৭০ টাকার গরম পানি

৩০-০৮-১২

প্ল্যান ছিলো বিকালের ট্রেনে করে সিলেটে যাবো ছয়জন। চতুর্থবারের মত সিলেট বিভাগ ভ্রমণ, তবুও উত্তেজনার কমতি ছিলনা।

Man down: ইদানিং ঘুরতে বের হলেই কুফা লাগে, ভ্রমণের শুরুতে গ্রুপের কারো না কারো কোন না কোন ভেজাল হয়ই। ট্রেনে চড়ার কয়েক ঘন্টা আগে জানা গেল রাবায়েতের ট্যুরে যাওয়া হচ্ছে না। তার বাসায় চোর ঢুকেছে। বিবেকবান বন্ধু হিসেবে তখন যা করা দরকার ছিল তাই করলাম; চোর ঢুকার কাহিনী শুনে প্রথমে একচোট হেসে নিলাম সবাই। এরপর ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে একজন ভালো ফটোগ্রাফার হারানোর আফসোস করতে করতে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম স্টেশনে।

বাই দ্যা ওয়ে রাবা, তোর জন্য করে রাখা টিকেটের টাকা মনে করে দিয়ে দিবি।

কাচ্চা ভয়ঙ্কর-পার্ট ওয়ানঃ শিশুদের সাথে আমার ভ্রমণের ইতিহাস বিশেষ সুখকর নয়। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিটা ভ্রমণেই কোন না কোন পিচ্চির পাল্লায় পড়তে হয়। রাবায়েত না আসায় গ্রুপে মেম্বারসংখ্যা বিজোড় হয়ে গিয়েছিলো, ফলে একজনকে একা বসতে হবে। মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে সেই একা সিটের মুখোমুখি বসে আছে দুই পিচ্চিবিশিষ্ট এক পরিবার। একা সিটে কেউ বসতে চায় না, ফলে ঠিক করা হলো পালা করে সবাই সেখানে বসবে। নিজের পালা যখন আসলো, বিশাল মন খারাপ করে বসলাম সেখানে। দুই পিচ্চি প্রথম কয়েক মিনিট আমাকে জরীপ করলো, এরপর বিরক্ত করার জন্য তাদের যা কিছু অস্ত্র আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। চিৎকার-চ্যাঁচামেচির পাশাপাশি দুজন ননস্টপ কিছু না কিছু খেয়ে যাচ্ছিল(মাশাআল্লাহ!)। ওদের খাওয়া নিয়ে আমার কোন সমস্যা ছিলো না, কিন্তু আমার বিস্মিত হওয়ার সকল ক্ষমতা বিকল হয়ে গেলো যখন ওই দুজন তাদের মুখের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ আমার গায়ে ছুঁড়ে মারতে থাকলো!! তারচেয়ে বড় কথা এই আকাম করার সময় তাদের দৃষ্টিতে যে নির্বিকার ভাব দেখলাম, তাতে মনে হল তারা বুঝাতে চাচ্ছে যে এ বেলা আমাকে অল্পের উপর দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। খালি ওদের বাপ-মা যদি সাথে না থাকতো……

লেইম জোকসঃ আমাদের বন্ধু মহলে লেইম জোকসের শাস্তি বেশ সভ্য পদ্ধতিতে দেওয়া হয়। কেউ লেইম জোক করলে তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে সবাই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে (আয়াজ মাঝে মাঝেই আক্ষেপ করে বলে যে ওর কলেজ লাইফটাই ভালো ছিল। আমরা ওর জোকস বুঝিনা, কলেজের পোলাপাইন ওর জোকসের প্রাপ্য মর্যাদা দিতো।) । তখন নিয়ম হচ্ছে লেইম জোক-কারীকে Sorry বলতে হবে এবং বাকীরা কিছুক্ষণ আগের অপ্রীতিকর মুহূর্তটি ভূলে যাবে। ভ্রমণের উত্তেজনায় নাকি কে জানে, কিন্তু, ট্রেনে উঠার পরপরই শফিককে কয়েকবার Look এন্ড Sorry থেরাপীর মধ্য দিয়ে যেতে হল।

