শ্রীলংকা ভ্রমন – রাবন রাজার দেশে

প্রথম পর্বঃ ক্যান্ডি

শ্রীলংকা!! ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় পাঠ্যপুস্তকে “সমুদ্রের প্রতি রাবন” কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের দাঁত ভাঙ্গা ভাষায় প্রথম লংকার সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে কিঞ্চিত অবগত হই। কিন্তু মালদ্বীপের সেই পাঁচদিনের রোমাঞ্চকর এবং মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার পর তিনদিনের এই শ্রীলংকা ট্যুরটির প্রতি আমাদের কোন এক্সপেক্টশনই ছিলনা। ভেবেছিলাম যা দেখব , অভিজ্ঞতার ঝুলি পুর্ণ হতে তা সাহায্য করবে কিন্তু তাতে সেই ঝুলি কতটা সমৃদ্ধ হবে সে সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই ছিলনা আমাদের।

যাই হোক, মালদ্বীপ এয়ারপোর্ট থেকে আকাশযানে উড়াল দিয়ে প্রায় একঘন্টা পঁচিশ মিনিট পর বেলা এগারটায় আমরা অবতরণ করলাম কলম্বো বান্দারনায়েক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই আমাদের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড প্রিয়ান এগিয়ে এল। ওর সাথে করে নিয়ে আসা এলিওন গাড়িতেই আমরা রওনা দিলাম ক্যান্ডির পথে। ও হ্যা এই ফাঁকে আমরা আমাদের শ্রীলংকা ট্যুর প্ল্যানটা বলি। আমাদের প্ল্যানটি ছিল এরকম, এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ক্যান্ডি। কলম্বো থেকে ক্যান্ডি প্রায় চার ঘন্টার ড্রাইভ। যাওয়ার পথে পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ দেখব। তারপর ক্যান্ডি রাত থেকে পরের দিন ক্যান্ডির দুই একটি সাইট সিয়িং করে দুপুরে কলম্বোর পথে যাত্রা। রাতে কলম্বো থেকে পরের দিন সারাদিন কলম্বো সিটি ঘোরাঘুরি করে রাতে ইন্ডিয়া ব্যাক। ফ্লাইট রাত একটায় ছিল বলে ঘুরাঘুরির জন্য সারাটাদিনই পরে আছে।

জলকেলিরত ঐরাবত গণ, পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অর্ফানেজ।

কলম্বো থেকে ক্যান্ডির ড্রাইভটি বেশ ভালই লাগছিল আমাদের । কোথাও কোন চড়াই উতরাই নেই, বেশ মসৃন। এলিফ্যান্ট অরফানেজের কিছু আগেই চানাহ নামক একটি রেস্টুরেন্ট এ লাঞ্চ করলাম। এখানে শ্রীলংকার ফুড ট্রাই করলাম প্রথম এবং আমার কাছে বেশ ভালই লাগল। শুনেছিলাম তারা নারিকেল তেল দিয়ে রাধে, খাবার মুখে দেয়া যায়না, আমার তেমন কিছুই মনে হলনা। এর কারণ হতে পারে এই যে, রেস্টুরেন্টটি বেশ পপুলার হওয়ার কারণে তারা ট্যুরিস্টদের টেস্টের কথা চিন্তা করে রান্নায় বৈচিত্র এনেছে। দুইঘন্টার ড্রাইভের পর গাড়ি এসে থামল পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ এ। এখানে এসে টিকিট কেটে শুনলাম হাতীগুলো সব নদীতে গোসল করতে গেছে আমরা তাই তাদের পিছু পিছু সেই নদীতে। ওখানে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ঐরাবতগণের জলকেলি দেখে আবার ফিরে এলাম অরফানেজ এ। এখন বলি এই অরফানেজ আসলে কি। শ্রীলংকা সরকার হস্তী প্রজাতির বিলুপ্তি রোধে তাদের রক্ষনাবেক্ষনের জন্য এই অনাথ আশ্রমটি গড়ে তুলেছেন। একশ হাতীর মত এখন ওখানে রয়েছে। একসাথে এত হাতী এর আগে কখনো দেখা হয়নি। ভালই লাগছিল আমাদের। আর একটু অপেক্ষা করলে টাকা পে করে বেবি হাতীদের ফিডিং করানোও যেত কিন্তু আমাদের হাতে বেশি সময় ছিলনা বলে কন্যার আবদার আর রক্ষা করা সম্ভব হলনা। আবার গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। লক্ষ্য এবার ক্যান্ডি। গাড়ি এবার আপ হিল ওঠা শুরু করেছে। সাথে সাথেই ভিউ চেঞ্জ হয়ে গেল রাস্তার। দূর আকাশের গায়ে পাহাড়ের সারি, সুর্য্য কিরণ গায়ে মেখে তারা নানা বর্ণে বর্ণিত। মালদ্বীপের এই পাঁচদিনে সাগরের নীলে মন ভাসিয়েছি বহুবার। এবার পাহাড়ের নীল সবুজে মন রাঙ্গানোর পালা। প্রকৃতির রঙ রুপের এই পরিবর্তনের সাথে নিজেদের রাঙ্গাতে প্রস্তত হলাম আমরা এবার।

