নেটওয়ার্কের বাইরে একদিন

আমাদের মানে আমি আর আমার বরের ট্যুর প্ল্যানের প্রথম দিনে ছিল খাগড়াছড়ি ভ্রমণ, ছিলাম মাউন্ট ইনে। দ্বিতীয় দিন সকালে উঠলাম ৭ টা নাগাদ। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে চলে এলাম শাপলা চত্বর। ইচ্ছে ছিল কোন একটা গ্রুপে ঢু মেরে জিপে চড়ে সাজেক যাবো। কিন্তু শেষমেষ নিজেদের মত ঘোরার ইচ্ছায় একটা সিএনজি ভাড়া করে ফেললাম। লিখিত ভাড়া ৫২০০ হলেও একটু দেনদরবার করে আমরা ৪৫০০ টাকায় তাকে রাজি করিয়ে ফেললাম। তারপর পাশের মনটানা রেস্টুরেন্টে নাশতা করে আটটার একটু পরেই বেরিয়ে পড়লাম সাজেকের উদ্দেশ্যে। কারণ আপনারা সবাই জানেন দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকর্ট ছাড়ে সাড়ে দশটা নাগাদ! সবাই হয়তো জানেন সাজেক রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন যেটা কিনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন! আর উইকি পিডিয়ার মতে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৭২০ ফিট।

দীঘিনালা বিজিবি ক্যাম্প এ নটার পরেই পৌঁছে গেলাম। ওখানে একটু বসে পুডিং গলাধঃকরণ করলাম। এরপর দীঘিনালা সিক্সার সেনাবাহিনী ক্যাম্পের সামনে দাড়ালো আমাদের সিএনজি। এখান থেকেই সকলকে একসাথে সাজেকের উদ্দেশ্যে বেরুতে হবে। পর্যটকদের ঘিরে বাজার জমে উঠেছে দেখলাম। কেউ পেঁপে খাচ্ছে, কেউ পাহাড়ি লেবু, কেউ বা কলা, কেউ আবার আমাদের মতে বাঁশের মধ্যে চা। কিন্তু এটার তেমন স্পেশালিটি নেই, সাধারণ মেশিন চা ই বাঁশের মধ্যে পরিবেশন করা হয়। কাজেই না খেলেও চলবে!

যাই হোক সাড়ে দশটার কিছু পর এসকর্ট যাত্রা শুরু করলো। প্রথমে বাইক, পরে প্রাইভেট মাইক্রো, কার, এরপর জিপ আর সবশেষে সিএনজি সাজিয়ে রওনা দিলো এসকর্ট। অর্থাৎ আগে পৌঁছেও কোন লাভ নেই!

যাত্রাপথে ই সাজেকের অর্ধেক সৌন্দর্য মনে হলো আমার কাছে। পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে এক দুটো বাঁশের চাটাই ঘেরা ঘর, সেসব ঘরের চারপাশে রকমারি ফুলের বাগান আর বাড়ির দরজায় দাড়ানো বা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শিশুদের হাত নাড়া সত্যিই মনোমুগ্ধকর! মনে হচ্ছিল এমন পথের ধারে একটা কুড়েঘর তুলে থাকলে নেহাত মন্দ হতনা!

মাঝখানে গাড়ির ইঞ্জিন ঠান্ডাকরা বিরতি ছিল মিনিট বিশেক। তাই পৌঁছুতে দুপুর একটা পার হয়ে গেল। প্রথম দেখায় সাজেককে বস্তি ধরনের মনে হলো। ভ্রমণপিপাসুরা আমাকে গালমন্দ করবেন হয়তো! কিন্তু রিসোর্ট গুলো খুব অল্প জায়গায় গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ আবার বাঁকা ভাবে উঠে দাড়িয়েছে। খুবই স্বল্প জায়গায় আমাদের সিএনজি ড্রাইভারের মতে ১৩৮ টার মত নাকি রিসোর্ট আছে! এখনই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেওয়া উচিত নইলে সাজেকের পরিবেশ নষ্ট হতে আর বেশি দূর নেই!

যাই হোক আমাদের রিসোর্ট খুঁজে পেতে একটু বেগ পেতে হলো – সূমুই ইকো রিসোর্ট যার কোন সাইনবোর্ড নেই। রিসোর্টটা নতুন, রিসেপশন ও নেই তাদের। রুমে ঢুকে প্রথমেই আশাহত হতে হলো। ছবিতে ঘরের আকার যেমন মনে হয়েছিল বাস্তবে তার চেয়ে ছোট, তার উপর ভ্যাপসা গরম। মনটা একটু দমে গেল,কিন্তু অত্যাধুনিক ফিটিংস সহ ওয়াশরুম দেখে একটু স্বস্তি পাওয়া গেল। সাজেক এ নাকি পানির সংকট। বেশ কিছু নিচ থেকে পানির ট্যাংক ভরে ভরে পানি আনতে হয়। তাই শাওয়ার স্পিড কম ! রুমে ঢুকেই একটু রেস্ট নিয়ে খেতে বের হলাম। গেলাম সকলের সাজেশনকৃত মনটানা রেস্টুরেন্টে, এটার গুগল রিভিউ ও সবচে বেশি ছিল। কিন্তু খাবারের মান ভালো লাগলো না। খাগড়াছড়িতে বেশিরভাগ হোটেলেই চিকন চালের আতপ চাল দেয় কিন্তু এখানে দেখলাম মোটা চাল। খেয়ে হতাশ ই হলাম। খাওয়ার পর  পাশের এঞ্জেলস টি গার্ডেনে কফি মেশানো চমৎকার দুধ চা খেয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি নেমে গেল।

