সোনাদিয়া দ্বীপে ক্যাম্পিং, সাথে মহেশখালীর মিষ্টিপান

ট্যুরে যাওয়ার পাঁচদিন আগে সকালের অপত্য ঘুম নষ্ট করে ঢাকা টু চট্টগ্রামের টিকেট কাটলাম কচ কচ করে। তুর্ণা এক্সপ্রেসে রাত ১১:৫৯ এ বিমানবন্দর স্টেশন থেকে। আমরা ছিলাম পাঁচজন তাই একটু দেরিতে টিকেট কাঁটায় দুই বগিতে সিট পেতে হলো আমাদের। এতে কিছুটা আশাহত হলেও ট্রেনে যখন দেখলাম করোনাকালীন বিধি নিষেধে দুই সিটে একজন বসতে হয়েছে, তখন আমাদের মুখে চাঁদের হাসি। বৃহঃস্পতি বার (০৩.০২.২২) রাত ১১:৫৯ এর তূর্ণা এক্সপ্রেসে উঠে পড়লাম আমরা। সারারাত কার্ড খেলে আর ট্রেনের অতিপরিচিত হৃদমে দুলতে দুলতে কিছুটা ঠান্ডা হাওয়া মাখিয়ে পরদিন (০৪.০২.২২) শুক্রবার খুব সকালে পৌঁছে গেলাম চট্টগ্রামে।

চট্টগ্রামে নেমে স্টেশনের পাশের একটি হোটেলে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে পাঁচজনেই একটি মাত্র সিএনজিতে নিজেদের গুঁজে নিলাম সাথে আমাদের সাথে আনা টন-খানেক মালপত্র, যাতে আছে বারবিকিউ মশলা থেকে শুরু করে ফ্রাইপ্যান-প্রেশার কুকার। কিভাবে এটা সম্ভব হলো সেটা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আঁটে না। একটু পরেই পৌঁছালাম নতুন ব্রিজে। নতুন ব্রিজে মারছা বাসে তৎক্ষনাৎ সিট না পাওয়ায় চলে গেলাম সৌদিয়ায়, পেয়েও গেলাম সামনের দিকের পাঁচটি সিট। কক্সবাজার পৌঁছে নামাজ পরে আমরা কিছু বাজার করে নিলাম পটাপট সোনাদিয়ার জন্য। কারণ সোনাদিয়ায় কোন বাজার নেই। আশেপাশে কেরোশিন না পেয়ে কিনে নিলাম দেড় লিটার ডিজেল, জ্বালাবো।

নামাজ শেষে প্রথমে গেলাম ঝাউতলার পঊশী রেস্টুরেন্টে, গরিবের ফাইভ স্টার। সেখানে দুপুরের খাওয়া শেষ করে রওনা দিলাম কক্সবাজার ৬ নং ঘাটে, ঘাটের টোল ২০ টাকা, বাধ্য হয়ে দিতেই হলো, একটা স্পিড বোট ঠিক করে উঠে পড়লাম পাঁচ জন। স্পিড বোটের ভাড়া কমাতে অনেক নাটক করতে হলো আমাদের। আমরা একটু দেরি করে ফেলায় মহেশখালী হয়ে না গিয়ে সরাসরি সোনাদিয়ায় যাবো ঠিক করেছিলাম আমরা। বাতাসের আগে উড়ে যাচ্ছে বোট। হঠাৎ করে ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নোনা পানি দিয়ে ভিজে যাচ্ছি আমরা। একটু পরে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের মধ্য দিয়ে উড়ে চললো স্পিডবোট।

২৫-৩০ মিনিটের মত লাগলো সোনাদিয়া পৌঁছাতে। আমাদের গাইডকে ফোন দিলাম। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়লাম সোনাদিয়ার, গভীর প্রেম। বিস্তৃত সবুজ মাঠ আর ম্যানগ্রোভ বনের আড়ালে উকি দিচ্ছে সোনাদিয়ার হালকা বসতি। গাইড চলে আসলে রওনা দিলাম আমাদের ক্যাম্পিং স্পটে। ক্যাম্পে পৌঁছানোর আগেই শুনতে পেলাম সমুদ্রের হুঙ্কার। সামান্য হেঁটেই পৌঁছেগেলাম পশ্চিমপাড়ায় বিচে ক্যাম্পিং স্পটে। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই খাটানো হলো তাবু। দুপুরে কক্সবাজার থেকে খেয়ে আসায় এখন আর কোন কাজ নেই। ক্যাম্পে মালপত্র রেখে আশেপাশে ঘুরলাম, পশ্চিমপাড়ার মসজিদে নামাজ পড়লাম আর পাশের ঝাউবন থেকে হালকা কিছু জ্বালানি সংগ্রহ করলাম।

