দুইদিনের কুষ্টিয়া মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ ভ্রমণের আদ্যপ্রান্ত

দুই দিনের ভ্রমনে আমরা যা দেখেছি শিলাইদহের রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, লালন সাঁইয়ের আখড়া, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, আমঝুপি নীলকুঠি, ভাটপাড়া নীলকুঠি, বৈদ্যনাথতলা, শৈলকুপা জমিদার বাড়ি, নলডাঙ্গা রাজবাড়ি ও পুরাতন মন্দির, ঐতিহাসিক গাজীকালু চম্পাবতীর মাজার। আমাদের মোট খরচ হয়েছিলো ২৫০০ টাকার মতো!

প্রথমে আপনাকে রাতের বাসে চলে যেতে হবে মেহেরপুরে। সকালে পৌঁছাবেন। পথে ফেরীঘাটে নেমে হাল্কা নাস্তা করে নিতে পারেন। মেহেরপুরে নেমে সকালের নাস্তা করে নিবেন। এখান থেকে এবার চলুন যাওয়া যাক আমঝুপি। আমঝুপিতেই বিখ্যাত নীলকুঠি। কুষ্টিয়ার বাসে উঠলে বললে নামিয়ে দিবে।

অনেকে আবার মুজিবনগর ঘুরে তারপর যায়। কারন এতে সময় বাঁচে। উল্টো পথ ঘুরতে হয় না। তবে আমরা আগে নীলকুঠিতে গিয়েছিলাম। মোঘল সেনাপতি মানসিংহ এবং নবাব আলীবর্দি খাঁর স্মৃতি বিজোড়িত এই আমঝুপিতেই পলাশীর পরাজয়ের নীলনকশা রচিত হয়েছিল। কথিত আছে এই নীলকুঠিই ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ লয়েড ও মীলজাফরের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের শেষ বৈঠক হয়েছিল। যার পরের গল্প অত্যাচার আর নির্যাতনের। আমঝুপির ষড়যন্ত্রেই নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় ঘটে। পরে এখানেই নীলকুঠি গড়ে উঠে।

বাংলায় নীল চাষ নিষিদ্ধ হলে সেটি রূপান্তরিত হয় মেদীনিপুর জমিদারদের কাচারীতে। নীলকুঠির পাশেই রয়েছে অপরূপ কাজলা নদী। এখান থেকে চলে যাবেন গাংনী। কারন এখানে আরেকটা বিখ্যাত নীলকুঠি আছে। ভাটপাড়া নীলকুঠি। ১৭৯৬ সালে এখানে নীল চাষ শুরু হয়। এ সময় বিখ্যাত বর্গী দস্যু নেতা রঘুনাথ ঘোষালির সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে গোয়ালা চৌধুরী নিহত হলে মেহেরপুর অঞ্চল রানী ভবানীর জমিদারীভুক্ত হয়। রানী ভবানী নিহত হলে কাসিম বাজার অঞ্চলটি ক্রয় করেন হরিনাথ কুমার নন্দী। পরে হাত বদল হয়ে গোটা অঞ্চলটি মথুরানাথ মুখার্জির জমিদারীভুক্ত হয়। এক সময় মথুরানাথ মুখার্জির সঙ্গে কুখ্যাত নীলকর জেমস হিলের বিরোধ হয়। অথচ মথুরানাথের ছেলে চন্দ্র মোহনই বৃহৎ অঙ্কের টাকা নজরানা নিয়ে মেহেরপুরকে জেমস হিলের হাতে তুলে দেয়। বর্তমানে মূল ভবন ছাড়াও জেলখানা, মৃত্যুকূপ ও ঘোড়ার ঘর আছে।

এবার এখান থেকে চলুন বিখ্যাত মুজিবনগর। প্রথমে মেহেরপুর এসে, মেহেরপুর থেকে লোকাল বাসে মুজিবনগর। ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা। আধা ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে অস্থায়ী সরকার গঠন করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে। মুজিবনগরের স্মৃতিসৌধ দেখুন, আম বাগানে হেঁটে বেড়ান। ভালো লাগবে!

