রাজশাহী-নাটোরে একদিনের ঝটিকা সফর

কোনরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ করেই ঘুরে এলাম আম ও রেশম নগরীখ্যাত রাজশাহী এবং কবি জীবনানন্দ দাসের প্রেয়সী বনলতা সেনের নাটোর জেলা থেকে। আমি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলা ঘুরেছি। কিন্তু উত্তরের জেলাগুলোতে তেমনভাবে পা ফেলা হয়নি। তাই ভাবলাম হোক না উত্তরে একটা ঝটিকা সফর।

আমার কর্মস্থলে সাপ্তাহিক ছুটি বৃহস্পতিবার। তাই বুধবার রাতে ডিউটি শেষ করেই চলে গেলাম সরাসরি কমলাপুর রেলস্টেশনে। তখন রাত সাড়ে দশটা। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল আমার এক্স-কলিগ জুবায়ের। সে-ও যথারীতি অফিস করেই এসেছে। আমাদের না আছে ব্যাগ, না আছে বাড়তি কোন পোশাক। থাকার মধ্যে যা আছে, তা হলো একটি করে ছাতা। আমরা জানতাম করোনাকালীন সময়ে  ট্রেনের টিকিট পাওয়া খুব একটা কঠিন হবে না। ট্রেনের প্রায় অর্ধেক আসনই শুনেছি ফাঁকা থাকে। তাই অগ্রিম টিকিট কেনার কোন প্রয়োজনবোধ করিনি। আর আমরা এ-ও জানতাম, বৃহস্পতিবার রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’ আর নাটোরের ‘উত্তরার গণভবন’ বন্ধ থাকে। কিন্তু আমাদের হাতে ছুটি না থাকায় আমাদের সাপ্তাহিক ছুটিকেই ভ্রমণের উপযুক্ত দিন হিসেবে বেছে নিতে হয়েছে।

আমাদের রাজশাহীগামী ট্রেন (পদ্মা এক্সপ্রেস) গন্তব্যে দিকে ছুটতে শুরু করবে ১১:২০ মিনিটে। তাই দ্রুত টিকিট কিনে আমরা ছুট দিলাম হোটেলের দিকে। উদ্দেশ্য রাতের খাবার হিসেবে কিছু কিনে নেয়া। সময় স্বল্পতা, তাই ৪টা পরোটা আর ২টা ডিমভাজা পার্সেল নিয়ে আমরা ট্রেনের নির্ধারিত আসনে বসলাম। ট্রেনটাও ছাড়লো নির্ধারিত সময়েই।

রাত ১২টায় আমরা রাতের খাবার খেলাম। এবার শুরু হলো ভ্রমণ প্ল্যানিং। কোথায় কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো ইত্যাদি বিস্তারিত আলোচনা। সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে নাটোর যাবো। শুনেছি নাটোরে একটি রেল স্টপেজ আছে, নাম আব্দুলপুর। কিন্তু সমস্যা হলো এটি নাটোর সদরে না, লালপুর থানার অন্তর্গত একটি রেলস্টেশন। এখান থেকে বাসে নাটোর যেতে ঘণ্টাখানেক লাগে। যা হবে যেখা যাবে। আমরা নাটোর ঘুরে বাসযোগে রাজশাহী চলে যাবো। প্ল্যান গুছিয়ে নিলাম। এবার খোঁজ নেয়ার পালা কয়টায় আমাদের ট্রেন আব্দুলপুর স্টেশনে পৌঁছবে। যা জানতে পারলাম তা হলো রাত ০৩:৩৫ মিনিটে। যেহেতু হাতে সময় খুব একটা নেই, তাই আমরা না ঘুমিয়ে গল্প করেই বাকি সময়টা পার করলাম। রাত ০৩:৫০ মিনিটে ট্রেন আব্দুলপুর এসে থামলো। কিন্তু শেষ সময় এসে জুবায়ের ট্রেন থেকে নামতে দ্বিমত পোষণ করলো। তার কথার যে সারমর্ম তা হলো- ভোর হতে আরো কমপক্ষে ১ ঘণ্টা বাকি। এই মাঝরাতে অচেনা একটা রেলস্টেশনে আমরা দুজনে কি করবো? আমাদের কাছে টাকা হয়ত কম আছে, কিন্তু মোবাইলতো আছে ৪টা। দিনকাল ভালো না, তাই রিস্ক নেয়াটা সমীচীন হবে না।

