বাংলাদেশ থেকে পরিবার নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া ভ্রমণ

কোরিয়ার কথা বললেই মনে ভেসে আসে জনপ্রিয় কে-পপ এর কথা যার জ্বরে আজকে সমগ্র পৃথিবী কাঁপছে। আমার চোখে কোরিয়ার কথা বললে অবশ্য লাল পতাকা, ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা এবং কিম পরিবারের ছবি ভাসে। সেটা অবশ্য অন্য জগৎ উত্তর কোরিয়া। আমি গিয়েছিলাম প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। অবশ্য কে-পপ নিয়ে কোন আগ্রহ ছিলো না। পরিবারের সঙ্গে নিছক ভ্রমণের উদ্দেশেই ছিল এই অভিযাত্রা। আমার ১৫ মাস বয়সী ছেলে কে নিয়ে এটা ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা।

দক্ষিণ কোরিয়া এর ভিসা বিস্তারিত

যথারীতি বিদেশ ভ্রমণের পূর্বশর্ত ভিসা আবেদনের জন্য বাংলাদেশে কোরিয়ার এম্বেসীতে যোগাযোগ করলাম। ভিসা আবেদন জমা দেয়ার জন্য ইমেইল এর ম্যাধমে এপয়েন্টমেন্ট দিলো। দূতাবাসের ওয়েবসাইটে উল্লেখিত সকল ডকুমেন্টস প্রস্তুত করে এপয়েন্টমেন্ট টাইম অনুযায়ী সরাসরি দূতাবাসে চলে গেলাম। বাচ্চা অনেক ছোট হওয়াতে তাকে সশরীরে দূতাবাসে যেতে হয়নি। ভিসার জন্য জন প্রতি ৩৬০০ টাকা জমা দিতে হয়েছে। আমার কাছে ভিসা প্রস্তুত করার জন্য ওরা ৭ কর্ম দিবস সময় নিলো। কিন্তু আমি অবাক জমা দেয়ার ঠিক পরের দিন আমাকে SMS করা হলো যে আমার ভিসা প্রস্তুত আমি যেন সংগ্রহ করে নেই। আমি ওদের সার্ভিসে অভিভূত হলাম।

ঢাকা থেকে দক্ষিণ কোরিয়া যাত্রা

কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে ভ্রমণ করা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে গিয়েছে। ২০১৯ সালে আমি অফারে মাত্র ৩৯০০০ টাকায় জাপান এর বিমান টিকেট ক্রয় করতে পেরেছিলাম সেখানে ১ লক্ষ টাকার নিচে কোরিয়ার কোনো টিকেট কিনতে পারছিলাম না। অনেক কষ্ট করে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স সামান্য কমে টিকেটের ব্যবস্থা করলাম। এটা অনেক কঠিন ছিল কারণ মালয়েশিয়াতে আমাদের ১৯ ঘন্টা ট্রানজিট ছিল যা ১৫ মাসের বাচ্চা নিয়ে একটা দুঃসাহসী ব্যাপার। ৪ ঘন্টা কুয়ালালামপুর ফ্লাই করে ১৯ ঘন্টা বিরতি নিয়ে আবার ৭ ঘন্টার সিউলের ফ্লাইটে উঠলাম। ৩০ ঘন্টা পর আমরা সিউলে অবতরণ করে ইমিগ্রেশন এবং কোভিড সংকান্ত যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চড়ে বসলাম এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেস ট্রেনে। গন্তব্য সিউল স্টেশন এবং সেখান থেকে বুসানের বুলেট ট্রেন ধরা। ইতো মধ্যে আমরা এয়ারপোর্ট থেকে লোকাল সিম কার্ড সংগ্রহ করে নিয়েছি। সিউল স্টেশনে পৌঁছানোর পর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সেই দিনের কোনো ট্রেনে আর বসার সিট নেই। একটাই উপায় আছে সেটা হচ্ছে ট্রেনে দাড়ায়ে যেতে হবে। ৩৩ ঘন্টা ছোট বাচ্চা নিয়ে জার্নি করে তখন আমাদের যায় যায় অবস্থা। কিন্তু হোটেল বুক করা বুসান শহরে। আমাদের না গিয়ে কোনো উপায় নেই। কফি খেয়ে নিজেদের চাঙ্গা করে নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভিযানে নেমে গেলাম। আমাদের সঙ্গে তখন ২ টি ব্যাগ এবং ১ টি স্ট্রলার মিলিয়ে প্রায় ৩৫ কেজি সঙ্গে ছেলে তো আছেই। সৃষ্টিকর্তার সাহায্যে প্রার্থনা করে মনোবল শক্ত করে ট্রেনে উঠে গেলাম। সিউল থেকে বুসান ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব। এই বুলেট ট্রেনে সময় লাগে ২ ঘন্টা ৪০ মিনিট। ট্রেন ছিল অসম্ভব পরিপাটি এবং ব্যাগ রাখার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। এই দীর্ঘ রাস্তা পারি দিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছলাম বুসান শহরে। দেরি না করে ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি হোটেলে চলে গেলাম।