নাভিদের আতিথেয়তাঃ সিলেট গিয়ে নাভিদের বাসায় উঠবো এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো। ট্রেন থেকে নেমে যখন দেখলাম নাভিদ আমাদের নিতে স্টেশনে হাজির, অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকালাম তখন। নাভিদদের বাসাটা খুব সুন্দর, খুব বেশি সুন্দর। চমৎকার গুছানো রুমগুলোর দেয়ালে দেখালে ঝুলানো নাভিদের ছোটবেলার আপত্তিকর সব ছবি। নাভিদের হবু বউ(যাকে এখানে ট্যাগ করার জন্য হাত নিশপিশ করছে) এই বাসা দেখে কি পরিমাণ খুশি হবে তা অনুমান করতে পারছি। যাইহোক সেদিন রাতের খাবার খেতে বসে মেন্যু দেখে আবার কোনমতে আনন্দাশ্রু আটকালাম। নাভিদের বাসা ছেড়েছিলাম পরদিন সন্ধ্যায়। এর মাঝে যতক্ষন তার বাসায় ছিলাম আন্টি(নাভিদের আম্মু), এবং নাভিদের নানু যেন খাইয়ে খাইয়ে মেরে ফেলার পণ করেছিলেন! খাওয়াদাওয়ার মাত্রা এতই তীব্র ছিল যে, এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেলো যা আগে কখনও ঘটে নি। আমাকেও বলতে শোনা গেল, “আর ক্ষুধা নেই”!!! পরদিন শ্রীমঙ্গল যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা ছাড়ার সময় নাভিদের নানু যখন আমাদের হাতে হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিতে থাকলেন তখন আরেকবার চোখ ছলছল করে উঠলো। Thanks for everything দোস্ত, তোর বাসায় প্রায়শই হামলা করবো মনে হচ্ছে।

গন্তব্য রাতারগুলঃ??

রাতারগুলঃ রাতারগুল একদম পয়সা উসুল করা একটা জায়গা। মিঠা পানির নীচে অর্ধেক ডুবে আছে একটা জঙ্গল, ব্যাপারটাই কি অসাধারণ! লক্ষণদার ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় রোদ, মেঘ, বৃষ্টি সবই পেয়েছিলাম। শুধু মেজাজ খারাপ করা স্মৃতির মাঝে থাকবে বিট অফিসের দুর্নিতীবাজ পয়সাখোরগুলা।

সর্পদর্শনঃ লোকমুখে শুনে গিয়েছিলাম রাতারগুলের গাছে সাপ দেখা যায়। আমরাও দেখা পেয়েছিলাম সাপের। তবে সাপ দেখার জন্য সারাক্ষণ খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়, সাপগুলা গাছের রঙের সাথে একেবারে মিশে থাকে। সাপ খুঁজে বের করা আসলেই অন্যরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার! অবশ্য শফিক ইসলাম এই অ্যাডভেঞ্চারের মুখোমুখি দ্বিতীয়বার হতে চাইবে বলে মনে হয়না। প্রথম সাপটি দেখার পরই ছেলেটার মুখের হাসি উবে যায়। সাপ দেখে বেচারা এমনিতেই কাইত, তার উপর মাঝি লক্ষণদার সব কথাই তার কানে একেকটা থ্রেট হিসেবে ঢুকতে থাকে। লক্ষণদা যদি বলে এটা পাতা সাপ, শফিক সেটাকে এ্যামপ্লিফাই করে চিল্লায় বলে, “এটা পাতা সাপ, চল চলে যাই”। এরপর লক্ষণদা যখন বললো এই সাপ লাফ দিতে পারে, তখন আর শফিককে থামায় কে! আর কিছুক্ষণ সেখানে নৌকা রাখলে হয়তো দাপাদাপি করে ডুবিয়েই দিতো।

লক্ষণ দা’স ফটোগ্রাফিঃ সবাই নৌকায় সিরিয়ালে বসে উসাইন বোল্ট পোজে ছবি তুলতে চেয়েছিলাম। ফলাফল-

এইটা লক্ষণ দা’র তোলা ছবিগুলার মধ্যে সবচেয়ে ভালো টা

পাঁচ ভাইঃ আস্ত কোয়েল উদরে চালান করে রেস্টুরেন্টটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।

SUST এর পেইন: পাঁচ-ভাইয়ে ভরপেট খেয়ে রওনা দিলাম SUST এর উদ্দেশ্যে। বোকার মত রিকশা না নিয়ে SUST এর গেট থেকে শহীদ-মিনার পর্যন্ত হাঁটা ধরলাম। ভরপেটে অতটুকু রাস্তা হাঁটার চেয়ে দুইটা পাহাড় বেয়ে ঊঠাও সহজ।

গন্তব্য শ্রীমঙ্গলঃ ??