তার যুক্তির কাছে হার মানলাম। নামলাম না ট্রেন থেকে। উপকারের মধ্যে এতটুকুই- তা হলো ০৩:৫০ মিনিটে নামবো বলে আর ঘুমালাম না, নির্ঘুম একটি রাত কাটালাম। আগে থেকে যদি জুবায়ের তার সিদ্ধান্ত জানাতো তাহলে হয়ত কিছুটা ঘুমিয়ে নেয়া যেত। কি আর করা। একটানে ভোর ০৫:৩৫ মিনিটে আমরা রাজশাহী রেলস্টেশনে।

রেলস্টেশনে নেমেই আমরা ফিরতি টিকিট কিনে নিলাম। রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস (রাত ১১:২০ মিনিট) ট্রেনের শোভন চেয়ার টিকিটের মূল্য ৩৪০ টাকা। স্টেশনটাকে ভালমতো পর্যবেক্ষণ করলাম। ছিমছাম রেলস্টেশন বলতে যা বোঝায়, এটাতে তা বলা যায়। কিন্তু স্টেশনের ভেতর কোন সিলিং ফ্যান নজরে পড়লো না। ওয়েটিং রুম বলতে আলাদা কিছু না থাকলেও সুন্দর সোফা জাতীয় সিট আছে অনেকগুলো। পাশে মোবাইল চার্জের জন্য চার্জার পয়েন্ট। টয়লেটগুলোও যথেষ্ট পরিষ্কার। এক কথায় সুন্দর ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান এখানে।

তখনও অন্ধকার, ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে করছে। কিছু পাখ-পাখালি ঘুম ভেঙেই আকাশে ডানা মেলেছে। হয়ত তাদের কোনো ব্যস্ততা আছে। তাদের চেয়েও আমাদের ব্যস্ততা বেশি, কারন আমাদের হাতে সময় শুধু আজকের দিনটা। দিন বলতে আজকে সকাল থেকে সন্ধ্যাটুকু, এই যা।

তাই দ্রুত আমরা পথে নামলাম। স্টেশন থেকে বাইরে বেরুলেই বাসস্টেশন। একটা চায়ের দোকানে চা পান করে দোকানদারের কাছ থেকে কিছু তথ্য নেয়ার চেষ্টা করলাম। আমার প্ল্যান ছিল- শুরুতেই আমরা রাজশাহী ঘুরবো না। প্রথমে রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ী যাবো। তারপর সেখান থেকে নাটোর। নাটোরে যা দেখার দেখে রাজশাহী ফিরবো।

তাই আমরা সিএনজিতে করে ৫ টাকায় ভদ্রা মোড়ে নামলাম। ভদ্রাও একটা ছোটোখাটো বাস স্টেশন। এখান থেকে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে লোকাল গাড়িগুলো ছেড়ে যায়। রাজশাহী টু নওগাঁ, রাজশাহী টু পাবনা, রাজশাহী টু রংপুর ইত্যাদি। ইতিমধ্যে ভোরের আলো ফুটেছে। এ সময়ের স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া আমাদের ঘুমহীন দীর্ঘ পথের কান্তিকে নিমিষেই প্রশমন করে দিলো। তারপর আমরা ভদ্রা মোড়ের একটি হোটেলে ঢুকে পড়লাম। উদ্দেশ্য সকালের নাস্তা করা। পরে কোথায় কি খাবো, কি খাবো না – আল্লাহ্ মালুম। ওই যে ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত রুবাইয়াতের চারটি চরণ আছে না? :

নগদ যা পাও হাত পেতে নাও
বাকির খাতা শুন্য থাক।
দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে
মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।

তাই আমরা অর্থের বিনিময়ে খাদ্য নগদায়নের দিকে মনোনিবেশ করলাম। শুধু খিচুড়ি ২০ টাকা আর ডিম খিচুড়ি ৩৫ টাকা। ডিম খিচুড়ি খেয়ে বিল পরিশোধের সময় আমার চোখ হোটেলের রান্নাঘরের দিকে গেল। রান্নাঘরে যা দেখলাম, তা আমি এর আগে কোথাও দেখিনি। দেখলাম একটা লাকড়ির চুলা। তবে চুলার মূল বিশেষত্ব হলো এর উচ্চতা।  প্রায় সাড়ে তিন বা চার ফুটের কাছাকাছি তো হবেই। যাহোক, পেটের আগুন যেহেতু নিভেছে সেহেতু চুলার আগুন দেখে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই।

