নীল পানির রাজ্য টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণ!

এক সপ্তাহ পরেই আশুরার ছুটি। শুক্র-শনি তো আছেই সেই সাথে রবিবারও ছুটি। পাক্কা ৩দিন। কিন্তু ব্যস্ততা আমাকে ছুটি কাটাতে দিচ্ছেনা। তাই এই ছুটিতে ট্যুরে যাই না… অনেকদিন হল। মজার ব্যাপার হল, বন্ধুসুলভ বড় ভাই হঠাৎ ফোন করে বললেনঃ বৃহস্পতিবার টাঙ্গুয়ার হাওড় যাচ্ছি, আপনিও সাথে যাচ্ছেন! জিজ্ঞাসা করলাম কয়দিনের ট্যুর? বললেনঃ একদিনের। টাক-ঢোক-টাক করে ২১-০৯-২০১৭ বৃহস্পতিবার টাঙ্গুয়ার হাওড়ে একদিনের একটা ট্যুর দিয়েই আসলাম! তাই সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওড় নিয়ে পোস্ট না দিয়ে পারলাম না।

মেঘ-পাহাড়-জল অন্যরকম এক রাজ্যে!

টাঙ্গুয়ার হাওড়টাঙ্গুয়ার হাওড়
অদ্ভূত টাঙ্গুয়ার হাওড়

টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যাওয়ার দুটো সময়ঃ ১- বর্ষাকাল। ২- শীতকাল। আমরা বর্ষাকালে গিয়েছিলাম। বাসে করে সোজা চলে গেলাম সুনামগঞ্জ। একদম লাস্ট স্টপেজে। বাস থেকে নেমে দেখি তাহিরপুর-তাহিরপুর বলে ডাকছে। আপনাকেও ডাকবে। সেখানে লেগুনা, সিএনজি আছে যেগুলো তাহিরপুর যায়। সেখান থেকে নৌকা বা ট্রলার-যোগে টাঙ্গুয়ার হাওড়। আমরা ৬জন হওয়ায় সিএনজি নিলাম। মাথাপিছু ১০০ টাকা বিশ্বম্বরপুর হয়ে একদম তাহিরপুর পর্যন্ত।

ইঞ্জিন বোট/ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া

একদিনের ট্যুর হলে ২০০০চেয়ে কমে ছোট- ইঞ্জিন বোট ভাড়া করতে পারবেন। আর যদি পূর্ণিমা উপভোগ করতে ২দিনের জন্য গিয়ে থাকেন তাহলে ৩০০০কমেই নৌকা ভাড়া করতে পারবেন। খুব সুন্দর ছই (ছই-এর উপরটা টিন সীট দিয়ে মোড়ানো) দেখে ইঞ্জিন বোট ভাড়া করবেন।যেন চাইলে ছইয়ের উপর শুয়ে বা বসে আশ-পাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে পারেন। যদি পূর্ণিমা উপভোগ করতে নৌকায় রাত্রি যাপন করতে হয় তাহলে প্রয়োজনীয় বাজার করে নিবেন।আর প্রাকৃতিক সকল ক্রিয়া-কর্ম নৌকাতেই সারতে হবে… 😆।

আমরা ১৫০০ টাকায় একটা ইঞ্জিন বোট ভাড়া করলাম।

যাত্রা হলো শুরু

সুরমা নদী দিয়ে যাত্রা শুরু করে … বিভিন্ন নদী ও খালের শাখা-প্রশাখা পাড়ি দিয়ে আমাদের বোট ছুটল টাঙ্গুয়ার হাওড় অভিমুখে।

ঐ–যে দেখা যাচ্ছে উত্তর দিকে, মেঘালয় রাজ্যের খাড়া খাড়া উঁচুনিচু পাহাড় আর তিন দিকে থৈ থৈ পানি! মাঠ-ঘাট রাস্তাসহ চতুর্দিকে শুধু পানি আর পানি! ভাটির দেশের প্রকৃত রূপ! কিন্তু কষ্টের বিষয় হল ঐ–যে পাহাড়ের কথা বললাম সেগুলো সব ভারতের অংশ!😡 এই পর্যন্ত যতগুলো জেলায় আল্লাহ্ পাক্ আমাকে ঘুরিয়েছেন প্রায় প্রত্যেকটি জায়গায় একই পরিণতি দেখেছি। পাহাড়গুলো তাদের আর ছুটকোছাটকা সব আমার সোনার বাংলার।😑

টাঙ্গুয়ার হাওড়ে পৌঁছে দেখি, অনেক দূর পর্যন্ত শুধু গাছ-গাছালীর উপরাংশ দেখা যাচ্ছে বাকি অংশ পানির নিচেই!পানি একটু ময়লা তবে সচ্ছ! পানির নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পানিপথে অনেকখানি যাওয়ার পর একটা ওয়াচ টাওয়ার চোখে পড়ল। অধিকাংশ পর্যটক এখানে নৌকা ভিড়িয়ে গোসল করে। কেউ কেউ শৈশবের দুরন্তপনার মতো ওয়াচ টাওয়ার থেকে পানিতে লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছে। আমদের প্রায় ৫জন সাঁতার জানত। আমারাও লাফালাফি থেকে পিছিয়ে ছিলাম না। যে সাঁতার জানত না সে আমাদের লাফ-ঝাঁপের ভিডিও করে। সাঁতার না জানা দু-একজন এমন থাকলে মন্দ কী😂!

