নেপালের ডাইরিঃ হিমালয়ের খোঁজে হিমালয়ের দেশে

গত ২০১৭ এর ঈদুল আযহার ছুটিতে নেপালে (Nepal) যাবার সুদৃঢ় এক প্লান ছিল আমাদের। ঘটনাক্রমে সামসময়িক জটিলতার কারণে সেবার ভুটান ঘুরে আসলাম ইন্ডিয়ার বাই রোডযোগে। কিন্তু হিমালয় কন্যা নেপালের জন্যে মনের ভেতর এক ধরণের চাঞ্চল্য ছিল তখন থেকেই। ডিসেম্বরে  বিজয় দিবসের অফারে আঠার হাজারের টিকেট পাই পনের হাজারে। হুট করে কেটে ফেলি ছয়জনের জন্যে।

ভুটান সফরের মত এবারও উদ্যোক্তা আরমান ভাই, পিছন থেকে গনেশ সরকার, সিফাত আর আমি পুরনো সাথী। নতুন করে যোগ হয় ট্রিপন দা আর নিলয়। ছয় জনের দল, সফরের সম্ভাব্য সময় নিই ২৩-০৩-১৮ থেকে ২৯-০৩-১৮ মোট সাত দিন। এ দিন গুলোতে ঘুরে বেড়াব সেখানের রাজধানী কাঠমান্ডু এবং প্রখ্যাত দুটি শহর পোখারা এবং নাগরকোট আর তার আশ পাশ জুড়ে।

বর্ষার শেষ যৌবনের মত শান্ত হয়ে থেমে থেমে আসা নদীর স্রোতের মত দিনগুলোর গতি যেন মন্থর, ভেতরকার উত্তেজনা যেন উত্তপ্ত লাভার মত টগবগ করছিল। এমনি করে আমাদের সফরের ক্রান্তিকাল চলে এল কিন্তু অসুস্থতার দরুন সিফাতের যাওয়া অনিশ্চিত, শেষমেশ  সিদ্ধান্ত হলো তাকে ছাড়াই। কলম –খাতায় আর গুগল সহযোগে আমরা ধারণামতে প্ল্যানের নিখুঁত ছক একে ফেলেছিলাম আগেই,পথের দুরত্ব, ট্রান্সপোর্টেশন, প্লেসেস, খরচাদি ইত্যাদি। বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জেনেছিলাম নেপালে খাবারের দাম অনেক বেশি, তাই বাজেট অল্প হওয়ায় কিছু রেডি নুডুলস, সুপসহ হাল্কা খাবারের নিয়েছিলাম খরচের মাত্রা কমিয়ে আনতে।

নেপাল আয়তনে প্রায় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। মানে আস্ত একটা বাংলাদেশ, পরিসংখ্যানে জনসংখ্যা প্রায় পৌণে তিন কোটি। ধর্মীয় অংশের দিক থেকে ৮১% হিন্দু এবং ৯% বোদ্ধ আর ইসলাম ধর্মাবলম্বী আছে সংখ্যায় ৪%। নেপালের স্বস্বীকৃত ভাষা হচ্ছে ‘নেপালি ভাষা’। কিছুটা হিন্দি মিশ্রিত, এছাড়াও কোথাও কোথাও ভোজপুরি, মারাঠিও শোনা যায়। কিন্তু সবখানেই হিন্দি  ব্যবহার অবাধে করা যাবে। নেপালের জাতীয় পোশাক হচ্ছে দোরা সুরায়াল, কোর্তার উপরে কোট এবং টুপি। এখানকার প্রসিদ্ধ খাবার হচ্ছে মম। কিন্তু বাঙালির স্পাইসি মুখে তা অতটা সুস্বাদু বোধ করি মনে হবে হবে না। তাছাড়া হরেক রকম সবজি দিয়ে ডাল ভাত তরকারী  আছেই।

সার্কভুক্ত দেশগুলর জন্যে নেপালের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা রয়েছে, ‘ফ্রি ভিসা বা গেটিস ভিসা অন আরাইভাল’। প্রতিবছর প্রথমবারের জন্যে এ সুবিধা রয়েছে, দ্বিতীয়বারের জন্যে টাকা গুনতে হবে পনের দিনের জন্য ২২০০ ত্রিশ দিনের জন্য ৩৫০০ আর তিন মাসের জন্য পুরো নয় হাজার টাকা আর প্রতিবারই বিদেশীদের জন্যে গুনতে হবে নগদ ডলার।

কাঠমান্ডুর পথে ২৩-০৩-১৮

সকাল আটটায়  বাসা থেকে রওনা দিই দুপুর একটার ফ্লাইটের উদ্দেশ্যে। জীবনের প্রথম প্লেন ভ্রমণের উত্তেজনা ভেতরে  কাজ করছিল বহু মাত্রায়। যথারীতি শাহজালাল এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোর্ডিং পাস নিয়ে আমরা  আমারা নির্দিষ্ট সময়ে আকাশে ওড়বার আশায় বোর্ডিং লাউঞ্জে বসে রইলাম।

