কুয়াশাঘেরা তিনচুলে

ঠিক সকাল সাড়ে আটটায় শিলিগুড়ি তে বিশাল সিনেমার পেছন থেকে শেয়ার জীপটা ছাড়ল।আমরা চলেছি দার্জিলিঙের কাছে ছোট্টো পাহাড়ী গ্রাম তিনচুলেতে। আমাদের গাড়ী ধীরে ধীরে শিলিগুড়ি শহরকে পিছনে ফেলে ক্রমশ পাহাড়ী পথে প্রবেশ করল। সময়টা মে মাস বলে একটু গরমও লাগছিল। যত এগোতে লাগলাম, রাস্তার দুপাশে চা-বাগানের মনকাড়া সৌন্দর্য ততই বাড়তে লাগল। রঙবেরঙের ছাতা মাথায় পাহাড়ী কন্যারা চা বাগানে কর্মব্যস্ত। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে এসে পৌঁছলাম তাগদাতে। শেয়ার জীপ এখানেই আমাদের নামিয়ে দিল। নেমেই দেখি হাসি মুখের অল্পবয়সী এক যুবক তার গাড়ি নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করছে। ওই অভিরাজ। ওরই গেষ্ট হাউসে আমরা থাকব।

তাগদা থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছেগেলাম তিনচুলে। অসাধারন জায়গা। চারিদিকে পাহাড়ের মধ্যে একটুকরো জনপদ। একটু ফেশ হয়ে জলখাবার খেয়েই সবাই বের হলাম পদব্রজে আশপাশটা ঘুরে দেখতে। বেশ কিছুটা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে একটা দারুন জায়গায় হাজির হলাম। চারিদিকে ঘন সবুজ চা বাগান, চা বাগানের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্ত এঁকেবেঁকে চলে গেছে নীচের দিকে। সামনে কুয়াশা ঢাকা বিভিন্ন শৃঙ্গ। নিখাদ প্রকৃতির বুকে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে চললাম আমাদের হোমস্টের দিকে। আর মিনিট কুড়ির মধ্যেই ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনা।

হোমস্টেতে ফিরে বারান্দায় একটু বসেছি আর হঠাৎ পুরো বাড়িটা দুলতে শুরু করল। বুঝলাম ভূমিকম্প হচ্ছে। দৌড়ে বাইরে এলাম। দেখলাম অভিরাজরাও পুরো পরিবার সমেত ভগবানের নাম জপতে জপতে রাস্তায় উঠছে। রাস্তায় উঠেও বা কি লাভ? একদিকে তো খাড়া পাহাড়। একসময় কাঁপুনি থামল। আমরাও মনে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে ফিরে এলাম। এরই মধ্যে আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। আর তার মধ্যেই আবার ভূমিকম্প! একদিকে তুমুল বৃষ্টি আর একদিকে ভূমিকম্ক। ভাবলাম এই পান্ডব বর্জিত জায়গায় ‘খেলা’ বোধহয় সেদিনই শেষ হয়ে যাবে। ভাগ্যের অসীম করুনায় সেদিন কিছু হয়নি। সমস্ত নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষন বাদে অভিরাজের কেবল টিভিতে জানতে পারলাম নেপালে বড়সড় ভূমিকম্প হয়েছে যার মাত্রা ৭.৪। ১২ইমে, ২০১৫–এই দিনটাকে কেনোদিন ভুলতে পারব না।

বিকেলে চারটে নাগাদ সবাই মিলে বের হলাম কেভ পয়েন্টের দিকে। আবাহাওয়া তখন বেশ ভাল। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হাজির হলাম কেভ পয়েন্টে। সূর্যদেব অস্ত যেতে বসেছেন। চা বাগান, পাহাড়, সব মিলিয়ে এক অনবদ্য প্রকৃতিক পরিবেশ। হঠাৎ আমাদের অবাক করে দিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়ে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল কুম্ভকর্ণ, কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রমুখ বিখ্যাত শৃঙ্গরাজি। শেষ বিকেলের মায়াবী আলোয় অসাধারন লাগছিল সেই দৃশ্যপট।

পরেরদিন প্রাতরাশ সেরে একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম লামাহাটা। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো জায়গাটা। পাহাড়ের পাদদেশ একটা পার্ক। রঙবেরঙের ফুল, গাছ। সুন্দরভাবে বাঁধানো একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের ওপর। ওপরে ছোট্টো একটা লেক আছে। ২.৫–৩ কিমির ছোটো একটা ট্রেকিং এর স্বাদ পাওয়া যায়। পুরো জায়গাটা প্রকৃতিপ্রেমিকদের স্বর্গরাজ্য। লামাহাটা থেকে গেলাম তিস্তা আর রঙ্গিতের মিলনস্থল দেখতে।প্রায় ১৪/১৫ কিমি গাড়িতে করে এসে পৌঁছলাম তিস্তার তীরে। তিস্তার কালো জল এসে মিশেছে রঙ্গিতের ধূসর জলের সঙ্গে। জায়গাটা বেশ মনোরম। এখান থেকে ফিরে এলাম নিজেদের হোমস্টেতে।

তিনচুলের কাছাকাছি আরও বেশ কিছু জায়গা আছে — বড়ামাঙ্গোয়া, লামাহাটা, লেপচাজগত। সবকটাই মোটামুটি দেড় দুঘন্টা দূরত্বের মধ্যে। এই সব জায়গা গুলোতে ঘোরার প্রকৃষ্ট সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল। মে মাসে বড় বেশী কুয়াশা থাকার সম্ভাবনা যেটা আমরা পেয়েছিলাম।

শিলিগুড়িতে বিশাল সিনেমার কাছ থেকে সকাল ৮টা নাগাদ একটা শেয়ার জীপ ছাড়ে তাগদা পর্যন্ত। অনেক কম খরচে যাওয়া যায়। নয়ত শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি পাওয়া যাবে। তিনচুলেতে গুরুং হোমস্টে, অভিরাজ হোমস্টে বেশ ভাল। নেটে ঠিকানা পাওয়া যাবে। অভিরাজ হোমস্টেতে ঘর ভাড়া মোটামুটি ১২০০-১৫০০, সারাদিনের খাওয়ার খরচ ৭০০/৮০০ জনপ্রতি।

Leave a Comment
Share