দক্ষিণ কোরিয়া ট্যুর এর বিস্তারিত

বুসান

বিশ্রাম নিয়ে আমরা বের হয়ে পড়লাম বুসান (Busan) ঘুরে দেখতে। বুসানে সর্বমোট ৪ দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েছিলাম। এই চার দিনে আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি হিউন্দাই সমুদ্র সৈকত, Blue Line Park, Seomyeon, বুসান টাওয়ার, Haedong Yonggungsa Temple সহ আরো অনেক চমৎকার জায়গায়। বাচ্চা সঙ্গে থাকায় আমরা বেড়ানোর ফাঁকে শপিং মলে অনেক বেশি সময় অবস্থান করতে হয়েছে। বুসান অনেক ছিমছাম একটা সুন্দর শহর। অথেন্টিক কোরিয়ান খাবারের জন্য বুসান বিখ্যাত। বুসান ভ্রমণ শেষে আমরা সিউলে চলে আসার জন্য আবার বুলেট ট্রেনে উঠলাম। এইবার আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়ায় আমরা অগ্রিম টিকেট বুক করে রেখেছিলাম। খুব সুন্দর ভাবে বসে যাত্রা পথে আনন্দ করতে করতে পৌঁছে গেলাম কোরিয়ার রাজধানী সিউল শহরে।

Haedong Yonggungsa Temple

সিউল

সিউলে (Seoul) ৫ দিন থাকার পরিকল্পনা করে এসেছিলাম। প্রথম দিন ঠান্ডা ও বৃষ্টির জন্য ভ্রমণ কিছুটা বিঘ্ন হয়েছিল। আবহাওয়া একটু ভালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা চলে গেলাম Cheonggyecheon stream দেখার জন্য। প্রায় ১ কোটি মানুষের শহরের ব্যাস্ততম রাস্তার নিচে অবস্থিত এক হারিয়ে যাওয়া নদী কে কিভাবে Urban Renewal এর সঙ্গে চমৎকার পাবলিক স্পেসে পরিণত করা যায় তার এক সফল কেস স্টাডি এই Cheonggyecheon এলাকা। দেখে কোনো ভাবে চিন্তাও করা যায় না এই জায়গাতে আগে বিশাল ফ্লাইওভার ছিল। Cheonggyecheon এর এই সফল পরিবর্তন সিউল শহর কে দিয়েছে এক নতুন রূপ। এটা সিউলের সবচেয়ে সফল এবং বড় মেগা প্রজেক্ট গুলোর একটি। Youtube এ Cheonggyecheon নিয়ে অনেক ভিডিও আছে, আগ্রহ থাকলে দেখতে পারেন।

Busan Skyline from Busan Tower

২য় দিন চলে গেলাম Deoksugung রয়েল প্যালেস দেখার জন্য। ছোট বাচ্চা সহ ঘুরে বেড়ানোর জন্য এটা চমৎকার জায়গা। এছাড়া পুরোদমে কোরিয়ান খাবার আমরা উপভোগ করছিলাম। নিকটবর্তী সিউল সিটি হল এবং Gwanghwamun Square ও ঘুরে দেখলাম।

সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম ৩য় দিন আমার ছেলের জন্য ডেডিকেটেড রাখবো। ওর মনোরঞ্জনের জন্য চলে গেলাম ওদের সবচেয়ে বড় থিম পার্ক লোটা ওয়ার্ল্ড। সারাদিন পরিবারের সঙ্গে এখানে সময় কাটালাম। সারাদিন থেকেও মনে হচ্ছিলো অনেক কিছু দেখা বাকি। এটার অবশ্য কারণ হচ্ছে অনেক বেশি ভিড় ছিল।

