ঊত্তাল সাগর আর অফ সিজনে সগরের বুক চিড়ে ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিন – এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!

ঊত্তাল সাগর আর অফ সিজনে সগরের বুক চিড়ে ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিন – এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হবে এই চিন্তা থেকেই হুট করে ৮ কলিগ মিলে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার প্ল্যান করলাম। অবশ্য ট্যুর এ না যেতে পারা আমাদের আরো জন পাচেক সহকর্মীর- সিগন্যাল, সাগর এবং ট্রলার জার্নি সম্পর্কে নানা ধরনের ভয় ভীতি প্রদর্শনে আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব সহজ ছিল না!

২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে টিকিট কনফার্ম করাহল সেণ্টমার্টিন পরিবহন হুন্দাই এর। বাস টেকনাফ এর উদ্দ্যেশ্যে আরামবাগ ছেড়ে গেল রাত ১০ টায়। মাঝে ৩ বার যাত্রা বিরতি দিয়ে আমরা টেকনাফ পোঁছালাম সকাল ৭.৩৫ এর দিকে।

প্রথম দিন (২৮ সেপ্টেম্বর)

কাউন্টারে নেমে কিছুটা সময় রেস্ট নিয়ে নাস্তা সেরে চলে গেলাম ট্রলার ঘাটে। হাটা পথ, ৫/৭ মিনিট লাগে। ট্রলার ছাড়বে ১০ টায় এটা জেনে আমরা বাজারে ই ঘোরাঘুরি করলাম কিছু ক্ষন। ট্রলারে সুবিধাজনক জায়গা পেতে সময়ের অনেক আগেই আমরা চলে গেলাম ট্রলার ধরতে। কিন্তু না, আমরা আসার অনেক আগে ই লোকজন এসে বসে পড়েছে। ফলাফল প্রায় বোঝাই হওয়া এক ট্রলারের ” অফিসের কাজে জাচ্ছি ” ট্যাগে সদ্য বানানো টিশার্টে আমরা ৮ সহযাত্রী।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শুরুহলো আমাদের স্বপ্ন যাত্রা। বিজিবি চেক পোস্ট এবং নাফ নদিতে পেরিয়ে ট্রলার বঙ্গোপসাগরে। প্রচন্ড রোদ, সাথে বাড়ির পাশের শান্ত গাঙ এর মত ঢেউ। কিছুটা হতাশ হলাম। সাগরে এলাম আর বড় বড় ঢেউই নেই। পাক্কা আড়াইঘন্টা পর পোঁছালাম স্বপ্নের গন্তব্যে।

দ্বীপে আমাদের উপস্থিতি জানান দিতে কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ল ছবি তোলায়। হবেই বা না কেন? একদম ই স্বচ্ছ সবুজাভ টলটলে পানি। পেছনে বিশাল এ জলরাশিকে রেখে একখান সেলফি তো হক বান্তা হ্যা ইয়ার।

সবাই চাইছিলাম বিচ ভিউ পাওয়া যায় এমন একটা হোটেল নিবো। ভাগ্য নিরাশ করেনাই। প্রথম দানে ই পেয়ে গেলাম প্রিন্স হ্যাভেন রিসোর্ট এন্ড রেস্টুরেন্ট এর দোতলার ২ টা রুম। দামাদামি করে রুম প্রতি ৮০০ করে ভাড়া নিলাম, প্রতি রুমে ৪ জন করে। ১ জন করে ফ্লোরিং করব এবং তার আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা হোটেল বয় করে দেয়।

দুপুর কাম বিকালে বিচ এ হালকা লাফালাফি করে দুপুরের খাবার শেষ করতে করতে প্রায় শেষ বিকাল। আগে থেকে অর্ডার না দিয়ে রাখায় খাবার দাবার নিয়ে আক্ষেপ করতেই পারেন। অফ সিজন হওয়ায় হাতে গোনা কয়েকটা খাবারের দোকান ছাড়া সবই বন্ধ।
দুধের স্বাধ ঘোলে মেটানোর মত সবার দৃষ্টি পড়ল গাছ থকে সদ্য পেড়ে আনা ডাব এর উপর। ২৫ টাকা মুল্যের ডাবের উসুল কোন ভাবেই টাকার অঙ্কে হবে না।

