স্যান মিগুয়েলের চূড়া বিজয়

শেরপা, অক্সিজেন মাস্ক, জীবন রক্ষাকারী গরম মুরগির স্যুপ, কয়েক পরতের উইন্টার জ্যাকেট ইত্যাদি ছাড়াই, শুধুমাত্র দুই বোতল পানি সম্বল করে শর্টস আর রানিং শ্যু পড়ে পর্বতের চূড়ায় এসে পৌঁছালাম। শ্রীমঙ্গলের সর্বোচ্চ পাহাড় মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের শীর্ষ জয় করার পরে স্যান ডিয়েগোর অদূরে মেক্সিকো সীমান্তসংলগ্ন ছোট শহর ছোলা ভিস্তার সর্বোচ্চ পাহাড় স্যান মিগ্যুয়েলের চূড়া বিজয়। নিজের পায়ে হেঁটে জীবনের এই সর্বোচ্চ অর্জনের পরে এই সাফল্যের পিছনে অবদান রাখা সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর পালা। গরুর প্রথম দুধ যেমন বাছুরেরও আগে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়, তেমনি করে প্রথম ধন্যবাদটা দিলাম তার উদ্দেশ্যে বিপুলা এই পৃথিবীর বুকে পৃথুল করে আমাকে সৃষ্টি করায়। তারপর স্পন্সরদেরকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে খেয়াল হলো এই অভিযান কোন স্পন্সর ছাড়াই নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সম্পন্ন করতে হয়েছে!


গ্রিনে ভরা পাহাড়ের পাদদেশ

প্রস্তুতি

শনিবার দুপুরে বার্গারকিং থেকে অ্যাংগ্রি হুপার বার্গার, মাঝারি ফরাসি আলু ভাজা আর ম্যাংগো শেইক দিয়ে আকণ্ঠ মধ্যাহ্নভোজ শেষ করার মাঝে এক বন্ধু ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল ৫ মাইল লম্বা হাইকিং-এ যাব কি না। অজ্ঞানতা প্রশান্তিকর, তাই বিস্তারিত কিছু জিজ্ঞেস না করেই পরনে যা ছিলো অর্থাৎ শর্টস, আলখাল্লা ধরনের একটা টিশার্ট, রানিং শ্যু তাই নিয়ে ব্যাকপ্যাকে দুই বোতল পানি ভরে গাড়ি নিয়ে রওয়ানা দিলাম ছোলা ভিস্তার উদ্দেশ্যে। বন্ধু সাথে করে নিয়ে এসেছে বিশাল এক বোতল স্প্রাইট আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দুই বোতল পানি। স্প্রাইটের মাঝে ক্যাফেইন থাকে আর ক্যাফেইন ডিহাইড্রেটিং ইত্যাদি বিষয়ে নাতিদীর্ঘ আলোকপাত করে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছালাম।

ফার্স্ট স্টেপ

ক্যালিফোর্নিয়া প্রায় সবুজ পাহাড়ে ভরা হলেও পাহাড়গুলো মোটামুটি রুক্ষ। বেশিরভাগ পাহাড় পাথুরে, বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো কিছু ঝোপ ধরনের গাছ সবুজ রঙ করার দায়িত্ব নিয়েছে নিতান্ত অনিচ্ছায়। পা হড়কে যায় এমন ছোট ছোট পাথরে ভরা পাহাড়ের গা। উপযুক্ত জুতার অভাবে ছোটবড় সব ধরনের পাথরের শেইপ পা দিয়েই বুঝতে পারছিলাম। শুরুর পথটা প্রায় সমতল বলে তরতর করে আগাচ্ছিলাম। তারপর পাহাড় খাড়া (দুষ্ট লোকদের দুষ্ট চিন্তার জন্য তিরস্কার) হতে শুরু করলেই বিপত্তির শুরু। আমার হৃদপিণ্ড পরিমিত পরিমাণ শ্রম (যেমন চেয়ারে বসে আলোর চেয়ে সামান্য কম গতিতে কীবোর্ডে ঝড় ফলানো, ড্রাইভিং সিটে বসে এক্সিলারেটরে মাইক্রো প্যাসকেল লেভেল চাপ দেয়া কিংবা অফিস থেকে বের হয়ে এলিভেটর পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে যাওয়া) এর জন্য যথেষ্ট দ্রুতগতিতে রক্ত পাম্প করে অভ্যস্ত। তাই পাহাড় চড়ার মাত্রাহীন পরিশ্রম সামাল দিতে গিয়ে বেচারা রীতিমত সামর্থ্যের শেষ সীমায় কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। সদয় গার্মেন্টস মালিকের মত তাই ডেডলাইনকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে বিশ ত্রিশ ফুট পরপর সূঁচালো পাথরের উপর অতি সাবধানে বসে হৃদপিণ্ডকে বিশ্রাম নিতে দিই।


