প্রজাপতি মাছের দেশ লক্ষদ্বীপ

কিছুটা তন্দ্রাছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ পাইলটের ঘোষণা শুনে আধ বোজা চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, আরব সাগরের ঘন নীল জলের বুকে জেগে রয়েছে দুটো পান্নার খণ্ড! তবে, ভাল করে দেখে বুঝলাম, ওগুলো আসলে উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ লাগুন পরিবৃত ছোট্ট দু’টি প্রবাল দ্বীপ। একটি লম্বাটে আর অন্যটি গোলাকার। পাশ থেকে আমার স্ত্রী পৃথা জানাল, আমরা এখনই আগাত্তি দ্বীপে অবতরণ করব।

উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ জল ও সাদা ধবধবে বালি আগাত্তির সৈকতে

কোচি থেকে উড়ে আসা আমাদের বিমানটি শেষে একটি গোল চক্কর কেটে প্রায় সমুদ্রের জল ছুঁয়ে মাটিতে নামল। আর অবতরণ করা মাত্রই যাত্রীদের মধ্যে সে কি হুড়োহুড়ি! অবশ্য হবে নাই বা কেন? বাইরে প্রকৃতি যে তার রূপের পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছে। বিমানবন্দরের প্রস্থ সাকুল্যে ১০০ মিটার মতো। তার দু’পাশে বেলাভূমির সাদা ধবধবে বালি সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। মাঝে মধ্যেই কিছু ঘন সবুজ ঝোপ-ঝাড়। বেলাভূমির পরেই লাগুন। লাগুনের টলটলে জলের সেই উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ রং মন মাতিয়ে দেয়। এক পাশের লাগুন বেশ চওড়া ও অগভীর। সেখানে জলে ঢেউ সামান্যই— বিশাল এক সুইমিং পুল বলে ভুল হতেই পারে। তার মাঝে দূরে একটি নৌকা কোথায় যেন চলেছে। অন্য পাশের লাগুনের প্রস্থ অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় স্বভাবতই সেখানের জলে ঢেউও বেশি। লাগুন থেকে চোখ সরিয়ে দ্বীপের ভেতরের দিকে তাকালে দেখা যাবে সারি সারি নারকেল গাছ। হঠাৎ শুনতে পেলাম পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘‘ওয়েলকাম টু লক্ষদ্বীপ— দ্য প্যারাডাইস ইন ইন্ডিয়া।’’

নাম শুনে মনে হতে পারে এক লক্ষদ্বীপের সমাহার। আসলে কোচির সমুদ্রতট থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে আরব সাগরের বুকে ছোট ছোট ৩৬টি প্রবাল দ্বীপ নিয়েই লক্ষদ্বীপ। এই দ্বীপগুলির মধ্যে একমাত্র আগাত্তিতেই রয়েছে বিমানবন্দর। ৩৬টির মধ্যে ১০টি দ্বীপে জনবসতি আছে। বাকিগুলো জনমানব শূন্য। মোটামুটি প্রতিটি দ্বীপই লাগুন পরিবৃত। লাগুন হল সমুদ্রের মাঝে অবস্থিত প্রবাল প্রাচীর বেষ্টিত জলাশয়। লক্ষদ্বীপে এখনও পর্যন্ত মোট চারটি দ্বীপে পর্যটকদের থাকার বন্দোবস্ত করা গিয়েছে। কাদমত, কাভারাত্তি, বাঙ্গারাম এবং ঠিন্নাকারা। আগাত্তি দ্বীপে আগে ট্যুরিস্টদের থাকার বন্দোবস্ত ছিল। কিন্তু কোনও কারণে তা আপাতত বন্ধ। আগাত্তি থেকে এই চারটি দ্বীপে যাওয়ার একমাত্র উপায় দ্রুতগতি সম্পন্ন নৌকা। আমরা কাদমত দ্বীপে রিসর্ট বুক করেছিলাম। লক্ষদ্বীপের সমস্ত রিসর্ট এবং হোটেল ‘স্পোর্টস’ নামের একটি সরকারি সংস্থার হাতেই ন্যস্ত। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হয়।