দ্বিতীয় দিন (২৯ সেপ্টেম্বর)

খুব সকালে ২ টা ভ্যান নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম দ্বীপ দর্শনে। গোছানো দ্বীপ টাকে একটু একটু করে যত দেখছি ততই যেন অবাক হচ্ছি। ১১ টার মধ্যে নাস্তা শেষ করে বিচ এর কূল ঘেঁষে শুরু করলাম ছেড়া দ্বীপ এর উদ্দ্যেশে হাটা। এক পাশে কেয়া বন, কিছু বসত বাড়ি আর অন্য পাশে নীল জলরাশি রেখে আমরা হেটেই চলেছি। মাঝে ১৫/২০ মিনিটের ডাব খাওয়া বিরতি নিয়ে দুপর ২.৩৫ এর দিকে তাহার দেখা পাইলাম।

ভাটা ততক্ষনে শুরু হতে যাচ্ছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। কটকটা রোদ, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার পানি, কোরাল আর ৩ খন্ড সবুজের টুকরা। স্থানীয়া মূলত মাঝের অংশটাকে ছেড়াদ্বীপ বলে। ওই সময়টাতে দ্বীপে আমরা ছাড়া অন্য কোন পর্যটক চোখে পড়েনি। পুরা দ্বীপটাই যেন ছিল আমাদের ক’জনার। অবশ্য ৩০/৪০ মিনিট পর ৪ জন এর একটা টিম এর দেখা পেলাম।

বিকাল ৫ টা। এবার ফেরার পালা। আসার সময় যে পরিমান কষ্ট হয়েছে যাবার সময় যেন একটু আরাম হয় তাই ওই টিম এর সাথে কথা বলে তাদের ফাইবার বোটের যাত্রী হয়ে গেলাম। একেই বোধহয় বলে ভাগ্য। নাহ, দুর্ভাগ্য!! আমাদের এই সিদ্ধান্ত কি ছিল এটা বুঝতে বুঝতে আমাদের রাত ১১ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

জোয়ার নেমে যাওয়ায় বোট সরানো যাচ্ছিল না। আমরা ৯ জন ( স্থানীয় ৭/৮ বছরের নজরুল অনেকটা জোড় করেই আমাদের সাথে চলে আসে ), মাঝি সহ ওনারা ৫ জন, মোট ১৪ জন প্রান পন চেষ্টা করে ও বোট নিচের দিকে অর্থাৎ যেখানে পানির গভীরতা বেশি সেখানে নিতে পারছিলাম না। চেষ্টা ছিল অন্তত ইঞ্জিন চালু করে যেন সুমুদ্রে নামতে পারি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা বা ৭ টার দিকে অল্প অল্প করে জোয়ার আসা শুরু হল। কিন্তু এত বড় একটা বোট চালানোর মত পানি পেতে হলে ভালো পরিমানের জোয়ার এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

সূর্যের শেষ আভা টুকু নিভে গিয়ে অন্ধকার করে রাত বেড়েই চলেছে। আমাদের বোটের চারপাশ কোরাল এ ঘেরা। পানি খুব আস্তে আস্তে বাড়তে থাকায় বোট পাথরে এত বেশি জোড়ে জোড়ে আঘাত খেতে লাগল যেন মনে হচ্ছিল এই বুঝি বোট ফেটে গেল! সে সময় সাগরে ছিল লো ওয়াটার অর্থাৎ পানির টান ছিল নিচের দিকে। অনভিজ্ঞ কিশোর মাঝি ঠিক ভাবে নোঙ্গর না করায় আমরা ইতিমধ্যে কূল থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম। এটা বোঝার পর প্রায় সবার মাঝেই আতঙ্ক ভর করে। অনেকে বলল বোট থেকে নেমে হেটে ছেড়া দ্বীপ এর দিকে চলে যাবে। কেউ কেউ বলল ইঞ্জিন চালু করে দেখি কি হয়! আসলে সাফিশিয়েন্ট ওয়াটার লেভেল না পেলে বোট এবং ইঞ্জিন হিট করতে পারে কোরালে। ফলাফল হতে পারে ইঞ্জিন বিকল হওয়া এবং বোট ভেঙ্গে চুরমার। সিদ্ধান্ত হল আমরা অপেক্ষা করব,পূর্ণ জোয়ার না আসা পর্যন্ত।