ক্যান্ডির কাছাকাছি পৌছে ভিউ পয়েন্টে নামলাম আমরা। এখান থেকে পুরো লেক পাহাড় আর বৃক্ষ ছাওয়া পুরো ক্যান্ডি শহরের চমৎকার একটি ভিউ পাওয়া যায়। আমরা সেই দৃশ্য আত্মস্ত করে চলে এলাম আমাদের হোটেলে। আমাদের হোটেলটি ছিল আসলে একটি ব্যাক্তি মালিকানাধীন গেস্ট হাউজ। ক্যান্ডি লেকের গা ঘেসা এই হোম স্টেটি ( প্রনবা হোম স্টে) আসলেই দারুন। আমরা রুমে ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরলাম নগর পরিদর্শনে। আমাদের গাইড অন্য কোথাও গাড়ি পার্ক করতে চলে গেল। আমরা পদব্রজেই তাই বেড়িয়ে পরলাম।

ভিউ পয়েন্ট থেকে ক্যান্ডি শহর।

পাহাড় বেস্টিত, সমুদ্র সমতল থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত এই শহরটি বেশ পরিস্কার, ছিমছাম, সুন্দর। এই শহরে বুদ্ধিস্ট দের অত্যন্ত পবিত্র একটি টেম্পল রয়েছে যার নাম “ টেম্পল অফ টুথ রেলিক” । গৌতম বুদ্ধের দাঁত এখানে রাখা আছে বলে এই মন্দিরটি তাদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র স্থান। প্রতি বছর জুলাই থেকে অগাস্টের মধ্যে কোন এক সময় পেরাহেরা নামক এক সপ্তাহ ব্যাপী এক বিশাল ফেস্টিভেবল এখানে অনুষ্ঠিত হয়। সৌভাগ্যজনকভাবে আমরা যখন ক্যান্ডিতে অবস্থান করছিলাম তখন তাদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবটি চলছিল। উৎসবকে কেন্দ্র করে সাজ সাজ রব শহরের চারিদিকে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ট্যুরিস্টদের সংখ্যা অগুনতি। শুধু এই উৎসবে সামিল হওয়ার জন্যেই তাদের আনাগোনা যে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমাদের হো্টেলটি এই টেম্পলের একদম কাছেই। তাই রাতের ক্যান্ডিতে হাঁটতে হাঁটতে আমরা উৎসবের সেই কেন্দ্রস্থলে চলে গেলাম। নানা রঙ্গে ও অলংকারে সজ্জিত বিরাটাকায় হাতী আর সুসজ্জিত কয়েক শত মানুষ রাজপথ এ নেমে এসে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহকারে নানারকম নৃত্যকলা প্রদর্শন করে চলেছে। পুরো এলাকা জুড়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের তৎপরতা চোখে পরার মত। আমরা সেই জন অরণ্যের মাঝে ঢুকে গিয়ে এদিক ওদিক উকিঝুকি মেরে একটু হাতীর শুঁড় কিংবা লেজের কিয়দংশ নয়ত নৃত্যরত মানুষদের দুই তিনটি ঠ্যাং থুক্কু পদযুগলের চাক্ষুস স্বাক্ষী হয়ে বিশাল অনুষ্ঠান দেখেছি এমন একটা পরিতৃপ্ত ভাব মুখে নিয়ে ক্যান্ডি সিটি সেন্টারে এসে পৌঁছলাম। এটি ক্যান্ডির অন্যতম একটি শপিং মল। এখানে চমৎকার একটি ফুড কোর্ট রয়েছে। সেই ফুড কোর্টে ডিনার করে আবার আমরা হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের পথে পারি দিলাম।
ক্যান্ডিতে যেহেতু এক রাতই থাকব আমরা তাই অদ্যই আমাদের শেষ রজনী। ভালমত একটা ঘুম দিয়ে সকালে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল থেকে চেক আউট করে বেড়িয়ে পরলাম আমরা। ইতিমধ্যে আমাদের ড্রাইভারও এসে হাজির। প্রথমেই আমরা গেলাম সেই বিখ্যাত টেম্পল” টেম্পল অফ টুথ রেলিক” এ।