এয়ারপোর্টের ভেতরকার  নির্দেশনা নিম্নে দেওয়া হল –

  • প্রথমে আপনি বহির্গমন গেট দিয়ে ফ্লাইট এর সময়ের কমপক্ষে ৩ ঘন্টা আগে বিমানবন্দরে প্রবেশ করবেন।
  • প্রবেশের পরে সাথে সাথে মালামাল স্ক্যানিং করাবেন এবং স্ক্যানিং ট্যাগ লাগাবেন এসময় লাগেজ সতর্কতার সাথে নজরে রাখবেন।
  • এরপর আপনি রো এরিয়াতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজের কাউন্টারে গিয়ে টিকেট এবং পাসপোর্ট দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করবেন এবং চেক-ইন লাগেজ কাউন্টারে জমা দিবেন।
  • এরপর আপনি বোর্ডিং কার্ড, পাসপোর্ট, ভিসা এবং পুরণকৃত ইডি কার্ড সহ যাবতীয় কাগজ হাতে নিয়ে এবং হ্যান্ড লাগেজ সহ ইমিগ্রেশনে নির্ধারিত লাইনে দাড়াবেন এবং ইমিগ্রেশন করাবেন। আপনার পাসপোর্টে একটি বহির্গমন সিল দেয়া হবে এবং তারপর পাসপোর্ট বুঝে নিন।
  • আপনি উড়োজাহাজ যে বোর্ডিং ব্রিজে লাগিয়েছে সেখানে গিয়ে আই এন এস চেকের মাধ্যমে ফাইনাল স্ক্যানিং করে বোর্ডিং লাউঞ্জে আসন গ্রহন করবেন।
  • এরপর সময় হলে উড়োজাহাজের গেট খুলে দিবে এবং আপনি আপনার বোর্ডিং কার্ডে প্রদেয় আসন নাম্বার অনুযায়ী উড়োজাহাজে আসন গ্রহন করুন। আপনার হ্যান্ড লাগেজ মাথার উপরে লাগেজ চ্যাম্বারে রাখুন। ল্যাপটপ ব্যাগ সিটের নীচেও রাখতে পারেন। সর্বশেষে সিট বেল্ট বেধে উড়োজাহাজে বসে থাকুন।

চোখের সামনে  সুবিশাল রানওয়ে আর খানিক বাদে বাদে প্লেনের উঠা-নামা মুখগহবর কিঞ্চিত খুলে বড় বড় চোখে দেখছিলাম এসব। নির্ধারিত সময়ে ডাক এলো, মধ্যম সাইজের বাসে চড়ে বিমানের কাছে যেয়ে নামলাম আমরা, ক্যাপ্টেন এবং তার সহযোগী উষ্ণ সংবর্ধনা জানালেন। বিমান বাংলাদেশ দেশের একমাত্র সরকারী এয়ারলাইন্স, বিমানের অবস্থাও একবারে সরকারী অফিসের মতই নড়বড়ে। প্লেনে আমার অভিজ্ঞতা যেহেতু প্রথম, বুঝতে পারলাম ছয় নাম্বার বাস কখনও আকাশে উড়ে প্লেনের বেশ ধরে।

যাবতীয় ফর্মালিটিস শেষে বিমান ওড়ার জন্যে তৈরি এমন সংকেত জানালেন পাইলট, আকাশে পরিভ্রমণের সময় ১:১৫ মিনিটের। চৈত্রের আকাশ ছিল স্বচ্ছ ,পরিস্কার চকচকে, মাটি ছেড়ে ডানা মেলতেই চোখের সামনে সব ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে একদম মিইয়ে গেল এরপর শুধুই নীল, কখনও শুভ্র মেঘের নানান আকৃতির মুখচ্ছবি। অবাক নয়নে চেয়ে ছিলাম জানালা দিয়ে। মিনিট ত্রিশ বাদে বিমান কর্তৃপক্ষ এক আধা কাঁচা শুকনো নামে মাত্র স্যান্ডুইচ দিয়ে গেলেন, একে তো ডিস্কাউন্টের টিকেট তার উপর আবার খাবার নিয়ে উন্নাসিকতা একদম বেমানান ভেবে চুপচাপ খেয়ে নিলাম। ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নেপালের একমাত্র আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট, তৎকালীন একটি ভয়ানক দুর্ঘটনার  জন্য ল্যান্ডিঙয়ে কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম, এয়ারপোর্টটা তুলনামূলক ছোট, সহি সালামতে নেমে চলে গেলাম সংলগ্ন অফিসে ভিসা প্রসেসিংয়ে। 

ভিসার জন্যে আবেদন করার সুবিধার্থে কিছু স্বয়ংক্রিয় মেশিন রয়েছে যেখানে সঠিক তথ্য প্রদান করে ছবি তুলে টোকেন নেওয়া যায়, অথবা আশপাশে বিভিন্ন জাগায় ভিসা আবেদন ফর্ম রাখা আছে হাতে পূরণ করেও নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো যায়। প্রয়োজন কেবল এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি এতে সময় কিছুটা বেশি যাবে। পিক সিজন থাকায় টুরিস্টের ভিড় ছিল বেশ, নানা দেশের মানুষ, নানায় ভাষায় ব্যক্ত করা তাদের মনোভাব মনোযোগ দিয়ে অবলোকন করছিলাম। সিরিয়ালে দাঁড়ানোর ব্যাপারখানা ছাড়া সব কিছু দ্রুতই হয়ে গেল। চেকিং পেরিয়ে বাইরের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম এক পাশে টুরিস্টদের জন্যে তথ্যভিত্তিক কিছু প্রসপেক্টাস রেখে দেওয়া হয়েছে, বিনামূল্যে, বেছে বেছে কয়েকটা নিলাম।

ঘড়ি জানাচ্ছে প্রায় তিনটে, বাংলাদেশের সাথে এখানকার সময়ের হেরফের মাত্র পনের মিনিটের। এয়ারপোর্টের মুল ফটকে দেখলাম ফ্রি সিম দিচ্ছে, এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি এবং পাসপোর্ট এর ফটোকপি হলে এটা নেওয়া যাচ্ছে সাথে ইনস্ট্যান্ট ব্যালেন্স ৫০ রুপি। উদ্যোগটি বেশ ভাল, পরবর্তীতে আমাদের বেশ কাজে এসেছে। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিলাম থামেল এর জন্য, হাজার বারশ রুপির ডিমান্ড করে থাকে এরা কিন্তু দূরত্ব আধা ঘণ্টার। আমরা বেশ দামাদামি শেষে ৮০০ রুপিতে ঝামেলা মিটালাম।

