এনজেপি স্টেশন থেকে গাড়িতে ওঠার কিছু ক্ষণের মধ্যেই প্রবল বৃষ্টি স্বাগত জানাল আমাকে। মিরিকে লেকের মৎস্য- চাঞ্চল্য বা চা বাগানের শ্যামল স্নিগ্ধতা অনুভব করতে অবশ্য বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে পাহাড়ের রূপ প্রত্যক্ষ করতে পারাটাও একটা প্রাপ্তি বটে। এরপর দার্জিলিঙের জন – কোলাহলে দুই দিন কাটিয়ে অবশেষে… লেপচাজগত।
প্রথমেই বলে রাখি, লেপচাজগতে কিন্তু দ্রষ্টব্য বলতে তেমন কিছুই নেই। তাই অনেক কিছু পাওয়ার আশায় এখানে এলে হতাশই হতে হবে। তবু….
লেপচাজগত… সত্যই ‘মেঘের জগৎ’। ‘মেঘ-আলয়’ বললেও বোধহয় চলে। ঘন সবুজ পাইন অরণ্য, মেঘের বিরামহীন আসা – যাওয়া, গভীর নীরবতা আর অচেনা পাখির দূরাগত ডাকই লেপচাজগতের সম্পদ। এই স্থান যতটা না দর্শনের, তার চেয়ে বেশি অনুভবের। হোম স্টের ছাদে বসে সামনের পাইন ভরা পাহাড়ের বুকে ধেয়ে আসা মেঘমালার দিকে চোখ রেখে যাপিত হতে পারে বহুক্ষণ। মনে হবে, জয় গোস্বামীর কবিতার পাতা থেকেই যেন উঠে এসেছে এই মেঘবালিকার দল। আপনার ইয়ারফোনে তখন বেজে উঠতেই পারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্বর্ণালী কণ্ঠসুর… ‘ওগো মেঘ, তুমি উড়ে যাও… কোন ঠিকানায়…’
না, অন্তহীন মেঘের দল আপনাকে তার ঠিকানার সন্ধান দিয়ে যাবে না, কিন্তু বীথি – পথে চলতে চলতে কখনও আপনাকে যাবে ভিজিয়ে দিয়ে… চারিদিক ধূসরতায় ঢেকে। দুপুরবেলাতেই সন্ধ্যার ক্ষণিক অন্ধকার নেমে আসবে আপনার চারিদিকে। আবার কখনও হয় তো দেখবেন বিদায়ী সূর্যকে সামনে রেখে ভেসে চলেছে রক্তিম মেঘের সারি।
সকালে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে বহুদূর হেঁটে যেতে পারেন। ফিরে এসে পাবেন ‘পাখরিন হোম স্টে’ (আমি এখানেই ছিলাম )র আমন ভাইয়া বা নীতেশ ভাইয়ার হাতে তৈরি গরম ব্রেকফাস্ট আর দার্জিলিং চায়ের স্বাদ। সন্ধ্যায় ঘরে বসে টিভি দেখার সুযোগ এখানে নেই। দেখতে পারেন দূরের দার্জিলিংকে প্রদীপমালার সাজে অথবা হোমস্টের সামনে বসে শুনতে পারেন গিটার হাতে কোনও স্থানীয় যুবকের নেপালী ও হিন্দি ভাষার গান। অনন্য এক অভিজ্ঞতা।
তবে সারাক্ষণই মনের মধ্যে ইচ্ছা জেগে থাকবে ‘হিমালয়ের রাণী’ কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন লাভের। ‘রাণী’ বলে কথা – – -তাই হয়তো উদ্ধত অহংকারে আমাদের মতো সামান্য প্রজাদের সহজে দর্শন দিতে চান না।। কিন্ত সেই স্বপ্নও আমার পূরণ হল। লেপচাজগত থেকে বিদায় নেওয়ার ঘন্টা দুয়েক আগে সূর্যের আলোয় (যা এখানে দুর্লভ) ভরে উঠল চারিদিক। ঘরের জানালার কাচ সরিয়ে দিতেই জীবনে প্রথমবারের মতো চাক্ষুষ করলাম সেই বহুকাম্য কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। ছুটে গেলাম হোমস্টের ছাদে। ‘প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে’ দেখলাম রূপার পাতে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। মনে হল, এবার যেন আমার এই ভ্রমণ সম্পূর্ণতা পেল।
তবে সবশেষে একজনের কথা না উল্লেখ করলে অপরাধী হব। আমার ড্রাইভার দাদা… দুলাল সরকার। এনজেপি থেকে মিরিক হয়ে দার্জিলিং এবং ফেরবার দিনে লেপচাজগৎ থেকে এনজেপি… সারাটা পথ অগ্রজপ্রতিম মমতায় যেন তিনি আমাকে গাইড করে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর সঙ্গলাভও এই ভ্রমণে আমার পরম প্রাপ্তি।
Leave a Comment