উৎসবের কেন্দ্রস্থল এই টেম্পলটিতে যেন সাজ সাজ রব চলছে। শত শত নর নারি শুভ্র বস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে হাতে লাল নীল পদ্ম নিয়ে প্রবেশ করছে টেম্পল প্রাঙ্গনে। একসাথে এত কালারের পদ্ম আমরা আগে দেখিনি, মুগ্ধ হলাম তাদের মনোহর রঙ বৈচিত্র দেখে। আমরাও টিকেট কেটে ঢুকে পরলাম সেখানে। ভেতরে কেমন যেন মাতাল করা ঢাকের আওয়াজ আর সেই সাথে নৃত্য ঘোর লাগানো অনুভুতি নিয়ে আসে। আরো ভেতরে স্বর্ন নির্মিত গৌতম বুদ্ধের মুর্তি , তাঁর পবিত্র দন্ত এবং তাদের আরো কিছু বুদ্ধিস্ট ধর্মীয় জিনিস রক্ষিত । খুব বেশি ভীড় ছিল বলে আমরা আর বেশিক্ষন থাকলাম না। তবে এখানে লক্ষ্যনীয় যে, আপনারা টেম্পলে প্রবেশ করে বাহির থেকে মন্দিরের ছবি তুলতে পারবেন কিন্তু বৌদ্ধ মুর্তি বা টেম্পলকে পেছনে রেখে নিজে পোজ দিয়ে কোন ছবি তুলবেন না। এইটা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। এখান থেকে বেরিয়ে আমরা এবার ক্যান্ডি মার্কেটে। টুকটাক শপিং সেরে আবার চলে এলাম ক্যান্ডি সিটি সেন্টার। এখানে আবার সেই ফুড কোর্টে লাঞ্চ সেরে হোটেলে ফিরে লাগেজ নিয়ে এবার আমরা পারি জমালাম কলম্বোর পথে। পথে পেরাডেনিয়া বোট্যাকিন্যাল গার্ডেন দর্শন হবে।

পেরাডেনিয়া বোটানিক্যাল গার্ডেন

পেরাডেনিয়া বোটানিক্যাল গার্ডেনটি কয়েকশত বছরের প্রাচীন বৃক্ষ কানন। অসংখ্য প্রজাতীর তরুরাজীর সমাহার এখানে। টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করার সময় আপনাকে একটি ম্যাপ দেয়া হবে এই গার্ডেনের। আপনি সেই ম্যাপ দেখে দেখেই প্রদক্ষিন করতে পারবেন পুরো বাগান কিন্তু এই বিশাল বাগানটি পদব্রজে পদক্ষিন করতে আপনার পা বেচারার উপর দিয়ে ধকল যে ভালই যাবে তাতে সন্দেহ নাই কোন। যদিও টাকার বিনিময়ে বাগিতেও ( এক ধরনের ছোট্ট খোলা গাড়ি) বাগান ঘুরে আসা যায় কিন্তু পর্যটকের তুলনায় এই গাড়ির সংখ্যা খুবই অপ্রতুল হওয়ায় এগুলো পাওয়াই মুশকিল হয়। আমরাও চেস্টা করে পাইনি। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে বোট্যানিকাল গার্ডেনটি ঘুরে ঘুরে অসম্ভব সুন্দর এবং দুষ্প্রাপ্য কিছু বৃক্ষরাজি, অর্কিড, ক্যাকটাস, ব্যাম্বু( এত মোটা বাঁশ আমি জীবনেও দেখিনি), ঝুলন্ত সেতু এবং সর্বোপরি প্রতি গাছে ঝুলন্ত কয়েক কোটি বাদুর দেখে অন্তরে কিঞ্চিত ভীতি কিন্তু পরিতৃপ্তি নিয়ে নিয়ে আমরা উঠে বসলাম আমাদের গাড়িতে। সামনে নাগরিক জৌলুস আর চাকচিক্য নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে সমুদ্রের নোনা গন্ধ গায়ে মাখা, সাগর তীরে অবস্থিত রাবন রাজের সেই রাজধানী শহর কলম্বো।