থামেল বেশ জনবহুল এলাকা, পায়ে পায়ে লাগোয়া দোকান আর  হোটেল। প্রথমে কিছু উটকো গন্ধ আমাদের নাক কিছুতেই মেনে নিচ্ছিল না, গলি গলি হেটে বেড়াচ্ছি। ঘরের বাইরে ভিন্ন দেশ ভিন্ন শহর ভিন্ন পরিবেশ পদে পদে আমাদের জানান দিচ্ছিল আমরা আগন্তুক। এত হোটেলের মাঝে নিজেদের বাছাইকৃত হোটেল খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হল। এ পর্যায়ে আমাদের শিক্ষণীয় ভুল ধরা পড়ল,  ভেবেছিলাম সরাসরি সাক্ষাতে রুম ভাড়া নেমে যাবে অনলাইনের অফারেরও নিচে, কিন্তু বাহ্যত রুমগুলোর ভাড়া অনলাইনের চেয়ে দিগুন বেশি।

নোটঃ অবশ্যই হোটেল পূর্বে বুকিং দিয়ে আসবেন, তাহলে ভাড়া কম পড়বে এবং ঝামেলা কমে যাবে অনেকটা অথবা নেট কানেকশন নিয়ে বাইরে দাড়িয়ে  অন্তত বুকিং দিয়ে চেক ইন করুন।

ডলার ভাঙানোর জন্যে থামেলে প্রচুর মানি একচেঞ্জ এর দোকান আছে, ক্ষণে ক্ষণে পালটায় রেট, আমরা কিছু  ৮৫ তে কেনা কিছু ডলার এয়ারপোর্ট থেকে ১০১ নেঃ রুঃ তে নিয়ে নিয়েছি। থামেলের রেট ১০২ ছিল। সাধারণত এক টাকা = ১.২০ নেঃ রুঃ ।

পছন্দের হোটেলগুলোয় বাজেট না মেলার কারণে প্রায় তিন ঘন্টা ঘুরে বেড়ালাম থামেলের অলিগলি, অবশেষে অবকাশ পাওয়া গেল, হোটেল থামেল। একটি টু সিংগেল বেড এবং থ্রি সিঙ্গেল বেড যথাক্রমে ৩০ ও ৩৫ ডলারে। মাঝারি মানের, কৃত্রিমভাবে ফুলের গাছ দিয়ে পরিবেশ আরও মোহনীয় করে তোলা হয়েছে। শরির তখন ক্লান্তি ছাড়তে চাইছে বিছানায়, পরের দিনের প্ল্যানের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তখনও নেওয়া হয়নি। খরচ বাঁচাতে এবং স্বল্প খরচায় সাধ্যের সবটুকু সুখ পেতে চেয়ে প্যাকেজের চিন্তা দেশে থাকতেই বাদ রেখেছি।

দ্বিমুখী টানে সব সদস্যরা কিছুটা হতাশ। তারপরও মনে খানিকটা জোর খাটিয়ে গেলাম আশ-পাশটায়, না হল না, শেষ ভরসা প্যাকেজ। এখানে মানুষজনের মত ট্যুর প্লানার কোম্পানিগুলো সংখ্যায় অসংখ্য, যেখানে-সেখানে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠে ছড়িয়ে আছে, একটু খোঁজ করে কিছু দামাদামি করলে আপনি স্বল্প খরচায় ভাল অফার নিতে পারবেন। শেষমেশ সারা সন্ধ্যারাত শেষে নানানভাবে দরদাম করে একটি সদ্য গড়ে ওঠা নতুন এজেন্সির সাথে দফারফায় আসি বাকী ছয়দিনের কাঠমান্ডু, পোখারা,নাগোরকোটের প্লান সামনে রেখে। মালিক ভদ্রলোক কমবয়সী এবং মোটামুটি ইংলিশ জানা ছেলে, সারোজ থাপা। জন প্রতি ১১০ ডলার করে মোট ৫৫০ এর চুক্তি  ট্রান্সপোর্ট এবং থাকার খরচা বাবদ, সকালের নাস্তা হোটেল থেকেই, কমপ্লিমেন্টরি। তখন পর্যন্ত আমরা স্টকের শুকনো খাবারের উপর জিইয়ে রাখছিলাম নিজেদের কারণ হালাল হোটেল এখানে খুবই দুষ্প্রাপ্য. অন্যথায় সবজী এবং ফল শেষ ভরসা।

রাত নয়টায় থামেলে ঘুমের আমেজ চলে আসে। তখনকার আবহাওয়ায় দিনে প্রচণ্ড গরম, আর ভোরে আর রাতে মোটামুটি শীত। প্ল্যানের প্রথম অংশ ‘নাগরকোটে সূর্যোদয়’ এর ভাবনা নিয়ে সে রাতে বিছানায় যাওয়া, যেতে যেতে সারোজ মনে করিয়ে দিল কাল ভোর চারটায় তৈরি থাকতে হবে।

