নৈনিতালের পথে এবং মনোরম মুক্তেশ্বর

২০১৮ এর পুজোর পরে। দিল্লি হয়ে চলেছি নৈনিতাল (Nainital) এর পথে। সুদীর্ঘ ৭ ঘন্টার পথ পেরিয়ে এলাম লেক সিটি নৈনিতালে। বেরিয়েছিলাম সকাল ৭ টা নাগাদ আর এসে পৌঁছলাম যখন, তখন ঘড়িতে বাজে দুপুর দু’টো। পথের ক্লান্তি ভুলে গেলাম এই সুন্দর শহরে প্রবেশ করে!! ঝাঁ চকচকে শৈলশহর! যার সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে নৈনি লেক! গাড়ির ড্রাইভার রাজকুমারকে হোটেলে পৌঁছে ছুটি দিলাম। বললাম “ভাইয়া, আজ আপকা ছুট্টি হ্যায়। হামলোগ আজ প্যায়দল হি ঘুমেঙ্গে!” ও খুশি হয়ে চলে গেল! বেচারি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল!

ঠাঁই হল হোটেল কৃষ্ণায়। একদম লেকের দিকে মুখ করা হোটেলটি কিন্তু মেইন রোড থেকে বেশ ৬০-৭০ ধাপ সিঁড়ি উঠলে তবে হোটেলের নাগাল পাওয়া যায়। তবে লাগেজ আমাদের বইতে হল না। কিন্তু নিজেদের টেনে তুলতেই কালঘাম ছুটে গেল!!

লেক ভিউ ঘর বুক করাই ছিল। ঘরে ঢুকে সটান ব্যালকনিতে চলে এলাম। খুব সুন্দর লাগছিল লেকের দৃশ্য। রংবেরঙের পাল তোলা নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। আমার যদিও জলে খুব ভয়, সাঁতারও জানি না! কিন্তু নৈনি লেক দেখেই বোটিং এর ইচ্ছে চাগাড় দিয়ে উঠল।

সন্ধ্যা নামার আগে

ঘরেই লাঞ্চ অর্ডার করে খেয়ে নেওয়া হল চটপট। তারপর ছেলে বসে পড়ল টিভি নিয়ে কার্টুন দেখতে কিন্তু আমি তাড়া লাগালাম। এখন টিভি নিয়ে বসলে চলবে? একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে। এরপর বেলা ছোট হয়ে আসবে।

বেরোলাম যখন তখন বিকেল প্রায় চারটে বাজে। সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। প্রচুর হোটেল আর রেস্তোরাঁ চারিদিকে। আর ঝাঁ চকচকে দোকান পাটের সারি। নৈনিতাল মলের এটাই বিশেষত্ব। লেক সাইডে হওয়ার জন্য এর সৌন্দর্য অনেক বেশি অন্য শৈলশহরের মলের চেয়ে।

কিন্তু এবারে বোটিং শুরু করতে হবে। লেক সাইড থেকে একটা নৌকা ভাড়া করে উঠে পড়লাম। সবচেয়ে কম ১৫ মিনিটে ১৬০ টাকার টিকিট কাটলাম কাউন্টার থেকে। মাঝি ভাইকে বললাম – আমাদের ঠিক উলটো পারে নৈনা দেবী মন্দিরে নামিয়ে দিতে।

প্রথম প্রথম অল্প ভয় লাগলেও আস্তে আস্তে ভয় কেটে গেল। বেলা তখন ধীরে ধীরে পড়ে আসছে। বেলাশেষের আলোয় লেক তখন রূপসী হয়ে উঠছে আরও। চারপাশে অজস্র রংবেরঙের শিকারা স্টাইলের বোট, সাধারণ বোট, পাল তোলা নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। বোট থেকে নৈনিতালের অনেকগুলি ছবি তুললাম।