শেষ পর্ব

ক্যান্ডি থেকে বেশ লম্বা পথ পারি দিয়ে যখন আমরা কলম্বো পৌছলাম তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। পথে বেশ ট্র্যাফিক থাকার কারণে চার ঘন্টার পথ প্রায় পাঁচ ঘন্টায় গিয়ে ঠেকল। তবে আমাদের নিয়ে গাড়িটি যখন কলম্বো শহরে প্রবেশ করছিল তখন চারপাশের নাগরিক আলোয় যতটুকু দেখলাম তাতে শহরটিকে আমার বেশ পরিচ্ছন্ন , ছিমছাম এবং সুন্দর বলেই মনে হল। যাই হোক দীর্ঘ পথযাত্রা শেষে রাত প্রায় নয়টার দিকে আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের হোটেলে। এখানে আমাদের হোটেলটি মেরিন ড্রাইভে, একদম সাগরের অপজিটে। মাঝখানে নগরীর মহাসড়ক সাগর আর হোটেলের ভবনগুলোর মাঝে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে। বেশ ভাল লাগল আমার লোকেশনটা। প্রচন্ড টায়ার্ড ছিলাম কিন্তু খেতে তো হবে। তাই কোনরকমে রুমে ব্যাগ রেখে আমরা চলে গেলাম পাশেই কেএফসিতে, ডিনার করতে। ফিরে এসেই নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া আর তারপর রাতের ট্রেনের নেশা ধরানো ঝিক ঝিক শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাওয়া।

পরদিন চমৎকার সকাল। কিন্তু আমাদের মন একটু বিষন্ন। কেন? কারণ আজ যে ঈদ। এখানে তো ঈদের ছিটে ফোঁটাও কোন লক্ষন নাই। যাই হোক, বারান্দায় এসে দাড়াতেই প্রথম দিনের আলোয় আমাদের স্বাক্ষাত হল কলম্বো সুন্দরীর সঙ্গে। সামনে বিস্তীর্ণ বিশাল সমুদ্র। তবে মালদ্বীপের সাগরের মত নীল নয় মোটেও , অনেকটা আমাদের কক্সবাজারের সাগরের মত ধুসর বরন জল। এখানে সাগরের ধার ঘেঁসেই রেইল লাইন। কিছুক্ষন পর পরই রেলগাড়ি চলছে । সামনেই ছোট্ট একটা স্টেশন ও আছে। কি অদ্ভুত! বেশ ভাল লাগল আমাদের সামনের ভিউটা। রেডি হয়ে হোটেলে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেড়িয়ে পরলাম শহর দেখতে। ঠিক করেছি কোন বিশেষ স্থান নয়, শুধুই এলোমেলো ঘুরব। আড়ম্বর না থাকলেও আজ তো ঈদ, সরকারী ছুটি। তাই সব দোকানপাট, অফিস আদালত বন্ধ। আমরা এখানে ওখানে, বিভিন্ন শপিং মলে একটু হানা দিয়ে লাঞ্চ করে ফিরলাম রুমে। একটু পরে আবার বেরোলাম। এবারও বাহন টুকটুক। তবে উবারের মত এ্যাপে চলে তারা। প্রথমে গেলাম লাকসালা নামক একটি সুভ্যেনিয়র শপে। সেখান থেকে টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করে চলে এলাম কলম্বোর সবচেয়ে পপুলার স্থান গালে ফেস বীচে।

