উটি এর পথে ছুটি

ব্যাঙ্গালোর (Bangalore) থেকে উটি প্রায় ২৬৫ কি.মি। আগের দিন রেন্ট-এ-কারের সাথে কথা বলে একটা ফোর্স ট্র্যাভেলার গাড়ি ঠিক করলাম আমরা। ভোর ৪ টায় ড্রাইভার চন্দ্র আমাদের অপেক্ষায় হোটেলের সামনে উপস্থিত। যে যার ব্যাগ প্যাক নিয়ে বের হলাম, শুরু হলো উটির পথে আমাদের যাত্রা।

চারদিক স্পষ্ট হওয়ার আগেই ব্যাঙ্গালোর (Bengaluru) এর কোলাহল এড়িয়ে এসেছি আমরা। ভোরের আভা আমাদের গাড়িকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঐতিহাসিক শহর মাইসোরের পানে। উইকিট্র্যাভেলস্‌-এর মতে মাইসোর (Mysore) ইন্ডিয়ার দ্বিতীয় পরিচ্ছন্ন শহর। বাস্তবেও তার প্রমাণ পেলাম।

প্রায় দেড় যুগ আগে বিটিভির বেশ জনপ্রিয় একটা সিরিয়াল ছিল ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’। “সুর্য্য আমি, অই দিগন্তে হারাবো।। অস্তমিত হবো, তবু ধরণীর বুকে চিহ্ন রেখে যাবো…” টিপু সুলতান (১৭৫০-১৭৯৯) ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর সালতানাতে মাইসোর-এর প্রতাপশালী শাসক। চতুর্থ এংলো-মাইসোর যুদ্ধে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।

ইতিমধ্যে আমরা চলে এসেছি বিখ্যাত মাইসোর প্যালেস (Mysore Palace) এর সামনে। জীবনে এত্তবড় প্রাসাদ এই প্রথম দেখছি তাই অনুভুতিটাও অতুলনীয়। তাজমহল-এর পর দর্শনার্থীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান এটি, প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ পর্যটক এখানে আসে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা আবার চললাম উটির পথে। মাইসোরে অনেক ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান আছে, সব ঘুরে দেখতে এক-দুই দিন লাগবে। হাতে সময় নাই, লিস্ট এ থাকলো।

মাইসোর প্যালেস

বান্দিপুর ন্যাশনাল পার্ক (Bandipur National Park) এর মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম একপাল হরিণ রাস্তা পার হচ্ছে। এই পুরো রাইডটা বেশ উপভোগ করলাম। দুইদিকে বন, তার মাঝে আকাবাকা খালি রাস্তা, হঠাৎ হঠাৎ বন্য পশুপাখির উপস্থিতি সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর।

বান্দিপুর ন্যাশনাল পার্কের হরিণের পাল

বেশ কিছুক্ষন চলার পর আমরা তামিল নাড়ু (Tamil Nadu) রাজ্যে প্রবেশ করলাম। দুপাশে উঁচু পাহাড় আর তার গা বেয়ে আমাদের উর্দ্ধমুখী যাত্রা আমাকে বান্দরবন থেকে চিম্বুকের রাস্তার কথা মনে করিয়ে দেয়। রাস্তার পাশে ঘন পাইন গাছের বাগান। পথে একটা উঁচু ভিউ পয়েন্ট দেখে আমরা থামলাম। দৃষ্টির সীমানা জুড়ে ছবির মতো সুন্দর তামিল নাড়ুর প্রকৃতি।

পাইন গাছের সারি
ভিউ পয়েন্ট থেকে তামিল নাড়ুর ছবি

উটি (Ooty) তামিল নড়ুর অন্তর্গত নীলগিরি জেলার প্রধান নগর। উটির প্রকৃত নাম উধাগামান্ডালাম (Udhagamandalam), ব্রিটিশরা বলতো ‘উটাকামান্ড’ টোডা ভাষায় এর অর্থ ‘পাহাড়ের মধ্যে বাড়ি’। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,২৫০ মি. উচ্চতায় সবুজ পাহাড়ি প্রকৃতির এক অপরুপ লীলাভূমি উটি। ১৮শ শতকের শেষ দিকে টিপু সুলতানের পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা এই অঞ্চল দখল করে নেয়। সর্বপ্রথম টোডা উপজাতি এখানে বসবাস শুরু করে, এখন বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের বাস।

রাস্তার ধারে হঠাৎ চোখে পড়া চা বাগান
উটির অপরূপ সৌন্দর্য্য

দুপুর দুইটার দিকে আমরা উটি পৌঁছুলাম। উটির বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, গাছপালা, প্রকৃতি সবকিছুই বেশ মনোহারী। যেতে যেতে বেশ কিছু চা বাগান, পাহাড়ি লেক, পাহাড়ের ঢালে লোকালয়, ক্ষেত-খামার চোখে পড়লো। এই সময়টাতে উটির আবহাওয়া বেশ স্বাস্থ্যকর, সামান্য ঠান্ডাও পড়েছে। তবে উটি ভ্রমনের মোক্ষম সময় ডিসেম্বর থেকে মার্চ । দেখতে দেখতে পেটের ভেতরের যন্ত্রপাতিগুলো ফুয়েলের অভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম উদরপূর্তি করতে। আমাদের সাথে কোন গাইড নেই, কোন পূর্বপরিকল্পনাও করা হয়নি। তাই ঝটপট ঠিক করে ফেললাম উটি আবিষ্কার করবো নিজেদের মতো।