কাঠমান্ডুর হালখাতা ২৩-০৩-১৮

রাতে তেমন ভাল ঘুম হয়নি, ভোরে না উঠতে পারার ভয়ে। গিজারের কুসুম গরম পানি শুভ সকাল জানাল। পরিচয় হল আমাদের টুরিস্ট কাম গাইড ভিম এর সাথে, আরবি, ইংলিশ ও হিন্দি জানা আধা কাঁচা-পাকা চুলের লোক, বেশ ভদ্র। আমরা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভূপৃষ্ঠা থেকে প্রায় বাইশ শত মিটার উপরের নাগরকোটের উদ্দেশ্য, সেখান থেকে সূর্য নাকি লজ্জাবতী বধূ সেজে তার যাবতীয় সৌন্দর্য নিয়ে উদিত হয়। কিছুক্ষন যাবার পর বোঝা গেল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাইরে। রাজধানী থেকে নাগরকোট প্রায় ৩০ কিঃ মিঃ পথ, জ্যাম ছাড়া সময় নিবে ১ ঘণ্টার মত। ভুমিকম্প নিজের ছাপ নাগরকোটের পথে স্পষ্ট করে গেছে। সেখানে যেয়ে পৌঁছে দেখতে পেলাম কুয়াশার ঘনত্ব চিঁরে সূর্যোদয় দেখা বড্ড দুস্কর। খানিক বাদে মেঘ কেটে উকি দিল নেপালের আকাশে আমাদের প্রথম সূর্য।

নাগরকোটে সূর্যোদয়

নাগরকোট (Nagorkot) শহর ঘেঁষা এক শহরতলী, এখানে  দর্শনীয় তেমন স্থান নেই সুতরাং এর সময়টা অন্য কোথাও দেয়া ভালো হবে। ফেরার পথে কাঠমান্ডুর ২০ কিঃমিঃ মধ্যে পড়বে ভক্তপুর। ভুমিকম্পের দরুন গোটা নেপাল অনেকটাই বিধ্বস্ত, সাথে সাথে ভক্তপুর হারিয়েছে তার আসল নান্দনিক কারুকার্য, একটি ঐতিহাসিক অতীত থাকার দরুন নেপালসহ সারা বিশ্বের ভ্রমনপিপাসু এবং অনুসন্ধিৎসুদের  জন্য এর গুরুত্ব  অপরিসীম এবং এটি ইউনিসেফের ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ এর তালিকাভুক্ত। পনেরশ শতাব্দির পূর্বে এটিকে রাজধানী হিসেবে গণ্য করা হত, নেপালীদের মতে ‘এনশিয়েন্ট অল্ড সিটি’।

ভক্তপুরে প্রায় ৯০ হাজার লোকের বাস কিন্তু সেখানে টুরিস্ট গাড়ি নিয়ে ঢোকা নিষেধ। স্থানীয়দের জন্যে টিকেট বা প্রবেশের জন্যে কোন ফি না থাকলে পর্যটকদের জন্যে রয়েছে। কিছু পুরনো আমলের নির্মিত মন্দির নিয়ে বিস্তৃত একটি গ্রাম, ঘন্টা তিনেক এর মধ্যে দেখা যাবে। গুগুল করলে যে সব এট্রাকশন ভক্তপুর বা তার আশ পাশে দেখিয়ে থাকে প্রায় আশি ভাগ এই সিটিতে গেলেই দেখা যায়। যেমনঃ দরবার স্কয়ার, গোল্ডেন গেইট, তাউমাদাহি টেম্পল, দাত্তারেয়া টেম্পল, চাঙ্গু নারায়ণ, ফিফটি ফাইভ উইন্ডো, ভক্তপুর লেক ইত্যাদি। খুব নিকট দূরত্বে কীর্তিপুর এবং পাতান নামে এলাকা রয়েছে। এখানে কিছু মন্দির রয়েছে, সময় থাকলে যাওয়া যেতে পারে।

ভক্তপুর

পশুপথিনাথ মন্দির

পনেরশ শতকের দিকে নির্মিত  হিন্দুদের জন্যে একরকম তীর্থ স্থান,  এর ভেতরে বাহিরে মিলিয়ে আনুমানিক  ১০/১১ টি মন্দির রয়েছে। ২০১৫ সালের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুমিকম্পের দরুন এর আসল জৌলুস অনেকটা ম্রিয়মাণ। ৪/৫ কি: মি: এর আয়তনে বিস্তৃত এবং এটিও ইউনিসেফের  ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ এর তালিকাভুক্ত।

বুধানাথ স্টুপা

বৌদ্ধদের  উপসনালয়, এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টুপা জ্ঞান করা হয় এবং এটিই একমাত্র যেখানে হিন্দু আর বৌদ্ধদের উপসনা এক সাথে হয়।  গোলাকৃতির শুভ্র গম্বুজ যেন আসমান ভেদ করতে চাচ্ছে। কিন্তু তেমন আকর্ষক নয়। স্টুপার চারপাশ জুড়ে বসেছে নানান জিনিসের দোকান।
প্রবেশ ফি: ১০০ জনপ্রতি নে:রু সবার জন্যে।

সায়াম্বুনাথ টেম্পল

বুধানাথের অদুরেই নেপালের সবচাইতে চাহিদাজনক এলাকা বা মন্দির হচ্ছে সায়াম্বুনাথ। একে মানকি টেম্পল বলা হয় কারণ এখানে প্রচুর বানরের দেখা মেলে। পাহারের উপরে মন্দির, কৃত্রিমভাবে সিঁড়ি এবং গাছ-পালা দিয়ে যায়গাটেকে পার্ক মতন করা হয়েছে। এর টপ সাইডে গেলে পুরো শহর দেখতে পারা যায়। কাঠমান্ডুবাসীদের জন্যে এটাই সম্ভবত বেড়াতে যাবার জায়গা।
প্রবেশ ফি: ৫০ নে: রু: জনপ্রতি।

বুধানীল কান্ঠা

অনেকে স্লিপিং বুদ্ধ বলে। সায়াম্বুনাথ ছেড়ে বের হওয়ার সময় এই স্থানটি পড়বে। আসলে এটি বিষ্ণু মন্দির, পানির উপর শুয়ে থাকা বিষ্ণুর পাথরের মূর্তি। আহামরি কিছু নয়। ক্যামেরা নিষিদ্ধ।

