নারিকেল জিঞ্জিরায় সাতবেলা

[ বার্ধক্যে যখন খাই খাই স্বভাবটা চলে যাবে, খাবারের চাইতে খাওয়া হজম করার ঔষধের পরিমাণ বেড়ে যাবে, তখন স্মৃতি রোমন্থন করে চোখের পানি ফেলার জন্য এই লেখাটা লিখতে বসলাম। ]

১৭ জানুয়ারি ২০১৩, রাতের বাসে রওনা দিলাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে। সর্বশেষ গন্তব্য সেন্ট মার্টিন। ভ্রমণসঙ্গী শফিক, আয়াজ, নোয়েল, রাবায়েত, সাজিদ এবং মিশেল। সেন্ট মার্টিনে আগেও গিয়েছিলাম, তাই এর মস্তিষ্কে বিকারের উদ্রেককারী সৌন্দর্য্য সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা ছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগের পাশাপাশি অন্য একটি বিশেষ উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম, যতরকম সম্ভব সি ফুড গলধঃকরণ করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যের সাফল্য নিশ্চিত করতে সাথে নেয়া ইমার্জেন্সি ঔষধপত্রের সিংহভাগই ছিলো পেট খারাপের ঔষধ। সেন্ট মার্টিনে সব মিলিয়ে মোট সাতবেলা খাওয়াদাওয়া করেছিলাম আমরা, এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গোপসাগরের মৎস্যকুলের ত্রাস হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে এসেছি।

(বেলা-১) ১৮ জানুয়ারি দুপুরবেলাঃ সুদীর্ঘ জার্ণি এবং হোটেল বাছাইয়ের ভেজাল শেষ করে সাগরে ঘন্টা দুয়েকের দাপাদাপির পর ক্ষুধায় আক্ষরিক অর্থেই চোখে অন্ধকার দেখছিলাম সবাই। তাই বেশি বাছাবাছির ধার না ধেরে আমাদের হোটেল, ‘প্রিন্স হেভেনের’ সামনেই বিচ সংলগ্ন খাওয়ার হোটেলে ঢুকে পড়লাম সবাই।

প্রথমবার যখন দ্বীপটায় গিয়েছিলাম তখনই সেখানকার খাওয়ার হোটেলগুলার একটা ব্যাপারে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। হোটেলের সামনে কাস্টমারদের জন্য নানারকম কাঁচা মাছ সাজিয়ে রাখে। আপনার কাজ হল লাইক আ বস কোনো মাছের দিকে অঙ্গুলিসংকেত করা। ব্যাস কিছুক্ষণ পরই সেই মাছ ভাজা হয়ে আপনার প্লেটে এসে পড়বে। এবারও সেই একই জিনিস দেখলাম।

সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাছ।
অর্ডারকৃত মাছ ভাজা হচ্ছে।

তাড়াতাড়ি সবাই নিজ নিজ খাবার পছন্দ করে নিলাম। প্রথমেই সার্ভ করা হলো সুন্দরী মাছ। নামের প্রতি পূর্ণ সুবিচার করেছে অতি সুস্বাদু মাছটি।

সুন্দরী মাছ।

এরপর এলো গোলচাঁদা মাছ। অবশ্য বাবুর্চি নাম না বলে দিলে রূপচাঁদার সাথে কোনো পার্থক্য করতে পারতাম না আমরা।

গোলচাঁদা মাছ।

সবশেষে এলো কোরাল মাছ। দুই রকমের কোরাল নিলাম। কি কি নাম শুনেছিলাম তা ঠিকমত খেয়াল নেই। আমি মনে রেখেছি মাঝারী আর বড় কোরাল নামে।

মাঝারী কোরাল।

চরম ক্ষুধার্ত,খাবারের অপেক্ষায় বিরক্ত, এমতবস্থায় যখন মাছগুলো সামনে রাখা হলো, একরকম ঝাঁপিয়েই পড়লাম। আহা! মচমচে করে ভাজা মসলাদার উপরের স্তরের নীচে তুলতুলে নরম সেই মাছের কথা আমি বেশিক্ষণ ভাবতে পারছি না, যেকোনোসময় লালা ফেলে কীবোর্ড ভিজিয়ে ফেলতে পারি।

বড় কোরাল।

গোগ্রাসে কিছুক্ষণ গেলার পর হুঁশ হলো যে রেস্টুরেন্ট থেকে সাগরের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। খাওয়া শেষে চা খেতে খেতে সাগরের সৌন্দর্যও গিললাম কিছুক্ষণ।