হোটেলঃ ??

মাধবপুর লেক এবং গাইড ইমন রবি দাসঃ অসাধারণ সুন্দর একটা জায়গা। জায়গাটা সম্পর্কে খুব উচ্চাশা ছিলো না বলেই মনে হয় এত বেশি মুগ্ধ হয়েছি। এমন জায়গায় গিয়ে মানুষ যে ভাবুক হতে বাধ্য তার প্রমাণ করতেই যেন মাটিতে কয়েকটি গ্লাসে পড়ে ছিলো বৈদেশী সুরার উচ্ছিষ্টাংশ। মাধবপুর লেকে আমাদের গাইড ছিলো ইমন রবি দাস নামের এক পিচ্চি। ইমন বেশ ঝানু ফটোগ্রাফার। ছেলেটা লাইফস্টোরি শুনিয়ে কিঞ্চিৎ মন খারাপ করে দিয়েছিলো।

লাউয়াছড়ায় অ্যাডভেঞ্চারঃ সত্যি বলতে, লাউয়াছড়া দেখে যে খুব বেশি মুগ্ধ হয়েছি তা না। সম্ভবত মাধবপুর লেকের উল্টো সাইকোলজি কাজ করেছে এখানে; লাউয়াছড়া নিয়ে লোকমুখে শুনে একটু বেশীই উচ্চাশা করে ফেলেছিলাম। যাইহোক, একটু অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে গাইড না নিয়ে ম্যাপ দেখে বনে ঘোরার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হল নোয়েল। পরে তার দেখানো পথে রওনা দিয়ে বনের মধ্যে রাস্তা গুলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! জঙ্গল থেকে কোনরকমে যখন বের হলাম, সবার পায়েই তখন জোঁক লেগে আছে।

ফরমাল নাফিঃ ভালো ছবির জন্য নাফি জীবন দিতেও রাজি। বান্দরবানেও ছেলেটাকে দেখেছি ফুলহাতা শার্ট পরে পাহাড় বাইতে, ফুলহাতা গেঞ্জি পরে কেওক্রাডং চড়তে( ফুলহাতার অন্য ব্যাখ্যাও আছে অবশ্য। বলা যাবে না, ইনসাইড জোক )। নাফি এবারো তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখলো। জঙ্গলেও ছেলেটা ফিটফাট হয়ে ঢুকলো, কারো গঞ্জনা গায়েই মাখলো না।

৭০ টাকার গরমপানিঃ জীবনে হয়তো বহু টাকা হুদাই খরচ করেছি, সামনেও হয়তো করবো। কিন্তু কখনোই ওই ৭০ টাকা জলে ফেলার দুঃখ সেগুলাকে বিট করতে পারবে না। হুম, শ্রীমঙ্গলের সাতরঙা চায়ের কথাই বলছি 🙁

রাতের- শ্রীমঙ্গল, খোলা মাঠে আড্ডাঃ ??

ট্রুথ অর ডেয়ারঃ এ ব্যাপারে বেশী কিছু না বলাই নিরাপদ বোধ করছি।

কাচ্চা ভয়ঙ্কর-পার্ট টুঃ ঢাকার ফিরতি ট্রেন। অবধারিতভাবে সঙ্গী হিসেবে আরেকটি দুইপিচ্চিবিশিষ্ট পরিবার। আগেরবারের পিচ্চিগুলোর তুলনায় এবারেরগুলা সাক্ষাৎ দেবদূত! পুরো ভ্রমণে বিন্ধুমাত্র টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করে নি। খালি প্রথমেই ছোট একটা কাজ করে গেছে- যে জানালার পাশে হাত ছড়িয়ে বসে ছিলাম, সে জানালায় বমি করে দিয়ে গেছে।

[লেখাটা অসম্পূর্ণ, বছর দুয়েক আগের লেখা। বিশেষ কারণে তখন পাবলিশ করি নাই, এখন করতে মন চাইলো। ঘোরাঘুরির কথা কিছুই মনে নাই বলে পয়েন্টগুলা কমপ্লিট করতে পারলাম না। ব্যাপারনা, স্মৃতি থাকুক]

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ sreemangalstorySylhettourtravel