বিকেলে এসে খাবার খেয়েছি আল মাদিনা হালাল ফুড। ঘরের খাবারের স্বাদ বেশ, সাথে দামও সহনীয়। থামেলের জন্যে এর চেয়ে বেস্ট হালাল ফুডের অন্য সোর্স বোধ করি আর নেই। তবে জানা ভালো এদের খাবার বেশ স্পাইসি। চারজনের খাবার খরচ ডাল-ভাত সবজী মুরগী মিলিয়ে হাজার রুপীতে ঝামেলা মিটে গেছে। খেয়ে দেয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা, শরীরে তখন রাজ্যের ক্লান্তি ভর করছে, তারপর পুরো সন্ধ্যা ঘুম। রাত কাটিয়েছি পোখারার জন্যে  প্রস্তুতি নিয়ে।

ওয়ে টু পোখারা ২৫-০৩-১৮

রাতভর বাধাহীন ঘুম শেষে সদ্য ফুটন্ত মত লাজুক একটা সকাল পেলাম। হোটেলের বুফেতে ৮/১০ রকমারী আইটেমে ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হওয়া, গন্তব্য পোখারা। জনসংখ্যার বিচারে  নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর, কাঠমান্ডু থেকে প্রায় দুইশত কি:মি: দূরত্বে গাড়ি যোগে ৬ ঘন্টার পথ, তারপর ট্রাফিক জ্যাম তো কিছুটা আছেই। যাবার পথ-ঘাট পরিচ্ছন্ন, পাহাড় কেটে কেটে ঘন ঘন তীব্র বাঁকের রাস্তা পাশ জুড়ে বয়ে চলা খরস্রোতা নদী,স্রষ্টা অবারিত সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন প্রতিটি স্থানে।

ঠিক মধ্যপথে মনোকামনা টেম্পল। ১৭০০ সালের নির্মিত পুরাতন মন্দির, স্থানীয় হিন্দুদের বিশ্বাস মতে দর্শনের সময় মনের সকল সদিচ্ছা পূরণ হয়। প্রায় চার হাজারের ফিট উপরে অবস্থিত মন্দিরে, সে মন্দির ঘিরে রয়েছে গ্রাম। যেতে হয় ক্যাবল কার যোগে। গ্রামবাসীদের জন্যে পাহাড়ি রাস্তা রয়েছে। ক্যাবল কার, নতুন অভিজ্ঞতা, তারের উপর ভর করে বিদ্যুতের সাহায্যে উপরে উঠে যাওয়া ঘুপড়ি। মন্দির ভিজিট এবং কেবল কার চারজ বাবদ ১০ ডলার (সার্ক ও নেপালিদের জন্যে), ফরেইনারদের জন্যে ২০। বছর কিছু আগের ভূমিকম্পে নেপাল অনেকটাই বিধ্বস্ত, মনোকামনা মন্দিরটিরও পূনঃনির্মাণ চলছে। সাধারণত সকাল ৯ টায় খুলে ১২টা পর্যন্ত থাকে, উৎসবগুলোতে বিকেলেও যাতায়াত হয়। সেখানে ঘণ্টা খানেক সময় কাটিয়ে নেমে এলাম পথে, পাশের হালাল রেস্টুরেন্টে বসে ঘরোয়া পরিবেশে মাটন দিয়ে ভাত খেলাম পেট ভরে সাথে কয়েক পদের সবজি। ড্রাইভার সহ আমাদের ১৫০০ রুপিতে হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় মানুষজন ঝাল খেতে পছন্দ করে না একদমই, আমাদের সাথে স্পাইসি মাটন খেয়ে তার সে কী অবস্থা। ফর্সা চেহারা টকটকে লাল হয়ে গেছে ততক্ষণে, আর চোখ নাক দিয়ে অঝোরে পানি তো পড়ছেই।

প্রবেশ ফি: সার্কভুক্ত অধিবাসীদের জন্যে  ৫০০ নেপালী রুপী জনপ্রতি। ফরেইনারদের জন্যে আরও বেশি।

পোখারা এসে পৌছতে প্রায় বিকেল। এখানকার পথ ঘাট যেন ছবির মত, মানুষের কোলাহল কাঠমান্ডুর তুলনায় একেবারে নেই বললেই চলে। পরিবেশ দেখলেই মন কেমন যেন উড়ু উড়ু হয়ে উঠে। তখন আকাশে মেঘের ঘনঘটা, পোখারার আবহাওয়া অসংজ্ঞায়িত,  হঠাৎ বৃষ্টি হঠাত রোদের ঘটনা এখানে অহরহ। এখানকার ঠিকানা ‘হোটেল রোমান্টিকা।’ বেশ পরিপাটি এবং সাজানো গোছানো। ফেওয়া লেইকেরে পাড় ঘেষে সামান্য ভেতরে উঁচু বহুতল ভবন।  এজেন্সির সাথে কততে দফারফা হয়েছে তা জানার চেষ্টা করেও সঠিক তথ্য পেতে ব্যর্থ হয়ে ছিলাম কিন্তু এজেন্সি আমাদের কাছ থেকে হোটেল ৩০ ডলার নিয়েছিল প্রতি দিনের জন্যে একেক রুমে। তাই আবার বলছি হোটেল অবশ্যই আগে বুকিং দিন নিজ দায়িত্বে।

