আরণ্যক ও একটি স্বপ্নময় রাত (রেমা-কালেঙ্গা) – দ্বিতীয় পর্ব

আগের পর্বঃ আরণ্যক ও একটি স্বপ্নময় রাত (রেমা-কালেঙ্গা) – প্রথম পর্ব

ভোর তখন ছ’টা। ঘুম ভেঙে কোথায় রয়েছি বুঝতেই খানিকটা সময় লাগলো। ধীরে ধীরে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো গতকাল রাতের সব স্মৃতি। ঝড়ো হাওয়া, মুষলধারে বৃষ্টি, ভিজে যাওয়া, ঠান্ডায় ঠকঠক দাতের বাড়ি। ঠান্ডায় আর গতকালের পরিশ্রমে রাতে ঘুম হয়েছে ভালই। সারা বন জুড়ে কে যেন হোম থিয়েটারে পাখির ডাক প্লে করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে পাখিদের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ভোরের লালচে আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। মেঘ নেই কোথাও। গতরাতে যে কি পরিমান ঝড় হয়েছে বোঝার উপায় নেই যদিনা তাবুর পাশেই একটা ভাঙা গাছ পড়ে থাকতে না দেখতাম। সৃষ্টিকর্তাকে হাজারবার ধন্যবাদ দিলাম। এই গাছটা যদি তাবুর উপরে পড়ত তবে এজন্মের মতো বাই বাই হয়ে যেতাম।


(সারারাত বৃষ্টির পর স্নিগ্ধ সকাল)

বাকিরা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এই ফাঁকে খালি পায়ে প্রাতঃরাশটা সেরে ফেললাম। সাথে সাজাচ্ছিলাম আজকের প্লান। এ বনে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২৭ টা ট্রেইল আছে। যেহেতু সময় নিয়ে আসিনি তাই একটা ট্রেইলই ধরতে হবে। সেক্ষেত্রে তিন ঘন্টার পায়ে হাটা ট্রেইল ভালো সমাধান। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। এখান থেকে শ্রীমঙ্গল হয়ে বের হয়ে যাওয়ার একটা ট্রেইল আছে। সেটা ঘুরে শ্রীমঙ্গল থেকে ট্রেন ধরলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। ক্যাম্পে ফিরে বাকিদের ঘুম থেকে তুললাম। আধা ঘন্টার মধ্যে ক্যাম্প গুছিয়ে চললাম বন বিভাগের অফিসের দিকে। পথিমধ্যে বিজিবি ক্যাম্পেও বলে যাওয়া উচিত যেন আমাদের খোজাখুজি না করে।
বিজিবি ক্যাম্প থেকে ভালোই সাহসিকতার তকমা কুড়িয়ে নযটার দিকে বন বিভাগের অফিসে আসলাম যদি তারা একজন গাইডের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। কিন্তু গতকালের ঝড়েররপর এখনও কেউ বের হয়নি। সকালের নাস্তা সারতে সারতে পেয়ে গেলাম গাইড, বেলালকে। আমাদের শ্রীমঙ্গল বের হওয়ার ট্রেইল দিয়ে নিয়ে যাবে।


জঙ্গলের যৌবন

নাস্তা সেরে রেমা-কালেঙ্গাকে বিদায় জানিয়ে কালেঙ্গা গেটের ঠিক বাইরে থেকে বাম দিকের রাস্তা ধরে রওনা হলাম। দুপাশে ফসলের ক্ষেত। ক্ষেতের মাঝে মাঝে মাচা। সদ্য লাগানো কচি ধানের মাঝে সাদা বকের উড়াউড়ি। মন্দ নয়। মিনিট বিশেক হাটার পর হাঠাৎই এক বন মোরগ সামনে থেকে দৌড়ে গেল। ফসলের মাঠও এখানেই শেষ। জঙ্গল শুরু এখান থেকে।