হোটেলের সামনে ভিউ। সাগর, রেল লাইন আবার ছোট্ট একটা স্টেশন ও

নাগরিক যন্ত্রণা থেকে খানিক মুক্তির আস্বাদ নিতে হলে একটি চমৎকার জায়গা হতে পারে এই গালে বীচ। সমুদ্রের তীর ঘেসে বাঁধ ঘেরা বিস্তীর্ন সৈকত, উত্তাল ঢেউ এসে আছরে পরছে সেই কংক্রিটের বাঁধে, অদূরে সুউচ্চ নাগরিক ইমারতের সারি যেন শহুরে জৌলুসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। বিকেলে পৌঁছে দেখলাম অসংখ্য মানুষ সেখানে একটু শান্তির পরশ পেতে ছুটে এসেছে। চারিদিকে ছোটখাট বিভিন্ন দোকান রং বেরং এর নানা রকম পন্যর পশরা সাজিয়ে বসেছে। ছোট বড় সবাই এখানে নানা রঙের, নানা আকারের ঘুড়ি উড়িয়ে সমুদ্র তীরের আকাশটিকে নানা বর্ণে বর্ণিল বানিয়ে দিয়েছে। আমরা আর চুপ থাকি কেন? আমরাও তাই পাখি আকৃতির একটি ঘুড়ি কিনে ফুল ফ্যামিলি অত্যন্ত সিরিয়াস মুডে ঘুড়ি উড়াতে ঝাপিয়ে পরলাম। বেশ কিছুক্ষন ঘুড়ির পেছনে ছুটাছুটি করে , ঘুড়ি কতদুর উড়ল জানিনা তবে সাগর থেকে ভেসে আসা মাতাল হাওয়ায় আমাদের মন যে উড়ল বেশ সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই কোন।

গালে বীচ

এখান থেকে সন্ধ্যার দিকে হোটেলে ব্যাক করলাম। অতঃপর আবার রাতে কেফসিতে ডিনার করে ফিরে এসে রাত নয়টার দিকে হোটেল থেকেই এ্যারেঞ্জ করা ট্রান্সপোর্ট এ করে চলে এলাম এয়ারপোর্ট এবং রাত একটায় শ্রীলংকায় তিনদিনের এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে, চমৎকার কিছু স্মৃতি নিয়ে উঠে বসলাম শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের চেন্নাইগামী ফ্লাইটে। চেন্নাই থেকে আবার পরবর্তী গন্তব্য কলকাতা।

এখন ভ্রমন সংক্রান্ত টুকিটাকি

এখন এই তিনদিনের শ্রীলংকা ভ্রমনের সকল খরচের বিবরন দিচ্ছি। আপনাদের সুবিধার জন্য সকল খরচ বাংলাদেশি কারেন্সিতে কনভার্ট করে বলছি।

এয়ারফেয়ারঃ এর আগে মালদ্বীপ ভ্রমন কাহিনীতে আমি এয়ারফেয়ারের ডিটেইল দিয়েছিলাম। আপনাদের সুবিধার জন্য আবার দিচ্ছি। ঢাকা টু কলকাতা রিটার্ন ( ইন্ডিগো) , কলকাতা টু চেন্নাই রিটার্ন ( ইন্ডিগো) এবং চেন্নাই টু মালে , মালে টু কলম্বো, কলম্বো টু চেন্নাই ( শ্রীলংকান এয়ারলাইন্স ) মোট আমাদের দুই জন এ্যাডাল্ট ও একজন চাইল্ড জন্য খরচ হয়েছে এক লাখ বিশ হাজার টাকা।

ভিসাঃ শ্রীলংকায় অন এ্যারাইভাল ভিসা দেয় বলে আমরা দেশ থেকে ভিসা নিয়ে যাইনি। এয়ারপোর্টে নেমে লাইনে দাঁড়াতেই কয়েক মিনিটেই ভিসা হয়ে গেল। আমাদের দুজনের জন্য ভিসা ফি লাগল ৫০ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৪২০০ টাকা। বার বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের ভিসা ফি লাগেনা বলে আমার আট বছরের কন্যার জন্য কোন টাকা দিতে হলনা।

হোটেলঃ ক্যান্ডিতে আমাদের হোটেল প্রনবা হোম স্টে। এক রাতের জন্য আমাদের পে করতে হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় ৭৬০০ টাকা। কলম্বোয় হোটেল ছিল “এ ওয়ান দ্যা মারিন।” এখানে একরাত এবং পরদিন রাত নয়টা পর্যন্ত স্টে করার জন্য আমাদের পে করতে হয়েছে ৬৮০০।