বিকাল টুকু হোটেলে রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যাবেলা রাতের শহর দেখলাম। এখানে জিনিসের দাম কাঠমান্ডুর প্রায় দ্বিগুণ, ডলার রেটও কম। পোখারার আলোয় আলোকিত পথের পাশে খাবারের দোকানের ছড়াছড়ি। সন্ধ্যাবেলা হাল্কা নাস্তা খেলাম নেপালের প্রসিদ্ধ খাবার মম। দোকানের নাম লাজিজ, ভদ্র লোকের নাম মুহাম্মাদ। মিষ্টি চেহারার লোক। বাংলাদেশ নাম শুনে গড়গড় কর বলে দিল কত শত ঘটনা। নিউ মার্কেট, উত্তরা, মিরপুর, পরিচিত নাম বিদেশের মুখে কী যে মধুর লাগে, সেদিন জেনেছিলাম। হেটে হেটে ক্লান্তি ভর করা পর্যন্ত ঘুরে ফিরলাম দিন শেষে একটি সুন্দর রাতের অপেক্ষায় বিছানায় এলাম। ডিনার ছিল আমাদের নিয়ে যাওয়া সুপ আর নুডুলস।

নোট: যদিও হোটেল আমরা এজেন্সির মাধ্যমে নিয়েছি, কিন্তু নির্দেশনা আগের মতই, পূর্বে বুকিং দিয়ে আসুন। এখানেও বেশ কিছু টুরিস্ট এজেন্সি প্রচুর। রাফটিং, প্যারাগ্লাইডিংসহ এক দিনের টাউন ট্যুর প্যাকেজ আছে। আমাদের প্লান আগের থেকে ঠিক করা থাকলেও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে হলেও কয়েক জায়গায় ঢু মেরে নিয়েছি। চেক করে দেখলাম যে আমাদের কাঠমান্ডুর এজেন্সি আমাদের যথেষ্ট অনার করেছে। সুতরাং আগের প্লান থাকলে ভালো না হয় এসব প্যাকেজ থেকে বেছে নিতে পারেন।

পোখারার পথে পথে ২৬-০৩-১৮

ভোরের সকাল শুরু হয়েছিল হিমালয়ের চূড়ার ফাঁক গলে আসা এক ফালি রোদ এর সাথে হিমালয়ের শীতল হাওয়ার মিশ্রণ দিয়ে। প্লান দিনভর পোখারার আশ-পাশের দর্শণ, কটকটে রোদটুকু ছাড়া পুরোটুকুই ছিল স্বপ্ন। 

ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা বা শান্তি প্যাগোডা

শুভ্র একটি প্যাগোডা, ১১০০ মিটার উঁচুতে পাহাড়ের চূড়ায়। ভিত্তি প্রস্থর হয় ১৯৪৭ এ, কালে কালে পরিমার্জনে আজকের এই চক্ষুশীতল করা রূপ পেয়েছে। সেখান থেকে ফেওয়া লেকসহ পোখারার নয়নাভিরাম যে  দৃশ্য পাওয়া যায় তা ভেবে ভেবে অনায়েসে কয়েক কাল কাটিয়ে দেওয়া যাবে। যদিও এইটি এজেন্সির লিস্টেড ছিল না, কিন্তু  আমাদের ড্রাইভার ভিম নিজ থেকে নিয়ে গেছেন। খাঁজ কেটে বানানো সিড়ি বেয়ে যেতে হবে, হেটে যেতে হবে বহু, প্রবেশ উন্মুক্ত। অবশ্যই যাবেন।
নোট: নীরবতা পালন করুন।
নোটঃ এজেন্সির জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকবেন না, নিজে গুগুল করে জেনে নিন, এট্রাকশনগুলো বেঁছে বেঁছে নিয়ে সে মতে প্লান সাজান।

ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা

দেবীস ফলস

মিনিট দশেক এর পথ। নেপালী নাম পাতাল চানগু, ১৯৬৩ এর এক ঘটনায় এর নাম হয় ‘দেবিস ফলস। গাছ-পালায় ঘেরা ছোট্ট যায়গা, গ্রিলের ওপাশে পানির ধারা বেশ গভীরে, এখন ততটা দর্শণীয় নয়। বর্ষা কালে এর রূপ প্রত্যক্ষ করা যাবে।
এন্ট্রি ফি: ৩০ নে: রু:

গুপ্তেশ্বর কেভ

দেবিস ফলের উলটো পাশে পোখারার প্রসিদ্ধ গুহা ‘গুপ্তেশ্বর কেভ’। প্রায় ছয়শ বছরের পুরোনো। ভেতরে সংস্কার কাজ চলছিল, ঘুরে দেখতে সময় লাগবে স্বাভাবিকতঃ বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট। শেষ প্রান্তে পেয়েছি ঝর্ণাধারা দেখা যায়। এন্ট্রি ফি: ১০০ নে: রু:

গুপ্তেশ্বর কেভ

মাউন্টেন আর্ট মিউজিয়াম

নেপাল সম্পর্কিত তথ্য , ইতিহাস এবং হিমালয়কে জানতে এর কোন জুড়ি নেই। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে জ্ঞান সংকলিত করে রাখার ব্যাপারটির জন্যে নেপালের সরকারে এ উদ্যোগে ভূয়সী প্রশংসাযোগ্য। বিশাল এরিয়া জুড়ে নির্মিত, বেশ সুন্দর, ঘুরে ঘুরে বেশ সময় নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। এখানে এভারেস্টসহ নেপালের ঐতিহ্য, বাসিন্দাসহ মূল্যবান কিছু তথ্য এবং জিনিস সংগ্রহে আছে। আছে  স্টাফ করা নানান জাতের পাখী ও প্রানী।
এন্ট্রি ফি: ২০০ নে: রু:

