লংকাপুরীর দিনরাত্রি – আমার শ্রীলংকা ভ্রমণ

শ্রীলংকায় এসে আমরা যে হোটেল উঠেছি, সেখান থেকে কিছুদূর হাঁটলেই মাউন্ট লাভিনিয়ার বাস স্টপেজ। তার পাশেই একটা রেস্তোরাঁয় সকালের নাশতা শেষে চলে আসি টুকটুক স্টপেজে। বেশ কয়েকটা খালি টুকটুক দাঁড়িয়ে। দেশের সিএনজি যেমন, গড়নে-চলনে শ্রীলংকায় টুকটুক তেমনই। পর্যটকদের প্রধান বাহন এটি। টুকটুকে করে আমরা যাব হোটেল গালাদারিতে। কিন্তু এ হোটেল আমরা চিনি না। চেনার কথাও নয়। দু’দিন আগে এসেছি শ্রীলংকায়; উঠেছি কলম্বোর উপকণ্ঠে মাউন্ট লাভিনিয়ায়। ফলে শ্রীলংকার রাস্তাঘাট তেমন চিনতে পারিনি এখনও। অবশ্য তাতে তেমন একটা সমস্যা নেই। হাতে আছে মোবাইল ফোন। মোবাইলে আছে ইন্টারনেট, গুগল ম্যাপ। গুগল ম্যাপই আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড। এ ছাড়া আনন্দের বিষয়, শ্রীলংকায় ভাষাগত সমস্যা তেমন নেই। কেননা, শ্রীলংকার মোটামুটি সবাই ইংরেজি বোঝেন; অনর্গল বলতেও পারেন অনেকে। অতএব নো টেনশন।

ঘড়িতে তখন শ্রীলঙ্কা এর সময় সকাল ১০টা। ট্যুর পরিকল্পনা অনুসারে আজ আমরা যাব অনেক জায়গায়। প্রথমেই যেতে হবে হোটেল গালাদারিতে, সেখানে ঊর্মির সেমিনারের রেজিস্ট্রেশন। আশা করি, সেটা সকালেই হয়ে যাবে। তারপর সারাদিন ঘোরাঘুরি; আমরা সময়টা কাটাব কলম্বো শহরে। ঘুরব ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী এ নগরীর অলিতে-গলিতে।

ট্যুর লিডার ঊর্মি গুগল ম্যাপ দেখে ইন্টারনেট ঘেঁটে সব তথ্য জেনে নিয়েছে আগেই। মাউন্ট লাভিনিয়া থেকে কলম্বো শহরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। কলম্বোর প্রাণকেন্দ্রেই এ হোটেল, পাশেই পুরনো পার্লামেন্ট হাউস। ধারণা করি, টুকটুকওয়ালা এক কথাতেই চিনবেন। টুকটুকওয়ালাকে বলি, হোটেল গালাদারি যাবেন?

মাঝবয়সী এক চালক। ইংরেজি ভালোই বোঝেন। চমৎকার বলতেও পারেন। টুকটুকওয়ালা বললেন, যাব।

জায়গাটা টুকটুকওয়ালা চিনেছেন কি-না, তা যাচাই করার জন্য বলি, ইটস নেয়ার দ্য ওল্ড পার্লামেন্ট হাউস।

টুকটুকওয়ালা মাথা নেড়ে বললেন, ইয়েস, ইয়েস!

পরম নিশ্চিন্তে উঠে পড়ি টুকটুকে। ১২ কিলোমিটারের পথ, ভাড়া খুব বেশি ওঠার কথা নয়। মাউন্ট লাভিনিয়া পার হলেই জায়গাটির নাম দেহিওয়ালা। দেহিওয়ালা পার হতেই কিছুদূর বাদে টুকটুক উঠে যায় এক উড়াল সেতুতে। কিছুক্ষণ পর আবার মূল রাস্তায়। ড্রাইভার কিছুদূর গিয়ে চলে এলেন একেবারে সমুদ্রের কাছাকাছি। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে এবার যাত্রাপথ। সমুদ্রের পাশে পরপর দুটি বড় রাস্তা। প্রথমটি রেললাইন, পরেরটি বাসের। টুকটুক সমুদ্রের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে কলম্বোর উদ্দেশে। একদিকে সমুদ্রের রূপ-লাবণ্য, অন্যদিকে শহরের সৌন্দর্য।

গল থেকে ফেরার পথে আমরা এ রোড ধরেই ফিরেছিলাম। সমুদ্রের পাশ দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর রাস্তা। সকালের সূর্যালোকে ঝলমল করছে সমুদ্র। দল বেঁধে ঢেউ আসছে কিনারে আবার ফিরে যাচ্ছে কোমর দোলাতে দোলাতে। ঢেউয়ের দোলায় সূর্যরশ্মি পড়ে ঝলমল করছে পানি। সমুদ্রের তীরে নানা ধরনের গাছ। নারকেল গাছ প্রচুর। পাম গাছও বেশ। সমুদ্র ও গাছপালার পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমরা দেখি কলম্বো শহর। ছিমছাম, নিরিবিলি। হাইরাইজ বিল্ডিং তেমন নেই। অধিকাংশ ভবনই দু-চার তলাবিশিষ্ট। বেশ প্রাচীন শহর, কিন্তু জনসংখ্যার আধিক্য নেই। ঢাকার মতো গিজগিজ করা মানুষ নেই, গাড়িও নেই। গাড়ির বিকট হর্নও নেই। ফলে গাড়িতে বসেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল কলম্বোর কলতান, সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ ঐকতান।

মিনিট ৪০ পর পৌঁছে যাই ঠিক হোটেলের সামনে। মিটারে দেখলাম, ভাড়া উঠেছে ৪৫০ রুপির মতো।

কলম্বোর গল ফেস হোটেল পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই পুরনো পার্লামেন্ট হাউস। তার পাশেই গালাদারি হোটেল। হোটেলের ঠিক পেছনে কলম্বোর বাণিজ্যিক এলাকা। বিখ্যাত টুইন টাওয়ার। পোশাকি নাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। অধিকাংশ ভবন ছোট হলে কী হবে, কলম্বোর টুইন টাওয়ার ঢাকার সর্বোচ্চ ভবনের চেয়েও উঁচু। এ দুটি ভবন ছাড়া কলম্বোর বাকি সব ভবনই মাঝারি আকারের। অবশ্য বেশ কিছু হোটেল দেখলাম বহু তলবিশিষ্ট।

ভাড়া মিটিয়ে হোটেলের সামনে নামি। চারদিকে প্রখর রৌদ্রকিরণ। এক পাশে সমুদ্র, তার থেকে খানিকটা সামনেই এ হোটেল। গালাদারির পাশেই দেখলাম আরেকটি হোটেল- হিলটন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক ঝলক দেখে নিই গালাদারির অবয়ব। সুউচ্চ ভবন। রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া হোটেলের গেট। আমরা নির্বিঘ্নে ঢুকি হোটেল লবিতে। তাতে ঝুলছে সেমিনারের বড় প্ল্যাকার্ড। পরিচয় দিতেই সেমিনারের দু’জন স্বেচ্ছাসেবক অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের। ঊর্মি রেজিস্ট্রেশন করল, কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই বুঝে নিল তার কাগজপত্র। দেখলাম ঊর্মির নামে সব গোছানো। তার ছবি দিয়ে সেমিনারের আইডি কার্ড। সেমিনারের ব্যাগ এবং সেমিনারের একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট বুক।

কলম্বোয় অনেক পাঁচতারা হোটেল রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি প্রাচীন ও পৃথিবীখ্যাত। গালাদারি তত প্রাচীন নয়; নতুন হোটেল, কিন্তু এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে বেশ। হোটেল লবিতে বসে কফি পান করি। ঊর্মি মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সেমিনারের ম্যাগাজিনটি। তাতে পত্রস্থ হয়েছে বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সঙ্গে তার একটি আর্টিকেলের সারাংশ। সেমিনার শেষ হলে প্রকাশিত হবে জার্নাল। তাতে স্থান পাবে তার গবেষণা প্রবন্ধ। প্রথম দিন সেমিনারের তেমন কোনো কাজ নেই। শুধু রেজিস্ট্রেশন। দ্বিতীয় দিন উদ্বোধন ও সেমিনার শুরু। তিন দিনের সেমিনারের শেষ দিনে ঊর্মি উপস্থাপন করবে তার গবেষণাপত্র।

সেমিনারের প্রাথমিক কাজ সেরে বের হই হোটেল থেকে। এখন শুধুই ঘোরাঘুরি। বাইরে তীব্র রৌদ্র দহন। খাড়া হয়ে রৌদ্রকণা তাপ বিলাচ্ছে মাথার ওপর। রৌদ্রের ঝলকানিতে উজ্জ্বল গোটা শহর। হোটেলের সামনে একটি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ভাবি_ হোয়াট উড বি আওয়ার ফার্স্ট ডেস্টিনেশন?

