সমুদ্রের দুঃখ আর পাহাড়ের আনন্দ!

হাদা পাহাড় খুব ভালোবাসে। ভালোবাসা বললে কমই বলা হবে, পাহাড়ের সাথে তার এতটাই সখ্য যে পাহাড়ের সাথে ওর প্রেম আছে বলেই পরিচিতজনরা বলে থাকে!

আর হাদার বৌ তো আরো এককাঠি সরেস, সে পাহাড়কে হাদার প্রেমিকার থেকে আর এক ধাপ এগিয়ে হাদার সাথে পাহাড়ের পরকীয়ার নিষিদ্ধ সম্পর্কে রূপ দিলো!

হাদার মনে এ নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই। পাহাড়কে সে যে কতটা ভালোবাসে বা পাহাড়ের জন্য যে হাদা কতটা ব্যাকুল সেটা সবাই বুঝতে পারে, এই তৃপ্তি নিয়েই হাদার দিন কাটে। সময়-সুযোগ আর অর্থ হলেই হাদা পাহাড়ে হারিয়ে যায়, হুট-হাট!

সামনে হাদার বিয়ে বার্ষিকী! হাদার অনেক দিনের ইচ্ছে, বৌকে নিয়ে পাহাড়ে গিয়ে বিয়ে বার্ষিকী উদযাপনের! কিন্তু বৌকে সে কথা বলার তেমন সাহস নেই! নাহ, তার মানে এই নয় যে হাদা বৌকে ভঁয় পায়! তা নয় আদৌ, কিন্তু হাদার বৌ পাহাড় পছন্দ করেনা, সেটা হাদা জানে! সেটা যতোটা না পাহাড়কে অপছন্দ তার চেয়ে বেশী হাদা কেন পাহাড়কে এতো ভালোবাসে, সেই হিংসায়! পাহাড়কে হাদার বৌ নিজের সতীন ভাবে! আর বলে পাহাড়ের সাথে হাদার পরকীয়া! নিষিদ্ধ সম্পর্ক! হাদা এসব শোনে আর মিটিমিটি হাসে। কোন অভিমান বা অভিযোগ করেনা কখনো।

হাদার বৌয়ের পছন্দ সমুদ্র-ঢেউ-বালুচর-বীচ-নীল জল-বৃষ্টি ভেজা বালুকা বেলা, বীচের নরম বালুতে হেটে বেড়ানো, ঢেউয়ের ছুটে আসা পানিতে পা ভেজাতে, জলকেলি করে উচ্ছ্বাসে হারাতে। যদিও হাদার বৌ কখনো পাহাড় দেখেনি, পাহাড় ছোঁয়নি, পাহাড়ের বাতাস গাঁয়ে মাখেনি, পাহাড়ের ডাক শোনেনি, পাহাড়ে ঢেকে যাওয়া মেঘ দেখেনি, পাহাড়ের বুকে সুখের অশ্রু হয়ে ঝরে পড়া ঝর্ণা দেখেনি, অনেক অনেক কষ্ট করে কোন পাহাড়ের চুড়ায় ওঠার যে কি সুখ সেটা কখনো অনুভব করেনি।

তাই হাদার খুব খুব ইচ্ছে বৌকে নিয়ে একবার পাহাড়ে যাবার। তারপর ফিরে এসে বৌকে জিজ্ঞাসা করার, যে তোমার কোনটা বেশী ভালো লেগেছে, পাহাড় না সমুদ্র? তুমি বেড়াতে গেলে কোনটা বেছে নেবে, পাহাড় না সমুদ্র? কিন্তু তেমন কোন উপলক্ষ বা পরিস্থিতি কখনো তৈরি করতে পারেনি যে বৌকে নিয়ে হাদা পাহাড়ে যাবার প্রস্তাব দেবে!

এবারও তাই হল, হাদার বৌ বিয়ে বার্ষিকী উপলক্ষে সমুদ্রে যাবে, চুপচাপ সমুদ্রের ঢেউ আর নীল জলে নিজেকে সপে দেবে কয়েকটা দিন। সেই রকম ভাবেই নেয়া হল সকল প্রস্তুতি। টিকেট কাটা হল সেন্ট মারটিনের, বুকিং দেয়া হল কটেজের, নেয়া হল অফিস থেকে ছুটি! প্রস্তুতি নেয়া হল অন্যান্য সকল কিছুর। সেন্ট মারটিনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার ঠিক আগের দিন বাঁধ সাধলো ঘূর্ণিঝড় “রুয়ানু”। আসলে বাঁধ সাধেনি “রুয়ানু”, এসেছিল হাদার কাছে আশীর্বাদ হয়ে! আসলেই তাই, যেটা হয়েছিল সমুদ্রের জন্য কষ্টের আর পাহাড়ের জন্য আনন্দের! কেন আর কিভাবে?