দেখা শেষ হলে মেহেরপুর হয়ে চলে যাবেন কুষ্টিয়া। আসতে আসতে দুপুর হয়ে যাবে। খেয়েদেয়ে হোটেলে উঠে পড়ুন। ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে যাবেন রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে। এটি শিলাইদহে। কুষ্টিয়া শহর থেকে খুব সহজেই আসতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। পরবর্তিতে ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদার হয়ে আসেন। এখানে তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করেন। এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, ইত্যাদি, গীতাঞ্জলী কাব্যের অনুবাদ কাজও শুরু করেন।

কুঠিবাড়ির তিন তলার কামরাটা ছিল কবি গুরুর লেখার ঘর। কবি এই ছাদের উপর বসে সুর্যোদয়, সূর্য্যাস্ত ও জ্যোৎস্না প্লাবিত প্রকৃতির শোভায় মুগ্ধ হতেন। এই খানে বসে কবির দু’চক্ষুকে যে সমস্ত দৃশ্য তন্ময় হতো। তা তিনি নিজেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করেছেন। এই ঘরের জানালা দিয়ে এখন শুধু পদ্মাকে দেখা যায়। আগে পদ্মা গড়াই দুটো নদীকে দেখা যেত। কবি রবীন্দ্রনাথ তখন ঘরে বসেই শুনতে পেতেন নদীর ডাক। নদী যেন কলকল ছলছল করে কবিকে ডাকতো। কবিও সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন পদ্মার বুকে, গড়াইয়ের বুকে। কখনো পদ্মার বুকে সাঁতরিয়ে তিনি আনন্দ উপভোগ করতেন।

এখান থেকে যাবেন ছেউড়িয়াতে। এখানেই লালনের আখড়া। কুঠিবাড়ি থেকে খুব সহজেই এখানে আসা যায়। দেখতে দেখতে দেখবেন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এবার কুষ্টিয়া ফেরার পালা। ফিরে আসুন কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়া শহর ঘুরে দেখতে পারেন সন্ধ্যার পর। ভালো লাগবে।

রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ুন। প্রচন্ড ক্লান্তি পেয়ে বসেছে জানি। চেষ্টা করবেন সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তে। কারন আগামীকাল বেশ পরিশ্রম যাবে। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন। নাস্তা করে চড়ে বসবেন ঝিনাইদহের গাড়িতে। তবে ঝিনাইদহ সদরে যাবেননা। নামবেন শৈলকুপায়। কারন এখানে আমরা দেখবো শৈলকুপা জমিদার বাড়ি। ৪০০ বিঘা জমির উপর নির্মিত একসময়ের এই অপূর্ব রাজবাড়িটির বর্তমানে ভগ্নদশা। একসময়ে এই জমিদার বাড়িতে কেবল কক্ষের সংখ্যাই ছিলো সাড়ে তিনশো। অজপাঁড়াগাঁয়ে সেই আমলেই রামসুন্দর শিকদার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন থিয়েটার হল।

বর্তমানে এখন বাস করেন জমিদার রামসুন্দর শিকদারের বংশধরেরা। এখানে দেখতে পারেন সংগ্রহে থাকা পাথরের তৈরী হুঁকো, কলের গান, শাল কাঠের তৈরী দুটো মন্দির, রূপার তৈরী বেনারসি শাড়ি সহ আরো নানান স্মৃতিচিহ্ন। শৈলকুপা থেকে ঝিনাইদহ হয়ে সোজা আসবেন নলডাঙ্গা। এখানেই নলডাঙ্গা রাজবাড়ি।