ব্যাট কেভ

ভেতরে অন্ধকার, লাইট নিতে হবে সেটার ভাড়া ২০ নেঃ রূপী এবং মিনিট পাচেঁকের পথের জন্যে গাইড নিতে হবে। ব্যাট কেভ থেকে বের হবার পথের দৈর্ঘ্য একজন মধ্য স্বাস্থ্যবান জন্যে যথেষ্ট নয়। কেউ এক্সিট না দেখলে বিশ্বাস করবে না। বিভিন্ন কায়দা করে পা ফেলে পাথর বেয়ে বের হয়ে আসতে হয়। ব্যাট কেভ এর বৈশিষ্ট্য হল দিনের বেলা হাজার বাদুর সেখানে ঝুলে থাকে। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটাকে তেমন আহামরি লাগেনি তার চেয়ে এক্সিট দিয়ে বেড়িয়ে আসাকে বেশি রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে। চাইলে আপনি গাইডের সাথে এন্ট্রান্স দিয়ে আসতে পারেন। আমাদের দুজন সহযোগী স্বাস্থ্যের দরুন প্রথম রাউন্ডে বাদ পড়ে গিয়েছেন আর নিলয় হাত ভাঙা থাকায় চেষ্টা করে নাই, আমি আর আরমান ভাই শেষে সেই দুর্গম এক্সিট এর স্বাদ চেখে দেখেছিলাম।
এন্ট্রি ফি: ৮০ নে: রু:

সেটি রিভার/গোরখা মিউজিয়াম/মাহেন্দ্রা কেভ

হাতে সময় ছিল তবুও সহকর্মীদের অনিচ্ছার দরুন ইচ্ছে করে দেখা হয়নি, এইগুলো উপরের মতই অনেকটা। আনুমানিক এন্ট্রি ফি পড়বে একেকটার জন্যে ৫০ বা কিছু বেশি পড়বে। হোটেলে এসে আমি ব্যক্তিগতভাবে ইউ টিউবে দেখে নিয়েছিলাম, আসলেই এখানে দর্শনীয় তেমন নেই। কিন্তু আমার মতে প্রতিটি স্থানের এবং দর্শনযোগ্য স্থান পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু প্রসিদ্ধতার কথা মাথায় রেখে হলেও ঘুরে দেখা উচিত।

দিনের কার্যক্রম এখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ, হালাল হোটেল আশে পাশে না থাকায় মধ্য পথের এক হোটেল থেকে সব্জীযোগে দুপুরের খাবার কোন মতে সেরে হোটেলে ফিরে আসি। আমাদের হোটেলের সুবিধা ছিল বহুতল ভবন হওয়া। ছাদ থেকে পুরো পোখারার আর ফেওয়া লেকের উন্মুক্ত রূপের স্বাদ আস্বাদন করা যায় অবাধে।

নোট: পোখারাতে হালাল খাবার দুষ্প্রাপ্য, যেখানেও ছিল খুব দামী তবে যা কয়েকটা আছেএকটু খুঁজে নিতে হবে।

সাথের ওনারা অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেন, লাঞ্চের পর তাদের শরীর চলছিল না, তাই আমি আর নিলয় একাই সিদ্ধান্ত নিলাম ফেওয়া লেক ঘুরে বেড়াবো বলে। মধ্যলেকে মন্দির ’তাল বারাহি টেম্পল’, কয়েক শতাংশ জায়গাজুড়ে। দ্বীপ মতন। এর চেয়ে সে সময়টুক লেকে ওপাড়ে বনের ধারে ঘুরে আসা ভালো। বোটের বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে, চাইলে একলা বোটিং করা যাবে। আমাদের ছিল দুজনের বোট আর চালক।
ফিঃ  ৫৮০ নে: রু:

রাতটুক আশ-পাশ ঘুরে দেখা। আবার মম খাওয়া। তারপর পরের দিনের জন্যে তৈরি।

নোটঃ রাতে আমি খুব করে সুযোগ বুঝে বাঞ্জি জাম্প আর প্যারাগ্লাইডিংয়ের খোজ নিয়েছিলাম। প্রাইস কিছু হের-ফের।

যদি ডে ট্যুরের সাথে কম্বাইন করে নেন তাহলে বেশ কমে এসব করা যাবে এমনিতে এসবে প্রতিটি প্রায় পাঁচ থেকে আট হাজার পড়ে যাবে কিন্তু আমার একার জন্যে আলাদা প্লান হবার নয় বলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাদ দিতে হল।

ফেওয়া লেক

ফিরে দেখা কাঠমান্ডু ২৭-০৩-১৮

পোখারার স্বপ্নের শেষটুকুর সাথে সাথে ফিরে যাবার তাগিদ শুরু হলো। এজেন্সির প্ল্যান অনুযায়ী সারাংকোট যাওয়া, সূর্যোদয় দেখার জন্যে। এখানেও সহকর্মীদের অনীহা এই ভেবে যে সূর্যোদয় নাগোরকোটে একবার দেখা হয়েই গেছে, তাছাড়া সন্ধ্যার আগে ফিরে যাবার তাগাদা। সে জন্যে আমরা বিন্দ্যাবাসীনি মন্দিরটাও দেখা হলো না। সুতরাং গ্রুপ ট্যুরে মেম্বার এড রাখুন সতেজ এবং প্রাণোচ্ছল।

সকালে হোটেল থেকে পাওয়া নাস্তা পর্ব সেরে রওয়ানা দিলাম কাঠমান্ডুর জন্যে। ফেরার মসৃণ পথ যেন মন খারাপের কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। লাঞ্চ জুটল পাহাড় ঘেঁষা এক রেস্টুরেন্ট এর কোলে, দুধের দামে পানির স্বাদে। তারপর পড়ন্ত বেলায় এসে পৌছুলাম চান্দ্রাগিড়ি হিলস আবার ক্যাবল কার ভ্রমণ।