যেহেতু সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন, ছুটিও নেয়া হয়েছে, সেহেতু সেন্ট মারটিন না হোক, কোথাও না কোথাও যেতেই হবে। কোথায় যাওয়া যায় আর কিভাবে যাওয়া যায় এই নিয়ে চলছিল আলাপ-আলোচনা।

আলোচনার মধ্যে ছিল কক্সবাজার, নাহ সে অনেক গিয়েছে হাদার বৌ, ওই ঘিঞ্জি জায়গায় এই লম্বা ছুটি কাটাতে কিছুতেই নয়!

বিছানাকান্দি, নাহ সেতো একদিনেই ঘুরে আসা যায়। এই লম্বা ছুটি চুপচাপ উপভোগের জন্য আদর্শ নয়!

হাদা কিছুটা সাহস করে প্রস্তাব দিল, তবে বান্দরবান? নাহ, কিছুতেই নয়! হাদার বৌয়ের সাফ জবাব। ওই পাহাড় আর বান্দরবান তোমাকে কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে! তাই ওখানে কিছুতেই নয়! পাহাড় ছাড়া অন্যকিছু দেখ।

তবে খাগড়াছড়ি, সাজেক আর ছোট-ছোট সবুজ পাহাড়? নাহ, তাও হবেনা। ওখানেও আছে তোমার প্রেয়সী আর আমার শত্রু সেই পাহাড়! আর সাজেক যে তোমার কতটা প্রিয় সে আমি জানি, তাই খাগড়াছড়িও বাদ!

হাদা এবার প্রস্তাব দিল, তবে রাঙামাটি? কিছুটা ভঁয়ে ভঁয়ে!

পাহাড় আছে কি ওখানে?

না নেই, একেবারেই নেই!

তবে কি আছে?

আছে টিলা ছোট-ছোট! তার উপরে কটেজ, সবুজে ছাওয়া, ছায়ায় ঘেরা, বাতাসে হৃদয় নাড়িয়ে যাওয়া! হ্রদের জল, মৃদু ঢেউ, সবকিছু মিলে ভীষণ মনকাড়া! যাবে ওখানে?

ঠিক আছে তবে, তাই চল। শুধু পাহাড় না থাকলেই হল! তখন তুমি আমাকে ভুলে যাবে, হারাবে পাহাড়ে-পাহাড়ে!

হাদা তাই এবার সবকিছু পরিবর্তন করে বেছে নিল রাঙ্গামাটিকে। রওনা হল রাঙ্গামাটির দিকে। পথে শুরু হল ভীষণ ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি। বাস চলছে খুব ধীরে ধীরে। ভঁয়ে ভঁয়ে খুব সকালে ওরা পৌঁছে গেল রাঙামাটি। বৃষ্টি যে শুরু হয়েছিল আগের দিন রাতে, তা ঝরে চলেছে অবিরত করে সব কিছু স্যাঁতসেঁতে!

বাস থেমেছিল এক পাহাড়ের পায়ের তলায়! আর ঝরছিল বৃষ্টি অঝোর ধারায়, তাই রক্ষে! নইলে হাদার বৌ টের পেয়ে যেত যে এটাও পাহাড় বেষ্টিত এক শহর! ওরা পাহাড়েই এসেছে! বৃষ্টির ছাট থেকে রেহাই পেতে ওরা টুপ করে ঢুঁকে গিয়েছিল এক চায়ের দোকানে। হাদা একটি সিএনজি এনে উঠে বসলো বৌকে নিয়ে। দুইপাশে ঢেকে দিল পর্দা দিয়ে, বৃষ্টির ছাট থেকে ভিজে যাওয়া ঠেকাতে। আসলে তার চেয়েও বেশী পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ যেন বৌয়ের চোখে না পড়ে সেই কারণে! পৌঁছে গেল ওদের নির্ধারিত পর্যটন মোটেলের নির্ধারিত কামরায়।

ব্যাস হাদা এবার অনেকটা নিশ্চিন্ত, এসে তো পড়েছে, পাহাড়ে এসেছে বুঝতে পারলেও এখনি তো আর যেতে পারবেনা বাস ধরে! সেই ভরসায়। এরপর শুরুহল ঝড়-বৃষ্টি-বাতাস-গাছপালা উড়িয়ে নিয়ে যাবার মত ঘূর্ণিঝড়! দরজা-জানাল পর্যন্ত খোলা যায়না। ভরসা কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের বাতাস-বৃষ্টি আর হ্রদের পানিতে ছোট-ছোট ঢেউ দেখা। আর একটু পরপর চা ও শুকনো খাবার উপভোগ করা।