চলে এলাম অপর প্রান্তে। নৈনা দেবী মন্দির প্রাঙ্গণে। নৌকা থেকে নেমে মাঝী ভাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রবেশ করলান নৈনা দেবী মন্দিরে। ৫১ সতী পীঠের অন্যতম এই মন্দির। কথিত আছে যে এখানে সতীর বাম নয়ন পড়েছিল! মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা বারন, বিশেষ করে বিগ্রহের। পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সুন্দর ব্যাবস্থা, নিজের মত সবাই পুজো দিচ্ছেন। পান্ডাদের কোন অস্তিত্বই নেই।

নৈনি লেক

এবারের গন্তব্য চারপাশের দোকানপাট। তবে এমন কোন বিশেষ জিনিস এখানে পাওয়া যায় না যেটা কিনা কোলকাতায় পাবেন না। তবে এখানকার বিখ্যাত জিনিস হচ্ছে মোমবাতি। নৈনিতালের মোমবাতি সর্বজনবিদিত! মোমবাতির দোকানে ঢুঁ মেরে কিছু মোমবাতি কেনা গেল নানান সাইজ ও শেপ এর।

এরপর একটা রেস্তোরাঁয় একটু বসে ভেজ মোমো আর কফি খেয়ে আজকের মত গাত্রোত্থান করা গেল। অন্ধকার নেমে এসেছে। রাতের আলোয় লেকের পার্শ্ববর্তী আলো গুলি জ্বলে উঠেছে। সেই ঝিকিমিকি আলোয় নৈনিতাল যেন আরও সুন্দরী আর মোহময়ী হয়ে উঠেছে! এবারে ফিরতেই হবে হোটেলে। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে খুব। আগামীকালের গন্তব্য মুক্তেশ্বর!

মনোরম মুক্তেশ্বর

আজ আমাদের মুক্তেশ্বর (Mukteshwar) বেরিয়ে যাওয়ার কথা।ইচ্ছে আছে মুক্তেশ্বর ঘুরে লেক ট্রিপ করে বিকেল নাগাদ হোটেলে ফেরার। মুক্তেশ্বরের আইডিয়াটা দিয়েছিলেন আমার বন্ধুবর ডাঃ গৌতম মুখার্জী। ওনার কুমায়ুন আগেই ঘোরা। আসার আগে কথায় কথায় আমায় বলেছিলেন যে “মুক্তেশ্বরটা মিস কোরো না কিন্তু!”

মুক্তেশ্বর ভ্যালী

ওনার কথা শুনেই পরের দিন টুর প্ল্যানে মুক্তেশ্বরকে ঢোকাই। গুগল বলছে নৈনিতাল থেকে প্রায় ৫২ কিমি দূরে এই ছোট্ট শৈল টাউন। গ্রামই বলা যায়। নিরিবিলি, শান্ত এবং কোলাহলমুক্ত।

সকাল ৯ টায় রওনা দেওয়া গেল। ড্রাইভার রাজকুমার এদিকটায় আগে না এলেও লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ঘন্টা দেড়েকের ড্রাইভে আমাদের মুক্তেশ্বর এনে হাজির করলেন। আগেই শুনেছিলাম এখানে দ্রষ্টব্য মূলত দুটি “মুক্তেশ্বর মহাদেব মন্দির” আর “চৌলি কি জালি”!! গাড়ি থেকে নামলাম, এগিয়ে এলেন একজন সুদর্শন যুবক। হিন্দিতেই বাক্যালাপ হল। পরিচয় পেলাম ওনার, নাম হেমন্ত বিস্ত। উনি লোকাল গাইড হিসেবে কাজ করেন। সব ঘুরিয়ে দেখাবেন আমাদের। দক্ষিণা যৎসামান্যই।

