির কোলে এই উপত্যকার অপরূপ সৌন্দর্য সম্পর্কে যা বলা হবে, তা অবশ্যই কম। নীল পাহাড়ে ঘেরা হ্রদ। আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের মেলা। সবুজ মখমলের মাঠে ছোট ছোট ফুলের রঙিন নকশা। মাঝে সুন্দর সুন্দর কাঠের বাড়ি। এই সব দেখে মনে পড়ে, পারস্য কবি আমির খসরুর কবিতার একটি লাইন— যদি স্বর্গ কোথাও থাকে, তা এখানেই, তা এখানেই, তা এখানেই।

এখানে আমরা পরের পাঁচ দিন কাটিয়েছিলাম উইল্ডারসুইল গ্রামের একটি ছোট সুন্দর হোটেলে। গ্রামের সীমানার সেই হোটেলের ঠিক সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোট্ট নদী। কাছেই একটি গির্জা ও ক্লক টাওয়ার। চার পাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে হোটেলের ঘর থেকে শোনা যেত নদীর চাপা কলধ্বনি। সময়ের ফাঁকে ফাঁকে গির্জার ঘণ্টাধ্বনি নিস্তব্ধতাকে অন্য মাত্রা এনে দিত।

ইন্টারলাকেনকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পাঁচ দিনের গন্তব্য ছিল জানগফ্র, লুজার্ন, মাউন্ট তিত্লিস, জার্মাট, গর্নাগ্রাট এবং মনত্রেউ। ৩৪৫৪ মিটার  উচ্চতায় জানগফ্র ইউরোপের সবথেকে বড় রেলস্টেশন। আমরা কগ হুইল এবং র্যাক রেলে চেপে কখনও সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে, কখনও বা পাহাড়ের টানেলের মধ্যে দিয়ে পৌঁছলাম আল্পস পর্বতের চূড়ায়। এর তুষারশুভ্র রূপ নির্বাক করে দেয়। রোদ ঝলমলে দিনে বরফ আর সূর্যরশ্মির যুগলবন্দিতে চোখ যাতে ঝলসে না যায় তাই স্নো-গগলস  পরতে হয়েছিল। বরফের ভাস্কর্যে সাজানো একটি হিমবাহ-গুহা রয়েছে এখানে।

পরের দিনের গন্তব্য লুসার্ন এবং মাউন্ট তিত্লিস। হ্রদ আর পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট শহর লুসার্ন। সেখান থেকে ট্রেনে করে আমরা এন্গেলবার্গ নামে একটি সুন্দর শহরে এলাম। সেখান থেকে কেবল কারে মাউন্ট তিত্লিস। ইউরোপের ট্রেন সফর এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। মাউন্ট তিত্লিসের সৌন্দর্যও অতুলনীয়। এখানেও একটি হিমবাহ-গুহা রয়েছে। শাহরুখ এবং কাজলের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’র একটি পোস্টার আজও রাখা রয়েছে এখানে। প্রচুর ভারতীয় পর্যটক ছবিও তুলছেন। আমরাও সে সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।

মেটার্হর্ন পর্বতের চূড়া দেখতে এর পর দিন যাই গর্নাগ্রাত। তবে মেঘলা দিন থাকায় পর্বতের চূড়াটা পরিষ্কার দেখতে পাইনি। শহরকে দূষণমুক্ত রাখতে এখানে ব্যাটারির গাড়ি চলে। সুইৎজারল্যান্ড ও ইতালি সীমান্তে এই শহরটি পর্যটকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় স্কি-রিসর্ট। শীতকালে দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা এখানে স্কিইং করতে আসেন।

দেখতে দেখতে যাত্রার প্রায় শেষে পৌঁছে গেলাম মন্ত্রৌয়ে। এই শহরটিকে সুইস রিভিয়েরা বলা হয়। এখানে লেক জেনেভার অসামান্য। আমরা একটি শ্যাত (বাংলাতে প্রাসাদ বা দূর্গ বলা যায়) দেখতে গিয়েছিলাম যার নাম ‘শ্যাত দ্য শিল্পীয়ন’। সূর্যাস্তের সোনা গলা রং ঢেলে জেনেভা তখন অন্যবদ্য রূপে। এর ঠিক পাশেই শ্যাতের নিজস্ব সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রকৃতি মিলেমিশে এক অন্য রূপ নিয়েছে।

মখমলের মতো সবুজ মাঠ, ছোট সুন্দর বাড়ি, মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে গরু, ভেড়া। চার দিকে মাথা তুলে সুন্দরী আল্পস। অবর্ণনীয় সুইজারল্যান্ড। সফর শেষে ঘরে ফেরার পালা। জেনেভা থেকে উড়ান ধরে সোজা প্যারিস। নীল আকাশের নীচে রঙিন প্রকৃতি দেখে সত্যি হল আমার আশৈশবের স্বপ্ন।

Leave a Comment
Share