লাদাখের নীল নির্জন প্যাংগং লেকে একদিন

প্যাংগং লেক, লাদাখ

আমাদের লাদাখ ট্রিপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান ছিল প্যাংগং লেক। লেহ্‌ থেকে রওনা দিয়েছি নীল আকাশকে সঙ্গে নিয়ে। একটা স্করপিওতে আমরা কলকাতার পাঁচজন। ইনার লাইন পারমিট নিতে থামতে হল কারু পুলিশ চেকপোস্টে। কারু ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে রাস্তা ক্রমশ বেশি খাড়া হতে থাকল। মনে রোমাঞ্চ— সামনে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম গিরিপথ চাংলা পাস, উচ্চতা ১৭৫৮০ ফুট।

চাংলা পেরিয়ে পড়ল জিংগ্রাল, ডারবাক গ্রাম। বিশাল একটা নদীর শুকনো বুকে নেমে বড়-ছোট নুড়ি ছিটকিয়ে ছুটতে থাকল স্করপিও। এলাম টাংগসে গ্রামে। এখানে জামবারলিং গার্ডেন রিসর্টে ঘরোয়া পরিবেশে আমাদের জন্য  লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছে।

অন্ধকারের আগেই আমাদের পৌঁছানোর কথা প্যাংগং, কিন্তু আচমকা এক যান্ত্রিক গোলমালে সব ওলটপালট হয়ে গেল। গাড়ির ব্রেক-শু খুলে পড়ে গেল আচমকা। পাহাড়ি পথে ব্রেক-শু বিহীন গাড়ি! কিন্তু কিছু করার নেই। স্বাভাবিকের চেয়ে অতি ধীর গতিতে গাড়ি চলতে লাগল। পথ বিপদসঙ্কুল। ধু ধু মরুর মতো এক প্রান্তরে এসে কিছুদূর পাওয়া গেল মসৃণ পথ। তার কিছু পরেই আবার ভাঙা পাহাড়। লাদাখের এই অঞ্চলে হিমালয়ের মাথায় বরফ, গায়ে বরফ। তবে  লাগোয়া বালির ধু ধু মরুপ্রান্তর আমাদের পিছু ছাড়ল না। প্রান্তরে  বুনো গাধার দেখা পাচ্ছিলাম। হঠাত্‌ উঁকি মারল হলদে রঙের বেজির মতো এক প্রাণী, মারমট।  যেন দু’হাত পেতে দাঁড়িয়ে বলছে, একটু খাবার দেবে?  দলে দলে চরছে কালো চমরি গাই। এই মরুপ্রায় অঞ্চলে এরা বুনো লাইকেন ছাড়া আর কী খেতে পায় কে জানে।

সন্ধ্যের  আগেই পৌঁছলাম প্যাংগং। দূর থেকে বরফের মুকুট পরা বাদামি পাহাড় ঘেরা প্যাংগং লেকের সমুদ্রনীল জল চোখে পড়তেই  উল্লসিত আমরা। এমন শীতল মরুভূমিতে এতবড় প্রাকৃতিক জলাশয়? চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কে যেন কালির দোয়াত উল্টে দিয়েছে লেকের জলে। লেকভিউ পথের ধারে আমাদের অস্থায়ী আস্তানা হিমালয়ান ট্যুরিস্ট ক্যাম্পের তাঁবুতে।

আদিগন্ত বিস্তৃত হিমালয়ের গিরিমালা। বাদামি। তার কোলে এই লেক। সূর্য ততক্ষণে মাথার ওপর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সরে এসেছে। নীল আকাশের ছায়া  পড়েছে লেকের জলে। জলের রং কী অনুপম! কাছে বর্ণহীন, মধ্যে অ্যাকোয়ামেরিন, তারপর টারকোয়াইজ আর সবচেয়ে দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ইন্ডিগো ব্লু। কেমিস্ট্রিল্যাবে কপার সালফেটের এমন নীল দেখতাম। যেন ফোটোশপ করা আকাশ, পাহাড় আর জল। লেকের জলে পা  ডুবিয়ে অবশ হল সারা শরীর। জলের স্রোতে হাওয়ার দোলা আর তিরতির শব্দ। মাথার ওপর দিয়ে সি-গাল উড়ছে অজস্র। শীতকালে এই লেক জমে বরফ হয় আর তখন এর ওপর দিয়ে গড়গড়িয়ে গাড়ি করে লেকটাকে চক্কর মেরে আসা যায়।

দূরে পাহাড়ের মাথায়  বরফ। জল ছুঁয়ে একফোঁটা জিভে ঠেকাতেই নোনতা স্বাদ পেলাম। ভারতের আর কোথাও তুষারাবৃত হিমালয়, লবণাক্ত লেক আর এমন শীতল মরুভূমির একত্র সহাবস্থান আছে বলে আমার জানা নেই। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পের তাঁবু থেকে মুখ বের করে দেখি পাহাড়ের রং সোনালি বাদামি হয়ে গেছে। ইয়েলো অকার। জলের রং তখন কালো আর নীল আকাশে সোনালি মেঘের ভেলা। দিকচক্রবাল চিকচিক করছে সোনায়।