ফার্স্ট স্টেপ, সেকেন্ড স্টেপ এবং সামিট

মাঝে মাঝেই দেখি ৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপযোগী সুপরিবাহী পোশাক পড়ে তরুণীরা সাথে মানানসই তরুণ শেরপাদের নিয়ে পাহাড়ে চড়ছে কিংবা পাহাড় থেকে নেমে আসছে। তরূণীদেরকে হাই বলে আর সহযাত্রী তরূণদের উদ্দেশ্যে তিরস্কারের দৃষ্টি হেনে তিল তিল করে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাই। দেখা হলো এক বৃদ্ধের সাথেও, সাথে সাথে মনে ভক্তিভাব জাগ্রত হলো, হাজার হাজার বছর আগে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও তো হিমালয়ের গা বেয়ে শেষ যাত্রা শুরু করেছিলেন।

মাঝে মাঝেই কিছু প্লেন উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের উপর দিয়ে, পাহাড়ের গায়ে প্লেনের ছায়া। কিছু কিছু মেঘ দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের পিছনে অর্ধেক লুকানো, আবার কিছু মেঘের ছায়াও পাহাড়ের গায়ে। ঘন্টাদেড়েক হাঁচড়েপাঁচড়ে একটা চূড়ায় উঠে অ্যামেরিকার ফ্ল্যাগকে উড়তে দেখলাম। ফ্ল্যাগের খুঁটিতে ভর করে দাঁড়িয়ে একটা ভি সাইন দিয়ে ফটো তুলে ভাবলাম পর্বত বিজয় সমাপ্ত, এবার সমতলের ছেলে সমতলে ফিরে আসতে পারি। কিন্তু নিচ থেকে দেখা গন্তব্য পাহাড় চূড়া তখনো আরো অনেক পিছনে। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম চাঁদকেও বাড়ির উঠান থেকে দেখা যায়।

সেকেন্ড স্টেপ

ফার্স্ট স্টেপে উঠার পরে দেখি ধুম করে অনেকটা নিচে নামতে হচ্ছে, তার মানে এতক্ষণ ধরে করা এত এত পরিশ্রমের অর্ধেকটাই ছিলো পণ্ডশ্রম। পাহাড়ের সৃষ্টিকর্তা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনারের এ হেন বেকুবি দেখে রীতিমত চটে উঠলাম। মেজাজ ঠাণ্ডা করতে আশে পাশে নজর দিলাম। পাহাড়ের ভ্যালিতে গলফ কোর্স, বড় বড় পুকুর আর বড়লোকদের বিশাল বিশাল প্রাসাদ দেখে মনটা হু হু করে উঠলো। তখন নজর আরো ছড়িয়ে দিলাম, দূরে দেখা গেলো করোনাডো দ্বীপ, স্যান ডিয়েগো ডাউনটাউন আর করোনাডো আর স্যান ডিয়েগোর মাঝের ব্রিজ। এক সময় সেকেন্ড স্টেপেও পৌঁছালাম।