তিনজন মিলে ঠিক করি, প্রথমে দেখব কলম্বোর একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার। হোটেল গালাদারি থেকে খানিক দূরেই মন্দিরের অবস্থান। হোটেলের পাশেই পেয়ে গেলাম টুকটুক। যেতে যেতে ঢুকে পড়ি শহরের হৃৎপিণ্ডে। টুকটুক যাচ্ছে বিহারের দিকে। আমরা দেখছি কলম্বোর রাস্তাঘাট, মানুষজন, বাড়িঘর। দেখছি তার নান্দনিক সৌন্দর্য। কী ছিমছাম শহর! ধুলোবালির উৎপাত নেই। রাস্তাগুলো ঝকঝকে, তকতকে। সঙ্গে ফুটপাতও পরিচ্ছন্ন। মানুষজনও বেশ সচেতন, রাস্তায় কিছুই ফেলে না। যদি কিছু ফেলতে হয়, নির্দিষ্ট দূরত্বে আছে সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন। সেখানেই ময়লা ফেলে তারা।

শহরের ভবনগুলোও সুন্দর, নান্দনিক। অধিকাংশ পর্তুগিজ, ব্রিটিশ ঘরানার ভবন। নতুন ভবনও আছে প্রচুর। সেগুলোও সুন্দর। এক ভবনের সঙ্গে অন্য ভবনের বেশ দূরত্ব। তাতে আপন গতিতেই বাতাস চলাচল করতে পারে। সমুদ্রছোঁয়া বায়ু বইতে পারে। যেতে যেতে চোখে পড়ে একটা মস্ত বড় লেক। শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে এই শান্ত-সুন্দর লেক। লেকের চারপাশে প্রশস্ত হাঁটার পথ, পথিককে ছায়া দিতে পথের সঙ্গে প্রচুর গাছপালা। নগরবাসী বিকেলবেলা ঘুরতে পারেন, হাঁটতে পারেন। লেকের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে টুকটুক। বিমুগ্ধ হয়ে আমি তাকিয়ে সেই লেকের দিকে_ পানি কী টলমলে, স্বচ্ছ! নগর পরিকল্পনাবিদরা কৃত্রিমভাবে তৈরি করেছেন এ লেক। ঢাকাতে লেক আছে কিছু। সবই এখন দখলে সংকীর্ণ, আবর্জনায় জীর্ণ। কলম্বোর পরিচ্ছন্ন লেকের দিকে তাকিয়ে ঢাকার কথা ভাবতে ভাবতে নিঃশব্দে ঝরে কয়েক ছত্র দীর্ঘশ্বাস!

৩০ মিনিট পর টুকটুক থামল মন্দিরের সামনে। আমরা এলাম ঐতিহ্যবাহী গঙ্গারামায়া টেম্পলে। ভাড়া মিটিয়ে অবাক নয়নে দেখি মন্দিরের বাইরের সৌন্দর্য। লেকের পাশেই তিন-চারটি বড় আকারের ভবন। প্রতিটি ভবন টেরাকোটায় উৎকীর্ণ। মন্দিরগাত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গৌতম বুদ্ধের গুণগাথা। টেরাকোটার কাজ দেখে সত্যিই অভিভূত। মন্দিরের বাইরের অংশের ছবি তুলি কিছু। এবার ভেতরে ঢোকার পালা। ঢোকার পথে স্পষ্ট নিদের্শনা- জুতা খুলে প্রবেশ করতে হবে মন্দির আঙিনায়। গোটা মন্দির ও মন্দির প্রাঙ্গণ কার্পেট বিছানো। ফলে ধুলোবালি, কাদার ফ্যাসাদ নেই। আমরা যথারীতি জুতা খুলে প্রবেশ করি মন্দির প্রাঙ্গণে। গেট থেকে ঢুকতেই হাতের বামদিকে বড় একটি মন্দির ভবন, ডান দিকে মিউজিয়াম। সামনেই মন্দিরের অফিস। প্রাঙ্গণে ঢোকার মুখেই টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি টিকিটের মূল্য ৭শ’ রুপি। খানিকটা অবাক হয়ে মনে মনে বলি, মন্দির দেখতে এত টাকা লাগবে!

গঙ্গারামায়া টেম্পল

হঠাৎ কাউন্টারে একটা চার্টে চোখ যায় বাঁধনের। সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য টিকিটের মূল্য ৫শ’ রুপি। অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জন্য তা ৭শ’ রম্নপি। বাঁধন উৎসাহী হয়ে বলল, আমরা সার্কভুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক।

কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা বলেন, পাসপোর্ট দেখাতে হবে। পকেট হাতড়ে দেখি আমার সঙ্গে পাসপোর্ট নেই। বাঁধনের সঙ্গেও নেই। আমরা পাসপোর্ট রেখে এসেছি হোটেলে। শুধু ঊর্মির পাসপোর্ট আছে তার ব্যাগে। অগত্যা টিকিটের পুরো মূল্যই পরিশোধ করতে হলো দু’জনের। তবে ঊর্মির টিকিট মূল্য রাখল ৫শ’ রুপি।

মন্দির আঙিনায় ঢোকার মুখেই বড় আকারের দুটি বুদ্ধমূর্তি। ধ্যানস্থ মূর্তিগুলো যেন স্বাগত জানাল আমাদের। মন্দিরের সামনেই গাইড রয়েছেন। নগদ ডলারের আশায় চকচক করছে তাদের চোখ। গাইড নেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। গাইড থাকলে মহাযন্ত্রণা, সারাক্ষণ বকবক করেন। সবচেয়ে উত্তম হলো, নিজেরাই ঘোরো ইচ্ছেমতো।

চারটি বড় আকারের মন্দির নিয়ে এ গঙ্গারামায়া মন্দির। প্রথমেই ঢুকি হাতের বাম পাশের বড় মন্দিরটায়। গাঢ় হলুদ রঙের মন্দির। ঢোকার পথেই সিংহের বড় মূর্তি_ হাঁ করে দাঁড়িয়ে। আমরা সিংহের দিকে তাকিয়ে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশমাত্রই তাজ্জব হয়ে গেলাম। আয়তনে যেমন বড়, দেখতেও তেমন নান্দনিক। গোটা মন্দির কারুকার্য করা। বিশাল বিশাল কাঠের থাম। তাতে বুদ্ধের অলঙ্করণ। মন্দিরগাত্রে নানা মোটিফ। সব মোটিফই গৌতম বুদ্ধের নানা কাহিনী অবলম্বনে আঁকা। বিশাল মন্দিরের শেষ মাথায় গৌতম বুদ্ধের ছোট-বড় অনেক মূর্তি। একতলা এ মন্দিরটি পাথর দিয়ে তৈরি। ওপরে গম্বুজ আকারের টালির ছাদ। মন্দিরের গঠনশৈলী বেশ নজরকাড়া। মন্দিরের স্থাপনাগুলো শ্রীলংকান, থাই, ভারতীয় এবং চীনা স্থাপত্যের সংমিশ্রণে গড়া। ভবনটি যেন দেখতে চীনের কোনো প্যাগোডার সঙ্গে সাযুজ্যময়।