দ্বিধা না করে ওনার সাথেই ঝুলে পড়লাম। পাশেই মহাদেব মন্দির। কথিত আছে যে এই শিব মন্দির পান্ডবরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেশ অনেক ধাপ সিঁড়ি টপকে মন্দির প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছলাম। খুব ফাঁকা ফাঁকা। হেমুজি বল্লেন শিবরাত্রির দিন প্রচুর ভীড় হয়। আপাতত পূজারী জী’র দেখা পাওয়া গেল না। আমরা ঘন্টা বাজিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করলাম সবাই।

মুক্তেশ্বর ভ্যালী

হেমুজি কেই বল্লাম – ” আচ্ছা চৌলি কি জালি (chauli ki jali) বস্তুটি ঠিক কি?” উনি বল্লেন আসুন স্যার আপনাদের দেখাচ্ছি। এরপরে মন্দিরের পেছনের জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে অল্প ট্রেক করে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। বেশ এবড়োখেবড়ো জঙ্গুলে রাস্তা। দেখেশুনে পা ফেলে হাঁটতে হয়! প্রচুর পাইন, ওক, দেবদারু গাছ চারিদিকে! ৫-৬ মিনিটের চড়াই উৎরাই হাঁটার পরে আমরা এসে পৌঁছলাম একটু উঁচু একটা জায়গায়। যেখানে প্রচুর বিরাট বিরাট সাইজের পাথর যেন গেঁথে বসানো আর পাশেই একটু প্রশস্ত জায়গা। পাশেই নেমে গেছে অতল খাদ। কিনারে বা পাথরের উপর উঠে দাঁড়ালে পুরো মুক্তেশ্বর ভ্যালীর মনোরম দৃশ্য নজরে আসবে। হেমুজি বললেন – “দেখুন স্যার। ওই বাঁ দিকে খাদের গায়ে পাথরের গায়ে বিরাট আকৃতির একটা ফুটো (জালি বা ছেদ) দেখা যাচ্ছে”!

বিস্মিত হয়ে দেখলাম, হ্যাঁ তাই তো! কথা বলে জানলাম নিয়মিত হাওয়ার ধাক্কায় পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে ওই ফুটো বা জালির সৃষ্টি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়েই। প্রত্যেক শিব রাত্রির দিন নিঃসন্তান দম্পতিরা এই মহাদেব মন্দিরে পুজা দিতে আসেন। ও পুজো দিয়ে ওই খাদের কিনারের “চৌলি কি জালি” পরিক্রমা করে মন্ত্রপূত চেলি বা কাপড় বাঁধেন পাহাড়ের গায়ে। পাশাপাশি অনেকে নিজেদের নাম ও খোদাই করেন পাথরে। জনশ্রুতি অনুসারে একমাত্র এইভাবেই তাঁরা সন্তান লাভে নাকি সক্ষম হন!

চৌলি কি জালি

“চৌলি কি জালি” থেকে গোটা মুক্তেশ্বর ভ্যালীর রূপ অনুপম। হেমুজি বল্লেন আকাশ পরিষ্কার ও মেঘমুক্ত থাকলে এখান থেকেই হিমালয়ের শৃঙ্গরাজি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়!! কিন্তু আজ আমরা দেখতে পেলাম না। আকাশ আজ মেঘে ঢাকা।

এবারে নেমে আসার পালা। এরপর চলে এলাম আমরা মুক্তেশ্বর কে এম ভি এন লজের প্রাঙ্গণে। খুব সুন্দর পরিবেশ। সামনের চত্বরেই বড় বড় করে লেখা “হিমদর্শন”! তবে আজ আমাদের কপালে নেই হিমদর্শন। মনে মনে ঠিক করলাম আবার যদি কখনো আসি তখন মুক্তেশ্বর কে করব অন্তত এক রাতের জন্য রাতঠিকানা!!

আপাতত ফিরে চলা। হেমন্ত বিস্তের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চল্লাম। মনের কোনায় কিন্তু মুক্তেশ্বরের রেশ রয়েই গেল!

Leave a Comment
Share