বাঙ্গারাম দ্বীপে পর্যটকদের থাকবার তাঁবু

বিমানবন্দর থেকে ‘স্পোর্টস’-এর বন্দোবস্ত করা গাড়ি করে আমরা আগাত্তি দ্বীপের অতিথিশালায় পৌঁছলাম। অতিথিশালায় মধ্যাহ্নভোজ ও ঘণ্টাখানেক বিশ্রামের পর সংলগ্ন জেটি থেকে কাদমত দ্বীপের উদ্দেশে আমাদের নৌকাযাত্রা শুরু হওয়ার কথা। আহারাদির পর এক ফাঁকে বেরিয়ে আমরা চললাম জেটি এবং তৎসংলগ্ন সৈকত দেখতে। লাগুনের জলের রং পান্নার মতো। এখন জেটিতে দাঁড়িয়ে দেখি জল এত পরিষ্কার যে নীচের বালি স্পষ্ট দেখা যায়। দেখতে পেলাম জলের বেশ গভীরে কিছু মাছ দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক যেন একটি চলন্ত মৌচাক। জলে ঢেউ অল্প। অদূরেই জেলেদের কয়েকটি ছোট নৌকা ভাসছে। আর বিস্তীর্ণ তটরেখা বরাবর যত দূর দৃষ্টি প্রসারিত হয় তত দূর শুধুই নারকেল গাছের সারি। ঊর্ধ্বপানে চেয়ে দেখি জলের সবজে রং লেগেছে মেঘেদের গায়েও। বেলা দ্বিপ্রহরের সূর্য সেই মেঘের ফাঁকফোকড় দিয়ে বেরিয়ে জলতলে সৃষ্টি করেছে আলো-ছায়ার এক অপূর্ব জলছবি। যেখানে আলো পড়ছে সেখানে জলের রং উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ, আর ছায়া যেখানে সেখানে রং কালচে সবুজ। সৈকতের সাদা বালি ও নারকেল গাছের মাথার উপরে মেঘের ঘনঘটা এক অদ্ভুত বৈপরীত্য এনে দিয়েছে সমগ্র দৃশ্যপটে। পুরো দৃশ্যটিই যেন পাকা হাতে আঁকা এক নিসর্গ চিত্র। অথবা প্রকৃতি যেন সদ্যযৌবনা অষ্টাদশী, নিজের খেয়ালে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে। যদিও মেঘ দেখে কিঞ্চিৎ ভয় হচ্ছিল পাছে নৌকা যাত্রায় বিঘ্ন ঘটে, তথাপি ওই অসামান্য চিত্র সদৃশ বাস্তব দৃশ্য দেখে মনে যে পুলক জেগেছিল তাতে ভাষাজ্ঞান থাকলে হয়তো একটি কাব্য রচিত হয়ে যেত! অতিথিশালায় ফেরার পথে দেখলাম একটি গাছের ছায়ায় বসে কয়েক জন স্থানীয় লোক সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়ায় আলস্যে জিরিয়ে নিচ্ছে।

