শান্তিনিকেতন এ একদিন (ভ্রমণ কাহিনী)

ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে শান্তিনিকেতনের রূপেরও পরিবর্তন হয়। তাই বর্ষার সতেজ, সবুজ , স্নিগ্ধ রূপটাকে দেখতে আমরা দুই বন্ধুতে ( যদিও সমাজ আমাদের স্বামী- স্ত্রী বলেই জানে ) রওনা দিলাম। বোলপুর ষ্টেশনে নেমে ১টা টোটো করে বেড়িয়ে পড়েছি। শুরু করলাম বিখ্যাত চিত্রকর ও ভাস্কর সেলিম মুন্সির নিহারীকা আর্ট গ্যালারী দিয়ে। অতীতের শান্তিনিকেতন মানে রবীন্দ্র আমলের শান্তিনিকেতনের একটা ধারনা পাওয়া যায় উনার ছবি গুলো থেকে। ছবি আর ভাস্কর্যের মুগ্ধতা নিয়ে চলে গেলাম খোয়াই, প্রকৃতিও নতুন সাজে আমাদের চোখে ধরা দিয়েছে।

প্রথম বর্ষার জল পাওয়া সোনাঝুরি বন এখন আরো সবুজ। পর্যটক শূন্য খোয়াই এর সবুজ বনানীতে যেন আমরা হারিয়ে গেলাম। সোনাঝুরি, ইউক্যালিপ্টাস, অমলতাস গাছগুলির দিকে তাকিয়ে একটা বেলা কাটিয়ে দেওয়া যায়। দীর্ঘক্ষণ ঘোরার ক্লান্তি, খিদে, তৃষ্ণা নিবারণ করতে খোয়াইয়ের রাম শ্যামে দিপ্রাহরিক আহার সেরে নতুন উদ্যমে বেড়িয়ে পড়লাম।

এবারের গন্তব্য আদিবাসী গ্রাম বনের পুকুর। আদিবাসী গ্রামের মাটির বাড়ির অপূর্ব দেয়াল চিত্র গুলো এক কথাই অনবদ্য। সেই দেয়াল চিত্র গুলো দেখতে, ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন আমাদের টোটো চালক বাহার বাড়ি, মন্দির দেখাতে বেশী উৎসাহী। বাহা সম্পর্কে আমাদের অঙ্গতা জানাতে টোটো চালক বেশ অবাক। কি করে তাকে বোঝাই বোকার মত বোকাবাক্সে সময় নষ্ট করার মতো সময় কই।

এবার গন্তব্য উত্তরায়ণ। পথে পড়ল শাপলা ফুলে ভর্তি একটা পুকুর, এটা উপরি পাওনা। আশ্রমে এসেই টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম উত্তরায়নের রবীন্দ্র মিউজিয়ামে। এখানে কবির ব্যবহার করা বিভিন্ন জিনিস, দেশ বিদেশ থেকে পাওয়া উপহার, নোবেল প্রাইজের রেপ্লিকা, বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের দেয়া উপহার, কবির নানা বয়সের ছবি দেখে বিস্মিত হলাম।

এরপর এলাম উদয়নে। এখানেই তিনি মূলত বাস করতেন। এরপর একে একে দেখেনিলাম কবির ভাবনাকে আকার দেওয়া তাঁর প্রিয় বাড়ি গুলো শ্যমলী, পুনশ্চ, উদিচী, কোনার্ক। একি টিকিটে দেখেনিলাম শান্তিনিকেতন ভবন আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ সালে এই বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন। বাড়িটি প্রথমে একতলা বাড়ি ছিল। পরে দোতলা হয়। বাড়ির উপরিভাগে খোদাই করা আছে সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং মহর্ষির প্রিয় উপনিষদের এই উক্তিটি। তিনি নিজে বাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন। তাঁর অনুগামীরাও এখানে এসে থেকেছেন। কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয়ে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কিছুদিন বাস করেন। শান্তিনিকেতন গৃহের পাশেই উপাসনা গৃহ। এরপর পায়ে পায়ে ঘুরে নিলাম ছাতিমতলা, ঘণ্টা তলা, আম্রকুঞ্জ , চৈত, অবাক হয়ে দেখলাম পাঠ ভবনের নন্দলাল বসু কতৃক দেয়াল চিত্র। কালোবাড়ি। আশ্রম জুড়ে রাম কিঙ্কর বেইজ এর অসামান্য ভাস্কর্য। দুজনে মিলে হাঁটতে হাঁটতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম, জানি ভেতরে কেউ নেই প্রতিচী এখন বিগ্রহ শূন্য দেউল। তবুও এসে ভালো লাগে।

শান্তিনিকেতন (Santiniketan, Bolpur) শিক্ষা দেয় প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতির সাথে মিশে অহংকার ছেড়ে অনারম্বর ভাবে বাঁচতে। এখানে শিশুরা খোলা প্রকৃতির মাঝে পড়াশুনা করছে। তাই এখানে নেই digital classroom, নেই অট্টালিকা। আছে শুধু সবুজ। অনুভুতির ভাঁড়ার পূর্ণ করে এবার ফেরার পালা।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ bolpursantiniketan