রাজশাহী জেলা সদর থেকে ৩২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নাটোর মহাসড়ক অভিমুখে পুঠিয়ার অবস্থান। তাই আমরা পাবনার একটি বাসে চেপে বসলাম। রাজশাহী থেকে পুঠিয়া বাজারের ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা। সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। পুঠিয়া বাজার যখন পৌঁছাই তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা। বাজার থেকে ভ্যানে জনপ্রতি ৫ টাকায় পুঠিয়া রাজবাড়ী। বলা বাহুল্য, পুঠিয়া রাজবাড়ী সম্পর্কে কিছু তথ্য গুগল মামা থেকে আগেই নিয়ে গিয়েছিলাম। পাঠকদের সুবিধার্থে এর সার-সংক্ষেপ কিছুটা আলোচনা করা হলো :

পুঠিয়া রাজবাড়ী বা পাঁচআনি জমিদারবাড়ি

পুঠিয়া রাজবাড়ী বা পাঁচআনি জমিদারবাড়ি : ১৮৯৫ সালে মহারানী হেমন্তকুমারী দেবী আকর্ষনীয় ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে আয়তাকার দ্বিতল বর্তমান রাজবাড়ীটি নির্মাণ করেন। ভবনের সম্মুখভাগের স্তম্ভ, অলংকরণ, কাঠের কাজ, করে দেয়ালে ও দরজার উপর ফুল ও লতাপাতার চিত্রকর্ম চমৎকার নির্মাণ শৈলীর পরিচয় বহন করে। রাজবাড়ীর ছাদ সমতল, ছাদে লোহার বীম, কাঠের বর্গা এবং টালি ব্যবহৃত হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রাজবাড়ির চারপাশে পরিখা খনন করা হয়েছিল।

পুঠিয়া রাজবাড়ীর আশপাশে ছয়টি রাজদিঘী আছে। প্রত্যেকটা দিঘীর আয়তন ছয় একর করে। মন্দিরও আছে ছয়টি। সবচেয়ে বড় শিব মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালেই অপূর্ব সব পোড়ামাটির ফলকের কারুকাজ। বাংলার বিভিন্ন গড়নরীতির এই মন্দিরগুলোর প্রতিটিই আকর্ষণীয়। এ ছাড়া রানির স্নানের ঘাট, অন্দর মহল মিলিয়ে বিশাল রাজবাড়ী প্রাঙ্গণ।

গোবিন্দ মন্দির : পুঠিয়া পাঁচআনি জমিদার বাড়ি অঙ্গনে অবস্থিত গোবিন্দ মন্দির একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি। একটি উচু বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত বর্গাকার নির্মিত মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে আছে একটি ক ও চার কর্ণারে রয়েছে ৪টি বর্গাকৃতির ছোট ক। গর্ভগৃহের চারপাশে ৪টি খিলান প্রবেশ পথ আছে। মন্দিরের কার্ণিশ সামান্য বাঁকানো। মন্দিরের পিলার ও দেয়াল অসংখ্য দেব-দেবী, যুদ্ধের সাজসজ্জা, ফুল ইত্যাদির পোড়ামাটির ফলক দ্বারা সজ্জিত। প্রেম নারায়ণ রায় আঠারো খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে এই মন্দির নির্মাণ করেন বলে জানা যায়।

ছোট আহ্নিক মন্দির : পুঠিয়া রাজবাড়ীর দণি পাশে এ মন্দির অবস্থিত। আয়তাকার নির্মিত উত্তর দেিণ লম্বা এ মন্দিরের পূর্বদিকে পাশাপাশি ৩টি এবং দণি দেয়ালে ১টি খিলান দরজা আছে। মন্দিরটি আঠার খ্রিস্টাব্দে প্রেম নারায়ণ কর্তৃক নির্মিত বলে জানা যায়।

ছোট শিব মন্দির : বর্গাকারে নির্মিত ছোট আকৃতির এ মন্দিরটি রাজবাড়ী হতে ১০০ মিটার দেিণ পুঠিয়া-আড়ানী সড়কের পূর্বপাশে অবস্থিত। মন্দিরের দণি দেয়ালে ১টি মাত্র খিলান প্রবেশপথ আছে। মন্দিরটি পোড়ামাটির অলংকরণদ্বারা সজ্জিত।