সামিট পুশ

দ্বিতীয় স্টেপে পৌঁছানোর পরে একটু নেমেই খাড়া পথ উঠে গেছে গন্তব্য চূড়ার দিকে। শামুকের চেয়ে ধীরগতিতে আগালাম, বিশ ত্রিশ ফুট পরেপরেই বসে ওভারক্যাপাসিটিতে কাজ করা হৃৎপিণ্ডকে ওভারহলিং এর সুযোগ দিতে হচ্ছিল, এ অবস্থায় সহযাত্রী অনেক উঁচু থেকে প্রথমে চিৎকার করে তারপর ফোন দিয়ে বলল আমি না পারলে মাঝামাঝি কোথাও বসেই অপেক্ষা করতে পারি, সে আমার জন্য সান্ত্বনামূলক গায়েবানা সার্টিফিকেট জোগড় করে দিবে। আমার মাঝের পৌরুষ মিউ মিউ করে গর্জে উঠলো। বললাম, তুমি আগাও, আমি একটু বিশ্রাম নিয়ে হলেও উপরে ঠিকই উঠে আসব। এমন সময় দেখলাম আমাদের অনেক নিচ থেকে যাত্রা শুরু করা এক আফ্রিকান অ্যামেরিকান ভদ্রলোক চূড়া বিজয় করে উপর থেকে নেমে আসছে। তার এই অনায়াস অভিযান চর্বিসর্বস্ব এই বাঙালীর বিরুদ্ধে মূর্তমান বর্ণবাদ মনে হলো। এবার তাই জোরেসোরে বাকি পথ অতিক্রম করায় মন দেই। পথে দুইটা পাথরের গায়ে লাল কালিতে কিছু লেখা। প্রথমটাতে “F**K YOU”, পরেরটাতে “You are almost there”। পাহাড়ের উদ্দেশ্যে এমন সাহসী উচ্চারণ আর কখনো কেউ করতে পেরেছে কি না সন্দেহ আছে।


সামিট পুশের এক পর্যায়

সামিট

দীর্ঘ দীর্ঘ অভিযান শেষে একসময় উপরে উঠে আসি। পাহাড়ে উঠে ইয়েতি দেখার কথা, কিন্তু দেখলাম একটা সরু পাকা রাস্তা আর রেডিও টাওয়ার। এই পাকা রাস্তা আছে জানা থাকলেতো গাড়ি নিয়েই উঠে আসতে পারতাম, এটা ভেবে কিঞ্চিত আফসোস হলো। দেশে চূড়া বিজয় নিয়ে অনেক বিতর্ক, তাই ফার্স্ট থিং ফার্স্ট: ছবি তোলায় মন দিলাম। ব্যাকগ্রাউন্ডে তেমন উঁচু কোন পাহাড় নেই, তবে নিচের ভ্যালি, প্রাসাদ, লেইক আর দূরের সম্ভবত মেক্সিকান পাহাড় সহ এশিয়ান ট্রেইডমার্ক ভিক্টরি সাইন দেখিয়ে ঝটফট ছবি তুলে ফেললাম। ক্লোজআপ ছবিতে ভুড়ির দৌরাত্ম্যের জন্য বিতর্কের ঝুঁকি রেখেও ঐতিহাসিক মুহূর্তে তোলা নিজের একটা ঝাপসা ছবিই এখানে যুক্ত করে দিলাম।


চূড়া থেকে দেখা পাহাড়ের সারি। এভারেস্ট দেখা যাচ্ছে কিনা নিশ্চিত না।

পরিশিষ্টঃ উপরের বর্ণনার অনেকাংশই অতিরঞ্জিত। স্থানে স্থানে তথ্যেরও অসংগতি আছে। কিন্তু তাই বলে আমার পর্বতজয়ের দাবির সপক্ষে প্রমাণ দাবী করে শুধু শুধু সময় নষ্ট করবেন না। মনে রাখবেন, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর”।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ mexicomiguelsan