রাত ৮ টা। মনে এল ৯৯৯ এর কথা। দিলাম কল, ভদ্রলোক দুদুবার করে সব শুনলেন। যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ইস্ট জোন চিটাগাং এর নাম্বার দিলেন। সেখানে কল রিসিভ করে ঘটনা শুনে অন্য একটি নাম্বার দিয়ে বললেন ওখানে যোগাযোগ করতে।
কি আর করা দিলাম কল। তিনি ও সব শুনে কিছু করবেন আশ্বস্থ করে কল কেটে দিলেন।

মিনিট ২০ পরে কল করে একজন কর্মকর্তা বললেন আপনারা যে জায়গায় আছেন তার চারপাশ কোরালে ঘেরা, ভুলেও বোট থেকে নামবেন না, ইনজুরড হতে পারেন। বেটার, মোমেন্ট টা ইঞ্জয় করেন! আর আমরা এসে ও কিছু করতে পারব না এখন। ওয়াটার লেভেল বাড়ুক। সো অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নাই।

এর মাঝে বোট মালিককে একাধিকবার কল করেও তার কাছ থেকে হেল্প পাওয়া যাচ্ছিল না। কাছাকাছি কোন আলো দেখলেই আমার মোবাইলের লাইট দেখিয়ে, শাউট করে হেল্প চাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। সারা দিন না খাওয়া, এতটা সময় এই সিচুয়েশন দেখতে দেখতে চোখ পড়ল নজরুল এর দিকে। বেচারা, কখন যে ক্ষিধা আর ভয়ে ঘুমিয়ে গেছে কেউ ই খেয়াল করিনি। বড্ড মায়া হতে লাগল ওর জন্য।

অবশেষে সোয়া ১০ টার দিকে একটা ট্রলার আমাদের দিকে এসে অনেক বড় ধরনের হেল্প করে। এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটানায় আমাদের মাঝি গেছে হকচকিয়ে, সে ঠিক মত নোঙ্গর উঠাতে পারছিল না, ইঞ্জিন টা ও ঠিক মত স্টার্ট দিতে পারছিল না ভয়ে। অনেক অনুরোধে সেই ট্রলার এর দুই জন কে সাথে নিয়ে রাতের সাগরের বুক চিড়ে আমরা বিদায় নিতে থাকি ছেড়া দ্বীপ থেকে।

রাত ১১ টায় যখন সেন্ট মার্টিন এ পোঁছালাম তখন কোস্ট গার্ড শেষ দফায় কল করল। আমাদের সাথে কথা বলতে চলে এল বাজারে। হালকার উপর একটু গর্জিয়াস বয়ান দিয়ে তারা যখন বিদায় নিল ক্ষিধা তখন চরমে। কোন রকমে পেটে কিছু দিয়ে সোজা হোটেল এ। পরদিন চলে যাবো! ২ মিনিটের দুরুত্ত থেকে ডাকতে থাকা সাগর পারে স্মরণীয় এক রাতের আহবানে সাড়া দিলাম ৫ জন। এ অনুভূতি নিয়ে লিখব অন্যদিন। রাত ৩ টায় সমুদ্র বিলাশ শেষ হল।

তৃতীয় দিন (৩০ সেপ্টেম্বর)

সকাল সাড়ে ৯ টার ট্রলারে চেপে আমরা টেকনাফ এর উদ্দেশে। ১২ টার মধ্যেই হাজির ।ঢাকার বাস পৌনে ৬ টায় হওয়ায় ঘুরে এলাম মেরিন ড্রাইভ এ। ঢাকায় ফিরতে ফিরতে পরদিন সকাল সোয়া ৮ টা।

শেষ হলো একে রোমাঞ্চকর যাত্রার, জীবন ভর মনে রাখার মত কিছু অভিজ্ঞতা সাথে একরাশ ভালোলাগা নিয়ে আবার সেই কর্মযজ্ঞে গা ভাসিয়ে দেয়া। আবার পুরোনো শহরটাকে আপন করে নেয়া। সাথে আজীবনের জন্য কিছু স্মৃতি নিয়ে ফেরা।

Leave a Comment
Share