দোল মন্দির : পুঠিয়া বাজারের মধ্যে অবস্থিত বর্গাকারে নির্মিত ৪ তলা বিশিষ্ট একটি সুদৃশ্য ইমারত। মন্দিরের চতুর্থ তলার উপরে আছে গম্ভুজাকৃতির ছাদ। পুঠিয়ার পাঁচআনি জমিদার ভুবেন্দ্রনারায়ণ রায় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

বড় শিব মন্দির : পুঠিয়া বাজারে প্রবেশ করতেই হাতের বামপাশে শিবসাগর নামক দীঘির দণি পাড়ে বড় শিব মন্দির অবস্থিত। ১৮২৩ সালে নারী ভূবনময়ী দেবী এ মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

জগন্নাথ/ রথ মন্দির : বড় শিব মন্দির সংলগ্ন পূর্বদিকে শিবসাগর নামক দীঘির দণি পাশে জগন্নাথ বা রথ মন্দির অবস্থিত। দোতলার কটি ছোট এবং চারপাশে উন্মুক্ত প্রবেশদ্বার রয়েছে। মন্দিরটি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রানী ভূবনময়ী কর্তৃক নির্মিত বলে জানা যায়।

চারআনি জমিদারবাড়ী ও মন্দিরসমূহ : পাঁচআনি রাজবাড়ী থেকে প্রায় ১২৫ মিটার পশ্চিমে শ্যামসাগর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে পুঠিয়ার চারআনী জমিদার বাড়ী অবস্থিত। চারআনী জমিদার কর্তৃক  বড় আহ্নিক, ছোট গোবিন্দ ও গোপাল মন্দির নামে পরিচিত একই অঙ্গনে পাশাপাশি ৩টি মন্দির আছে।

বড় আহ্নিক মন্দির : উত্তর-দেিণ লম্বা আয়তাকার পূর্বমুখী এ মন্দিরে পাশাপাশি ৩টি ক আছে। মাঝের করে পূর্বদিকে তিনটি খিলান প্রবেশ পথ এবং উপরে দোচালা আকৃতির ছাদ আছে। মন্দিরটির সম্মুখের দেয়ালে অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। মন্দিরটি সতের-আঠার শতকের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত বলে জানা যায়।

ছোট গোবিন্দ মন্দির : বড় আহ্নিক মন্দিরের উত্তর পাশে বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরটি ছোট গোবিন্দ মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরের দেয়ালের ফলকগুলোতে  যুদ্ধের কাহিনী, বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীর চিত্র, সংস্কৃত ভাষায় রচিত পোড়ামাটির ফলক ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত।

গোপাল মন্দির : চার আনি মন্দির চত্ত¡রের উত্তর পাশে অবস্থিত আয়তাকার দ্বিতল মন্দিরের দণিদিকে ৩টি এবং পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ১টি করে প্রবেশপথ আছে। দণিমুখী এ মন্দিরের উত্তর দিক ব্যতিত অপর তিনদিকে বারান্দা আছে।

যাহোক, আমরা খুব একটা সময় নষ্ট করিনি ওখানে। সম্পূর্ণ রাজবাড়ীটি ঘুরে দ্রুত কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। তারপর ভ্যানে করে পুঠিয়া বাজার। সেখান থেকে ২০ টাকার বিনিময়ে আরেকটি বাসে নাটোরের মাদ্রাসা মোড়ে নামলাম। সময় লাগলো আধঘণ্টার কাছাকাছি। মাদ্রাসা মোড় থেকে রাণী ভবানী রাজবাড়ী গেলাম ব্যাটারীচালিত রিকশায়। ভাড়া ১৫ টাকা। কিন্তু ভাগ্যদেবী বোধহয় এবার আমাদের প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন। রিকশা থেকে নামার আগেই রাজবাড়ীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক পুলিশ সদস্য বলল- রিকশা ঘুরিয়ে নিন। করোনার কারনে লকডাউনের পর থেকেই নাটোরের সকল দর্শনীয় স্থান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।

কি আর করা! রিকশা ঘুরিয়ে আবারও মাদ্রাসা মোড়ে। ভেবে দেখলাম যেহেতু জেলার সকল দর্শনীয় স্থান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ সেহেতু নাটোরের এমন একটি জায়গায় ঘুরতে হবে যেখানে ঢুকতে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এবার গুগল মামার সাহায্য নিলাম। দেখলাম কাছাকাছি দেখার মতো যা আছে তা হলো- হালতি বিল। সিদ্ধান্ত নিলাম, সেখানেই যাবো।