প্রথমেই গেলাম কাছাকাছি একটা লেক দেখতে। চমৎকার সুন্দর এই লেকে দর্শনার্থীদের জন্য বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে। যারা স্ত্রী বা জিএফ এর সাথে যাবেন তাদের জন্য রিকমেন্ডেড।

উটি লেকের বোট

পরের আকর্ষণ উটির সবচেয়ে উঁচু স্থান ডুড্ডাবেট্টা পিক (Doddabetta Peak)। প্রায় ২,৬২৩ মিঃ উচ্চতা থেকে উটির বিস্তৃত পাহাড়ি বনাঞ্চল, লেক, লোকালয় সবকিছুর একটা অবিস্মরণীয় ছবি উপভোগ করলাম আমার চোখের ওয়াইড এংগেল লেন্স দিয়ে। সত্যি অনিন্দ্য সুন্দর এক দৃশ্য। এখানে একটা হারবাল ও ভেষজ তেলের দোকান আছে। যারা মাজা ব্যাথা, কোমর ব্যাথা, গিটে গিটে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, বাতের ব্যাথায় ভুগছেন; দীর্ঘদিন গুলিস্তান থেকে সান্ডার তেল, জোঁকের তেল কিনে মালিশ করছেন; অষ্ট ধাতুর আংটি, তাবিজ কবজ লাগাইছেন কিন্তু কোন ফল পাননি; তারা একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

ডুড্ডাবেট্টা পিক

উটিতে গেলে এখানকার হোমমেড চকলেট কিনতে ভুলবেন না। বাহারি দেখতে আর রকমারি স্বাদের এই চকলেট বেশ বিখ্যাত। এর এমনিই যাদুকরি স্বাদ যে আপনাকে আত্মভোলা করে দিবে। বিভিন্ন ধরনের হ্যান্ডিক্র্যাফ্‌টও পাওয়া যায় এখানে।

পরদিন নাস্তা সেরে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ বেরিয়ে পড়েছি কারন উটিতে আজই আমাদের শেষ দিন। প্রথমেই যাব সেন্টিনারি রোজ পার্ক (Government Rose Garden)। কতৃপক্ষের মতে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম গোলাপের বাগান। ভেতরে ঢুকলেই বুঝবেন কেন এই কথা বলছে। প্রায় ৪ হেক্টর জমির ওপর ২০,০০০ প্রজাতির বাহারি রঙের গোলাপের বাগান এটি।

সেন্টিনারি রোজ পার্ক

এরপর গেলাম ওয়াক্স মিউজিয়ামের (Wax World Museum)। এখানে ভারতীয় ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা হয়েছে মোম এর কারুকাজের মাধ্যমে। ছোট হলেও মিউজিয়ামটা বেশ ভালো লেগেছে আমার।

ওয়াক্স মিউজিয়াম

ফেরার পথে থামলাম স্যুটিং স্পট-এ। বিশাল এলাকা জুড়ে উঁচু বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর, দূরে ছোটবড় পাহাড়ের মেলা, সবমিলিয়ে স্যুটিং এর জন্য পারফেক্ট। উইন্ডোজ এক্সপির ডিফল্ট ওয়ালপেপার এর সাথে হুবহু মিল আছে জায়গাটার।

স্যুটিং স্পট থেকে উটির দৃশ্য

উটি ছেড়ে বেশ কিছুদূর চলে এসেছি, পথে একটা লেক দেখে থামলাম। সামনে এগতেই দেখি কলকাতার এক দাদা। আমাদের বাংলায় কথা বলতে দেখে বললেন “ওদিকে যেয়ে লাভ নেই, দু দুটো টাকা দিয়ে টিকিট করলাম পুরটাই জলে গেছে, দেখার কিচ্ছু নেই”। আরও এগিয়ে দেখি পাহাড় আর লেকের সমন্বয়ে এক অনবদ্য দৃশ্য। হাজার টাকায়ও এর মূল্য পরিমাপ করা যাবেনা।

উটি থেকে ফেরার পথে লেকের ছবি

বিকেলের দিকে মাইসোর পৌঁছে কিছু কেনাকাটা করলাম, এখানকার সিল্ক এবং কাপড় বেশ নামকরা। ফিরতে ফিরতে চোখে শুধুই ভাসছে উটির নৈসর্গিক রূপ। সুযোগ পেলে আমি আবার যাব উটির অদেখা সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে।

Leave a Comment
Share