আগাত্তি দ্বীপের সমুদ্র সৈকত

এর পর শুরু হল কাদমত দ্বীপের উদ্দেশে নৌকায় সমুদ্রযাত্রা। আমাদের বাহন একটি বড় আকারের স্পিডবোট। জনা পনেরো লোক বসতে পারে। আমরা ছিলাম সাকুল্যে আট জন পর্যটক, তিন জন নৌকার কর্মী ও চার জন স্থানীয় লোক। আট জন ট্যুরিস্টের মধ্যে আমাদের দু’জন ছাড়াও ছিলেন এক সুইডিশ চিকিত্সক, এবং পাঁচ জনের একটি ওড়িয়া পরিবার। ক্রমে আগাত্তি দ্বীপের লাগুন অতিক্রম করে আমাদের নৌকা গভীর সমুদ্রে পৌঁছল। গভীর সমুদ্রে জলের রং নীলার মতো গাঢ়। আবহাওয়া ঠিক থাকাতে সমুদ্রও বেশ শান্ত। দূরে একাধিক দ্বীপ চোখে পড়ছে। হঠাৎ দেখলাম কি যেন একটা জল থেকে উঠে কিছু ক্ষণ উড়ে আবার জলে সেঁধিয়ে গেল। পর ক্ষণেই আবার একটি। এ বার বুঝলাম ওগুলো আসলে উড়ুক্কু মাছ! জীবনে প্রথম বার উড়ুক্কু মাছ দেখে বেশ ভাল লাগল। এই ভাবে প্রায় চার ঘণ্টা উড়ুক্কু মাছ ও আরব সাগরের ঘন নীল জল দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম কাদমত দ্বীপ সংলগ্ন লাগুনে। ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় ছ’টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। সূর্য দিগন্তের কাছাকাছি পৌঁছেছে, কিন্তু অস্ত যেতে ঢের বাকি। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় লাগুনের জলের সেকি প্রভা! তবে জলের রং আগাত্তির মতো অতটা সবজে নয়, নীলের ভাগ যেন একটু বেশি। আর এত স্বচ্ছ যে প্রায় তিন থেকে পাঁচ মিটার গভীর হওয়া সত্বেও উপর থেকে জলের একেবারে নীচের প্রবালও দেখা যায়। জেটিতে নামার পর ‘স্পোর্টস’-এর কর্মচারীরা পেয়ারার রস দিয়ে আমাদের সাদর অভিনন্দন জানিয়ে নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে দিলেন। ঘরে গিয়ে দ্রুত স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়লাম সূর্যাস্ত দেখতে।

কাদমতের পূব লাগুন

উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত কাদমত দ্বীপটি লম্বায় প্রায় আট কিলোমিটার, কিন্তু খুবই সরু। এর সব থেকে চওড়া অংশের প্রস্থ ২০০ মিটার। আমরা যেখানে উঠেছি সেখানে দ্বীপের প্রস্থ প্রায় ৫০ মিটার। অর্থাৎ আমাদের ঘরের দু’পাশেই সুন্দর সৈকত এবং লাগুন। পশ্চিম দিকের লাগুন খুবই চওড়া ও অগভীর। অপর পক্ষে পুব দিকের লাগুন সরু এবং তুলনামূলক গভীর। স্বভাবতই পুবদিকের জলে ঢেউও বেশি। তট থেকে একটু দূরে প্রবাল প্রাচীর বা কোরাল রিফ। ওখানেই লাগুনের সংগে সমুদ্রের সংযোগস্থল। সমুদ্র সৈকতে ঢেউ যেমন বালুকাবেলার উপর আছড়ে পড়ে ঠিক তেমনি ওখানে লাগুনের জলের উপর ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। কাদমত দ্বীপে বালির রং মুখ্যত সাদা হলেও একটু হাল্কা গোলাপি আভা দেখা যায়। সমুদ্র সৈকতে মাঝে মাঝে চেয়ার ও ছাতা বিছানো। রয়েছে প্রচুর নারকেল গাছ, ঝাউ গাছ, মাঝে মাঝে কিছু ঘাসও। লোকজন বিশেষ নেই বললেই চলে। শুধু কয়েকজন পর্যটক ও কর্মচারী। তাও আবার কর্মচারীরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। নৈশ আহারের বন্দোবস্ত হয়েছিল পশ্চিম দিকের সৈকতে এক অস্থায়ী তাঁবু লাগিয়ে। সেও এক অভিজ্ঞতা বটে। চাঁদনি রাতে খোলা আকাশের নীচে লাগুনের পাশে বসে টুনা মাছ দিয়ে ডিনার। তার উপর ইলিশ প্রিয় বাঙালির কাছে টুনা মাছ অনেকটাই ইলিশের স্বাদ এনে দেয়। নৈশ আহারের পর এক স্থানীয় বাসিন্দা কাছেই জেটির উপরে পাতা চেয়ারে গিয়ে বসতে পরামর্শ দিলেন। সেখান থেকে বহু দূর অবধি সমুদ্র দেখা যায়। দূরে গভীর সমুদ্রে ভেসে থাকা একটি জাহাজের আলো দেখছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল খানিক দূরে জলে কী যেন একটা ভাসতে ভাসতে কাছে আসছে। একটু পরেই বুঝলাম ওটা আসলে সেই সুইডিশ চিকিত্সক। ডাক্তার থমাস সুইমিং করছেন চাঁদনি রাতে! ঠান্ডা হাওয়ায় কিছু ক্ষণ বসে থেকে ক্রমে চোখে ঘুম চলে এল। তবে এরূপ বেহস্তেও যে মশক সম্প্রদায় খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে তা আগে থেকে জানা ছিল না!