নাটোর শহর থেকে হালতি বিল যেতে হলে প্রথমেই আপনাকে মাদ্রাসা মোড় থেকে সিএনজিতে করে ১০ কিলোমিটার উত্তরে নলডাঙ্গা থানার অন্তর্গত পিপরুল ইউনিয়নের পাটুল বাজারে নামতে হবে। ভাড়া পড়বে মাথাপিছু ৩০ টাকা আর রিজার্ভ করলে ২০০ টাকা। হালতির বিলে যাবার পথেই (নাটোর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে) পড়বে- ইতিহাসখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী বা উত্তরা গণভবন। গণভবন ছাড়িয়ে সিএনজি মিনিট পাঁচেক এগিয়ে গেলেই চিরায়ত গ্রামের দেখা মিলবে। রাস্তার দুইপাশে বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত। বাতাসে দোল খাচ্ছে ধানগাছ। মাঠভর্তি সোনালী ফসল। যেন তেপান্তরের মাঠ। মাঠ পেরিয়ে জনবসতি। কিছু গ্রাম্যবাড়ি। বাড়ি থেকে উলঙ্গ শিশুরা বেরিয়ে রাস্তায় নেমেছে খেলতে। হাতে প্লাস্টিকের ব্যাট-বল। তাদের চোখে স্বপ্ন-তৃষ্ণা। অদূর ভবিষ্যতে এখান থেকেই হয়ত বেরিয়ে আসবে আগামীর সাকিব-মুশফিক, তামিমরা।

উত্তরা গণভবন

যাহোক, আধঘণ্টা পর আমরা পাটুল বাজারের নামলাম। নেমেই দেখলাম সারি সারি ইঞ্জিনচালিত নৌকা যাত্রীর অপেক্ষায় ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। ১২/১৫ জন হলেই প্রতিটি নৌকা ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে। ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা আর রিজার্ভে গেলে ২০০ টাকায় যাওয়া যায় খাজুরা গ্রাম পর্যন্ত। আমরাও একটি নৌকায় চেপে বসলাম। মেঘলা আকাশ। যেকোন সময় ঝুম-ঝুমান্তি বৃষ্টি নামবে। এরই মাঝে এগুতে লাগলো নৌকা। আমরা গিয়ে পড়লাম হালতি বিলে।

মূলতঃ নাটোর সদর উপজেলার পিপরুল, খাজুরা, মাধনগর ও ব্রপুর ইউনিয়নের বিস্তৃত এলাকা  হালতি বিলের অংশ। বৈশাখ মাস হতে কার্তিক মাস পর্যন্ত  বিল এলাকা ৫ থেকে ৮ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। প্রাকৃতিক মাছের প্রজননস্থল হিসেবে হালতি বিল বিখ্যাত। হালতি বিল আত্রাই নদীর সাথে সংযুক্ত। শীতকালে এ যেন সাগরের বুকে একগুচ্ছ দ্বীপ। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এটি ‘মিনি কক্সবাজার’ হিসেবে পরিচিত। বিলের উত্তাল জলরাশি আর ঢেউ যে কারো মন নিমেষেই ভালো করে দিতে পারে। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই অথৈ জলরাশি আর ঢেউ। সেই ঢেউ ভেঙে ছুটে চলে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত অসংখ্য নৌকা। দিগন্তরেখায় সবুজের কারুকাজ। সবুজ গাছপালায় ঘেরা একেকটি  ছোট গ্রাম। প্রতিটি গ্রামের ওপারে আবার দিগন্তজোড়া জলরাশি। বিশাল জলরাশির মধ্যে রয়েছে একটি ডুবন্ত সড়ক। বর্ষায় অথৈ পানি আর শীতে ফসলি জমির এই বিলের মাঝ বরাবর ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি নির্মাণ করা হয় ২০০৪ সালে। এটা যেন কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোড।