গঙ্গারামায়া টেম্পল শুধু আরাধনার জায়গা নয়; একই সঙ্গে শিক্ষালয়ও। পাশাপাশি বুদ্ধ-ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণারও উত্তম জায়গা। বিশাল এলাকা নিয়ে অবস্থিত এ মন্দিরে তাই প্রতিদিন হাজারো মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যে পর্যটকের সংখ্যাই বেশি।

প্রায় ১২০ বছর আগে বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন কলম্বোর এক জাহাজ ব্যবসায়ী। দানশীল সেই বণিকের নাম ডন বাস্তিয়ান। তিনিই প্রথম বিহার নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং প্রচুর টাকা খরচ করে নির্মাণ করেন মন্দিরটি। পরে আশপাশের জায়গা সংগ্রহ করে বাড়ানো হয় মন্দিরের পরিসর। গোটা মন্দিরে বুদ্ধমূর্তির সংখ্যা কত হবে কে জানে! নানা রঙ ও ভঙ্গির কয়েক হাজার বুদ্ধমূর্তি গোটা মন্দিরের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত। শুধু বুদ্ধমূর্তি নয়; গঙ্গারামায়ার মিউজিয়ামে দেখি দেশ-বিদেশের বুদ্ধ-নিদর্শনের অপূর্ব সমাহার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান শ্রীলংকান সরকারকে যেসব বুদ্ধমূর্তি ও বুদ্ধ-ঐতিহ্যের স্মারক উপহার দিয়েছেন, গঙ্গারামায়া মন্দিরের জাদুঘরে তা থরে থরে সাজানো। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম এক বুদ্ধমূর্তি আছে সেখানে। আছে হাতির দাঁতের তৈরি নানা উপকরণ, কয়েক হাজার বছরের নানা প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনও।

বিহার, জাদুঘর দেখে আমরা পাশের আরেকটি মন্দিরে প্রবেশ করি। গোটা মন্দির কাঠের তৈরি। দুই তলাবিশিষ্ট। নিচতলায় অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি। আছে পুরনো গাড়ির সংগ্রহও। এ ছাড়া আছে সিংহের মূর্তি, নানা আকারের হাতির মূর্তি। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আমরা উঠি মন্দিরের দ্বিতীয় তলায়। সেখানেও প্রচুর মূর্তি। মন্দিরের কাঠগুলোতেও খোদাই করে আঁকা বুদ্ধের নানা মূর্তি। এ মন্দিরের পাশেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বোধিবৃক্ষ দাঁড়িয়ে । তার নিচে ধ্যানরত বুদ্ধের মূর্তি। সেখানে দেখি পূর্জা-অর্চনা করছেন শ্রীলংকান বুড্ডিস্টরা।

মন্দিরের পাশেই আছে বড় আকারের কমপ্লেক্স। সেখানে দেশ-বিদেশের বৌদ্ধ পুরোহিতদের গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু পূর্জা-অর্চনা নয়; বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারে গঙ্গারামায়া টেম্পলে রয়েছে রিসার্চ সেন্টার, ট্রেনিং সেন্টারসহ নানা কিছু।

দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত আমরা ঘুরে দেখি গঙ্গারামায়া টেম্পল। মন্দিরের পূর্বদিকে লেকের দিকে চোখ যেতেই দেখি, মন্দির থেকে একটি সেতু চলে গেছে লেকের মাঝ বরাবর। সেখানেও এক ঐশ্বর্যময় মন্দির দাঁড়িয়ে। শ্রীলংকার স্বাধীনতার পর গঙ্গারামায়া টেম্পলে যোগ হয় নান্দনিক ও চমৎকার নির্মাণশৈলীর আরেকটি মন্দির_ সীমা মালাকা। বেইরা লেকের পানির ওপর ভেসে আছে মনোহর এ মন্দির। বিস্ময়কর বিষয় এই যে, শ্রীলংকার এক মুসলিম ব্যবসায়ী এ মন্দির নির্মাণের যাবতীয় খরচ বহন করেন। এ মন্দিরের ডিজাইন করেন জেফরি বাওয়া_ পৃথিবীখ্যাত এক স্থপতি। তাকে শুধু শ্রীলংকার নয়; পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা স্থপতি মনে করা হয়।

শতাধিক বছর আগে নির্মিত হয়েছিল সীমা মালাকা মন্দির। পরে কিছু অংশ ভেঙে যায়, বাকি অংশ ডুবে যায় বেইরা লেকের পানিতে। এর পর ১৯৭৬ সালে আমির এস মোসাজির স্মরণে তার বাবা মুসলিম ব্যবসায়ী এসএইচ মোসাজি মন্দিরটির পুনর্নির্মাণে সব ব্যয়ভার বহন করেন। ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধ ও অসাম্প্র্রদায়িকতার এ এক অনন্য নজির।

এক

কলম্বোতে যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাঁদের জন্য গল ফেস সৈকতে যাওয়াটা ফরজ কাজ! কলম্বোর প্রাণকেন্দ্রে ফুরফুরে হাওয়া বিলিয়ে দিচ্ছে অনিন্দ্যসুন্দর এই সৈকত। পাশেই দাঁড়িয়ে কলম্বোর বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক এলাকা। ঠিক সামনেই পুরনো পার্লামেন্ট ভবন। খানিক এগোলেই সৈকতঘেঁষে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত গল ফেস হোটেল।

কলম্বোর বেশকিছু দর্শনীয় জায়গা ঘুরে একদিন বিকেলে হাঁটতে-হাঁটতেই আমরা চলে আসি গল ফেস সৈকতে। শ্রীলংকার অন্যান্য সৈকতের সঙ্গে এই সৈকতের বিস্তর তফাৎ। অন্য সৈকতগুলো শানবাঁধানো নয়, কলম্বোর এ-সৈকতের তীরটা শক্ত পাথর দিয়ে বাঁধানো। ভারত মহাসাগরের তীরে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয় বিশাল বাঁধ। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেই পাথরের বাঁধে। বাঁধটা সমুদ্র থেকে খানিক উঁচুতে। বাঁধের ওপর মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তা। সৈকতের পোশাকি নাম ‘গল ফেস গ্রিন’।

গলফেস সমুদ্র সৈকত

সৈকতটির একদিকে মহাসাগরের বিশাল বিস্তৃতি, অন্যদিকে কলম্বো শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। মাঝখানের চারপাশটা খোলা, উন্মুক্ত। বাঁধের পেছনটায় কার্পেটের মতো শুয়ে আছে সবুজ চত্বর। হয়তো এ-কারণেই গল ফেস গ্রিন নামকরণ। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক একবার বেড়াতে এসেছিলেন কলম্বোর এ-সৈকতে। শ্রীলংকা ভ্রমণ নিয়ে তিনি স্বল্পপরিসরে লিখেছিলেন চমৎকার একটা ভ্রমণগদ্য ‘দারুচিনি দ্বীপ’।

বিকেলে হাঁটতে-হাঁটতে গরম লাগছিল খুব। সৈকতের পাড়ে দাঁড়াতেই উড়ে এলো একঝলক হাওয়া। নিমিষেই জুড়িয়ে গেল শরীর-মন। এখানে সারাক্ষণই দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে বইতে থাকে মহাসাগরের মাতাল হাওয়া। বিকেল-সন্ধ্যায় পর্যটকরা সেই লোভেই যেন শানবাঁধানো সমুদ্রের তীরে ভিড় করেন। বাঁধের ওপর সুন্দর বসার জায়গা। সেটিও পাথর দিয়ে তৈরি। পাথরের বেঞ্চিতে শ্রীলংকার তরুণ-তরুণীরা, প্রেমিক যুগলরা, পর্যটকরা বসে আছেন হাত ধরাধরি করে। প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য যেন অপূর্ব জায়গা। অনেকের মাথার ওপর ছাতা। আশপাশের মানুষের দৃষ্টি এড়াতে, বিকেলের রৌদ্র থেকে ছায়া পেতে ছাতার নিচে বসে গল্প করছেন অনেকেই। সমুদ্রের তীরে একটা ফাঁকা বেঞ্চি পেয়ে যাই আমরা, বিকেলে সেই বেঞ্চিতে বসে উপভোগ করি সমুদ্রের সান্নিধ্য।