প্রায় ৮০০০ ফিট উপরে ট্যুরিস্টদের কথা মাথায় রেখে বছর আটেক আগে নির্মিত। মনকামনার চেয়ে এইখানের ক্যাবল কারের উচ্চতা বেশি এবং আশ পাশ বেশ দর্শনীয়। এখান থেকে এভারেস্ট এর ভিউ দেখা যায়। ভাগ্য অসহায় বলে মেঘের আধিক্যের দরুন দেখা হল না। উপরটা ছোট্ট পার্ক মতন। উচ্চতা আর ক্যাবল কার ভ্রমণ ছাড়া আমাদের নীলগিরি/নিলাচল এর চেয়ে শত কেন হাজারগুন ভালো বোধ করি।
ফি: ১১৫০ নে: রু:

নোটঃ আপনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী না হলে একান্তই কোন উদ্দেশ্য না থাকলে মনকামনা টেম্পলটা আউট অফ প্লান রেখে এখানে সময় কাটাতে পারেন।

হোটেল ফিরে দিনের ক্লান্তি বিছানায় লেপ্টে দিলাম। ডিনার হিসাবে নিয়েছি এখানকার প্রসিদ্ধ ‘থামেল ডোনার কেবাব’ এর শর্মা। এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার মূল্য তিনশ রুপি। এর চেয়ে প্যারিস বাগেত থেকে খেয়ে নিবেন।

ফেরার ডাক। ২৮/২৯-০৩-২০১৮

আটাশে মার্চ, বুধবার পুরোদিন হোটেলে রেস্ট নিয়ে আর লোকাল মার্কেট ঘুরে ঘুরে শেষ। এজেন্সি প্রাইস অনুপাতে খুব ভালো হোটেল দেয়নি, ৩০ ডলারে আমরা এর চাইতে ভালো কিছু পেতাম। কাঠমান্ডু মূলত নেপালের ঢাকা। আদতে এখানে দর্শনীয় কিছু নেই। কোলাহল, হর্ন, জ্যাম ছাড়া। সুলভ মূল্যে কেনাকাটার জিনিস বড্ড অভাব। নেপালের বাজার ধরে রেখেছে ইণ্ডিয়া, সম্প্রতি চায়না তাদের বাজার প্রসার করছে। আর বাংলাদেশে এসব আমাদের হাতের মুঠোয়। তবে শালের বাজার বেশ ভালো। খুঁজে খুঁজে হোল সেল থেকে কিনে নিলে দাম বেশ কম পাওয়া যায়। এবার শুধু ফেরার অপেক্ষা। গার্ডেন ওফ ড্রিম নামে একটা যায়গা ছিল, কৃত্রিম ভাবে বানানো, তিনশ রুপি শুনে কান চেপে উল্টো হাঁটা দিলাম।

আজ ঊনত্রিশে মার্চ, একটার ফ্লাইট ধরতে রওনা দেই বেলা দশটায়, অবশেষে ল্যান্ডিং ৩ টায়। সেই পুরোনো চিরচেনা মাটির ঘ্রাণ, পরিচিত দৃশ্যপট আর ধোঁয়াটে বাতাস, চিরচেনা শহর পথ-ঘাট আর মানুষ, আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নেই, বহুদিনের মেপে মেপে ছাড়া নিঃআজ বুক টেনে ছেড়ে দেই। আমি আগে বুঝতে পারি নাই, এ দেশের আলু ভর্তা ডালে, একটু শুকনো মরিচে এত এত ভালোবাসা মিশে ছিল, মানুষের জীবন প্রবাহতে এত মায়া, এত মমতা ভেসে বেরাচ্ছিল। এই ছিল নেপাল ভ্রমণের সারাংশ।

মৌলিকভাবে আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছে ৩৩০০০ টাকা, শপিং এবং উপরি খরচাদি যার যার ব্যক্তিগত।

নোটঃ  প্ল্যান করবার পূর্বে অবশ্যই আপনার দৈহিক সহ্যশক্তি এবং এবং আর্থিক খরচার ব্যাপার মাথায় নিবেন। পোখারার শেষ রাতে ড্রাইভার ভিম আমাদেরকে লুম্বিনি হয়ে চিতওয়ান নিয়ে যাবার প্ল্যান দিয়েছিল, লম্বা জার্নি এবং পকেটের ক্ষীণকায় অবস্থা হয়ে গেছে বিধায় সেটা নেওয়া হয়নি। আমার মতে কাঠমান্ডুতে কালক্ষেপন করা ঠিক নয়। এর চেয়ে প্রথম দিনে পোখারায় বাসে চলে যাওয়া উত্তম হবে। জাগদাম্বা ট্রাভেল নাইটকোচ ছাড়ে, এছাড়াও পোখারার টুরিস্ট বাস আছে। অল্পদিনে মোটামুটি কভার করতে যদি চান তাহলে এইসব ভেবে স্বল্প খরচায় সাধ্যের সবটুকু পেতে পারেন  সুতরাং পোখারার পর লুম্বিনি, চিতওয়ান শেষ করে শেষ দিন কাঠমান্ডু ঘন্টা পাঁচেকে অনায়েসে দেখে নেওয়া যাবে। এসব তখন যদি আপনার দলে শিশু, মহিলা এবং আয়েশী লোক না থাকে তবে। লুম্বিনি এবং চিতওয়ান এর ব্যাপারে যা জ্ঞান সেসব গুগুল থেকে পাওয়া। যেহেতু সেখানে স্বচক্ষে ঘুরে দেখা হয়নি তাই তা উল্লেখ না করাই শ্রেয় মনে করছি।

এমন স্মরণীয় একটি ভ্রমণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকা প্রত্যেক সদস্য এবং নেপালের আন্তরিকতার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং তাদের জন্যে শুভ কামনা একরাশ, সবশেষে। একটি সফল ভ্রমণের জন্যে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, এবং ধন্যবাদ সবাইকে। আপনার ভ্রমণ শুভ হোক, হোক সুন্দর, মনোরম এবং আনন্দদায়ক। শুভকামনা পাঠককে।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ kathmandunagarkotnepalpokhara