সূর্যাস্তের সেই প্রদোষে ক্রমশ সূর্য ঢলে পড়ল পাহাড়ের পেছনে আর শুরু হল জলের রং বদলানো। দিনের শেষ আলো অকৃপণভাবে রং ছড়িয়ে দিল পাহাড়ের গায়ে। ছবি তোলা শেষ হলে এল গরম চা-বিস্কিট। সন্ধ্যে হল সাতটায়। ফিরে এলাম তাঁবুর মধ্যে। হাওয়া তখন ধারালো হয়ে উঠেছে। তাপাঙ্ক নামছে হু হু করে। পর্যাপ্ত গরম জামাকাপড় না থাকলে ঠান্ডা লাগবে অবধারিত।

রাতে আমরা তিনজন থাকব সুখী তাঁবুকোণে। শুক্লা তৃতীয়ার একফালি চাঁদ দেখতে তাঁবুর বাইরে চেয়ার পেতে মুড়িসুড়ি দিয়ে বসি। দূষণমুক্ত ঘুটঘুটে আকাশে ফুটফুটে  তারারা। আমাদের শহুরে চোখ এ আলো দেখতে অনভ্যস্ত। ছেলে ও বাবা মনের আনন্দে সেলফোনের গুগ্‌ল স্কাইম্যাপ থেকে দিব্যি জিপিএস দিয়ে আকাশের দিকে তাক করে তারা চিনছে। একে একে দৃষ্টিগোচর হল সপ্তর্ষিমণ্ডল, ধ্রুবতারা, চিত্রা, অভিজিত্‌, ক্যাসিওপিয়া। তারপরেই হঠাত্‌ দেখি এক কৃত্রিম উপগ্রহ আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা মেঘমুক্ত আকাশে পাড়ি দিচ্ছে।

শহর কলকাতায় এ চিত্র সত্যি বিরল। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে র্ইলাম। তারা গোনার শেষে আবার সেই ঠান্ডার বৈতরণী সাঁতরে তাঁবুতে ফিরে ডিনার। রাত যত বাড়ছে ঠান্ডা বাড়ছে প্রচণ্ড। তাঁবু হাওয়ায় কাঁপে। তাপমাত্রা সাব-জিরোয়। টেন্ট-বয় জানাল, একবালতি জল ভরে রাখতে, কারণ ভোরবেলায় কলের জল জমে  যায়। তাঁবুর মধ্যে যথাসময়ে প্রত্যেকের জন্য একটি করে হট-ওয়াটার ব্যাগ পৌঁছল। পরমানন্দে টুপি-মোজা-সোয়েটার চাপিয়ে গরমজলের ব্যাগ বগলে করে লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে সে রাতটা শীতের মোকাবিলা করা গেল।

সেলফোনে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। ভোর পাঁচটায় তাঁবুর বাইরে উঁকি দিতেই চমকে উঠলাম। সামনে লেক, লেকের পেছনে হিমালয়ের বাদামি-রঙা দেওয়াল। আমাদের তাঁবুর পেছনে হিমালয়ের গিরিশ্রেণির মাথা সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা। সূর্য উঠবে পুবদিক থেকে, সেই আলো প্রথম গিয়ে আছাড় খাবে পাহাড়ের মাথায়। আর তখুনি শুরু হবে জলে রঙের খেলা। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে জলের দিকে চোখ পড়তেই দেখি সে তখন কালোমুখ করে বসে আছে। অগত্যা সূর্যোদয়ের অপেক্ষা।

পাঁচটা বেজে পনেরো মিনিটে পশ্চিমের পাহাড় যেন একটু একটু করে উজ্জ্বল আভা ধরতে শুরু করল। সূর্য কিন্তু পুবের পাহাড়ের পেছনে মুখ লুকিয়ে। তখনও দৃশ্যমান নয়। জল যেন ধূসর শ্লেটপাথর।  ধীরে ধীরে পশ্চিমের পাহাড়ের পুবমুখী গা বেয়ে সূর্যরশ্মি নেমে এল আর রং ছড়াতে লাগল লেকের জলে। জলের রং বদলে গিয়ে ধীরে ধীরে অ্যাকোয়ামেরিন ব্লু হল। সমস্ত চরাচর ভাসছে সোনালি আলোর ছোঁয়ায়। রং-তুলির টানে একটা ক্যানভাস যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে চোখের সামনে। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই রংবদল দেখলাম। তারপর তাঁবুতে ফিরে ধূমায়িত চা। এবং আবার সেই বিস্তীর্ণ নীলের সামনে এসে বসা।

প্যাংগং থেকে পরদিনই ফিরতে হবে লেহ্‌। ফেরার পথে থ্রি ইডিয়টসের শ্যুটিং পয়েন্ট ছুঁয়ে যাওয়া হল। রোদগলা সকালে। লেকের এই পাশে উড়ছে সিগালের ঝাঁক। অচেনা কিন্তু অপরূপ হাঁসের দেখা পেলাম। জলে এসে বসছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অদ্ভুত ভাললাগা ছড়ানো সেই নীল নির্জনে।

লিখেছেনঃ ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

Leave a Comment
Share