(বেলা-২) ১৮ জানুয়ারি রাতের বেলাঃ বারবিকিউর রাত। আমাদের অদক্ষ হাতে বড় মাছের বারবিকিউ করাটা খুব বেশি সাহসীকতার কাজ হয়ে যেত, তাই মুরগী বারবিকিউ করার সিদ্ধান্ত হলো। ঢাকা থেকে কিছু দরকারী সরঞ্জাম (নেট, মসলা ইত্যাদি) কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। হোটেল বয়ের সাহায্য নিয়ে বাকি জিনিসপত্র (মুরগী, কাঠ, তেল) কিনে নিয়ে এলাম। মুরগী জবাইয়ে সিদ্ধহস্ত আয়াজের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আল্লাহর নাম নিয়ে জীবনে প্রথমবার মুরগী জবাই দিলাম। আমাদের মাস্টারশেফ রাবা। মসলার পরিমাণ নির্ধারণ, মসলা মাখানো সবকিছুই করে যাচ্ছিলো কান্ডারীর মতো। মসলা মাখানোয় শফিক ইসলামও যোগ দিলো (এবং তার কাজটা যে কতটা ভাইটাল তা বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকলো)। যাইহোক, ইট দিয়ে বানানো চুলার উপর নেট বিছিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হলো তুষের আগুন।

বারবিকিউ চলছে।

ভাগাভাগি করে সবাই মুরগী ঝলসানোর কাজটা শুরু করলাম। তবে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ইন্সপায়ারিং কাজটা ছিলো মিশেলের। আরামে আসন গ্রহণ করে আমাদের কাজ কোন কোন জায়গায় ভুল হচ্ছিলো তা তৎক্ষণাৎ ধরিয়ে দিতে তার বিন্দুমাত্র দেরি হচ্ছিলো না। পালাক্রমে মুরগীর পাশাপাশি আগুনে নিজের হাত ঝলসানোর মাধ্যমে শেষ হলো বারবিকিউ করা। কিনে আনা পরোটা দিয়ে সাবাড় করলাম হাড়ে লেগে থাকা শেষ মাংসটুকুও।

বারবিকিউ।

(বেলা-৩) ১৯ জানুয়ারি সকালবেলাঃ সকালবেলাটা কোনো এক্সপেরিমেন্টাল ফুড দিয়ে শুরু করার রিস্ক নিলাম না কেউ। পরোটা-ডিমভাজি দিয়ে সেরে নিলাম নাস্তা। নাস্তার নাম শুনেই নাক সিঁটকাবার আগে মাথায় রাখুন, এটা কিন্তু যেন তেন ডিমভাজি না! টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে কিনে আনা ফার্মের মুরগীর ডিম……হুমম….। সেই লোভনীয় ডিমভাজির ছবি দিয়ে কারো চক্ষুশূল হতে চাচ্ছি না বলে ছবি দিলাম না।

(বেলা-৪) ১৯ জানুয়ারি দুপুরবেলাঃ আমার পায়ে হেঁটে পুরো দ্বীপ চক্কর দেবার আইডিয়ায় সাড়া দিয়ে আধমরা হয়ে (মনে মনে আমাকে গালি দিতে দিতে) সবাই যখন সেন্ট মার্টিন বাজারে ফিরে এলাম তখন মাথায় সবার একটাই চিন্তা, কিছু নাকেমুখে গুঁজে কখন সাগরে ঝাঁপ দিবো। শফিকের সাজেশনে ঢুকলাম ‘আল্লাহর দান’ রেস্টুরেন্টে। সেন্ট মার্টিনে এসে আসল রূপচাঁদা না খেয়ে গিয়ে সারাজীবন বিবেকের দংশনে পোড়ার কোনো মানে হয়না। অতএব রুপচাঁদা অর্ডার করা হলো।

রূপচাঁদা।

আমি নিলাম ঢাউস সাইজের কড়া করে ভাজা একটা গোলচাঁদা। আহা! লেবুর সাথে ধোঁয়া উঠা মচমচে ভাজা চাঁদা মাছ, কাঁটা বাছার কোনো ভেজাল নেই, মুখে দিলেই কুড়মুড় করে ভেঙ্গে যায়। মাছটার স্বাদের বর্ণনা করতে গিয়ে আমার শব্দভান্ডারে বিশেষণের টান পড়ছে…..।