রাতে হোটেলে থাকতে চাইলে টাঙ্গুয়ার হাওড় দেখে সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসতে হবে তাহিরপুরে। অথবা আপনি যদি তাহিরপুর না ফিরে টেকেরঘাট হয়ে ঘুরে যেতে চান তাহলে টেকেরঘাটে থাকার বেবস্থা আছে! এডভেঞ্চারপ্রিয় হলে তো কথাই নেই নউকায়েই রাত কাটিয়ে দিতে পারবেন।

টাঙ্গুয়ার হাওড়কে কেন্দ্র করে অনেক মাছ ধরা হয়। যদিও মাছ ধরা নিষেধ। যার জন্য মেজিস্ট্রেট সহ আনসার কর্মকর্তাগন হাওড় রক্ষার দায়িত্বে আছেন।তবে বাজারে দেখেছি বিভিন্ন রকমের পাঁচমিশালি ছোট ছোট তাজা মাছ বিক্রি হয়…। কিনে মাঝিদের দিয়ে বা নিজেরা রান্না করে খেতে পারেন।যার যেমন রুচি। আর স্থানীয় এলাকায় একপ্রকার সুগন্ধি চাল আছে (এই মুহূর্তে আমার মনে নেই) অবশ্যই খোঁজ নিয়ে খাবেন।

আমরা যারা ক্যামেরা বা মুঠোফোন দিয়ে প্রাকৃতিক ছবি তুলতে আরম্ভ করলাম তখন একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম আকাশ জুড়ে হরেক রকম মেঘ আর মেঘ। একটা চিত্র বেশি সময় থাকে না। এই বুঝি বৃষ্টি নামল!😍🌪 একটু ধরে আসলেও আসলনা! আর হ্যাঁ… সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহূর্তের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক অদ্ভূত ভাললাগা দৃশ্য!

আমরা তাহিরপুর দিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে গিয়েছি। আমরা সুনামগঞ্জ শহর থেকে তাহিরপুর গিয়ে– বোট নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড় ঘুরে ইট বিছানো এবং কাঁচা রাস্তা ধরে টেকের ঘাটে পৌঁছাই (টেকেরহাট ভুল উচ্চারণ) টেকেরঘাট থেকে মটর সাইকেলযোগে সুনামগঞ্জ শহর। প্রতি মটর সাইকেল ভাড়া নিবে ৩০০/৩২০ টাকা। দরকাষাকষি করে ভাড়া ঠিক করে নিবেন। এরা পর্যটকদের কাছ থেকে বকশিশ অতিরিক্ত দাবি করে।

আর টেকেরঘাট থেকে সুনামগঞ্জ শহর প্রায় চল্লিশ কিঃমিঃ দূর।একমাত্র মটর সাইকেলই যাওয়ার মাধ্যম। সুনামগঞ্জ শহরে অনেকে টেকেরঘাট হয়ে টাঙ্গুয়ার যাওয়ার পরামর্শ দেন। আমার মতে এটা ঠিক না। তাই সুনামগঞ্জ তাহিরপুর থেকে নৌকা ভাড়া নিতেই আমি সাজেষ্ট করবো।

সারাদিন টাঙ্গুয়ার হাওর সহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সুনামগঞ্জ শহর থেকে ২২-০৯-২০১৭ শুক্রবার রাতের বাসেই ঢাকা ফিরে আসি।

ভ্রমণ স্পট

  • তাহিরপুর।
  • জাদুকাঠা নদী।
  • টাঙ্গুয়ার হাওর।
  • নীলাদ্রি লেক।
  • টেকের ঘাট।
  • বারিক্কা টিলা।
  • নীলাদ্রি ঝর্ণা।

খরচ

  • রাতের বাসে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ৫৫০ টাকা (নন এসি বাস)।
  • সকালের নাস্তা খিচুড়ি ৫৫ টাকা।
  • সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর সিএনজি করে (৬জন) মাথাপিছু ১০০ টাকা।
  • ইঞ্জিন বোট ১৫০০%৬= ২৫০ টাকা।
  • টেকেরঘাট থেকে সুনামগঞ্জ শহর মোটর সাইকেল দিয়ে ১৫০ টাকা। ১ মোটর সাইকেল ৩০০ টাকা = ১৫০ মাথাপিছু।
  • রাতের খাবার ১৫০ টাকা। কি খাবেন সেটার উপর খরচ ডিপেন্ড করে।
  • ৫৫০ টাকা দিয়ে রাতের বাসে ঢাকায়।
  • টোটাল ১,৮৫০ টাকা খরচ হয়েছে।
দয়া করে হাওড়ের পানিতে কোন ময়লা বা আবর্জনা ফেলবেন না। বিশেষ করে চিপ্সের প্যাকেট,কোক বা পানির বোতল সহ বিভিন্ন পলিথিন পানিতে ফেলবেন না। সেখানে আমি যেটা দেখেছি যে, অনেকে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ওয়াচ টাওয়ারের কাছে গিয়ে গোসল করেন সঙ্গে শ্যাম্পু ব্যাবহার করে শ্যাম্পুর প্যাকেটটা পানিতে ফেলে… এটা একদম-ই ঠিক না। সাঁতার না জানলে অবশ্যই সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখবেন সবসময় বড় নৌকা ভাড়া করবেন ।
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ haorSunamganjtanguarwetland