রেস্ট নিতে নিতেই বিকাল গরিয়ে সন্ধ্যা নেমে গেলো। সাথে শুরু হলো বিচের ঠান্ডা বাতাস। কি জন্য যেনো সবার ক্ষুধা লেগে গেলো কিন্তু রেডি কিছু না থাকায় সোনাদিয়া থেকে মুড়ি চানাচুর নিয়ে মাখানো হলো অমৃতসম জাদুমাখা-মুড়ি। এরপর কক্সবাজার থেকে আনা মুরগিটা বের করে মেরিনেট করে রাখা হলো আর ক্যাম্পফায়ার করে সেটায় কয়লা একটু আগুনে দিলাম। শুরু হয়ে গেলো রাতের রান্নার আয়োজন। আগুন জ্বালিয়ে ভাজলাম রেডিমেড রুটি। রান্না শেষে এবার খাওয়ার পালা। চিকেনটা একটু ঝাল বেশি হলেও সব মুহুর্তেই শেষ হয়ে গেলো তবে গাইডের জন্য আগে থেকেই কিছুটা রেখে দিয়েছিলাম আমরা। রাতে কার্ড খেললাম আমার নিয়ে যাওয়া সোলার লাইটের চকচকে আলোতে।

হঠাৎ চারদিকে হুহু বাতাস আর মেঘের আনাগোনা। শান্তর পূর্বাভাস অনুযায়ী শুরু হলো দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টি। একটু থামে আবার শুরু হয়। সব কাপড় আর শুকনো জিনিস ভিজে যাচ্ছে বিধায় আমরা সিন্ধান্ত নিলাম গাইডের বাড়িতেই রাতের বাকি এক চতুর্থাংশটা কাটাবো।

পরদিন (০৫.০২.২২) শনিবার সকালে এক দোকানে চা খেয়ে চলে আসলাম ক্যাম্পিং সাইটে। সকালে রান্না হলো কাপ নুডুল্স আর ডিম সেদ্ধ। নাস্তা সেরে রওনা হলাম দ্বীপ ঘুরে দেখতে। নিরিবিলি দ্বীপ। নেই কোন কোলাহল বারতি ট্যুরিষ্টের চাপ কিংবা অনেক অনেক রিসোর্ট। আছে শুধু উত্তাল হাওয়ায় উন্মত্ত সাগরের গর্জন আর দমকা হাওয়ায় দুঃখ ভুলানোর গান। সাগর পাড়ে বসে চললো কিছুক্ষন অপার সমুদ্রের সাথে মান অভিমানের খেলা সাথে সর্বহারা পথিকের গান আর সোনাদিয়া দ্বীপের গান।

ফিরে আসতে আসতে শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টির তাড়া। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই, রান্না করতেই হবে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ত্রিপল আর ডিজেলের সাহায্যে চললো ভাত, আলুভর্তা, ডাল আর ডিমভাজির আয়োজন। সবাই মিলে কাটাকাটি আর রান্নার মধ্যে আলাদা একটা অনুভুতি। নেই কোন শহুরে সুবিধা, নেই কোন কোলাহোল বা যন্ত্রের ঝনঝনানি আছে শুধু প্রকৃতির মায়া আর অপরুপ সৌন্দর্যে মাখা আলিঙ্গন।

দুপুরে খেয়ে রেস্ট নিলাম, গল্প গান আড্ডা। আজ রাতের খিচুরি ডিমভাজিটা হলো সবচেয়ে মজাদার। খেয়ে আমরা কিছুক্ষন কার্ড খেলে মিশেলকে রেখে হাঁটতে বের হলাম। দূরে এল.এন.জি’র একটা জাহাজ দেখা যায় আর দেখা যায় কিছৃ মাছ ধরার ট্রলারের অস্তিত্ব। শুবিশাল সমুদ্র আর অসীম আকাশের নিচে নিজের মনেহলো পতঙ্গসম ক্ষুদ্র।

রাতে ঘুমালাম সবার নিজেদের ভৌতিক অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে। রাতে শোনা গেলো কিছু শিয়ালের ডাক। কাল সকালে রওনা দিতে হবে তাই সবাই ঘুমালাম একটু আগে আগেই।

পরদিন (০৬.০২.২২) রবিবার সকালে উঠে নুডুল্স আর ডিম খেয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা হলাম মহেশখালীর উদ্দ্যেশ্যে। যন্ত্রের নৌকায় উঠলাম বেলা ১২ টার দিকে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌছালাম ঘটিভাঙ্গা। ঘটিভাঙ্গা থেকে অটোতে চলে গেলাম গোড়কঘাটা বাজারে। যাওয়ার পথে চোখে পড়লো লবনের জমি আর পানের বরজ। বাজারে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে খেলাম দুপুরে। খেয়ে রওনা হলাম মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে। সেখান থেকে শুটিং স্পট এরপর খেলাম মহেশখালীর বিখ্যাত মিষ্টি পান। বিকাল ৫ টার দিকে মহেশখালী ঘাট থেকে (গোরকঘাটা) রওনা দিলাম কক্সবাজারের উদ্দ্যেশ্যে।

