সেন্ট মার্টিনের স্মরণীয় রাত – একটি ভ্রমণ গল্প

সেন্ট মার্টিন পৌঁছেছিলাম বিকেল তিনটায়। একটু ফ্রেস হয়ে আর মাছ ভাঁজা দিয়ে ভাত খেয়ে আর পানির পরিবর্তে ডাবের পানি দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে বের হব, এমন সময় একজন বিলাসী ভ্রমণসঙ্গী বলে বসলেন তিনি এখন দুই ঘণ্টা ঘুমাবেন!

অন্য কারো কি মনে হয়েছে জানিনা, আমি তো আকাশ থেকে পরলাম! বলে কি সেন্ট মারটিন এসে কেউ একবেলা ঘুমিয়ে কাটানোর কথা কিভাবে ভাবতে পারে? যদি না হয় ভীষণ বিলাসী কোন পর্যটক অথবা বেশ দুর্বল বা অসুস্থ! কিন্তু তিনি একগুয়ে জেদ ধরেছেন, একটা ভাত ঘুম না দিয়ে কিছুতেই বের হবেনা না রুম থেকে! ওদিকে বাইরে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর সেই ঢেউয়ের কান ফাটানো গর্জনে রুমে বসে বা শুয়ে থাকা দায়।

সে যাই হোক সবাই একসাথে বাইরে না গেলে আর সমুদ্র না দেখলে আবার সমুদ্রের সঠিক মজাটা পাবোনা বলে থেকে যেতেই হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। তবে সেটা বোধয় শেষে ভালোই হয়েছিল, এমন স্মরণীয় আর অনেক রোমাঞ্চকর একটা সমুদ্র বিলাস পেয়েছিলাম বলে।

তো সেই বিলাসী পর্যটকের সাথে একটু বিশ্রাম নিয়ে তার ইচ্চামত বের হলাম প্রায় শেষ বিকেলে। অন্য সবাই মিলে তাকে আরামের পুরো শোধ তোলার জন্য ঠিক করলাম আজ এই অবকাশের বীচ থেকে ডান দিক ঘুরে হাটা শুরু করবো আর আবার অবকাশের এই বীচে এসেই থামবো পুরো সেন্ট মারটিন পায়ে পায়ে ঘুরে এসে। বীচ-বালু আর ঢেউয়ের তালে তালে। তাতে যত সময় লাগে লাগুক। তিনি নিম রাজী হয়েই আমাদের সাথে পিছনে পিছনে পথ ধরেছিলেন। এবার শুরু হল আমাদের পুরো সেন্ট মারটিন দ্বীপ হেটে হেটে পরিভ্রমনের পালা।

সন্ধা তখনো নামেনি ধরায়, সমুদ্রে তখন ভাটার টান, রঙিন কাঁকড়া গুলো মেতে উঠেছিল বাঁধ ভাঙা উল্লাসে, পেয়ে অবারিত বালুর সৈকত, পানি নেমে গিয়ে বিসৃত করেছিল ওদের চরাচর আর অবাধ অবাধ্যতা। নীল-সাদা ঝিনুকেরা চিকচিক করে উঠছিল পেয়ে সূর্যের শেষ আলোর আবরণ। সাদা বালুতে শেষ রোদের ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছিল, এমনকি সমুদ্রের পানিরও ছিল শত রকমের রঙ আর উচ্ছ্বাস। আর আকাশ? আকাশ যে সেজেছিল কত রঙের সেটা অবর্ণনীয়! সেন্ট মারটিনের সেই গোধূলি লগ্নটা এমনই ছিল।

ডান পাশ থেকে বীচ ধরে হাটতে হাটতে মূল ঘাটে পেরিয়ে যখন ছেড়া দ্বীপে যাবার মাঝখানে পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধা। এবার একটু দ্রুত পথ চলতে শুরু করলাম। কারণ পূর্ব থেকে পশ্চিম বীচে যখন হাঁটবো তখন সন্ধা থেকে রাত নামবে, আকাশে চাঁদের দেখা তখনো নেই। তাই কিছুটা চিন্তিত, তবে রোমাঞ্চও ছুঁয়েছিল সবাইকে। কারণ রাতের অন্ধকারে কোন সমুদ্রের বীচ ধরে কখনো হাটা হয়নি। আর সেই সাথে যদি থাকে উত্তাল ঢেউয়ের প্রান পাগল করা আহ্বান! তো কথাই নেই।

ছেড়া দ্বীপের প্রবেশ মুখে বা সেন্ট মারটিনের শেষ বিন্দুতে যখন পৌছালাম তখন সন্ধা অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। পুব আকাশে চাঁদের আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছে। কারণ কয়েকদিন আগেই পূর্ণিমা তার পূর্ণ যৌবনের মাদকতা শেষ করেছে, তাই চাঁদ আজ একটু দেরি করেই উঠেছে। তবে সে তার পূর্ণ আলো তখনো বিলাতে শুরু করেনি।

আর এগোনো যাচ্ছেনা। সামনে জঙ্গল। কিভাবে যাবো ওপাশে? ছয়জন তিন ভাগে ভাগ হয়ে রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। তিন চার মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও কোন রাস্তা না পেয়ে একটু ভঁয় ভঁয় করতে লাগলো। সবাই আবার এক সাথে হয়ে ফিরে যাবো কিনা যে পথে এসেছি সেই পথেই এমন ভাবনা ভাবতে লাগলাম। প্রায় তেমনই মনস্থির করে ফেলেছি, শেষ চেষ্টা হিসেবে আর একবার দেখতে চাই?