তারপরই সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! দেখলাম মেঘেরা সাজেকের রাস্তা পার হচ্ছে! ধোয়ার মত উরো মেঘ! বিশ্বাস ই করতে পারছিলাম না এগুলো মেঘ। রুমে ফিরে দেখলাম বারান্দা টা সাদা মেঘের উপর ভাসছে! আহা! আগের দুঃখ কষ্ট মেঘের মতোই উবে গেল! সাজেকে নাকি দুই দিন থেকেও অনেকে মেঘের দেখা পায়না। কিন্তু কপাল ভাল আমাদের। পৌঁছানোর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মেঘ দর্শন হলো !

বিকেলে হালকা বৃষ্টির মধ্যেই কংলাক পাহাড় দর্শনে বের হলাম ড্রাইভারের ভরসায় ! এই বৃষ্টিতে নাকি পাহাড় ভেজে না! আসলেই তাই! দুজন দুটো বাঁশের লাঠি নিয়ে কংলাক পাহাড় বিজয়ে রওনা দিলাম। এই পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফিট অর্থাৎ সাজেক থেকেও প্রায় ৮০ ফিট উচু! কিন্তু খুব বেগ পেতে হলনা পাহাড় চূড়ায় পৌঁছুতে। বেশ কিছু ছবি টবি তুলে আবার নামলাম। বৃষ্টি পড়ছিল অনবরত ই!

এরপর ঢু মারলাম হেলিপ্যাডে! হেলিপ্যাডে বান্দরবানে ও দেখেছিলাম । তাই হেলিপ্যাডের থেকে আশেপাশে বসা খাবার এর প্রতি আকর্ষণ ছিল বেশি। বাঁশ কড়লের  রোল খেলাম একটা ৪০ টাকা দিয়ে। বেশ সুস্বাদু! চেখে দেখতে পারেন কিন্তু! সাজেক শহরে এসে থিং হং কফি শপে দুই কাপ আসামি চা খেয়ে রুমে ফিরলাম। দোকানের মালকিনকে জিজ্ঞেস করতে জানলাম থিং হঙ মানে নাকি ” রাশিয়া ছাড়!”

রাতের খাবারের অর্ডার ছিল সাজেক পেদা টিং টিং এ। পেদা টিং টিং মানে আগেই জানতাম – পেটপুরে খা! এখানকার খাবারের মান কিন্তু ভালো লাগলো। মনটানাতে না খেয়ে এখানেই খাওয়া দাওয়া সারতে পারেন। খাবার খুব হালকা, কম স্পাইসি কিন্তু বেশ সুস্বাদু!

সাজেকে বোমাং চিফের বাড়িতে দেখলাম অনেক রকম কুকুর বিড়াল! বুঝলাম চিফ মানুষটা বেশ প্রানিপ্রেমী! এমনকি সাজেকের রাস্তায় ও দুতিনটা মিক্স ব্রিড এর কুকুরের সন্ধান পেলাম!! ভাবছিলাম একটা ব্যাগে পুড়ে নিয়ে এসে পড়ব কিনা!

পরদিন ভোর পাঁচটায় উঠে মেঘ দর্শন করলাম। বারান্দার সামনে দিয়ে মেঘেরা দৌড়ে যাচ্ছে, কখনো যাচ্ছে হেঁটে! অপার্থিব সৌন্দর্য! এমন দৃশ্য দেখতেই আবার সাজেক অসতেহবে ঠিক করলাম! ছয়টায় ভাবলাম ঘুমিয়ে নি ঘন্টাখানেক! ঘুমাতে গিয়েই আবার বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির পর সাদা তুলোয় ভরে গেল বারান্দা! মেঘ দেখতে দেখতেই কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে! সাড়ে সাতটার দিকে উঠে বেরিয়ে পরলাম। এবারের নাস্তা করলাম chimber restaurant এ ! পাহাড়ের পাশে বসেই নাস্তা সেরে গেলাম লুসাই গ্রাম। প্রবেশ মূল্য ৩০ টাকা!  বেশ সাজানো গুছানো অনেক গাছের সমারোহে লুসাই গ্রামের আদলে তৈরি একটা পার্ক। চাইলে লুসাই রাজাদের ড্রেস ভাড়া নিতে পারবেন ১০০ টাকা দিয়ে, বনে যেতে পারবেন ২০ মিনিটের লুসাই রাজা বা রানি!

সাড়ে দশটার দিকে এসকর্ট ছেড়ে গেল আর আমরা বের হলাম এগারোটা দশে। অর্থাৎ ছেড়ে যাওয়ার বেলায় সাজেকের নিয়ম একটু ঢিলে!

সবশেষে ছুটির দিনে সাজেক গেলে অন্তত এক মাস আগে রিসোর্ট বুকিং দিলে পছন্দসই রিসোর্ট পাবেন!

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ sajek