গোলচাঁদা।

(বেলা-৫) ১৯ জানুয়ারি রাতের বেলাঃ লবস্টারের রাত। এই রাতটা অনেক দিন মনে থাকবে। কারণ এই রাতে জীবনের সেরা আর্থ্রোপোডটা খেয়েছিলাম।
আসার পর থেকেই মিশেলের মাথায় চেপেছে লবস্টারের ভূত। মূলত ওর প্ররোচনায় সবাই তুলনামূলক দামী এই সী ফুডটিও চেখে দেখার সিদ্ধান্ত নেই। রাত্রিবেলায় ট্যুরিস্ট সংখ্যা অনেক কমে যায়, তাই খাবার দাবারের দামও বেশ কমে যায়। কয়েকটা হোটেল ঘুরাঘুরি করে মোটামুটি সাইজের লবস্টার ঠিক করলাম ‘ইউরো বাংলা রেস্তোরা’ য়।

লবস্টার

হোটেলের কমবয়সী বাবুর্চির সাজেশনে লবস্টার ভাজা না খেয়ে টম্যাটো দিয়ে মাখামাখা করে রান্না করে দেওয়ার অর্ডার দেয়া হলো। জিনিসটা যখন রান্না হয়ে আসলো তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের প্রতিটা পয়সা উসুল হতে চলেছে।

রান্নার পর।

শক্ত খোলস ছাড়া যতটুকু খাওয়া হিউমেনলি পসিবল তার একটা কণাও ছাড়লাম না! আর সেই স্বাদ! সেই স্বাদ লেখায় বর্ণনা করা এই অধমের কাজ না, সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো লেখকের কাজ। শুধু এটুকুই বলবো, যে সেন্ট মার্টিন গিয়ে লবস্টার না খেয়ে চলে এসেছে, সেই লোক অতীত জীবনে বড় কোন পাপ করেছিলো (আই অ্যাম ড্যাম সিরিয়াস)। খাওয়ার পর ইচ্ছা করছিলো বাদশাহী কায়দায় সেই রন্ধন শিল্পীর হাতে চুমু খেতে। ছেলেটা কি না কি ভেবে বসে, এটা চিন্তা করে কাজটা আর করিনি 😛

বস

(বেলা-৬) ২০ জানুয়ারি সকালবেলাঃ পরোটা-ডিমভাজি। যথারীতি কারো চক্ষুশূল হতে চাচ্ছি না…

(বেলা-৭) ২০ জানুয়ারি দুপুরবেলাঃ নারিকেল জিঞ্জিরায় শেষ বেলা। আরেকটি দীর্ঘ ভ্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে কেউ রিস্ক নিলো না, সবাই মুরগী দিয়ে খাবার সারলো। এক ইঞ্চি জমি অনাবাদী রাখবো না – নীতিতে বিশ্বাসী হওয়ায় আমি সাহস করে টুনা মাছ অর্ডার করলাম। পেপারে মিলিয়ন ডলারে টুনা বিক্রির খবর পড়েই গিয়েছি শুধু এতদিন। বহুদিনের সেই আক্রোশ তাই এই শিশু টুনার উপর ঝাড়লাম।

টুনা মাছ।

টু মেক লং স্টোরি শর্ট, জিনিসটা খেয়ে আফসোস করতে হয়নি। সি ফুড খাওয়ার মিশন এখানেই শেষ করতে রাজি নই আমি। এবারও অনেক কিছু খাওয়া বাকি রয়ে গেছে। নেক্সট টাইম সেগুলাও ছাড়বো না ইনশাল্লাহ…

রাঙ্গা চাঁদা। এই জিনিস খাওয়ার জন্য মনকে পাথর বানাতে হবে।
লাল কোরাল।
সামুদ্রিক কাঁকড়া।

যারা অদূর ভবিষ্যতে সেন্ট মার্টিন যাবেন তাদের জন্য কিছু সাজেশনঃ দুপুরবেলা পর্যটকের ভীড় খুব বেশি থাকে। তাদের বেশিরভাগই রাতে থাকে না। তাই দামি সি ফুড, বা বড় মাছ বারবিকিউ খাওয়ার জন্য রাতের সময়টা বেছে নিন। দুপুরের প্রায় অর্ধেক দামে পাবেন। হাজার টাকার লবস্টারও পাঁচ-ছয়শোতে ছেড়ে দেয়।

ছবিগুলো সাজিদ, রাবা আর আমার ক্যামেরা থেকে নেয়া। কোনটা কার তোলা মনে নেই।
Leave a Comment
Share