১৮৫৬ সালে বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ সিংহলের গভর্নর স্যার হেনরি জর্জ ওয়ার্ড (১৭৯৭-১৮৬০) শহরবাসীর বিনোদনের জন্য, বৈকালিক ভ্রমণের জন্য বাঁধটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ধারণা করি, শুধু বিনোদন নয়, সমুদ্রের ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে শহরকে রক্ষার জন্যও বাঁধের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৮৫৯ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। তখন থেকেই এটি হয়ে উঠেছে কলম্বোবাসীর এক অফুরান বিনোদনকেন্দ্র।

বিশাল খোলা চত্বরে এক ফোঁটা ছায়া নেই। বিকেল হলেও রোদের তেজ আছে বেশ। তবে সমুদ্র-হাওয়ায় মস্নান হয়ে যাচ্ছিল রোদের তেজ। মাথার ওপরে ঝকঝকে নীল আকাশ, সামনে নীলাভ জলরাশি; অসংখ্য মানুষ উপভোগ করছেন এই দৃশ্যাবলি, তাঁদের বেশিরভাগই টুরিস্ট, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে না হতেই বেড়ে যায় মানুষের পদচারণ। যেন মানুষের মেলা বসে যায়। পাথরের বেঞ্চিতে বসে-বসে ভাবি, কলম্বোবাসী খুব ভাগ্যবান। তাঁদের সমুদ্র দেখতে দূরে যেতে হয় না। অনেকে ঘরে বসেই দেখতে পারেন সমুদ্রের মায়াবী সৌন্দর্য। হঠাৎ চোখে পড়ে একটি বড় কাঠের সেতু। বাঁধ থেকে সেই সেতু চলে গেছে সমুদ্রের কিছুটা ভেতরে। সমুদ্রকে ভালো করে দেখার জন্য, পর্যটকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য ব্রিজটি তৈরি করা হয়েছে। আমরা হেঁটে-হেঁটে যাই ওই ব্রিজের মাথায়। সুনীল সমুদ্র ব্রিজের গোড়ায় আছড়ে পড়ছে ফেনিল হয়ে।

ব্রিজের গোড়ায় দেখি পান বিক্রি করছেন এক ভ্রাম্যমাণ হাকার। পুরান ঢাকার মতো অবিকল পান যেন, বিভিন্ন মশলা দিয়ে সাজিয়ে বিক্রি করছেন। শ্রীলংকা মশলার দেশ, পানও উৎপন্ন হয় প্রচুর। রাস্তাঘাটে নানা জায়গায় বিক্রি হয় মশলাপান।

শুধু পান-বিক্রেতা নন, বাঁধের ওপর সারি-সারি ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান। ভ্যানে বিক্রি হচ্ছে চিংড়ি, কাঁকড়া, সামুদ্রিক মাছভাজা। বিক্রি হচ্ছে চিপস, পানিসহ নানা খাবার। ছোট-বড় অনেক দোকান চারদিকে। ভ্যানের ওপরই ভাজা হচ্ছে কাঁকড়া, মানুষ খাচ্ছেও খুব। বাঁধনকে বলি, চলো কাঁকড়াভাজা খাই। বাঁধন এককথায় রাজি। কিন্তু ঊর্মি কাঁকড়া খাবে না। চিংড়িভাজা খাবে।

ব্রিজ থেকে খানিক সামনে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। বয়স্ক এক দোকানি গরম তেলে ভাজছেন কাঁকড়া। ফুটপাতের খাবার আমার বেশ পছন্দের। দেখেই উশখুশ করছি কেনার জন্য।

হাউ মাচ ইজ ফর এভরি ক্র্যাব ফ্রাই?

প্রশ্ন শুনে তাকালেন দোকানি। ভাবলাম ইংরেজি তেমন বলতে পারবেন না। আমাকে অবাক করে চমৎকার ইংরেজি বললেন সেই দোকানদার।

কাঁকড়াভাজা প্রতিটি ৫০ রুপি। একটা বড়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু ছোট চিংড়ি। এটার দামও ৫০ রুপি। আবার বিক্রি হচ্ছে বড় আকারের চিংড়িও। তবে দাম বেশি পড়বে। বড় আকারের চিংড়ির দাম ১০০ রুপি।

আমি আর বাঁধন কাঁকড়া ভাজার অর্ডার করি। ঊর্মির জন্য চিংড়ি ভাজা। চোখের সামনেই ভাজা হচ্ছে কাঁকড়া। গরম তেল থেকে কাঁকড়া নামানোর পর রাখা হলো একটা কাগজের পেস্নটে। তারপর ভাজা কাঁকড়ার ওপর ছিটিয়ে দেওয়া হলো কয়েকজাতের মশলা। সঙ্গে শুকনা মরিচের গুঁড়া। ছড়িয়ে দেওয়া হলো কুচি-কুচি করে কাটা পেঁয়াজ। ঢেলে দেওয়া হলো সস। অনুরূপভাবে চিংড়িভাজাতেও দেওয়া হলো পেঁয়াজ। সঙ্গে মশলা ও মরিচের গুঁড়া। কলম্বোর ফাইভস্টার হোটেলে খেয়েছি; কিন্তু কাঁকড়া ভাজার সঙ্গে সব ফেল। সৈকতের পারে ভ্রাম্যমাণ দোকানে খাওয়া কাঁকড়া ভাজার স্বাদ ছিল সত্যিই অতুলনীয়।

আমরা বসেছি একটা বেঞ্চিতে। চারদিক শান্ত, বেশ নিরিবিলি। সৈকতটাও ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। কিছুক্ষণ বসলেই স্নিগ্ধ হাওয়ায় মনপ্রাণ কোমল হয়ে যায়। দেখতে-দেখতেই পশ্চিম কোণে সূর্য হেলে পড়ছে প্রকৃতির নিয়মে। বিকেলের মায়াবী আলোয় লক্ষ করি সৈকতে এক নববিবাহিত দম্পতিকে, তাঁদের পরনে বিয়ের ঝলমলে পোশাক, নতুন জুটি ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তুলছে নানা ভঙ্গিমায়।

ঊর্মি মনোযোগ দিয়ে দেখছিল ওই দম্পতিকে। মনে-মনে হয়তো ভাবছিল, আহা! বিয়ের পোশাক পরে যদি ছবি তোলা যেত কোনো সমুদ্রসৈকতে!

দুই

ভারত মহাসাগরের অতল ঠিকানায় সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগে। একে-একে জ্বলে উঠছে কলম্বোর নিয়ন আলো। ঝলমল করছে রাস্তা, সৈকত, শহরের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো। গল ফেস গ্রিন থেকে আমরা হাঁটতে-হাঁটতে চলে আসি পুরনো পার্লামেন্ট ভবনের সামনে। সামান্য কাছেই বাস স্টপেজ। শহরের বাসগুলো স্টপেজে থামছে সুশৃঙ্খলভাবে, যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে আবার। কোনো ফ্যাসাদ নেই। হেলপারদের চিল্লাচিল্লি, হাঁকডাকও নেই। পাশেই বেশ কিছু খালি টুকটুক যাত্রীর আশায় দাঁড়িয়ে। তেমন ভিড়বাট্টা নেই। ফলে সহজেই মিলল টুকটুক। আমরা এখন যাবো ওডেল শপিং সেন্টারে; কলম্বোর বিখ্যাত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এটি, শপিংয়ের জন্য যার নামডাক খুব।

ওডেল শপিং সেন্টার

শ্রীলংকায় আসার আগে দেশটি সম্পর্কিত কয়েকটি বই পড়ি, পাশাপাশি প্রচুর সময় ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করি, তাতে একটা চমৎকার ধারণা তৈরি হয়। শ্রীলংকায় কোথায় থাকব, কোথায় ঘুরব – মোটামুটি ট্যুর শিডিউল করা হয়। ভ্রমণের শিডিউল তৈরি করেছে ঊর্মি। কলম্বোর সেরা শপিংমল কোনটা – ঊর্মি নেট ঘেঁটে জেনে নিয়েছে আগেই।

মনে করেছিলাম ওডেলের কথা হয়তো ঊর্মি ভুলে যাবে। শপিংয়ের কথা কি আর মেয়েরা ভুলে যায়, গল ফেস দেখার পরই ঊর্মির তাড়া – মার্কেটে চলো!