পরবর্তী দিন শুক্রবার হওয়াতে দুপুরে চলে গেলাম সিউল কেন্দ্রীয় মসজিদে। মসজিদটি সুন্দর স্থাপত্যশৈলীতে পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত। এই জায়গাটা থেকে শহরের খুব সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়। নামাজের পর চলে গেলাম কোরিয়ান ওয়ার মিউজিয়াম দেখার জন্য। উনিশ শতকের স্নায়ুযুদ্ধ এখনো কিভাবে কোরিয়ান পেনিসুলাকে ২ ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে তা এই মিউজিয়ামে গেলে অনুভব করা যায়। যুদ্ধে ১৯৫৩ সালে পুরোপুরি ধ্বংস স্তুপে পরিণত একটা দেশ কোনো প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া কিভাবে বিশ্বের অন্যতম সফল রাষ্ট্র হতে পারে তা যে কাউকে শিহরিত করতে বাধ্য।

Korean War Museum

যতটুকু সময় হাতে বাকি ছিল আমরা ডেডিকেট করলাম বিভিন্ন সুস্বাধু কোরিয়ান খাবার টেস্ট করার জন্য। আমরা নামপদং এবং মিয়ংদং এ স্ট্রিট ফুড ট্যুর করলাম। এর মাঝে একটু শান্তিপূর্ণ সময় কাটানোর জন্য গিয়েছিলাম Namsangol Hanok Village। এরপর আবার ফুড ট্যুর। কোরিয়ান খাবার এর স্বাদ এখনো আমাদের মুখে লেগে আছে ।

Namsangol Hanok Village

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

  • আমরা পুরো কোরিয়া ট্রিপ এ মাত্র ২ বার ট্যাক্সি ব্যবহার করেছি। বুসানে ২ বার এবং সিউলে একবারও ব্যবহার করি নাই। কারণ পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন খুব ভালো। পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবহার করলে কোথাও স্ট্রলার ভাঁজ করতে হয় না। সব জায়গা এক্সেসিবল। ট্যাক্সিতে বরং স্ট্রলার ভাঁজ করার ঝামেলা আছে।
  • কোরিয়াতে বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে আমাদের খুব বেশি কষ্ট হয়নি। বাচ্চার খাবারের কোনো ঝামেলাই নেই। জায়গায় জায়গায় গ্রোসারি স্টোরে এবং সেখানে বাচ্চাদের স্বাস্থকর রেডি ফুড পাওয়া যায়। আমার বাচ্চা ওখানকার গ্রোসারি স্টোরের জাউ ভাত খুব মজা করে খেয়েছে। এতো সুবিধা আর কোথায় আছে আমার জানা নেই।
  • সব জায়গায় সুন্দর বেবি চেঞ্জিং এবং বেবি ফিডিং রুম আছে। এক কোথায় অসাধারণ। বাচ্চা নিয়ে সারাদিন বাইরে থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই।
  • পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবহার করার জন্য T-Money কার্ড করে নিতে হয়। সব স্টেশনে কার্ড কেনা এন্ড রিচার্জ করার মেশিন আছে। এটা করার জন্য ক্যাশ পেমেন্ট করতে হয়।
  • এছাড়া ক্যাশের ব্যবহার অনেক কম। বেশির ভাগ জায়গাতেই ডিজিটাল পেমেন্ট।
  • কোরিয়াতে আমার কাছে জেনারেশন গ্যাপ অনেক বেশি মনে হয়ছে। বয়স্ক এবং তরুণদের পার্সোনালিটি কালচার সব কিছু আকাশ পাতাল আলাদা।
  • কোরিয়াতে মোবাইল ফোন প্যাকেজ অনেক বেশি ব্যায়বহুল। বাংলাদেশ থেকে এখানে আসলে দেশের মোবাইল অপেরাটরদের জন্য ব্যাপক শ্রদ্ধা তৈরী হবে। ১০ দিনের ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য এইখানে বাংলাদেশী টাকায় ৩৫০০ টাকা। যদিও এইখানকার ইন্টারনেট বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতির ইন্টারনেট। কিন্তু তারপরও প্যাকেজ প্রাইসটা দেয়ার পর মন খারাপ হতে বাধ্য।
  • বিভিন্ন দামের হোটেল আছে কোরিয়াতে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় দাম একটু বেশি। ৩ ষ্টার হোটেলে প্রতি রাতের মূল্য পিক সিজনে ৬০০০ টাকার মতো।
কোরিয়াতে পরিবেশকে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়। আমাদের ভ্রমণে এবং নিজের দেশে ২ জায়গাতেই পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিশেষ ভাবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ busankoreaseoulsouth korea