গতকালের বৃষ্টিতে জঙ্গল যেন যৌবন ফিরে পেয়েছে। সবকিছু সবুজ আর সতেজ। নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম ফুসফুস ভরে। হাটছি আর রোমাঞ্চিত হচ্ছি বিভিন্ন পশু পাখির ডাকে। আমাদের গাইড চেনাচ্ছি কোনটা কিসের ডাক। ভেবেছিলাম এ একেবারে নির্জন, জন্যশূন্য। কিন্তু এ পথ দিয়েও মানুষের যাতায়াত আছে। আর তাদের একমাত্র বাহন দুই চাকার সাইকেল। পথে কয়েকজন সাইকেল যাত্রীর দেখা পেলাম।

ট্রেইলের অর্ধেক পথ ইতিমধ্যে পেরিয়ে গিয়েছি। এতোক্ষনে বুঝে গেলাম আজকের আর কোন চমক সামনে আসছে না। তবে আমার শখের ফটোগ্রাফির জন্য সাবজেক্টের প্রাচুর্যের কোন কমতি নেই। এগোচ্ছি আস্তে ধীরেই। একটা বিজিবি ক্যাম্প, সামনেই একটা উপজাতিদের উপাসানালয়। আরও কিছুটা সামনে এগোতেই মেঘ কালো করে পুরো জঙ্গল অন্ধকার হয়ে আসছে। সামনের বাঁকও ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। এবারে অবস্থা বেগতিক। এই অবস্থায় আবার বৃষ্টি হলে ভেজা ছাড়া উপায় নেই। সবাই তড়িঘড়ি করে সামনে এগোচ্ছে। আমার অতো তাড়া নেই। ভিজলেই বা কি! ছবি তুলছি আর সাবজেক্ট খুজছি। হঠাৎই বনের মধ্যে একা। সবাই অনেক দূরে চলে গেছে।


চশমা পড়া হনুমান

আরও কিছুটা এগোতেই বনের মধ্য থেকে খচমচ একটা শব্দ ভেসে আসলো। উপরে তাকাতেই বনে এই প্রথম চশমা পড়া হনুমানের দেখা পেলাম। এক-দুইটা নয়। পুরো একটা দল। একটা জুম লেন্সের জন্য বড়ই আফসোস হচ্ছিল। বানরের বাদ্রামী দেখতে দেখেতে কখন যে হারিয়ে গিয়েছি মনে নেই। হুশ হলো গালে বৃষ্টির ছাট লাগায়। আশে পাশে কেউ নেই। একা হয়ে পড়েছি। চিৎকার দিয়ে ডেকেও বাকিদের নাগাল পাওয়া গেল না। এদিকে বৃষ্টও শুরু হয়েছে। দৌড় দেয়া ছাড়া উপায় নেই। মিনিট খানেক দৌড়াতেই দেখি জঙ্গল শেষ, চা বাগান শুরু। সাথে হবিগঞ্জও শেষ, শ্রীমঙ্গল শুরু।


বুনো ফুল

ইতিমধ্যে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। হিন্দুরখান বাজারে একটা চায়ের দোকানে দেখি সঙ্গীরা আগেই বসে আছে। চা খেয়ে শরীর একটু গরম করতে করতেই বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। গাইডকে বিদায় দিয়ে সিএনজি নিয়ে ছুটলাম শ্রীমঙ্গল স্টেশনে। শ্রীমঙ্গল স্টেশনে যখন পৌছাই তখন দুপুর ১ টা। ট্রেন বিকাল ৫ টায়। এতোক্ষন স্টেশনে বসে থাকার কোন মানেই হয় না। আশেপাশে ঘুরে দেখার প্লান করলাম। পাশেই “বিটিআরআই”। দুপুরের খাবার খেয়েই ছুটলাম এক্সট্রা প্রাপ্তির খোজে।


জঙ্গলের শেষ

সবকিছুকে বিদায় জানিয়ে বিকাল ৫ টার ট্রেন যখন সাড়ে ছয়টায় ছাড়লো তখন শরীরে সারা দিনের ক্লান্তি। ট্রেনের দরজায় পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বিমান বন্দর স্টেশনে পৌছালাম তখন রাত এগারোটা। দুই দিনের এক স্বপ্নময় জীবন কাটিয়ে ফিরে এলাম নাগরিক জীবনে। সাথে নিয়ে এলাম একরাশ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি।

Leave a Comment
Share