কিছুক্ষণ গৌতম বুদ্ধের মতো মৌনব্রত অবলম্বন করি। অবশ্য তাতে লাভ হয়নি কিছুই।

গল ফেস গ্রিন থেকে বেশি দূরে নয় ওডেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই মার্কেটটির সামনে। ঢোকার মুখেই দেখি সুউচ্চ ক্লক টাওয়ার। সাদা ধবধবে মিনার, তার মাথায় ঘড়ি টানানো। নান্দনিক স্থাপনা বটে। গাছপালাঘেরা বড় আকারের মার্কেট। সেটাও সফেদ রঙের। মার্কেটের ভবনটা পুরনো আমলের। তবে ভেতরে ঝলমল করছে পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিক সব শপিংসম্ভার। কী নেই তাতে? এক ছাদের নিচে নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের মানুষের কেনাকাটার অপূর্ব সমাহার।

শপিং নিয়ে আমার কোনো তাড়া নেই, আগ্রহও নেই। ঊর্মি ও বাঁধন ঢুকেছে ওডেলরাজ্যে। মার্কেটের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি দেখছি রাতের কলম্বো। রাস্তা-লাগোয়া মার্কেট, সামনের ফুটপাতে কোনো দোকান নেই। ভিখারিদের উৎপাতও নেই। মানুষের গা-ঘেঁষাঘেঁষি ভিড় নেই। ফুটপাত যেমন পরিচ্ছন্ন, রাস্তাও তেমন। রাস্তা ভাঙা, এবড়ো-খেবড়ো নয়। কোথাও খোঁড়াখুঁড়িও নেই।

ঢাকার রাজপথে সন্ধ্যা মানেই অসহনীয় যানজট, কালো ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে পিপিলিকার গতিতে ছোটে বাস, টেম্পো, সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, রিকশা; কলম্বোতে ঘোরলাগা সন্ধ্যায় বিখ্যাত একটি মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি – ছিটেফোঁটাও যানজট নেই। শ্রীলংকায় লোকসংখ্যা খুবই কম; ঢাকার মিরপুরে যত মানুষ থাকে, গোটা কলম্বো শহরে তত মানুষ নেই। মিরপুরের জনসংখ্যা কত হবে? ১৫ লাখ, ২০ লাখ? জানা যায়, বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি। অন্যদিকে গোটা কলম্বো শহরে জনসংখ্যা ১০ লাখের মতো!

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা অতিরিক্ত জনসংখ্যা, তা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সব রাজনৈতিক দলই এখানে নীরব। ঢাকার ফুটপাত, রেললাইন, বস্তি, কাঁচাবাজার, আবাসিক এলাকা, মার্কেট, টার্মিনাল, বাণিজ্যিক এলাকা – চারদিকে মানুষ আর মানুষ। গোটা ঢাকা শহরই যেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের জনসভা! আমার কেবলই মনে হয়, ভয়াবহ ভিড়ের দেশে একটি কিংবা দুটির বেশি সন্তান নেওয়াটা অসভ্যতা, বর্বরতা!

রাজধানী ঢাকার অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, সমস্যা নিয়ে দারুণ মনোগ্রাহী ও বিশ্লেষণধর্মী একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান। তাঁর ‘জনসংখ্যা আর কত বাড়লে সরকার সজাগ হবে?’ শীর্ষক রচনায় শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যার গভীরতর সমস্যার দিকটি উঠে এসেছিল সুচারুভাবে।

নগরবিদদের অভিমত অনুসারে, আয়তন ও অবকাঠামো অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা হওয়া উচিত ছিল ৩০ লাখ, তাহলে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারতেন। সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বাস করতে পারতেন, ঠিকভাবে নাগরিক সুবিধাও পেতেন। ঢাকার লোকসংখ্যা এখন প্রায় দুই কোটির কাছাকাছি। ৩০ লাখ মানুষের অবকাঠামো দিয়ে কি দুই কোটি মানুষের চাহিদা পূরণ করা যায়?

লঙ্কাপুরীর দিনরাত্রি’ রচনাটি পড়তে যদি এক ঘণ্টা সময় নেন, তাহলে দেখবেন এর মধ্যেই বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে ৪৮০টি শিশু! প্রতি মিনিটে জন্ম নেয় আটটি শিশু। একঘণ্টায় ৪৮০টি শিশু জন্ম নেয় বাংলাদেশে; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কি খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বাসস্থানের যথাযথ ব্যবস্থা করতে পারব?

ঢাকা মহানগরে নাকি প্রতিদিন মানুষ বাড়ছে এক হাজার ৪১৮ জন। তাহলে বছরে ঢাকায় মানুষ বাড়ছে পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৫৭০ জন। বুঝুন ঠেলা!

তুলনা ঠিক নয়, তারপরও কীভাবে যেন তুলনা চলে আসে ঢাকা ভার্সেস কলম্বো। কলম্বো ছিমছাম, নিরিবিলি, যানজটমুক্ত – তার প্রধানতম কারণ জনসংখ্যার আধিক্য নেই। ঢাকায় যত কোলাহল, ভিড়বাট্টা – তার প্রধান কারণই হলো অতিরিক্ত জনসংখ্যা।

বিশ্বাস করবেন কিনা কে জানে, দৃঢ়ভাবে বলি, ঢাকাকে বাঁচাতে আরেকটি ‘নতুন ঢাকা’ গড়তে হবে। নতুন দিল্লির মতো হতে পারে নতুন ঢাকা। সেটি ঢাকার উপকণ্ঠে, যেখানে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু – তার চারদিকে নতুন ঢাকা হতে পারে কী? পরিকল্পনা করে যদি পদ্মার তীরে নতুন ঢাকা নির্মাণ করা যায়, সরকারের সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম যদি সেখানে নেওয়া যায়, তবেই সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে উঠবে প্রাণের শহর ঢাকা।

ঢাকার মহাসমস্যার কথা ভাবতে-ভাবতেই মোবাইল বেজে উঠল তারস্বরে। ঊর্মি ফোন করে বলল, তাড়াতাড়ি এসো, জামা পছন্দ হয়েছে তোমার জন্য।

সুবিশাল মার্কেট ওডেল, ঊর্মিকে খুঁজে পেতে ঘুরতে হলো কয়েকটি ফ্লোর। চারদিকে প্রচুর কেনাকাটার সামগ্রী। থরে-থরে সাজানো সব। তৈরি পোশাকের বিশাল ভাণ্ডারের জন্য ওডেলের ব্যাপক খ্যাতি। শুধু তৈরি পোশাক নয়, স্পোর্টস, ডিলাইট, সুগন্ধি ও প্রসাধনী, বই, সংগীত ও চলচ্চিত্রের অ্যালবাম-ডিভিডি, জুতা, হাতব্যাগ, জুয়েলারি, লাগেজসহ আছে নানা সামগ্রী। এছাড়া আছে বৃহৎ কিডস কর্নার। আছে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা। একটি ফ্লোরজুড়ে শুধুই নানা জাতের চা ও কফির সম্ভার। সব মিলিয়ে এলাহী ব্যাপার!