এভাবে কিছু দেখা, কিছু ঘুম, কিছু জাগরণে কেটে গেল সারাদিন। শেষ বিকেলে ধরে এলো বৃষ্টি কিছুটা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা আর উঁচু-নিচু পথে ঝরে পড়া ডাল-লতা-পাতা-জংলী ফুলের কুড়ি-উড়ে এসে পরে থাকা রঙিন ফুলের পাপড়ি, টসটসে পাকা কালো জামের টকটকে লাল রঙের বৃষ্টির পানিতে ছড়িয়ে পরা, সবুজ ঘাসে-ঘাসে বৃষ্টির পানি জমে থাকা, কটেজের চারপাশ ঘিরে কাঠ গোলাপ-গন্ধরাজ-জুই-করবী- বেলির সমারোহ আর মাতাল বাতাসে ছড়িয়ে পরা সেইসব ফুলের ঘ্রাণ পাগল করে তুলেছিল মন-প্রান! বাতাসের আচমকা ঢেউয়ে গাছের পাতায়-পাতায় জমে থাকা পানির ঝরে পড়াতে ভিজে যাওয়া, পাশে ঢেউ তোলা হ্রদ, দূরে দাড়িয়ে থাকা মেঘে ঢাকা পাহাড়! উহ সবকিছু মিলে সে এক অপার্থিবতা!

এসব দেখে-ছুঁয়ে আর উপভোগ করে, হাদার বৌয়ের চোখে-মুখে খুসির ঝিলিক! আর তাই দেখে হাদার এক অন্যরকম পূর্ণতা আর প্রাপ্তির আনন্দ!
সেদিন আর কোথাও যাওয়া হলনা, আবারও ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায়। তাই অপেক্ষা পরদিন সকালের। পরদিন সকালে ওরা ঝরা পাতায় সেজে থাকা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হেটে চলেছে, ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে আর হ্রদের কিনারে, বোটে করে শুভলং যাবে। বোট ঠিক করে ওরা চড়ে বসলো হ্রদের নরম ঢেউহীন জলে।

রাঙামাটি শহর ছেড়ে কিছুদূর যেতেই ওদের বোট একেবেঁকে বাঁক নিল ডানে। দুই পাশে খাড়া পাহাড়, কোথাও সবুজ, কোথাও রুক্ষ, কোথাও পাথুরে, মাঝে স্বচ্ছ ঢেউহীন টলটলে জল, দূরে মেঘ-আকাশের মিতালী, বুনো ফুলের হাসি, সাদা বকের উড়ে চলা, ডাহুকের আহ্বান! গাছে-গাছে পেকে থাকা পেঁপে-কাঁঠাল-কলার আর আমের নিখাদ নিমন্ত্রণ!

সেই সবকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলোনা কিছুতেই, তাই বোট থামিয়ে নেমে পরা। সেখানেই চ্যাং-প্যাং বা এমনই একটি খটমট নামের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারের অর্ডার দেয়া। বাঁশের ভিতরে মুরগী রান্না, কাপ্তাই লেকের তাজা মাছ, আর জুম চালের ভাত।

এক উঁচু পাহাড়ের চুড়ায়, বাসের মাচায় বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে রসালো ফলের আস্বাদনে আপ্লুত ওরা। দূর থেকে ভেসে আসা লেকের বাতাস, মায়াবী জলের খেলা, ছোট-ছোট ডিঙ্গি নৌকায় জেলেদের মাছ ধরা, ঢেউ ছড়িয়ে ছুটে চলা নৌবাহিনীর স্পীড বোট, হ্রদের মাঝে মাঝে জেগে থাকা পাহাড়ের চুড়া! তিন পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজ পাহাড়, গাছে গাছে ফুল-ফলের রঙ-রূপ আর মাতাল করা গন্ধ! সেই সব দেখে-শুনে আর হারিয়ে গিয়ে হাদার বৌ নিজের অজান্তেই বলে ফেলল…

এখানে এই পাহাড়ের চুড়ায় বসেই কাটিয়ে দেয়া যাবে কয়েকটি দিন, শুধু বসে-বসে আর তাকিয়ে থেকে ওই হ্রদ ও পাহাড়ের দিকে, বুক ভরে নিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস, পা দুলিয়ে এই বাসের মাচায়, হাত রেখে তোমার হাতে আর মাথা রেখে তোমার কাঁধে!

হাদা হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কেন তোমার সমুদ্র? তবে তার কি হবে?

আরে ধুর সমুদ্র! ওর দেখার কি আছে!! শুধু পানি আর ঢেউ!!! আর কি আছে বল?

হাদা তার বৌয়ের এই কথাশুনে হাঁদারাম হয়ে গেল, বিস্ময়ে! আর মনে মনে বলল খাগড়াছড়ি আর বান্দরবান তো পরেই রইলো, এই রাঙ্গামাটির টিলাময় পাহাড় দেখেই এই অবস্থা! আর দার্জিলিং-সিমলা-মানালি-নেপাল-ভুটান? সেতো অসীম আকর্ষণের!

তাই তো হাদা তার বৌয়ের কথা শুনে আর হাদার বৌয়ের পাহাড়কে ভালোবেসে আপন করে নেয়ার আনন্দে! হাদা মনে মনে বলল বা নাম দিল……

“সমুদ্রের দুঃখ আর পাহাড়ের আনন্দ!”

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ rangamatistorytravel