পর দিন ভোরে উঠে সূর্যাস্ত দেখে চললাম কাদমত দ্বীপের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত বালিয়াড়ি দেখতে। ওই অংশটি আমাদের ঘরের কাছেই। দ্বীপের পশ্চিম তট বরাবর একটু হেঁটেই পৌঁছে গেলাম। দারুণ দৃশ্য! ছোট ছোট বিভিন্ন রঙের শঙ্খ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাদা রঙের কিছু কাঁকড়াও দেখতে পেলাম। আমরা শঙ্খের ছবি তুলতে সক্ষম হলেও কাঁকড়াগুলো খুবই লাজুক। কিছুতেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পোজ দিল না। এর পর কিছু ক্ষণ লাগুনের জলে সাঁতার কেটে শরীর জুড়িয়ে গেল। জল না ঠান্ডা, না গরম— খুবই আরামদায়ক। জলে ঢেউ সামান্যই। তাই সাঁতার কাটতে খুব মজা। সাঁতার না জানলেও কোন অসুবিধে নেই, লাইফ জ্যাকেট পরে নিলেই হল। দুপুরের আহারের পর সাইকেল ভাড়া করে চললাম দ্বীপের উত্তর প্রান্ত দেখতে। পৃথা, ডাক্তার থমাস আর আমি। রিসর্ট থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই দেখতে পেলাম গ্রাম। ওর ঠিক মধ্যিখান দিয়ে চলে গিয়েছে সরু একটি কংক্রিটের রাস্তা। দু’পাশে অজস্র নারকেল গাছের সারি। তার ফাঁকে ফাঁকে কুড়ে ঘর। কোথাও আবার এক দু’টি দালানও দেখা গেল। মাঝে মাঝে জলসত্র ও কিছু দোকান। অত নারকেল গাছ দেখে আমাদের ইচ্ছে হল ডাবের জল খাওয়ার। কিন্তু কি আশ্চর্য! জানতে পেলাম কেউই নাকি ওখানে তা বিক্রি করেন না! আমাদের অবস্থা যেন গ্রিক পুরাণের অভিশপ্ত ট্যান্টালাসের মতন, যিনি জলে দাঁড়িয়ে থেকেও তৃষ্ণা মেটাতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত এক বৃদ্ধ দোকানদার তার দোকানের পাশের গাছ থেকে মাটিতে পড়ে থাকা একটি নারকেল কেটে আমাদের জল খেতে দিল। অতি সাধাসাধি সত্ত্বেও সেই ভদ্রলোক একটি টাকাও নিলেন না।