হালতি বিল

মিনিট দশেক পর আমরা যখন হালতির বুকে তখনই শুরু হলো প্রবল বর্ষণ। নৌকার ছইয়ের ভিতর বসে থাকাটাই দায় হয়ে দাঁড়ায়। বিলে প্রচন্ড স্রোত। অগত্যা কি আর করা, বসে রইলাম ঝিম ধরে। পাটুল থেকে খাজুরা ৪৫/৫০ মিনিটের যাত্রাপথ। এই সময়ের বেশিরভাগ সময়ই আমরা নৌকার ভেতর ঝিমিয়ে কাটিয়েছি। বৃষ্টি যখন থামলো তখন আমরা খাজুরা গ্রামের কাছাকাছি। যাহোক, খাজুরা ঘাটে আমরা নামলাম। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে তখনও। হাতে সময় কম। তাই গ্রামের খুব একটা ভিতরে ঢুকলাম না। আশপাশে কিছুটা সময় ঘুরে চলে আসলাম ঘাটে। ঘাট থেকে সোজা ফিরতি নৌকায় পাটুলের পথে যাত্রা। তবে এবার আর নৌকার ছইয়ের ভিতর না, ছইয়ে উপরে বসে বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম পুরোটা সময়। পাটুল বাজারে নেমে গরম গরম সিঙ্গারা খেয়ে সিএনজিতে সরাসরি মাদ্রাসা মোড়। দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছিল। তাই সোজা চলে গেলাম- পচুর হোটেল। মাদ্রাসা মোড় থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথে এই হোটেলটি। খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেশি।

পেটের আগুন নিভিয়ে ডেজার্টে মনোনিবেশ করলাম। তবে এই হোটেলে না। নাটোরে আসলাম আর বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা খাবো না, এটা কি হয়? তাই মাদ্রাসা রোড থেকে ৫ টাকা সিএনজি ভাড়ায় চলে গেলাম জেলার সবচেয়ে ভাল কাঁচাগোল্লার দোকান মৌচাক মিষ্টি ভান্ডার-এ। সেখানে কাঁচাগোল্লা খেলাম। জানিয়ে রাখা ভাল, কাঁচাগোল্লার দর প্রতি কেজি ৪৮০ টাকা। দাম মিটিয়ে আবার সিএনজিতে মাথাপিছু ১০ টাকায় চলে আসলাম বাইপাস মোড়ে। কারন মাদ্রাসা রোড থেকে বেশিরভাগ রাজশাহীগামী বাসই লোকাল। অনেকটা সময় অপচয় হবে। তাই আর রিস্ক নিলাম না। মাইপাস মোড় থেকে বাসে ৫০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে নেমে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। ঘড়ির কাটায় তখন বিকেল ৪টা।  তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এরই মাঝে আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লাম।  করোনা পরিস্থিতির কারনে ক্যাম্পাস সুনশান নিরব। অথচ মাসকয়েক আগেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত।  এত বড় ক্যাম্পাস এত স্বল্প সময়ে ঘুরে শেষ করতে পারবো না। তাই একটা রিকশা নিয়ে নিলাম। রিকশায় পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলাম। তবে ক্যাম্পাসের ভিতরের প্যারিস রোডের কথা না বললেই নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট থেকে শের-ই-বাংলা হল পর্যন্ত যে রাস্তাটি চলে গেছে সেটিই প্যারিস রোড নামে পরিচিত। রাস্তাটির দুপাশে চোখ ধাঁধানো গগনশিরীষ গাছ। পিচঢালা রাস্তার দুপাশের এই আকাশচুম্বি গাছগুলো কেবল সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, লালন করে ক্যাম্পাসের বহু বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য। ১৯৬৫ সালের দিকে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর এম শামসুল হক ফিলিপাইন থেকে কিছু গাছ নিয়ে আসেন। রোপিত হয় এই রাস্তাটির দুইধারে। গাছগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এর সৌন্দর্য। আর বৃষ্টিস্নাত পিচঢালা প্যারিস রোডের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা সেই রিকশাতে করেই পদ্মার পাড়ে চলে আসলাম। তখন পড়ন্ত বিকেলে সুনীল বন্দোপাধ্যায়ের কনে দেখা আলোয় বিষন্ন সন্ধ্যার আয়োজন চলছে। এমন পরিবেশে নিজের অজান্তেই মনটা হু-হু করে ওঠে। সন্ধ্যাটা পদ্মার পাড়ে কাটিয়ে সিএনজিতে ১০ টাকা ভাড়ায় চলে গেলাম রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সামনে। সেখানে গরম গরম রাজশাহীর বিখ্যাত কালাই রুটি খেলাম। প্রতি পিছ ২০ টাকা। সাথে ২/৩ রকমের ভর্তা ফ্রি। তারপর সোজা হেঁটে চলে গেলাম বর্ণালী মোড়ে। উদ্দেশ্য হলো- তান্দুরী চা পান করা। যদিও হাঁটাপথে দূরত্ব প্রায় ৩৫ মিনিটের মতো। তবুও রাতের শহর দেখতে হলে না হেঁটে উপায় কি?