ট্রান্সপোর্টঃ দেশে থাকতে অনলাইনে যোগাযোগ করে একটি ট্রাভেল এজেন্সির ( Visit our Lanka Tours ) মাধ্যমে কলম্বো টু ক্যান্ডি ট্রাভেলের জন্য ট্রান্সপোর্ট ঠিক করি আমরা। কলম্বো এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের পিক করে ক্যান্ডি এবং সেখানে এক রাত থেকে পরেরদিন আবার কলম্বো ব্যাক এবং সেইসাথে সকল সাইট সিয়িং ইনক্লুড করে ামাদের টোটাল খরচ পরেছে ১১০ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৯০০০ টাকার মত। এছাড়া কলম্বো হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট ড্রপ করার জন্য আমাদের ট্যাক্সিতে পে করতে হয়েছে ১৮০০ টাকা। কল্মবোর মধ্যে ঘুরাঘুরিতে আমরা টুকটুক ব্যাবহার করেছি যার ভাড়া খুব বেশি লাগেনি। বিভিন্ন সময় ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি বলে এক্সাক্ট কত লেগেছে বলতে পারছিনা।

সাইট সিয়িংঃ টেম্পল অফ টুথ রেলিক ক্যান্ডিতে আমাদের দুইজনের লেগেছে ১০০০ টাকা। বাচ্চারা ফ্রি। পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ এ তিনজনের টিকিটে লেগেছ ৯০০ টাকা। পেরাডেনিয়া বোট্যানিকাল গার্ডেনে আমাদের তিন জনের লেগেছে ২০০০ টাকা।

শপিংঃ শ্রীলংকায় জিনিসপত্রের দাম আমার কাছে খুব বেশি মনে হয়নি। আসলে ওদের ১ টাকা সমান আমাদের প্রায় ৫০ পয়সা। যে কোন দামই বাংলাদেশি টাকায় অর্ধেকে নেমে আসে বলে শপিং করে আনন্দ পাওয়া যায় বেশ। এখানে লেদারের জিনিস কিনতে পারেন স্বচ্ছন্দে। বিভিন্ন রকম জেমস এর জন্য শ্রীলংকা প্রসিদ্ধ তাই টাকা থাকলে রত্নও কিনতে পারেন নিশ্চিন্তে। সুভ্যেনিয়রের জন্য লাকশালা নামক শপটি বেশ প্রশিদ্ধ। তবে সুভ্যেনিয়র কিনতে গেলে প্রত্যেকটি শো পিস এবং অন্যান্য যাবতীয় সুভ্যেনিয়রে হাতীর বিবিধ ব্যাবহার দেখতে দেখতে হস্তী সম্প্রদায়ের প্রতি যদি আপনার বিরক্তি আসে তাহলে দোষ দেয়া যাবেনা মোটেই।

পরিশিষ্টঃ ভারত মহাসাগরের বুকের আর একটি ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র এই শ্রীলংকা। আকারে ছোট্ট হলে কি হবে জীব বৈচিত্র আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভুমি এই দেশ। আমরা আসলে এই স্বল্প সময়ে এর বিচিত্রতার কিছুই দেখিনি বলা যায়। খুব ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও সময় স্বল্পতার কারণে আরেক পাহাড়ি সৌন্দর্য্যের লীলাভুমি নুয়ারা এলিয়া যাওয়া হয়নি। দেখা হলনা এডামস পিক, গলে, রাবন রাজের টেম্পল, সিগিরিয়া, এন্ড অফ দ্যা আর্থ আরো কত কি! এছাড়া ছোট্ট এই দেশটির মানুষগুলিকেও খুব আন্তরিক এবং ভদ্র বলে মনে হয়েছে আমাদের। মালদ্বিপের মন ভোলানো সৌন্দর্য্য দেখে শ্রীলংকা নিয়ে যে আমাদের একপ্রকার উদাসীনতা ছিল তা এই দেশটির সংস্পর্শে এসে, এর সৌম্য, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন রুপ দেখে কবেই উধাও হয়ে তার জায়গায় দেশটি সম্পর্কে এক অদ্ভুত মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই আমরা। তাই রাবন রাজের “সেই কাঞ্চন সৌধ কিরিটিনী লংকা” যেন সত্যিই তার যথার্থ রুপে আবির্ভুত হয় আমাদের সামনে। মাইকেল মধুসুদনের দাঁতভাঙ্গা ভাষাকে যে সহজ, বোধগম্য করে দেয় সেই দেশটিকে ভাল না বেসে কি পারা যায়?

এর পরে ইনশা আল্লাহ দেখা হবে আবার কোন নতুন ডেস্টিনেশনের গল্প নিয়ে , ততদিন পর্যন্ত বিদায়

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ gallekandysrilanka