লাগুনে সূর্যাস্ত

দ্বীপের একেবারে উত্তর প্রান্তের সমুদ্র অপেক্ষাকৃত অশান্ত, কিন্তু ভীষণ সুন্দর। ওখানে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়বে জলের দিকে একটু ঝুঁকে থাকা একটি বিশেষ নারকেল গাছ। এ ছাড়াও রয়েছে কাঁটাযুক্ত এক ধরনের ঘাস। হাঁটতে গেলে জামা কাপড়ে লেগে যায়। কিন্তু সৌন্দর্যের টানে কাঁটার খোঁচা খেলেও সেটার ব্যথা যেন অনুভব হয়ই না। তটে পৌঁছেই থমাস জলে নেমে গেলেন সাঁতার কাটবে বলে। আমরা তো সেটা দেখে থ! একে অশান্ত সমুদ্র তার উপর সঙ্গে আলাদা পোশাক আনেননি, না আছে টাওয়েল। অথচ জলে নেমে গেলেন! অতটা সাহসী না হওয়ায় আমরা তটে নেমে ছবি তুলছিলুম। হঠাৎ দেখলাম কিছু স্থানীয় বালিকা আমাদের দেখে হাসছে। মনে হয় আমাদের পোশাক বা অন্য কিছু নিয়ে তাদের প্রচণ্ড কৌতুক বোধ হয়েছে। পৃথা ওর টুপিটা সাইকেলেই রেখে এসেছিল। ওটা নিয়ে ওই বালিকারা কয়েক বার ট্রায়াল করল। অতঃপর টুপিটা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে চলে গেল। এই দ্বীপের অধিবাসিরা খুবই সরল ও সৎ। যাই হোক, তটে কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেরার পথে সেই বালিকারা আমদের জল খেতে দিল। ফিরে এসে ক্যান্টিনের স্টাফ রফিককে অনুরোধ করলাম ডাবের জল খাওয়াতে। কিছু ক্ষণ পরে সে কোথা থেকে দু’টি ডাব কেটে তার জল ও মালাই বের করে আমাদের জন্য নিয়ে এল। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ডাবের জল পান করছিলাম আর মনে হচ্ছিল স্বর্গে থাকার মেয়াদ এক দিন কমে গেল!

কাদমত দ্বীপের পশ্চিম পাশের লাগুন

কাদমত দ্বীপে হরেক রকম জলক্রীড়ার বন্দোবস্ত রয়েছে। যাদের বুকের পাটা বেশ শক্ত তাদের জন্য রয়েছে ডিপ সি ডাইভিং, প্যারাসেইলিং। ছোটবেলা থেকে ‘কাঁচকলা দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল’ খেয়ে খেয়ে চিত্ত দুর্বল হওয়ায় অতটা ঝক্কি না নিয়ে আমি বেছে নিলাম স্নরকেলিং। অবশ্য স্নরকেলিংয়ের থেকে সহজতর ও ঝক্কিহীন বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল, যেমন গ্লাস-বটমড বোটে চড়ে লাগুনে ঘুরে বেড়ানো। এই নৌকার তলদেশের কিছুটা অঞ্চল কাচ জাতীয় স্বচ্ছ জিনিস দিয়ে তৈরি যাতে কিনা ভ্রমণের সময় ওই কাচের মধ্যে দিয়ে জলের নীচের প্রবাল ও মাছ দেখা যায়। যদি কালীপুজোর রাতে পটকার আওয়াজে আপনার পিলে চমকে ওঠে তো ঝামেলায় না গিয়ে এই শেষোক্তটি বেছে নিতে পারেন। এগুলো ছাড়াও রয়েছে কায়াকিং, ব্যানানা বোট।