রাজশাহী শহর সম্পর্কে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। পরিচ্ছন্ন শহর বলতে যা বোঝায়, রাজশাহী ঠিক তাই। শহরের পথ-ঘাট যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন। ধুলিবালি নেই বললেই চলে। শহরের মানুষ এ ব্যাপারে খুবই সচেতন।  ছোট এই সিটির ভেতর কোন লোকাল বাস বা ট্যাম্পু জাতীয় যানবাহন নেই। যা আছে তা হলো- রিকশা আর ব্যাটারিচালিত অটো।  আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ৫০ টাকা পকেটে নিয়ে বের হলে পুরো শহর মাত্র ১ ঘণ্টায় ঘুরে দেখা সম্ভব। আর রাতের রাজশাহী? সে তো যথেষ্ট-ই দৃষ্টিনন্দন। চারদিকে ঝলমলে আলো। সড়ক বিভাজনে হরেক রকম মনোরম ফুলের গাছ আর লতাগুল্ম। এক কথায় রাজশাহী শহরটা অসাধারণ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধভূমি

অবশেষে চায়ের দোকানের দেখা পেলাম। দোকানের নামও- তান্দুরী চা। তবে দোকানের প্রধান বৈশিষ্ট হলো- দোকানের ভেতর বসার জন্য কোন চেয়ার বা টুল নেই। আছে ৩/৪ টি সোফা। প্রতি সোফায় ৩ জন লোক বসতে পারে। যাহোক অর্ডার দিলাম তান্দুরী চায়ের। স্বাদ মোটামুটি ভালো।

চা পর্ব শেষ করে আবারও চেপে বসলাম অটোতে। ১০ টাকা ভাড়ায় চলে আসলাম সাহেব বাজার। উদ্দেশ্য রাজশাহীর বিখ্যাত কমলাভোগ মিষ্টি খাওয়া। ২৬০ টাকা কেজি দরের কমলাভোগ খেলাম রাজশাহী মিষ্টি ভান্ডার থেকে। স্বাদ তেমন আহামরি কিছু না। যাহোক, খাওয়া পর্ব শেষ করে চলে গেলাম সাহেব বাজারের বড় মসজিদের পেছনের গলিতে। সেখানে নিউ বিদ্যুৎ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট নামে একটা হোটেল আছে। শুনেছি ওখানে ভালো মানের কলিজা সিঙ্গারা বানায়। যদিও আমরা ওই হোটেলে কলিজা সিঙ্গারা পাইনি। তারা নাকি সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই সিঙ্গারাটা বানায়। কি আর করা। ভঙ্গ মনোরথে আমরা ২০ টাকা অটোভাড়া দিয়ে সরাসরি বাসস্ট্যান্ডে চলে আসলাম। রাত তখন ৯টা। পাশের একটি হোটেলে আমরা রাতের খাবার খেলাম। তারপর আশপাশে কিছুক্ষণ ঘুরাঘরি করে ফিরে গেলাম রেলস্টেশনে। সেখানে বসে প্রায় ঘণ্টা দুই ঝিমুলাম। তারপর যথারীতি রাতের ট্রেনে ঢাকায়। এভাবেই শেষ হয় আমাদের একদিনে দুই জেলার ঝটিকা ভ্রমণ।

বিঃ দ্রঃ এই ঝটিকা সফরে জনপ্রতি আমাদের খরচ হয়েছিল মাত্র ১,৪০০ টাকা। কারণ এটি ছিল সম্পূর্ণ বাজেট ট্যুর। কেউ যদি আরেকটু রিলাক্সে ঘুরতে চান তাহলে দু’হাজার টাকার বেশি লাগবে বলে মনে হয় না। তবে একটি কথা না বললেই নয়। আমরা সবাই জানি, ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। তাই নতুন কোন জেলা বা অপরিচিত কোন এলাকায় বেড়াতে গিয়ে সেখানকার মানুষ বা ঐতিহ্য নিয়ে এমন কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়, যাতে করে সেখানকার লোকজন মনোক্ষুন্ন হয়।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ natorerajshahitravel story