গোটা মার্কেটে প্রচুর ট্যুরিস্ট। মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি ইউরোপ-আমেরিকান প্রচুর। চাইনিজ, জাপানিজরাও কেনাকাটা করছেন দেদার। নিজের জন্য নিই শার্ট, গেঞ্জি। বাঁধন কেনে গেঞ্জি, প্যান্ট। ঊর্মি কেনে কয়েক সেট বাহারি গহনা, ব্যাগ, জামা। তার বোনের মেয়ে আমীরাহর জন্য কেনে জামা। পাক্কা দুই ঘণ্টা ওডেলে কাটিয়ে বুঝতে পারি, আমাদের সঙ্গে নেই ‘অঢেল’ ডলার!

তিন

শপিংশেষে এখন ফিরতে হবে কলম্বোর পাশেই মাউন্ট লাভিনিয়ায়, আমাদের অস্থায়ী আস্তানায়। মার্কেটের সামনেই পেয়ে যাই টুকটুক। রাতের কলম্বো দেখতে-দেখতে আমরা যখন মাউন্ট লাভিনিয়ার দিকে যাচ্ছি, তখন মনটা ভার ছিল বাঁধনের। অল্পদিনেই শ্রীলংকাকে বেশ ভালো লেগেছে তার। বিমানের ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গেছে আগেই, ঢাকা ফিরেই পরের দিন চাকরির ভাইভায় বসবে। মাত্র তিনদিনের জন্য এসেছিল, রাত পেরোলেই ভোরের মিহিন লংকার বিমানে দেশে ফিরবে।

মাউন্ট লাভিনিয়া

শ্রীলংকা ট্যুরে এখন পর্যন্ত সবকিছুই হয়েছে ঠিকঠাক। তবে একটা বিষয় মেলেনি পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে। তৃতীয় দিনে ঠিক করেছিলাম, ঊর্মি তার সেমিনারে যাবে, আমি আর বাঁধন যাবো অ্যাডামস পিক দেখতে। বাঁধনের শ্রীলংকা আসার মূল উদ্দেশ্যই ছিল অ্যাডামস পিক দেখা – হজরত আদম (আ.) পা মোবারকের পবিত্র চিহ্ন দেখার খুব ইচ্ছা তার।

শ্রীলংকায় এসে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি – অ্যাডামস পিক দেখতে যেতে প্রায় একদিন লেগে যাবে, আসা-যাওয়ায় দুদিন কাবার; অগত্যা অ্যাডামস পিক দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম।

মাউন্ট লাভিনিয়া এসে আমরা থামি বার্গার কিংয়ের সামনে। বার্গার কিং ফাস্টফুডের দোকান। শ্রীলংকান খাবার বেশি পছন্দ হয়নি বাঁধনের, খাবার নিয়ে সে এক্সপেরিমেন্ট করতে রাজি নয়, এছাড়া রাত ২টার দিকে রওনা হবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে, ভোর ৬টায় তার পেস্নন ছাড়ার কথা। এ-অবস্থায় ফুড এক্সপেরিমেন্ট স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

ঊর্মি বলল, বার্গার কিংয়ে তো খেয়েছি কয়েকবেলা। এবার চলো কেএফসিতে। শ্রীলংকান কেএফসির স্বাদ নিতে হবে।

বার্গার কিং থেকে খানিক দূরে কেএফসি। দোতলায় বড় স্পেস নিয়ে এ-রেসেত্মারাঁ। এককোনায় বাচ্চাদের খেলার ঘর, বাংলাদেশেও দেখেছি সেটা। পরিচিত খাবার অর্ডার করি। ফ্রাইড রাইস, চিকেন, ভেজিটেবল। সঙ্গে কোমল পানীয়।

খাওয়া শেষে রাত ১১টার দিকে আমরা হাঁটতে-হাঁটতে ফিরি হোটেলে। কেএফসি থেকে কাছেই হোটেল। রাস্তায় তেমন মানুষ নেই। মাঝেমধ্যে শাঁ করে ছুটে যাচ্ছে টুকটুক কিংবা প্রাইভেটকার। ছিনতাইয়ের শিকার হবো না তো – মনে কুডাক শুনি। আনন্দের কথা শ্রীলংকার রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি। গোটা পরিবেশই খুব পর্যটক-সহায়ক।

তিনজন এসেছিলাম শ্রীলংকায়, রাত ২টার দিকে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হবে বাঁধন। বাকি দিনগুলো শ্রীলংকায় থাকব আমি আর ঊর্মি। সকালে কাজ আছে বেশকিছু। নতুন একটা হোটেলে উঠব, সেটিও মাউন্ট লাভিনিয়ায়। সেদিন এক ফাঁকে হোটেল বুকিং দিয়ে এসেছি, একনজর দেখে এসেছি। ঠিক যেন হোটেল নয়, বাংলো টাইপ বাড়ি। তিনতলাবিশিষ্ট, গাছগাছালি-ঘেরা যেন এক বাগানবাড়ি। হোটেলটির নাম আইভরি ইন।

কেএফসি থেকে রাতে খেয়ে আমরা এলাম হোটেলে। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে শরীর ক্লান্ত। ব্যালকনিতে বসে আছি উদাস হয়ে। সমুদ্রের বাতাস এসে উড়িয়ে দিলো সমূহ ক্লান্তি। বাঁধন ঘুমাবে কিছুক্ষণ, তারপর রাত ২টার দিকে রওনা হবে এয়ারপোর্টে। ঊর্মি ল্যাপটপে বসে কাজ করছে সেমিনারের। আমার তেমন কাজ নেই। রুমে এসে শুয়ে-শুয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ি। শ্রীলংকার ট্যুরিস্ট আকর্ষণ নিয়ে ম্যাগাজিন। হোটেলে ওঠার পর রুমে ম্যাগাজিনটি দিয়ে গেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। পর্যটক আকর্ষণের জন্য তাদের কত উদ্যোগ, কত পরিকল্পনা – সত্যিই অবাক হতে হয়।

পর্যটন খাতে তরতর করে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে উঠে যাচ্ছে শ্রীলংকা। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, ঐতিহ্যে শ্রীলংকার অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে। দেশটিতে যদি গৃহযুদ্ধ না থাকত, এশিয়ার আরেক সিঙ্গাপুর হতে পারত শ্রীলংকা। গৃহযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দেশটির। ধীরে-ধীরে তা কাটিয়ে উঠছে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠছে রাবণের দেশ।

ম্যাগাজিনটির কাগজ উন্নতমানের, ছাপা ঝকঝকে। তাতে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার বরাত দিয়ে ছাপা হয়েছে দারুণ একটি খবর। ভারত ও শ্রীলংকা পক প্রণালি দ্বারা বিচ্ছিন্ন। দুই দেশের মধ্যে দূর হবে বিচ্ছিন্নতা। সংযোগ তৈরিতে নির্মাণ করা হবে পৌরাণিক যুগের সেই ‘হনুমান সেতু’।

রামায়ণ অনুসারে সীতাকে উদ্ধারের জন্য সিংহলে অভিযান পরিচালনা করেন দেবতা হনুমান। কথিত আছে, সাগরে পাথর ফেলে তৈরি করা হয়েছিল একটা মজবুত সেতু। পৌরাণিক সেই সেতু দিয়েই লংকায় প্রবেশ করেছিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ।

পুরাণের ঘটনা যদি বাস্তবায়িত হয়, সেই সেতু যদি আবার নির্মিত হয়, তবে ভারত ও শ্রীলংকার মধ্যে তৈরি হবে নতুন এক যোগসূত্র। জানা যায়, ভারত ও শ্রীলংকার সরকারপ্রধান এ-সম্পর্কে একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

দেবতা হনুমানের তৈরি সেতুর ঐতিহ্য অনুসরণে ভারত মহাসাগরের পক প্রণালির ওপর তৈরি হবে হনুমান সেতু। পক প্রণালিতে সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে ৩০ কিলোমিটার। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এ-সেতু নির্মাণ অসম্ভব কিছু নয়।

কিছুক্ষণ পড়াশোনার পর আমি আর ঊর্মি হোটেলের ব্যালকনিতে বসে থাকি আনমনা হয়ে। সামনে ভারত মহাসাগর, হোটেল থেকে অনেক দূরে, সমুদ্রের মাঝবরাবর কয়েক বিন্দু আলো কাঁপছে তিরতির করে, রাতের রহস্যময় আলো-আঁধারিতে তা যেন রূপ নিয়েছে জাদুর গোলকে। দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস আসছে হালকা পরশ নিয়ে, দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় – সত্যিই শ্রীলংকা এক মায়াপুরীর দ্বীপ!

কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে বাঁধন এখন বেশ ফুরফুরে। লাগেজ গুছিয়েছে, তৈরি হয়েছে বিমানবন্দরের উদ্দেশে। ঠিক রাত ২টার দিকে গাড়ি এলো তাকে নিতে। আমরা যখন তাকে বিদায় দিই, আমাদের বেশ খারাপ লাগছিল। এয়ারপোর্টে ৪টার মধ্যে পৌঁছালেই হবে। আশা করি এক ঘণ্টার মধ্যেই সে পৌঁছে যাবে।

বাঁধনকে বহন করা মাইক্রোবাসটি ছাড়ার মিনিট ৪০ পরে ঊর্মি ফোন করে বাঁধনকে। একবার নয়, কয়েকবার; অদ্ভুত বিষয় ফোন রিসিভ করেনি সে। অজানা শঙ্কা ভর করে আমাদের মনে! মাঝরাতে রাস্তায় কোনো ঝামেলা হলো কিনা, ছিনতাইকারীর হাতে পড়ল কিনা – খুব দুর্ভাবনায় পড়ে যাই আমরা। মিনিট দশেক অপেক্ষা করে ফোন করে ঊর্মি। এবারো ফোন রিসিভ করেনি সে, চিন্তায় আমাদের তো হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম!

উচ্চস্বরে চিল্লাচিল্লি করে ঊর্মি বলল, তোমাকে বলেছিলাম বাঁধনের সঙ্গে যেতে। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারতে। তাই না?

ঊর্মির চোখমুখে রাজ্যের টেনশন। মাঝরাতে কোথায় যাব, কীভাবে খোঁজ নেব – চিন্তার জাল আচ্ছন্ন করে আমাকেও। তারপরও ঊর্মিকে অভয় দিয়ে বলি, হয়তো গাড়িতে সে ঘুমিয়েছে। মোবাইল সাইলেন্ট করা আছে। ঠিকই জেগে উঠে ফোন করবে। ঠিকমতোই পৌঁছাবে।

আমার কথায় কিছুটা শান্ত হয়ে ঊর্মি বলল, তুমি তো ড্রাইভারের ফোন নম্বরটাও নিতে পারতে? সেটাও করোনি।

ঊর্মিকে বলি, সেটা ঠিক। তবে ড্রাইভার তো হোটেল কর্তৃপক্ষের। ফলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সহজেই ড্রাইভারের নাম, ফোন নম্বর সব খুঁজে বের করা যাবে।

বাঁধনের অবস্থান খুঁজতে, ড্রাইভারের ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে আমরা যখন হোটেল রিসিপশনে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছি, তখনই বেজে উঠল ঊর্মির ফোন। অতঃপর ফোন করেছে বাঁধন। আমাদের দীর্ঘক্ষণ টেনশনে রাখার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তার। গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। মোবাইল ছিল সাইলেন্ট করা। ঘুম থেকে জাগল এয়ারপোর্টের সামনে এসে, তখন দেখে তার মোবাইলে নয়টি মিসড কল!

চার

গল ফেস সৈকতের পাশেই দাঁড়িয়ে পৃথিবীসেরা গল ফেস হোটেল। একদম সমুদ্রঘেঁষে হোটেলটির অবস্থান, মাউন্ট লাভিনিয়া হোটেলও সমুদ্রের কাছে, তবে এতটা কাছে নয়। গল ফেস সৈকতে ঘুরতে-ঘুরতে হোটেলটি দেখেছি কয়েকবার, সামনের রাস্তা দিয়েও আসা-যাওয়া করেছি দুয়েকবার। একদিন বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য দেখে আসি ইতিহাসখ্যাত গল ফেস হোটেল। হুমায়ূন আহমেদ ও শাকুর মজিদ হোটেলটির তারিফ করেছেন, বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন। কবি মুজিব মেহেদী শ্রীলংকায় এসে অতিথি ছিলেন এ-হোটেলে, তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে খুব প্রশংসা করেছেন হোটেলটির। শুধু তাঁরা নন, পৃথিবীর অনেক লেখকই লিখেছেন হোটেলটির কথা।

গল ফেস হোটেল

ঊর্মি তার সেমিনার নিয়ে ব্যস্ত। তারপরও ফোন করি – গল ফেস হোটেলটা দেখতে যাবো। আমার সঙ্গে যাবে?

বিকালের মলিন আলোয় তখন আমি গল ফেস সৈকতে দাঁড়িয়ে। খানিকটা সামনেই সেই গল ফেস হোটেল; ঊর্মির সেমিনার হচ্ছে যেখানে, সেই গালাদারি হোটেলটাও সৈকতের পাশে। নিজের আগ্রহের কথা জানিয়ে তাকে বলি, তোমার সেমিনারের যদি সমস্যা না হয় তাহলে চলে এসো সৈকতে।

ঊর্মি বলল, ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তখন সেমিনার শেষ হবে।

সেমিনার শেষে সেদিনের জায়গাটায় আসতে বলি তাকে – আমরা যেখানে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম অনেকক্ষণ।

কলম্বোতে আমাদের প্রিয় একটা জায়গা গল ফেস সৈকত। পরপর কয়েকটা সন্ধ্যা কাটিয়েছি এ-সৈকতে। বসেছি পাথরের বেঞ্চিতে, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভেবেছি – আহা! কোনোদিন আর কী আসা হবে শ্রীলংকায়!

মনের কথা ঊর্মিকে বলতেই সে আগ্রহ নিয়ে বলল, আমরা আবার কোনো একদিন আসব। হয়তো ১০ বছর পরে, কিংবা তারও অনেক বছর পরে। বেঁচে থাকলে অবশ্যই আবার আসব শ্রীলংকায়।

কথাগুলো শুনতে-শুনতে ঊর্মির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি একদৃষ্টিতে। তার কথা শুনে প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কথা ভেসে উঠল মনে। শ্রীলংকায় আসেননি কবি, কিন্তু কী চমৎকার কবিতা লিখেছেন সিংহল সমুদ্র নিয়ে! পৃথিবীতে মানুষের যাত্রা ঠিক কত বছর আগে শুরু হয়েছিল, কোন জায়গা থেকে শুরু হয়েছিল – বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদিও তা বিতর্কিত, কিন্তু কিছু ধর্মগ্রন্থের অনুসারীরা মনে করেন, প্রথম মানবের পা পড়েছিল শ্রীলংকায়। জীবনানন্দ দাশ সেই ইতিহাস টেনে বলেছিলেন, হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার কথা, লিখেছিলেন সিংহল সমুদ্রের কথা।

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দ- শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবসত্মীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
(‘বনলতা সেন’, জীবনানন্দ দাশ)

আমরা এখন প্রিয় কবির সিংহল সমুদ্রের পারে, দারুচিনি দ্বীপের ভেতরে। শ্রীলংকা তো দারুচিনিরই দ্বীপ। চারদিকে সিনামন রব। কত কিছুর নামের সঙ্গে জড়িয়ে সিনামন, তার হিসাব নেই। সিনামন নামে শ্রীলংকায় আছে নানা হোটেল, মোটেল, কটেজ, রিসোর্টসহ অসংখ্য স্থাপনা। কলম্বো ঘুরতে চোখে পড়ল পাঁচতারা সিনামন গ্র্যান্ড হোটেল। শপিং করতে গিয়ে চোখে পড়ল সিনামনের সাবান, ফেসওয়াশ থেকে শুরু করে নানা কিছু। হোটেলে খেতে গিয়ে বুঝতে পারি সিনামনের উজ্জ্বল ও মোহময় ঘ্রাণ।