তৃতীয় দিন দুপুরবেলা আমরা চললাম স্নরকেলিং করতে। স্নরকেলিং করতে হলে এক অদ্ভুত দর্শন মুখোশ ও চশমা পড়তে হয়। সেই পোশাক পরে পৃথা তো হেসেই কুটিপাটি। প্রথমে আমাদের কিছু ক্ষণ মুখোশ পরিয়ে ট্রেনিং দেওয়া হল। অতঃপর স্নরকেলিং গাইডের সঙ্গে নৌকায় চেপে আমরা তট থেকে প্রায় দু’ কিলোমিটার দূরে লাগুনের মাঝে একটি জায়গায় পৌঁছলাম। সেখানে জলে নেমে সাঁতরে জলের নীচে বিবিধ প্রবাল ও বিভিন্ন রঙের মাছ দেখতে দেখতে সময়ের খেয়ালই ছিল না আর। কত রঙের মাছ— নীল সার্জেন ফিশ, রেড স্ন্যাপার, অক্টোপাশ, লাল রঙের নাম না জানা মাছ, সাদা কালো হলুদের সমন্বয়ে প্রজাপতি মাছ ইত্যাদি। প্রবালের রঙও দেখবার মতন। জীবন্ত প্রবাল কাছে গেলেই মুখ বন্ধ করে নিচ্ছে। নীল-সাদা প্রবাল, লালচে প্রবাল, কালো রঙের লতার মতো প্রবাল ইত্যাদি কত কী। খুবই সুন্দর দৃশ্য! সম্মুখে যেন এক সম্পূর্ণ নতুন জগৎ খুলে গেছে, যে জগৎ এত দিন ডিসকভারি চ্যানেলেই দেখেছি শুধু। এ যেন জলের নীচে আঁকা জলছবি। আমাদের এতটাই ভাল লেগে গেল যে, আমরা আরও একটি জায়গায় স্নরকেলিং করতে গেলাম। সেটা ছিল দ্বীপের পূর্ব পাশের লাগুনে। সেখানে ঢেউ অনেকটা বেশি এবং লাগুনের গভীরতাও বেশি। তবে মাছের সংখ্যাও প্রচুর। সর্বত্রই দেখা গেল প্রজাপতি মাছ।

বাঙ্গারাম সংলগ্ন লাগুন

ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এল। আমাদের লক্ষদ্বীপে থাকার মেয়াদও প্রায় শেষ। রাত আটটায় সমুদ্রতটে নৈশাহার শেষে লাগুনের ধার দিয়ে খানিকটা হাঁটতে চললাম। পশ্চিমাকাশে এক ফালি চাঁদ উঠেছে তখন। চাঁদের বাঁধ ভাঙা আলোয় লাগুনের জল প্রকৃত অর্থেই অপার্থিব রূপ নিয়েছে। যেন পৃথিবী থেকে বহু দূরের কোনও অজানা অচেনা গ্রহে পৌঁছে গিয়েছি। পর দিন সকালে এল বিদায়ের সেই বিষাদঘন মুহূর্ত। এই তিন দিনেই লক্ষদ্বীপের গাছপালা, জল, মানুষজন সকলের সঙ্গেই এক প্রকার আত্মীয়তা হয়ে গিয়েছে, ছেড়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল। অনেক জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু এরূপ মনের সঙ্গে যোগ অন্য কোথাওই হয়নি। এই স্বর্গের মতো সুন্দর দ্বীপ ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শান্ত, সমাহিত এক স্বপ্নদ্বীপ যেন। মনে মনে পুনরায় ফিরে আসার অঙ্গীকার করে সকাল সাতটায় আমরা কাদমত দ্বীপ থেকে বিদায় নিলাম। তিন ঘণ্টা নৌকা যাত্রা করে পথে বাঙ্গারাম দ্বীপ সংলগ্ন অসাধারণ লাগুন দেখে বেলা ১০টা নাগাদ আগাত্তি দ্বীপে ফিরলুম। এর ঘণ্টাখানেক পরে সেই ছোট্ট বিমানে চেপেই শেষ বারের মতো লক্ষদ্বীপকে বিদায় জানিয়ে আমরা ভারতের মূল ভূখন্ডের দিকে পা বাড়ালুম।

Leave a Comment
Share