ছোট্ট সেই পারকির চর

স্মৃতিময় অনুভূতি কারো কাছে তুচ্ছ আবার কারো কাছে সব চেয়ে দামী বস্তু। কয়েক বছর আগের কথা। খুব বেশি দিনও না। তারপরও স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “পালামৌ” প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে গেল। অনেক দিন আগের কথা লিখতে বসেছি। সব কিছু স্মরণ হয় না। আগে লিখলে যেভাবে লিখতাম এখন হয়তবা সেভাবে লিখা হবে না। সে আগের চোখ এখন আর নেই। 

তখন সবে মাত্র দশম শ্রেণীতে উঠেছি। সিনিয়রদের কাছ থেকে আগে থেকেই একটি প্রবাদ বাক্য শুনে এসেছি,”জে এস সি দেওয়ার পর অনেকেরই পাখা গজায়, যেটা কাটা যায় দশম শ্রেণীর নির্বাচনী পরীক্ষা দেওয়ার পর।” জে এস সি তে খুব ভালো ফলাফল করায় আমারও একই অবস্থা হয়েছিল। সারাদিন খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ায় ব্যস্ত থাকতাম। রোজার ঈদ ছিল তখন জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে। প্রত্যেকবার ঈদ আসলেই বাসা থেকে খুব কাছে হওয়ায় আমরা ঘুরতে যেতাম পতেংগা সমুদ্র সৈকতে। তাই এবার চিন্তা করলাম অন্য কোথাও যাওয়া যাক। শুনলাম কর্ণফুলী নদীর ওইপাড়ে নাকি একটি ছোটখাট সমুদ্র সৈকত আছে। এর আগে যেহেতু কখনোই যাইনি তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার ওখানেই যাবো। আমি, রাহাত, নীরব, রোহান, রাফিদ, বড় নোমান, বক্কর যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। বাসায় বললাম পতেংগা সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছি। কারণ সত্য কথা বললে কখনোই যেতে দিত না। আমাদের কলোনি থেকে প্রথমেই চলে গেলাম ১৪ নাম্বার। সেখান থেকে নৌকা করে কর্ণফুলী নদীর ওইপাড়ে আনোয়ারাতে যেতে হবে। এর আগে কখনো ছোট খাল-বিলেও নৌকাতে উঠিনি। আর এতো খরস্রোতা নদী।

এদিকে নীরব ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আমাকে বললো, ভাই তুইও সাঁতার পারিস না, আমিও পারি না। ডুবে গেলে খেল খতম। বাদ দে। চল বাসায় চলে যাই। আর না হয় পতেংগা সমুদ্র সৈকতেই চল। সে মুহূর্তে আমিও দ্বিধায় পড়ে যাই। যাবো কি যাবো না। নৌকা ডুবে গেলে আর খুঁজেও পাওয়া যাবেনা। অনেক্ষণ চিন্তা করার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে যেহেতু এসেছি তাই যাবো যেভাবেই হোক। যা হবার হবে। ওইদিকে নীরব কিছুতেই রাজি হচ্ছে না যাওয়ার জন্য। অনেক কস্টে সবাই মিলে ওকে রাজি করালাম। এরপর নৌকায় উঠলাম।

ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকা। কিন্তু মনে হলো ধারণ ক্ষমতার বেশি মানুষ নেওয়া হয়েছে। নৌকা খুব সহজেই ডুবে যেতে পারে। এই চিন্তা করতে করতে নৌকায় উঠার সময়ই আমার সানগ্লাস পড়ে যায় ইঞ্জিনের পাশে পানির ভিতরে। কোনোমতে উঠিয়ে নিয়ে বসে পড়লাম এক কোনায়। এদিকে নীরবকে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছিল। আশে পাশে আরো কিছু নৌকা ছিল সাথে বিশাল বিশাল জাহাজ। নৌকায় বসে নদীর বাতাস উপভোগ করলাম। খুব বেশিক্ষণ লাগেনি। চলে গেলাম নদীর ওই পাড়ে। সেখান থেকে দুটো লোকাল সিএনজিতে করে রওয়ানা দিলাম পারকির চরের উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রাম শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। পারকির চরে যাওয়ার রাস্তাঘাট খুবই ভালো ছিল। যাওয়ার সময় পাশে দেখলাম বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সার কারখানা চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড। সিএনজিতে যাওয়ার কারণে আশেপাশে ঠিকমতো কিছুই দেখতে পারি নি। হয়তোবা রিক্সা করে গেলে আনোয়ারার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালো করে উপভোগ করা যেত। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পারকির চর চলে এসেছে। কিছুক্ষণ পর সিএনজি থেকে নেমে গেলাম। এরপর একটু হেঁটে গেলেই পারকির চর। আমরা বের হয়েছিলাম খুব সম্ভবত ৩টা ৩০ এর দিকে। আর ওইখানে গিয়ে পৌঁছেছিলাম ৫ টার দিকে। বঙ্গোপসাগর আর কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের মাঝামাঝি হওয়ায় একই সাথে পারকির চরে দুটো জিনিসই দেখা যায়, যদিওবা পার্থক্য করা যায় না। পারকির চর খুব বেশি বড় না। শুধুই বালুর চর। ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, আর প্রস্থে হবে মাত্র ৩০০-৩৫০ ফিট। বিকেলের দিকে হওয়ায় তখনও কিছুটা ভাটা ছিল। ভাটা শেষে জোয়ার আসবে আসবে এমন অবস্থা।