কক্সবাজারে নেমে অটো করে রওনা দিলাম ডলফিন মোড়ের দিকে। সনাতন সমপ্রদায়ের বানী অর্চনা পূজা (সরস্বতী পুজার) বিশাল বহরের পিছে পরলাম আমরা। ঢাকের তালে ভিতরে কিছুটা উন্মত্ততা তৈরি হলেও ট্রেন মিস করার তাড়নায় তা বাস্পিভূত হলো। ডলফিন মোড়ে নেমে তখনকার চট্টগ্রামের বাসের টিকেট কেটে উঠে পড়লাম বাসে। রাতে চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজে নেমে খেয়ে উঠে পড়লাম ১১ টার তূর্ণা এক্সপ্রেসে। ভোরে ভোরে পৌঁছে গেলাম ঢাকায়। সকাল ৮:০০ টায় উঠে রেডি হয়ে ৯ টায় অফিস ধরলাম, অফিসে কাজের ফাঁকে চায়ের আসর মাতালাম সোনাদিয়া আর মহেশখালীর রঙ্গে।

হঠাৎ প্ল্যানিং এ শুরু হওয়া সোনাদিয়া ক্যাম্পিং ট্যুর হঠাৎ ভাঙা স্বপ্নের মতই শেষ হয়ে গেলো তবে রেখে গেলো কিছু সুখানুভুতি আর অপূর্ব স্মৃতি।

আমাদের রুট

ঢাকা – চট্টগ্রাম রেলস্টেশন – চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ বাসস্ট্যান্ড – কক্সবাজার ডলফিন মোড় – ৬ নং জেটি ঘাট – সোনাদিয়া স্পিড বোটে – সোনাদিয়া – ঘটিভাঙ্গা (মহেশখালী) – গোড়কঘাটায় আদিনাথ মন্দির – মহেশখালী ঘাট – কক্সবাজার ৬ নং জেটি – কক্সবাজার ডলফিন মোড় – চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ – চট্টগ্রাম রেলস্টেশন – ঢাকা।

যেভাবে যাবেন সোনাদিয়া দ্বীপ

দেশের যেকোন যায়গা থেকে চলে যেতে হবে কক্সবাজার তথা কক্সবাজারের ৬নং জেটি ঘাটে। সেখান থেকে সোনাদিয়া সরাসরি স্পিডবোটে গেলে খরচ পড়বে বেশি। আর মহেশখালী হয়ে সোনাদিয়ায় গেলে খরচ পড়বে কম।

তবে মহেশখালীর ঘটিভাঙ্গায় সোনাদিয়া থেকে একটা মাত্র নৌকা আসে সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১ টার মধ্যে, জোয়ারের সময়ের সাথে মিল রেখে। এজন্য যদি কক্সবাজার থেকে সকাল সকাল বের হওয়া যায় তাহলে এই রুটে যেতে পারেন আপনারা। এজন্য প্রথমে ৬ নং ঘাট থেকে স্পিড বোটে চলে যেতে হবে মহেশখালীর ঘাট গোরকঘাটায় সময় ২০-২৫ মিনিট। গোড়কঘাটা থেকে অটোতে চলে যেতে পারবেন ঘটিভাঙ্গায় সময় লাগবে ৩০-৪০ মিনিট। এরপর ঘটি ভাঙ্গায় সোনাদিয়ার নৌকায় উঠতে হবে।

সোনাদিয়া থেকে আসার জন্যও ওই একটা নৌকা যেটা ছাড়বে জোয়ারের সাথে মিল রেখে ১০ টা থেকে ১২ টার দিকে। সেই নৌকায় আসতে হবে ঘটিভাঙ্গা, সেখান থেকে গোড়ক ঘাটা ঘাট, সেখান থেকে কক্সবাজার জেটি।

সরকপথে মহেশখালী হয়ে সোনাদিয়া ভ্রমন

সরক পথে সোনাদিয়ায় যেতে আপনাকে নামতে হবে চকোরিয়াতে, সেখান থেকে আসতে হবে সিএনজিতে/অটোতে মহেশখালীর গোড়কঘাটায় এবং তারপর অটোতে ঘটিভাঙ্গায় এরপর নৌকায় সোনাদিয়া। যাওয়ার সময়ও চকোরিয়া হয়ে।

খরচ

নন এসি বাস ট্রেন নৌকা সব মিলিয়ে ২ রাত সোনাদিয়ায় থাকলে খরচ ৪০০০-৫০০০ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। খাওয়া দাওয়া আর কক্সবাজার-মহেশখালীতে একটু সচেতন ভাবে খরচ করলে খরচটা আরেকটু কমেও যেতে পারে।

ট্রাভেলারের বৈশিষ্ট্য প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে সম্মান করা। প্রকৃতির ক্ষতি হয় বা স্থানীয় অধিবাসী ও আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে ছোট করা হয় এমন কোন কাজ আমরা করবো না। পথে প্লাস্টিক জাতীয় আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবো।
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ campingmoheshkhalisonadia