কারণ আমাদের দুই জনের টিম যেদিকে গিয়েছিলাম সেদিকে গাড় অন্ধকার আর গভীর বনের ফাঁক দিয়ে দূরে সামান্য সাদা বা ক্ষীণ অন্ধকার চোখে পরেছিল বলে মনে হয়েছিল, তবে ভ্রমও হতে পারে ভেবে চলে এসেছিলাম। তাই আর একবার দেখতে চাই। এবার সবাই মিলে। সেদিকেই গেলাম। মাত্র ৪০ সেকেন্ড বেশী গেলাম আগের জায়গার চেয়ে। আর গিয়ে হাত দিয়ে কেয়ার কিছু পাতা সরাতেই ওপাশে চিকচিক করে ঝিলিক মারলো চোখের মনিতে! ব্যাপার কি? কিসের আলো? নাহ কোন আলোতো নাই আসলে, তবে কি এবারও ভ্রম!

সবাই মিলে সেই পাতা সরিয়ে ওপাশে যেতেই আহম্মকের মত “থ” হয়ে গেলাম! কারণ এপাশেই আর এক সমুদ্র, পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী উত্তাল আর মাতাল করা। অনেক অনেক বড় বড় ঢেউ আর অনেক বেশী গর্জন তোলা গ্রাস করে ফেলা সব আছড়ে পরা ঢেউ। আর সেই ঢেউয়ের উপরে পুব আকাশের চাঁদের আলো পরে ঝলমল করে উঠছিল। যেটা আমি বা আমরা আগেই দেখে দিয়েছিলাম। ভঁয়ে বা আতঙ্কে সেটা তখন বুঝতে পারিনি।

নতুন সমুদ্র আর অন্যরকম উত্তাল ঢেউ দেখে সবাই ভীষণ উচ্ছ্বসিত। সেই সাথে রাতের তারা ভরা আকাশ আর প্রায় পূর্ণিমার ঝকঝকে চাঁদ। পাশে বিশাল বিশাল উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পরা, বেশ বড় বড় পাথর আর ধারালো কোরালের মাঝ দিয়ে হেটে যেতে হয়েছিল অনেক অনেকটা পথ। হাঁটছি হাঁটছি আর হাঁটছি, পথ যেন আর শেষ হতে চায়না কোন ভাবেই। সবাই বেশ বেশ ক্লান্ত। কারণ অন্ধকারে অনেক বেশী চড়াই-উৎরাই করতে হয়েছে বড় বড় পাথর আর ধারালো কোরালের মধ্যদিয়ে।

সমতল, মিহি বালুর শীতল বীচে সমুদ্রের আছড়ে পরা ঢেউয়ে পা ভেজাতে ভেজাতে এক সময় দূরে চোখে পড়লো কিত্রিম নিয়ন আলো। তার মানে মানুষের আবাস আছে একটু দুরেই। ওখানে গিয়েই না হয় একটু বিশ্রাম নেয়া যাবে। রাত তখন প্রায় ৮ টা। সামনে আর কতটা পথ পেরুলে অবকাশ বা এর আশে পাশের হোটেল বা কটেজের দেখা মিলবে সেটাও জানিনা আমরা কেউই! কারণ সবাই সেবারই প্রথম এমন করে পুরো সেন্টমারটিন হেটে হেটে ঘুরে আসার মিশনে নেমেছিলাম।

আরও প্রায় এক ঘণ্টা হাটার পরে অবকাশের বিল্ডিং, জেনারেটরের আলো আর মানুষের বীচে চলাচল বুঝতে পেরেছিলাম। এবং ভেসে ছিলাম অনেক অনেক আনন্দে। অদ্ভুত, অসাধারণ আর একেবারেই অন্যরকম একটা অর্জনের আনন্দে। ভিন্ন আঙ্গিকে আর অনন্য স্বাদে রাতের চাঁদের আলোতে আর গর্জনে ফেটে পরা ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসে উপভোগ করা সমুদ্র ও সেন্টমারটিনকে।

অবকাশে পৌঁছানোর সাথে সাথে তাজা ডাবের পানি দিয়ে পুরাপ্পায়ন! সাথে ভেটকি (কোরাল) আর রূপচাঁদার বারবিকিউ এর পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি। সেটাও একদম বীচে বসে। বালিশে হেলান দিয়ে। আর গল্প-আড্ডা-গানে হারিয়ে গিয়ে।

কতক্ষণ জানিনা, তবে শরীরের সব টুকু শক্তি আর জেগে থাকার সামরথের শেষ বিন্দু পর্যন্ত। শেষে এই গানে গানে রুমে ফিরেছিলাম………

“এই রাত অক্ষয় হোক, দেখ অধরের তৃষ্ণায় মরেছে অধর!”

“দু চোখে মরেছে দুই চোখ, এই রাত অক্ষয় হোক!”

সেন্ট মারটিনের সেই রাত আজও অক্ষয়।

সপ্নময় চোখের পাতায়, মনের বর্ণিল আঙিনায় আর কল্পনার রুপালী আকাশে।

Leave a Comment
Share