সমুদ্রের তীরে ঝাউ গাছ থাকবে না এমনটা কি হয়? সেখানেও চরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ঝাউ গাছের সারি ছিল। আমরা চরে নেমে প্রথমেই রিং খেললাম। একটা টেবিলে কিছু আইটেম রাখা থাকে। রিং মেরে ওগুলো নিতে হয়। প্রত্যেকবারের মতো আমি সেবারও কিছু পাইনি। যতদূর মনে আছে কেউ একজন একটি সিগারেটের প্যাকেট পেয়েছিল।

তারপর গেলাম একটু সমুদ্রের পানির কাছে। পতেংগা সমুদ্র সৈকত কিংবা কক্সবাজারে যেমন অনেক বড় বড় ঢেউ দেখা যায়, এখানে তেমন না। এখানকার ঢেউগুলো খুবই ছোট। তবে এখানে মূল আকর্ষণের বিষয় ছিল একটি বিশাল জাহাজ। নাম ক্রিস্টাল গোল্ড। সচরাচর সমুদ্রের পাড়ে কখনোই এতো বড় জাহাজ দেখা যায় না। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম দুই মাস আগে হওয়া ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে এই জাহাজ এখানে এসেছে। এতো বিশাল জাহাজ এখন টেনেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সবাই জাহাজের সামনে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল। যদিও আমি কোনো ছবি তুলিনি। জাহাজের পাশে বাতাস বেশি ছিল। মনে হয় বিশাল জাহাজে বাতাস ধাক্কা খেয়ে যেতে পারছিল না দেখেই বেশি বাতাস ছিল। এখন যেটা শোনা যায় সবাই নাকি শুধু মাত্র এই জাহাজ দেখতেই পারকির চরে আসে। যদিও এখনও জাহাজটি এখানে আছে নাকি সরিয়ে ফেলা হয়েছে তা জানা নেই। এক পাশে অনেক গুলো লাল লাল কাঁকড়া দেখা যাচ্ছিলো। ছোট্ট কাঁকড়াগুলো একবার গর্তে ঢুকছিল, আবার বের হচ্ছিল।

এর কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা হয়ে আসলো। সমুদ্রের পাড়ে যাবো আর সূর্যাস্ত দেখবো না এমনতো হয় না। যদিও পতেংগা সমুদ্র সৈকতের সূর্যাস্ত দেখে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু পারকির চরের সূর্যাস্তের অনুভূতি যেন মোহময়। সূর্যাস্ত শেষে আমরা ঠিক করলাম এবার কিছু খেয়ে নেয়া যাক। কিন্তু সেখানে ওই সময় খাওয়ার পরিবেশ অতো ভালো ছিল না। তাই ঠিক করলাম নদীর এই পাড়ে এসেই খাওয়াদাওয়া করা যাবে। আবার আগের মতো আমরা সিএনজি করে নদীর পাড়ে এলাম। এরপর আবার সেই নৌকা। তবে আগে থেকে ভয়টা কিছুটা এবার কম ছিল। রাতের কর্ণফুলীতে ছিল অন্যরকম এক সৌন্দর্য। বিশাল বিশাল জাহাজের লাইটিং ছিল মনোমুগ্ধকর। ছোট্ট একটি নৌকা অতিক্রম করে যাচ্ছিল ছোট বড় বিভিন্ন জাহাজ। এবার নৌকা স্রোতের অনুকূলে থাকায় খুব তাড়াতাড়ি নদীর এপাড়ে চলে আসি। নৌকা থেকে নামার পর দেখলাম নীরব অনেক খুশি। মনে হয় যুদ্ধে জয় লাভ করে ফিরেছে। এরপর খাওয়াদাওয়া শেষ করে চলে আসলাম বাসাতে।

এখানে ভালো লাগার মতো বিষয় হচ্ছে মনোরম পরিবেশ। অন্যান্য জায়গার থেকে ভিড় অনেক কম থাকে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন পারকির চর অতোটাও উন্নত ছিল না। তবে শুনেছি এখন নাকি বেশ উন্নতি হয়েছে। পিকনিক স্পট হিসেবে ভালোই। সরকার চাইলেই এখানে পতেংগা সমুদ্র সৈকতের মতো নতুন অনেক কিছু যুক্ত করতে পারে। সামনে সুযোগ পেলে আবারও যাওয়ার ইচ্ছা আছে ছোট্ট সেই পারকির চরে।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Chittagongchorparkiparkir