প্রায় ৫০০ বছর আগে ফরিদপুরের তেলিহাট্টি পরগনার অধীন ভবরাসুর গ্রামে বসবাস করতেন ভট্টনারায়ণ। তারই উত্তরসুরি বিষ্ণুদাস হাজরা ঝিনাইদহের নলডাঙ্গার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার বাবার নাম ছিল মাধব শুভরাজ খান। বৃদ্ধ বয়সে বিষ্ণুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন এবং ফরিদপুরের ভবরাসুর থেকে ঝিনাইদহের নলডাঙ্গার কাছে খেড়াসিং গ্রামে এসে বেগবতী নদীর তীরে এক জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন। ১৫৯০ সালে মোগল সুবেদার মানসিংহ নৌকাযোগে বেগবতী নদী দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাওয়ার পথে তার সৈন্যরা রসদ সংগ্রহে বের হন। এ সময় জঙ্গলে তপস্যারত বিষ্ণুদাস সন্ন্যাসী সৈন্যদের রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে বিষ্ণুদাস সন্ন্যাসীকে পাশের পাঁচটি গ্রাম দান করেন। এ গ্রামগুলোর সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারি এবং পরে নলডাঙ্গা রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এ এলাকাটি নলখাগড়া ও নটা উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ছিল বলে পরিচিত হয় নলডাঙ্গা নামে। এরপর প্রায় ৩০০ বছর এ বংশের বিভিন্ন শাসক রাজ্যটি শাসন করেন। ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দুভূষণ যক্ষ্মা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক ছেলে রাজা বাহাদুর প্রমথভূষণ দেবরায় রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি এখানে প্রতিষ্ঠা করেন আটটি মন্দির। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে নলডাঙ্গায় ১৬৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কালীমাতা মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, গনেশ মন্দির, দুর্গা মন্দির, তারামনি মন্দির, বিঞ্চু মন্দির, রাজেশ্বরী মন্দিরসহ সুদৃশ্য আটটি মন্দির। এরই মধ্যে স্থানীয়দের সাহায্য ও জেলা পরিষদের আর্থিক সহযোগিতায় শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, কালীমাতা মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, তারা মন্দির, বিষ্ণু মন্দির সংস্কার করা হয়েছে। ঝিনাইদহের নলডাঙ্গা রাজ্য রক্ষায় এক সময় ছিল সৈন্যবাহিনী। রাজপ্রাসাদ রক্ষায় চারদিকে খনন করা হয়েছিল পরিখা। রাজার জীবন বাঁচাতে বেগবতী নদীর ভেতর তৈরি করা হয়েছিল গোপন সুড়ঙ্গ পথ। আজ তার কিছুই নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু নলডাঙ্গায় আটটি মন্দির এখনও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।

নলডাঙ্গা থেকে আসবেন কালীগঞ্জ পেরিয়ে বড়বাজারে। এখান থেকে কাছেই। এখানেই বিখ্যাত গাজীকালু চম্পাবতীর মাজার। গাজী কালু চম্পাবতীর পরিচয় নিয়ে রয়েছে নানা রকম কাহিনি। প্রচলিত আছে বৈরাট নগরের রাজা ছিলেন দরবেশ শাহ সিকান্দর। তারই সন্তান বরখান গাজী। কালু হলেন রাজা দরবেশ শাহ সিকান্দরের পালিত পুত্র। কালুর সঙ্গে গাজীর দারুণ ভাব ছিল। কালু গাজীকে খুব ভালোবাসতেন। যেখানেই গাজী সেখানেই কালু, বিষয়টা এরকমই ছিল। চম্পাবতীর ভালোবাসার টানে গাজী ছুটে এসেছিলেন ছাপাই নগর। এই ছাপাই নগরই পরবর্তিতে বারোবাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। পুরো কাহিনী বললে পোস্ট লম্বা হয়ে যাবে।

গাজী-কালুর কথা শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জনশ্রুতি আছে গাজী কালুর আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘে ও কুমির একঘাটে জল খেত! গাজী কালু এমনই স্বনামধন্য ঐতিহাসিক চরিত্র। হিন্দু ধর্মবলম্বলীরা বনদূর্গার বদলে যাদের পূজা করে তাদের মধ্যে গাজী-কালু অন্যতম। গাজী-কালুকে নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত। এখানে এলে গাজী কালু চম্পাবতীর মাজার দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাম রাজার দীঘিটির সৌন্দর্যেও মুগ্ধ হবেন।

দেখতে দেখতে জানি বিকেল পেরিয়ে যাবে। এবার ফেরার পালা। চাইলে ঝিনাইদহ হয়ে ঢাকা ফিরতে পারেন। আবার চাইলে যশোর হয়েও ঢাকা ফিরতে পারেন! একদিন যদি বাড়তি থাকে তবে যশোরও ঘুরে দেখতে পারেন! 😉

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে মেহেরপুর বাসে যাওয়া যায়। যেতে সাত থেকে আট ঘন্টার মতো সময় লাগে। শ্যামলী বা জেআর পরিবহনে ভাড়া ৪৫০ টাকা।

Leave a Comment
Share