২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। ওই অঞ্চল তখন পানিতে ভরপুর। তাহিরপুরে আমাদের দলটি ১৫ দিন ছিল। প্রতিদিনের নির্ধারিত কাজ শেষে আমরা চারপাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখতাম। আজ আপনাদের শোনাবো টাঙ্গুয়ার হাওড় নামক এমন একটি জায়গার কথা, যাদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি, যদি কখনো সময় এবং সুযোগ হয়, যেতে ভুলবেন না।
তাহিরপুরের অন্যান্য দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে খুবই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই যেদিন অন্যান্য কলিগদের সবার টাঙ্গুয়ার হাওড় দেখতে যাবার কথা, সেদিন আমি বললাম, “আপনারা বরং যান, আমি ক্লান্ত।” কিন্তু মমিন ভাইয়ের জোড়াজোড়িতে আমাকে যেতেই হলো তাদের সাথে। ট্রলারের পাইলটের নাম আলী নূর। মধ্য বয়স্ক একজন ধার্মিক মানুষ। তার সাহায্যকারী হিসেবে আছে কম বয়সী একটা ছেলে। আলী নূরের সাথে কথা-বার্তা ফাইনাল হলো যে আমরা বিকাল ৩ টার দিকে রওনা হবো। আর তাহিরপুর ঘাট থেকে যাওয়া-আসা বাবদ তিনি নিবেন ৮০০ টাকা। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখছি, তাহিরপুরে থাকার তেমন কোন ভাল ব্যবস্থা নেই। আমরা সরকারী ডাকবাংলোতে ‘ম্যানেজ’ করে ছিলাম। ডাক বাংলো দুইটা আছে। একটা ঘাট থেকে কাছে, আরেকটা একটু দূরে, হাঁটা পথ। তাহিরপুরে ভালমানের খাবার হোটেল নেই কোন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমরা স্থানীয় একজন বাবুর্চি (বুয়া) নিয়োগ দিয়েছিলাম। নদীর তাজা মাছ প্রতিদিনের আইটেমে ছিল যদিও শাক-সব্জি এইসব হাওড় এলাকায় কমই পাওয়া যায়।
সুনামগঞ্জের হাছন রাজা ঘাট থেকে ট্রলারে করে তাহিরপুর ঘাটে যেতে আমাদের সময় লেগেছিল ৬ ঘন্টা। ট্রলারেই যেতে হয়েছিল, কারণ তখন ছিল পানির মৌসুম। তবে শীতকালে (ডিসেম্বর-জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী) মোটর সাইকেলে ২ ঘন্টায় যাওয়া সম্ভব। ট্রলার রিজার্ভ করে গেলে ২০০০-২৫০০ টাকা পড়বে। আর একটি মোটর সাইকেলে ড্রাইভার ছাড়া তিন জন যাত্রীর প্রত্যেকের ২৫০ টাকা করে লাগবে।
টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ফিরে আসি আবার। এই হাওড়ের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এবং ধর্মপাশা উপজেলায় হাওড়টি অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওড়কে Ecologically Critical Area ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতিবছর শীতকালে প্রায় ২০০ প্রজাতির শীতকালীন পাখি এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে উড়ে আসে এবং এই হাওড়টি ১৪০ প্রজাতির মাছের জন্য বিখ্যাত।
আমাদের ট্রলার যখন বিকাল ৪.৩০ এর দিকে টাঙ্গুয়ার হাওড়-এর কাছাকাছি এল, হঠাৎ সজোড়ে ধাক্কা খেয়ে ট্রলার থেমে গেল। পাইলট অফিসার আলী নূর জানালেন, পানি কমে গিয়েছে, তাই ট্রলার আটকে গিয়েছে। তারপর ট্রলারের ৪-৫ জন যাত্রীরা আমরা সবাই নেমে গায়ের জোর দিয়ে ধাক্কা দিলাম। আর আলী নূর তার বাঁশের লগি দিয়েও চেষ্টা করতে লাগলেন। এভাবে কিছুক্ষণ পর আবার ট্রলার চলা শুরু হলো।
গাছের বেষ্টনীর ফাঁক দিয়ে আমরা ঢুকলাম টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। বেশ কিছুদূর ঢোকার পর আলীনূর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন। ট্রলার ভাসতে থাকলো পানির উপরে। আমরা চারপাশের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য দেখলাম। দু’ধারে গাছের সারি, আর তার মাঝ খানে আমাদের ট্রলারটা ভেসে রয়েছে। গাছের উপরে বিশাল সাইজের ধারি ইঁদুর, যারা গাছের বাকল খেয়ে বেঁচে আছে। আলী নূর বললেন , আগে এই এলাকাটা নির্জন বলে এখানে অনেক ডাকাতি হতো। এখন আর হয়না তেমন একটা। হঠাৎ দেখলাম, একটা ডিঙ্গি নৌকা খুব দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে। আলী নূর জানালেন, যদিও এখানে মাছ ধরা বা পাখি শিকার করা নিষেধ, তারপরেও চুরি করে মানুষ-জন এ কাজগুলো করছে।
ধীরে ধীরে সন্ধা নেমে এলো। পানির নিচ থেকে উঠে আসা দু’ধারের সারিবদ্ধ গাছগাছালিগুলোতে নাম না জানা হাজারো অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত। আমরাও ধীরে ধীরে রওনা হলাম তাহিরপুরে আমাদের গন্তব্যে।
১. উপজেলা ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার কৃপেশ দাস: 01724968161
২. উপজেলা গেস্টহাউজের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আনিসুল হক কে অনুরোধ করতে হবে: 01715172238
ট্রলার ভাড়া করতে হলে আলী নূরকে ফোন দিন: ০১৯২২০৫৬৭৩০
Leave a Comment