আমরা শেষ বিকেলের আলোয় দেখতে যাই গল ফেস হোটেল। কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। সমুদ্রের তীরঘেঁষে হাঁটতে-হাঁটতে চলে আসি হোটেলের গেটে। গেটের সামনেই হোটেলের লোগো, তার ওপর ইংরেজিতে লেখা ১৮৬৪! বোঝা যায় দেড়শো বছর আগে নির্মিত হয়েছিল হোটেলটি। পুরনো ব্রিটিশ ধাঁচের ভবন। দেখতে মনে হয় রাজবাড়ি। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত মানুষের পা পড়েছে হোটেলটিতে। পৃথিবীর সেরা ও সুন্দরতম একশ জায়গা নিয়ে সাড়াজাগানো বই হান্ড্রেড পেস্নসেস টু সি বিফোর ইউ ডাই। বইটির ওই গৌরবময় তালিকায় নাম আছে হোটেলটির।

হোটেলটির ক্যাটালগে লেখা রয়েছে বিখ্যাত মানুষদের নাম, যাঁরা অতিথি ছিলেন এ-হোটেলে। ভেতরে ঢুকে দেখি লবিতে, রিসিপশনেও বিখ্যাত মানুষদের ছবি টানানো – ভিআইপিদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। প্রিয় লেখক আন্তন চেখভ শ্রীলংকায় বেড়াতে এসেছিলেন এখানে। রিসিপশনে ঢোকার মুখে তাঁর ছবি টানানো। নিচে লেখা আনন্ত চেখভ সম্পর্কে কিছু তথ্যবিবরণী। রাশিয়ার পৃথিবীখ্যাত এ-লেখক হোটেলটির অতিথি ছিলেন ১৮৯০ সালে। হিসাব করি, সেটাও প্রায় ১১৫ বছর আগের কথা। সায়েন্স ফিকশনের মাস্তান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক তো এই হোটেলের প্রেমে পড়েছিলেন। দীর্ঘ সময় তিনি এ-হোটেলে কাটিয়েছেন, তারপর শেষ জীবনেও চিরদিনের জন্য থেকে যান শ্রীলংকায়। সিমন উইনচেস্টার, বার্নার্ড শ, মার্ক টোয়েনসহ অতিথি ছিলেন অনেক কবি-সাহিত্যিক। রিসিপশনে তাঁদের নামগুলো পড়তে-পড়তে জেগে উঠছিল অদ্ভুত এক ভালোলাগা। সমুদ্রের পাড়ে তাঁরা হেঁটেছেন, সমুদ্রের গর্জনে বিমোহিত হয়েছেন, কফি পান করতে ভেবেছেন লেখার কথা, তাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাস যেন মিশে আছে দেয়ালে-দেয়ালে।

শুধু লেখক-সাহিত্যিক নন, রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে বিখ্যাত বহু মানুষ ছিলেন গল ফেস হোটেলে। খানিকটা আফসোস হলো, যদি আবার কোনোদিন আসি শ্রীলংকায়, থাকব এ-হোটেলে।

ভারত মহাসাগরের তীরঘেঁষে প্রতিষ্ঠিত এ-হোটেলে বিশ্ববিখ্যাত যাঁরা থেকেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন – ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, জাপানের রাজা হিরোহিতো, প্রথম স্পেসযাত্রী ইউরি গ্যাগরিন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হিব, স্পেনের রাজা আলফনসো, ডেনমার্কের রাজকন্যা আলেকজান্দ্রা ও রানী ইনগ্রিদ, পোপ জন পল, প্রিন্স ফিলিপ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, যুগোশস্নাভিয়ার মার্শাল টিটো, অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের মহাসচিব কার্ট ওয়ার্ল্ডহেইম, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট রিচার্ড এটলি, প্রিন্সেস এলি ও সদরুদ্দিন আগা খান, জওহের লাল নেহরুসহ নানা বিখ্যাত মানুষ। আমাদের ড. মুহাম্মদ ইউনূসও আছেন এ-তালিকায়। এ ছাড়াও চার্লস কনরাড, রিচার্ড এফ গর্ডন, রকফেলার থেকে শুরু অনেক মানুষ কলম্বো এসে অতিথি ছিলেন এ-হোটেলের। পৃথিবীবিখ্যাত অনেক ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, অভিনয়শিল্পী, সামরিক ব্যক্তিত্বের নাম রয়েছে তালিকায়। তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। সেখানে একটা নাম দেখে রক্ত নেচে উঠল – বিপস্নবের মহান পুরুষ চে গুয়েভারাও ছিলেন এ-হোটেলের অতিথি।

সমুদ্রলাগোয়া হোটেলটির উন্মুক্ত রেসেত্মারাঁ। ভিড়বাট্টা বেশ। বিকেলের নাশতার জন্য অতি উত্তম জায়গা। আমরা সমুদ্রের ধারে পেয়ে যাই একটা ফাঁকা টেবিল। ঝলমল করছে টেবিলগুলো। পাশের টেবিলগুলোয় বসে আছেন যাঁরা, তাঁদের সবাই বিভিন্ন দেশের ট্যুরিস্ট। ঠিক পাশের টেবিলেই বসেছেন তিনজন চাইনিজ। নাকি জাপানিজ? চিউ-মিউ করে কী যেন বলছেন এক ভদ্রলোক, তাঁর পাশে বাসা দুই তরুণী হো-হো হাসছেন। হাসির শব্দে আশপাশের লোকজন ফিরে-ফিরে দেখছেন তাঁদের।

গুড আফটারনুন ম্যাডাম! গুড আফটারনুন স্যার! পাশেই দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে স্বাগত জানালেন সুন্দরী ওয়েট্রেস। অপরূপা সুন্দরী। পাঁচতারা হোটেলে অনেক ভিনদেশি জব করেন। বোধহয় ফরেনার।

আর ইউ অ্যা শ্রীলংকান সিটিজেন?

আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটির মুখের হাসি বেড়ে গেল খানিকটা। অসম্ভব সুন্দর হাসি। মেয়েটির দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলাম না। বউকে পাশে নিয়ে অন্য মেয়েদের দিকে তাকানো নিরাপদ নয়।

অপরূপ হাসি ছড়িয়ে মেয়েটি বললেন, ইয়েস! তারপর আগ বাড়িয়ে তিনি বললেন, মাই মাদার ইজ অ্যা ব্রিটিশ, অ্যান্ড মাই ফাদার ইজ ফ্রম শ্রীলংকা। দ্যাটস হোয়াই পিপল থিংক আই অ্যাম অ্যা ফরেনার।

ঊর্মি অর্ডার করল নাশতার। আমরা অপেক্ষা করছি নাশতার জন্য। পাশ থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। হু-হু করে আসছে সমুদ্রের বাতাস। কিছুক্ষণ পরই এলো নাশতা। চিকেন স্টিক, চিকেন কাটলেট উইথ টিউমারিক সস, মিনি বিফ বার্গার। শেষে কফি। বিকেলের নাশতা চমৎকারই লাগল।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর বহু দেশে গেছেন। শ্রীলংকাতেও এসেছিলেন কয়েকবার। তিনি কেন এ-হোটেলে আসেননি কে জানে!

রেস্তোরাঁর যেখানটায় বসেছি আমরা, তার পাশেই হোটেলের দেয়ালে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। ভেজার আশঙ্কা নেই, খানিক উঁচু দেয়াল আছে সমুদ্রের পাশে। ঢেউয়ের ঝাপটায় না ভিজলেও স্পষ্টতই শোনা যাচ্ছিল সমুদ্রের গর্জন।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে নেয়া।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ sri lankastorytravel